প্রতিবেদন
কলকাতা হাইকোর্টেরও বক্তব্য : ডিএ’র টাকা কর্মচারিদের হকের পাওনা
Calcutta High Court also said

প্রসঙ্গ ডিএ মামলা : ২২ মে ২০২২, বিচারপতি হরিশ ট্যাণ্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তকে নিয়ে গঠিত কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এক গুরুত্বপূর্ণ আদেশে স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনালের ২০১৮ সালের একটি আদেশ শুধু অনুমোদনই করলেন না, বরং পুনর্বিচনার জন্য আবেদনকারী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে সবক শেখানোর ঢঙে নির্দেশ দিলেন যে রায় ঘোষণার দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য ডিএ, বকেয়া সহ পরিশোধ করতে হবে। এই আদেশের প্রেক্ষাপট হল, একদিকে সরকারি কর্মীদের আইনত প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের চরম অনীহা, অন্যদিকে সরকারের অনিচ্ছুক হাত থেকে পাওনা মহার্ঘ ভাতা আদায়ের জন্য সরকারি কর্মী, প্রাইমারী শিক্ষক, বোর্ড-কর্পোরেশনের কর্মীদের আইনি ও রাস্তায় নাছোড় লড়াই; যুযুধান এই দু’পক্ষের খবরগুলো কাগজের শিরোনামে চলে আসছে বেশ কিছুদিন যাবত। স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনালের ২০১৮’র আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্যে রাজ্য সরকার বর্তমানে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায় ২০১৯ সালে।

ডিএ আন্দোলনের বিষয়টি জানা-বোঝার জন্য হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আদেশ অনুযায়ী

১) রাজ্য সরকারকে মহার্ঘভাতা (ডিএ) দিতে হবে ওয়েষ্ট বেঙ্গল সার্ভিসের পে অ্যাণ্ড অ্যালাওয়েন্সেস রুলস (রোপা) ২০০৯’র ব্যবস্থা ও ব্যাখ্যা অনুযায়ী।

২) সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ’র পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে সর্বভারতীয় গড় মূল্যসূচকের ভিত্তিতে এখন যা ৫৩৬তম বিন্দুতে অবস্থান করছে (১৯৮২’র মূল্য সূচক = ১০০ ধরে)। এই হিসেব অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মীর মূল বেতনের ৩৪ শতাংশ ডিএ প্রাপ্য, ইতিমধ্যে পেয়েছেন ৩ শতাংশ, বকেয়া ৩১ শতাংশ। স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনালও ২০১৮-এ অনুরূপ নির্দেশ জারি করেছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চ আরও বলেন, শুধুমাত্র আইনি অধিকার হিসেবেই সরকারি কর্মচারীরা ডিএ পাবেন এমনটা নয়। তাঁরা ডিএ পাবেন সম্মানজনক জীবন যাপন এবং জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য, সংবিধানে উল্লিখিত ২১ নং ধারা অনুযায়ী, যা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, সরকার পরিচালিত কাজগুলো রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রধান চালিকা শক্তি এঁরা; অধিকার থেকে এঁদের বঞ্চিত করা যায় না, এঁদের আইনি অধিকারকে একটু সম্মান জানান আপনারা; নির্ধারিত হারে ডিএ প্রদানের জন্য টাকার সংস্থান করুক সরকার; সরকারের টাকা নেই — এ যুক্তিতে সারবত্তা নেই। আমরা এই যুক্তি খারিজ করছি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তার অধীনস্থ কর্মচারীদের মধ্যেই বৈষম্যের নীতি নিয়ে চলে, সেই বামফ্রন্টের আমল থেকেই। যেমন, দিল্লী, চেন্নাইতে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন তথ্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলোয় পদস্থ কর্মীরা অন্য কিছু বিশেষ ভাতা ছাড়াও কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা পান। এপ্রসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে এই বৈষম্যমূলক নীতি সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের ১৪ নং ধারা, অর্থাৎ সমতার অধিকারকে খর্ব করছে। রাজ্য সরকার তার কর্মীদের কাজের বৈচিত্র্য অনুযায়ী বিশেষ ভাতা দিতেই পারে, কিন্তু ডিএ বিশেষ ভাতা নয়, এটা আইনি অধিকার। রাজ্য সরকার একই শ্রেণীভুক্ত কর্মীদের মধ্যে বিভাজন করছে যা অসাংবিধানিক। রাজ্য সরকার যদি এভাবে কর্মীদের আইনি দাবির প্রতি বধির থেকে যায় তবে সরকারের কাজকর্ম গুরুতরভাবে ব্যহত হতে পারে। সেক্ষেত্রে এই আদালত তাঁর চূড়ান্ত আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে এপ্রশ্নে রাজ্য সরকারকে বাধ্য করতে পারে।

