প্রতিবেদন
স্কুলশিক্ষার বর্তমান হাল হকিকৎ ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০
National Education Policy 2020

রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন (১৯৪৮), মুদালিয়র কমিশন (১৯৫২), কোঠারি কমিশন (১৯৬৪) সহ স্বাধীনতার পর থেকে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে ভারতে। রচিত হয়েছে বেশ কয়েকটি জাতীয় শিক্ষানীতি — যেমন ১৯৬৮’র শিক্ষানীতি, ১৯৮৬’র শিক্ষানীতি। শিক্ষানীতিগুলির মধ্যে সাম্প্রতিকতমটি হল জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। এই শিক্ষানীতির নানা দিক নিয়ে এখানে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করব। খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব বিদ্যালয় শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে কী কী নিদান দিচ্ছে এই নতুন শিক্ষানীতি। কোন কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তনের কথা বলছে। সেই পরিবর্তনের ফল কী হতে পারে?

শুরু করা দরকার বিদ্যালয় শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা দিয়েই। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোচনায় বিস্তারিতভাবে যাওয়ার আগে বর্তমানে স্কুলশিক্ষা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, বিশেষ করে সরকারী স্কুলশিক্ষা, সে সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক।

সরকারী স্কুলগুলোতে যাঁরা পড়ান, বা এর হালহকিকৎ কাছ থেকে প্রতিদিন দেখেন, তাঁরা সাধারণভাবে কয়েকটা সমস্যা লকডাউন পরবর্তী সময়ে লক্ষ করছেন। সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর মান সাধারণভাবে অনেক নেমে গেছে। এর আগেও, মানে লকডাউন বা কোভিড ২০২০তে আসার আগেও সরকারী স্কুলের শিক্ষার মান তেমন ভালো ছিল না।

অনেকদিন ধরেই মধ্যবিত্ত অভিভাবক অভিভাবিকারা তাদের সন্তানদের সরকারী স্কুলগুলো থেকে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। ভিড় বাড়ছিল বেসরকারী ইংরাজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে। সরকারী স্কুলগুলোতে, বিশেষ করে শহর ও শহরতলীতে ভর্তি হচ্ছিল একেবারে গরীব প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তারা অধিকাংশই ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। বাড়িতে বাবা মা হয় পড়াশুনো জানেন না বা সামান্য জানেন।

প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক স্কুল পেরিয়ে যখন মাধ্যমিক স্তরে আসল, তখন দেখা গেল তারা অনেকে নিজের নামটুকুও ঠিকমত লিখতে পারে না। দু’চার লাইন বাংলাও ঠিকমতো পড়তে পারে না।

২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হবার পর থেকেই আর ফেল প্রথা নেই। যারা ক্লাস ওয়ানে স্কুলে নাম নথিভুক্ত করল তাদের অনেকে কিছু না শিখেই বা সামান্য শিখে ক্লাস নাইন অবধি চলে আসতে পারল।

কেউ কেউ ফেল প্রথাকে দোষারোপ করলেন। সরকারও লকডাউনের ঠিক আগে নীতি বদলে কয়েকটি ক্লাসে ফেল প্রথা ফিরিয়ে এনে বলতে চাইলেন যে ফেল প্রথা তুলে দেওয়া ভুল হয়েছিল। তা সংশোধন করা হল।

National Education Policy

এখন প্রশ্ন হল ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনা কি আবার খানিক পিছিয়ে যাওয়া নয়? আবারো অসংখ্য ছেলেমেয়েকে ড্রপ আউটের দিকে ঠেলে দেওয়া নয়? ছাত্রছাত্রীদের ফেল করার দায় কেবল তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়? রেমেডিয়াল ক্লাসের মাধ্যমে যোগ্যতামান না পেরোনো ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী ক্লাসের উপযোগী করে নেওয়ার কথাটি কেন কার্যত প্রায় সর্বত্রই থেকে গেল খাতায় কলমে, কেন তার কোনও বাস্তব প্রয়োগ থাকল না — তা নিয়ে কোনও সমীক্ষা বা পর্যালোচনা কিন্তু হল না। এইভাবে সরকার ও শিক্ষা প্রশাসন তাদের নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলে সব দায়টাই চাপিয়ে দিলেন শিশু-কিশোর ছাত্রছাত্রীদের ওপর।

সরকারী শিক্ষার এই যে দৈন্য দশা নিয়ে কথা যে তেমন হয় না তার একটা কারণ শহর শহরতলীর ‘ভোকাল সেকশান’ যাদের বলা হয়, তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখন আর সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে সেভাবে পড়েই না বা অতি সামান্য সংখ্যায় পড়ে। অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা মূলত দিনমজুর বা পরিচারিকা বা এই ধরনের নিম্ন আয়ের পেশার সঙ্গে যুক্ত। নানা কারনেই তারা শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষত বা ক্ষতি নিয়ে কথা বলার জায়গায় সেভাবে নেই।

