বেঙ্গালুরু শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলে ডুবে গেছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে ওই অঞ্চলে। বৃষ্টির ধরণে বদল দেখা গেছে। হঠাৎ করে এমন আকাশভাঙা বৃষ্টি আগে কখনও দেখেনি বেঙ্গালুরু। বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। জল আটকে প্লাবিত হয়ে ভারতের ‘আইটি হাব’ হাবুডুবু খাচ্ছে। বৃষ্টি কমে আসার পরও জল বেরোতে পারছে না। জল বেরোতে না পারার পেছনে, বলাই বাহুল্য, সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত নগরায়ন দায়ি। আর এই অস্বাভাবিক বর্ষণের পেছনে আছে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও বায়ুদূষণ। বাতাসে ভাসমান বড় কণার (এয়ারোসল) পরিমাণ বেড়ে গেলে বাতাসের জলীয় বাষ্প জমে মেঘ হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায় এবং অতি অল্প সময়ে অনেকটা বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা বেড়ে গেলে জলের বাষ্পীভবনও বেড়ে যায়। ভারত মহাসাগরের পৃষ্ঠদেশের গড় উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মার্চ মাসে প্রকাশিত আইপিসিসি রিপোর্ট পৃথিবীর বিভিন্ন শহরগুলিতে আসন্ন প্লাবন সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। বিশেষত ভারত সহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের শহর জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর জন্য মোটেই প্রস্তুত নয়।
ভারতের ‘আইটি হাব’ বেঙ্গালুরুর এই অতিবৃষ্টি ও প্লাবনের খবর মিডিয়াতে এসেছে। যদিও বড় বড় গেটওয়ালা কোটি টাকার বাড়িতে ঢুকে পড়া জল আর রাস্তায় হাবুডুবু খাওয়া দামি মোটর গাড়ির ছবিই মিডিয়াতে বেশি বেশি তুলে ধরা হয়েছে। গরিব শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত বসতিগুলো শ্রেণীবৈষম্যের সমাজে ঐতিহাসিকভাবে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলিতেই গড়ে ওঠে, নিকাশী ব্যবস্থা যেখানে আরও অপ্রতুল। বিপর্যয়ের সিংহভাগ দুর্ভোগ এদেরকে পোহাতে হয়, তাদের অনেককেই সর্বস্ব খোয়াতে হয়। খবরে তা তেমন আসে না। কেনই বা পূর্বসতর্কতা থাকা সত্ত্বেও বেঙ্গালুরুকে এভাবে ভেসে যেতে হল তার প্রেক্ষাপট নিয়েও মূলধারার সংবাদ পরিবেশনে কোনও চর্চা থাকে না।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসে হাজির হয়েছে যা খবরের কাগজ বা চ্যানেলে তেমন চর্চায় নেই। পাকিস্তানে অভূতপর্ব বন্যা। পাকিস্তানের তিনভাগের এক ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। সবচেয়ে তীব্র ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সিন্ধ ও বালুচিস্তান প্রদেশে। এছাড়া আছে খাইবার পাখতুনখয়া, গিলগিট-বাল্টিস্তান, পাঞ্জাব ও আজাদ কাশ্মীর প্রদেশ। ১৪ জুন থেকে শুরু হওয়া প্রবল বর্ষণ ও প্লাবনে এখনও পর্যন্ত ১,৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ৪৯৯ জন শিশু। আহত আরও বহু। ৬ লক্ষের কাছাকাছি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও বহুগুণ। ৭.৫ লক্ষ গবাদি পশু মারা গেছে। ৬.৫ হাজার কিমি রাস্তা, ২৬৯টি ব্রীজ, ১৭.৫ হাজার স্কুল ও বিরাট পরিমাণ কৃষিক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তানে এই মাত্রার বন্যা আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব এবং জলবায়ু সংকটের বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একদিকে ভারত মহাসাগরের উষ্ণতা বেড়ে অতিরিক্ত বর্ষণ, অন্যদিকে গিলগিট-বাল্টিস্তানের হিমবাহ গলে যাওয়া। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব। এবং এই প্রভাব সীমান্তের কাঁটাতার মানে না। বিশেষত পাকিস্তান ও ভারত একই ভৌগলিক অঞ্চলের অন্তর্গত। পাকিস্তানের এই বন্যা জলবায়ু সংকটের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিস্তারিত চর্চা হওয়া দরকার। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২.১ শতাংশ পাকিস্তানে বসবাস করে, আর মোট কার্বন নিঃসরণের ১ শতাংশ পাকিস্তানের অর্থনীতি থেকে আসে। কিন্তু মাথাপিছু নিঃসরণের হিসেবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম নিঃসরণ ঘটালেও বিপর্যয়ের ধাক্কা বড় হয়ে নেমে আসছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মুনাফার তাড়না সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয় বলেই বিশ্ব আজ এই সংকটে। আর সব সংকটের মতো পরিবেশ সংকটের বোঝাও সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলির ওপরই এসে পড়ে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলার প্রশ্ন তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী প্রশ্ন।