প্রতিবেদন
মজুরির ক্রমঅধোগতিই আজকের প্রধান সমস্যা
wages is the main problem

প্রথাগত ভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সাবেক অর্থনীতিবিদেরা শাসক দলের সমালোচনায় খুব সহজেই হাতিয়ার করেন মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতিকে। এটা বহুদিনের প্রচলিত রীতি। সমালোচকেরা হয়তো আশা করেন, মূল্যবৃদ্ধি ও কর্মহীনতা যদি খুব সঙ্কটজনক জায়গায় পৌঁছে যায় তাহলে শাসকদলের জনপ্রিয়তা কমবে। এই কিছুদিন আগে যখন ক্রমাগত পেট্রল-ডিজেলের মূল্য বেড়েই চলছিল ও একইসঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নও হচ্ছিল, অনেকেই ভেবেছিলেন আমাদের দেশেও শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু তা সচরাচর হওয়ার নয়, বাস্তবতা বরং অন্য কথা বলে, অন্য একটি দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চায়।

আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, আমাদের দেশ ও বিশ্ব এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে প্রবেশ করেছে; যাকে কেউ কেউ ‘গিগ অর্থনীতি’ বা ‘মেটাভার্স অর্থনীতি’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলাই বাহুল্য, আজ অর্থনীতির ভুবনে ডিজিটাল দুনিয়ার প্রধান আসন গ্রহণ ও তার পরিব্যাপ্তিকে অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা। স্পষ্টতই, এই নতুন অর্থনীতি দুটি বড়সড় পরিবর্তন সাধিত করেছে।

১) শ্রমের আঙ্গিকে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছে যেখানে শ্রমের নিযুক্তি হয়ে পড়েছে বহু গুনে অনিশ্চিত, স্বল্প সময়ের জন্য ও চুক্তিভিত্তিক।

২) আয়ের বহুধা পথ নির্মিত হয়েছে, যেখানে ডিজিটাল ভুবনের সহায়তায় আইনি-বেআইনি বিবিধ নকশায় এটাসেটা কিছু-না-কিছু রোজগার তেমন কষ্টকল্পিত নয় আর।

এমতাবস্থায়, কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির হারের ওঠানামায় বড় কিছু আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। এই হার উঠবে, উঠলে বিরোধীরা সোচ্চার হবেন যা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু এই হার যখন আবার নিম্নমুখি দেখাবে তখন তেমন বলারও কিছু থাকবে না। কিন্তু তা বলে, দারিদ্র্য, বিপন্নতা, অভাব-অনটন, শ্রমের শোষণ ও তার সামাজিক অনুষঙ্গ সব একেবারে মুছে গেছে, তা তো নয়। আসলে বলার কথা এই, রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক সার্বিক পরিবর্তনের ফলে সমস্যার সুলুকসন্ধানটা করতে হবে অন্যতর দিকে। নয়তো এর নাগাল পাওয়া রীতিমতো দুষ্কর।