ডিভিশন বেঞ্চের উক্ত আদেশ প্রচার হওয়ার পর স্বভাবতই প্রায় ৪০ বছরের অনাদায়ী দাবির হয়তো মিমাংসা হতে চলেছে বিচার ব্যবস্থার হস্তক্ষেপে। সরকারকে ডিভিশন বেঞ্চ ১৯ আগস্টের মধ্যে তাঁর নির্দেশ কার্যকর করতে বলেছিলেন। কিন্তু ১২ আগস্ট সরকার ওই বেঞ্চের কাছেই পুনরায় ২২ মে’র রায় পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। ডিভিশন বেঞ্চ আবেদনটি গ্রহণ করে মাত্র দু’দিনের শুনানিতে (২৫-২৬ আগস্ট ২০২২) সরকার পক্ষকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিলেন। তবে রায় দান কয়েকদিনের জন্য স্থগিত রাখলেন। এই কালক্ষেপকারী সর্বশেষ আবেদনে রাজ্য সরকার বলেছে, “ডিএ কর্মচারীর অধিকার নয়, সরকারের দয়ার দান”। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি মহামান্য স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনাল ২০১৮ সালেই খারিজ করেছে।

সম্প্রতি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করা এসবিএসটিসি’র কর্মীদের অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও সরকারের অস্বাভাবিক নিরবতা লক্ষ্য করে হাইকোর্ট কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে এবং পরিবহন সচিবকে কোর্টে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ জারি করে। হাইকোর্টের অন্য এক বেঞ্চের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা মন্তব্য করেন, ডিএ’র টাকা কি বাদাম ভাজা খাওয়ার জন্য! রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের দুই সংস্থা — বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার প্রায় ২০,০০০ কর্মচারীর নতুন বেতন কাঠামোর নিরিখে প্রাপ্য ডিএ আটকে রাখে ওই পর্ষদ। হাইকোর্ট ডিএ’র টাকা গত ২৩ জুনের মধ্যে পাঁচটি কিস্তিতে মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। যথারীতি ওই আদেশ কার্যকর হয়নি। বিচারপতি জুন মাসের শেষে পর্ষদের কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ওই উক্তিটি করেন, সঙ্গে সঙ্গে পর্ষদের তিনজন আধিকারিক, দুই জেনারেল ম্যানেজার ও চিফ ম্যানেজিং ডিরেক্টরদের মাইনে বন্ধের নির্দেশ দেন। উপরোক্ত তিনটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকারের অধীন সর্বস্তরের কর্মীরা তাঁদের পাওনাগণ্ডা আদায়ের জন্য হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হচ্ছেন, হাইকোর্টও নজিরবিহীনভাবে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছেন। সম্প্রতি, সরকারি কর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন, বোর্ড-কর্পোরেশনের কর্মচারি, স্কুলের অশিক্ষক কর্মী ও প্রাইমারি-সেকেণ্ডারি স্কুলের শিক্ষকরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কলকাতায় দু’টি নজরকাড়া মিছিল সংগঠিত করেছেন। ৩০ আগস্ট রাজ্য সরকারি কর্মীরা দু’ঘণ্টার জন্যে কর্মবিরতি পালন করেছেন। লড়াইটা রাস্তায় নিয়ে আসা জরুরি, এটা তাঁরা উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যেতে পারছেন।

- শান্তনু ভট্টাচার্য

খণ্ড-29
সংখ্যা-36