পড়াশুনো শেখা ও শেখানোর ব্যাপারটা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে তার আলোচনাই যথাযথভাবে হয় না। সমাজ করে না, সরকার করে না, এমনকি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোও সেভাবে করে না।

শিক্ষার মান নিয়ে ঘনিয়ে আসা এই অন্ধকারের মধ্যেই এল কোভিড ও লকডাউন। স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ রইলো। তারফলে পড়াশুনোর মান চলে গেল আরো নিচে। এই ক্ষতি কতটা গভীর ও ব্যাপক তা জানার জন্য দরকার ছিল একটি ব্যাপক সমীক্ষার। কিছুদিন আগে অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ জঁ দ্রেজ’এর নেতৃত্বে এইরকম একটি সমীক্ষা হয়েছে। তার রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে।

অগস্ট ২০২১-এ এই সমীক্ষাটি চালানো হয় ভারতের ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জুড়ে। তারমধ্যে আছে অসম, বিহার, চণ্ডীগড়, দিল্লী, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ।

School Education and National Education Policy

রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ২৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই পর্বে নিয়মিত পড়াশুনো করেছে। ৩৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনো চলেছে অনিয়মিতভাবে। আর ৩৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনোর সম্পূর্ণ বাইরে থেকেছে।

সমীক্ষকরা দেখেছেন ৫০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কয়েকটি শব্দও একটানা পড়তে পারছে না। অভিভাবকরাও জানিয়েছেন যে তাদের সন্তানদের অনেকেই এই সময় পড়া ও লেখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে কবে আবার স্কুল খুলবে, তারা তাদের সন্তানদের আবার স্কুলে পাঠিয়ে পড়াশুনোর সুযোগ করে দিতে পারবেন। কারণ অনলাইন শিক্ষার সুযোগ তাদের সন্তানদের পক্ষে সেভাবে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে শহুরে এলাকায় ২৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের সুবিধে নিতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। স্মার্টফোন না থাকাটা এর একটা কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। যে সমস্ত পরিবারের স্মার্টফোন আছে, শহুরে এলাকায় সেই সব ঘরের ছাত্রছাত্রীদের ৩১ শতাংশ নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করেছে। গ্রামীণ এলাকায় করেছে স্মার্টফোন থাকা পরিবারের মাত্র ১৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। এর কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে স্মার্টফোন মূলত পরিবারের রোজগেরে সদস্য সঙ্গে নিয়ে কাজে চলে যান, ফলে অনলাইন ক্লাসের সময় ছাত্রছাত্রীরা তা ব্যবহার করে উঠতে পারে না। সমীক্ষা রিপোর্ট জানিয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর নিজেদের স্মার্টফোন আছে। স্মার্টফোনের সমস্যা ছাড়াও অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেটের ডেটা-প্যাক কেনার ক্ষমতার অভাব। শহুরে এলাকার মাত্র ২৩ শতাংশ অভিভাবক মনে করেছেন তাদের সন্তানরা ঠিকমতো অনলাইন ক্লাস করতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় এটা মাত্র ৮ শতাংশ।

যারা অনলাইন ক্লাস নিয়মিত বা মাঝেমাঝে করতে পেরেছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী সমীক্ষকদের জানিয়েছে যে তারা অনলাইন ক্লাস ভালোভাবে অনুসরণ করে পড়া বুঝে নিতে সক্ষম হয়নি। আর যারা অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি, তাদের অধিকাংশই নিজেরা বইপত্র খুলে এই পর্বে তেমন পড়াশুনো করেনি। যে সমস্ত পরিবার আর্থিকভাবে খানিকটা সক্ষম এবং সন্তানদের জন্য উপযুক্ত গৃহশিক্ষক বা গৃহশিক্ষিকার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, সেই সমস্ত পরিবারের সন্তানরাই এই পর্বে খানিকটা নিয়মিত ও ভালোভাবে পড়াশুনো করতে পেরেছে বলে সমীক্ষকরা জেনেছেন।

এইরকম একটা সঙ্কটের পরিস্থিতিতে যে শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হচ্ছে তার কাছে সমাজ ও শিক্ষাজগতের কিছু বিশেষ দাবি থাকে। সেই দাবি রক্ষার দিকে কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি তেমন কোনও আগ্রহ দেখায়নি। বরং এমন কিছু সুপারিশ করেছে যা শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি হওয়া সামাজিক বিভাজনকে আরো বাড়িয়ে দেবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ক্রমশ বিস্তারিত আলোচনার দিকে এগোব।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-29
সংখ্যা-36