সম্প্রতি, ‘ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চ’এর একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, আমাদের দেশে সার্বিকভাবে মজুরি সংকোচন হয়েছে। অর্থাৎ, যে হারে গড় মজুরি বাড়ার কথা, তার থেকে কম হারে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আর্থিক বছরে যেখানে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ, তা ২০১৭ থেকে ২০২১’র মধ্যে নেমে দাঁড়িয়েছে ৫.৭ শতাংশে। এটা আরও দুর্ভাগ্যজনক যখন ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের প্রথম অর্ধে জাতীয় বৃদ্ধির হার ১৩.৫ শতাংশে পৌঁছেছে বলে সরকারের দাবি। তার মানে কি এই যে, জাতীয় বৃদ্ধির সুফল খেটেখাওয়া মানুষের ঘরে পৌঁছচ্ছে না! উপরন্তু, যা আরও উদ্বেগের ও গুরুত্বপূর্ণ, শহর এবং গ্রামে যেখানে মজুরি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ২.৮ ও ৫.৫ শতাংশ, তা মুদ্রাস্ফীতিকে গণ্য করলে (যদিও জুলাই ২০২২’র শেষে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে) আসলে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে নেতিবাচক বৃদ্ধিতে — যথাক্রমে (-)৩.৭ ও (-)১.৬ শতাংশে। অর্থাৎ, মুদ্রাস্ফীতিকে গণ্য করলে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। মানুষ আরও দরিদ্রতর হয়েছে। এখানেই বিপদের বীজটি লুকিয়ে আছে। গিগ অর্থনীতির এই হল ধরন, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শ্রমের আঙ্গিককে এমনভাবে পুনর্নিমিত করা হচ্ছে যে মজুরির হারে সার্বিক পতন ক্রমেই এক সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গোলকধাঁধাটা হল, কাজের নানা ধারা-উপধারা তৈরি হচ্ছে, প্রায় সকলেই কোনও না কোনও অথবা কিছু না কিছু কাজ জুটিয়ে নিতে পারছে স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু তাদের কাজের আঙ্গিকটা এমনভাবেই নির্মিত হচ্ছে যেখানে বহুক্ষণ শ্রম দিয়েও বিনিময়ে জুটছে সামান্য মজুরি। আর এই কাজের আঙ্গিক ও নির্দেশটা তৈরি করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদম যা নৈর্ব্যক্তিক — স্মার্টফোন থেকে স্মার্টফোনে প্রবাহিত হয়ে মুনাফা ও মজুরির হারের পূর্ব-নির্দিষ্ট সূত্রকে বাস্তবায়িত করে। উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের এ এক নতুন নকশা যাকে না বুঝতে পারলে আজকের শ্রম, শ্রমিক আন্দোলন ও মজুরি-দাসত্বকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা যাবে না।

main problem today

বাস্তবতাটা দেখুন। সম্প্রতি বাগুইআটিতে দুই কিশোরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জানা গেল যে অতনু দে বলে ছেলেটি অভিযুক্ত খুনীকে একটি বাইকের জন্য ৫০,০০০ টাকা দিয়েছিল। সে ওই টাকা কোথা থেকে পেল? তদন্তে প্রকাশ, অতনু অনলাইন গেমিং’এ রীতিমতো পাকা খেলোয়াড় ছিল। বন্ধুদের কাছে নিজের গেমিং অ্যাকাউন্ট বিক্রি করেই তার টাকা জোগাড়। ডিজিটাল দুনিয়া এমনতর নানাবিধ আয়ের পথ খুলে দিয়েছে যা মানুষকে তাড়িত করছে নানারকম রোজগারে। এইরকম বহু উদাহরণ পেশ করা যায়। প্রশ্নটা হল, এই মরীচিকার পিছনে দৌড়লে কি সত্যিই সকলের হিল্লে হবে? একেবারেই নয়। কারণ, জুয়া বা লটারিতে যেমন সকলের জয় কাম্য নয় — সকলেই জিতে গেলে হারবে কে, আর যদি কেউ না হারে তাহলে লাভের টাকাটা আসবে কোথা থেকে — তেমনই ডিজিটাল দুনিয়ার নানাবিধ আয়ের পথ থেকে সকলের আয় সুনিশ্চিত নয়। কিন্তু সকলেই ভাববে, এবার আমার ‘ভাগ্যে’ বুঝি শিকে ছিঁড়বে। তাই সকলেই দৌড়বে, যেভাবে তৃষ্ণার্ত মানুষ মরীচিকার দিকে ছুটতে থাকে। আর যারা মজুরির বিনিময়ে শ্রম দিচ্ছেন, তাঁরা ভাববেন, আরও কিছুটা খেটে দিলে বাড়তি দু’পয়সা আসবে। যেমন, রাতবিরেতে ডেলিভারি বয় অথবা অ্যাপ-ক্যাবের চালক ভেবে নেন যে, অসময়ে কাজটা করে দিলে ইন্সেনটিভ’টা আরেকটু বেশি হবে।

অর্থাৎ, যে কেউ যে কোনও কাজে ঢুকে যা হোক কিছু রোজগার করছে। কিন্তু সমস্যাটা হল, কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক সে পাচ্ছে না। অন্যভাবে বললে, সে যা আয় করছে, তা দিয়ে সংসার চলছেনা। উপরন্তু, তার কাজেরও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি তাকে বলছে, যখন ইচ্ছে কাজ করো, কিন্তু যত বেশি কাজ করবে তত বেশি মজুরি পাবে। আপেক্ষিকভাবে, বেশি কাজে মোট মজুরিটা বেশি হচ্ছে কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির হার অথবা মজুরির ভাগটা ক্রমশই মুনাফার সঙ্গে আনুপাতিক হিসাবে কমে যাচ্ছে। সহজ করে বললে, নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।

সাবেক মজুরদের ক্ষেত্রেও মজুরির এই অধোগতি যে বাস্তব, তা স্পষ্ট হবে ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র (এনসিআরবি) সাম্প্রতিক তথ্য থেকেও। বলছে, ২০২১ সালে আমাদের দেশে প্রতি চারটি আত্মহননের মধ্যে একজন হলেন দিনমজুর। ২০২১ সালে নথিবদ্ধ ১.৬ লক্ষ আত্মহত্যার মধ্যে দিনমজুরদের সংখ্যা ছিল ৪২,০০৪। মোট আত্মহননের ঘটনায় দিনমজুরদের আত্মহননের অনুপাত ২০১৪ সালে ছিল ১২ শতাংশ যা ২০২১ সালে ২৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, গায়ে-গতরে খাটা দিনমজুরদের কাজ বহুলাংশে কমে এসেছে, ফলে, চাহিদার থেকে তাদের জোগান বেড়ে যাওয়ায় মজুরি কমে গেছে, বাজারে ঋণের বোঝা বেড়েছে এবং সর্বোপরি আয়ের নিরিখে খাদ্যদ্রব্যের প্রকৃত দাম অধিক হয়ে ওঠায় সেই বিপন্ন, বিপর্যস্ত জীবন থেকে ‘বাঁচার জন্যই’ তাদের উত্তরোত্তর আত্মহননের পথ বেছে নিতে হচ্ছে। এঁরা মূলত নির্মাণ শিল্প ও অন্যান্য গৃহভিত্তিক কাজে এতদিন নিযুক্ত হয়ে এসেছেন। ফ্ল্যাটবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাইওয়ে ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণে এইসব মজুরদের প্রচুর চাহিদা ছিল। আজকাল এইসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে কাজের সে জোয়ার নেই, উপরন্তু, নানারকম আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি এসে পড়ায় দিনমজুরদের চাহিদা অনেকটা পড়ে গেছে। এদের পরের প্রজন্ম বা যারা এখনও অল্পবয়সী — তাঁরা হয়তো নতুনতর ডিজিটাল কাজের জন্য নিজেদের তৈরি করে নিচ্ছেন যাদের একটা অংশকে উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে প্ল্যাটফর্ম সংস্থাগুলি নতুন বাজার তৈরি ও ধরার চেষ্টা করছে।

সবটা মিলিয়ে শ্রম ও শ্রমের বাজার আজ একদিকে স্বল্প আয়ের অভিঘাতে বিপর্যস্ত, অন্যদিকে এক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুনতর পরিসরে প্রসারিত। আমরা জানি, প্রকৃত মজুরির পরিমাণ যত কম হবে, মুনাফার হার তত বেশি হবে। বিবর্তনটা এই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে শ্রমের একটা বড় অংশকে যেমন প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহযোগী হিসেবে মনুষ্যশ্রমের দামও আপেক্ষিক বিচারে কমে আসছে। সামগ্রিকভাবে সাবেক ও নতুন — সব ধরনের শ্রমের মূল্যেই অধোগতি আজকের প্রখর বাস্তবতা। এই কঠোর প্রবণতাকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তাই আজকের চর্চার কেন্দ্রে থাকা উচিত।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

খণ্ড-29
সংখ্যা-37