প্রতিবেদন
মুখ্যমন্ত্রীর ‘নীতি শিক্ষা’
moral education

বাগুইআটির দু’টি কিশোরকে অপহরণ করে খুন করা হল। তেরো দিন পর দেহ উদ্ধার হল। এতগুলো দিন পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলে কেন? কেনই বা দুটি কিশোরকে এমন নৃশংসতার বলি হতে হল? সামাজিক অপরাধ লাফিয়ে বেড়ে চলেছে-প্রশাসনের ঔদাসীন্যে, কখনও প্রচ্ছন্ন মদতে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় প্রশাসন নিশ্চয়ই তার দায় এড়াতে পারে না। তেমনই দায়ী সেইসব দুনীর্তিগ্রস্ত সমাজ অভিভাবকরা যারা এই আবহ তৈরি করেছেন।  

ঘটনাসূত্রে যা জানা যাচ্ছে, মূলে ছিল একটি বাইক কেনার ব্যাপার। এই ‘বাইক’ আরও কত তরুণের যে প্রাণ হরণ করবে! বলা যায় না, মাননীয়া হয়তো এবার সাইকেলের বদলে বাইক দেওয়াও চালু করতে পারেন। সব দিচ্ছেন তিনি, শুধু শিক্ষক ছাড়া যিনি ‘শিক্ষা’ বিতরণ করবেন। শিক্ষা তো মাননীয়ার বিতরণযোগ্য নয়! কিন্তু শিক্ষকদের তো তিনি রাস্তায় বসিয়ে রেখেছেন! আদালত চত্বরে পাঠিয়েছেন! শিক্ষাঙ্গন তাই ‘শিক্ষা’শূন্য। ছাত্ররা সেখানে কী করে? কী করা সম্ভব?

মাননীয়া শিক্ষক দিবসে ছাত্রদের 'নীতি শিক্ষা' দেওয়ার কথা বলেছেন। সেজন্য আলাদা ক্লাস, পাঠ্যসূচি আর তা নির্ধারণের জন্য ‘বিশেষজ্ঞ’দের নিয়ে একটা কমিটি গড়ার নির্দেশও দিয়েছেন।

বিদ্যালয়ে ‘নীতিশিক্ষা’ তো ভালোকথা। কিন্তু যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতি, দৌরাত্ম্য, অসাধুতা পাকাপোক্ত ঠাঁই করে নিয়েছে, দলীয় রাজনীতি আর প্রশাসনের সৌজন্যে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সদিচ্ছা’ কতটা ফলপ্রসূ হবে? অনেক স্কুলে মিড ডে মিল নিয়েও দুর্নীতি চলছে। খানাখন্দ ভরা রাস্তায় নিত্য দুর্ঘটনা। ১০০ দিনের কাজের নামে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ হচ্ছে না। পয়সা দিয়ে জব কার্ড কিনতে হচ্ছে। ‘বাংলার বাড়ি’ নিয়েও দুর্নীতি। যাদের দরকার তারা পাচ্ছেন না। যাদের আছে তারাই প্রভাবশালী নেতার আত্মীয় পরিজন হওয়ার সুবাদে পেয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতির সামাজিকীকরণ হয়ে গেছে – লুটে নাও! দু'দিন বৈ তো নয়! আর উপার্জনের রাস্তাই বা কোথায়? সরকারি নিয়োগ বন্ধ। কল কারখানা বন্ধ। শ্রমিক-পীড়ক নয়া শ্রমকোড কারখানার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। টোটো অটো এখন বেকারদের পেটের ভাত জোটাচ্ছে। সেখানেও হ্যাপা অনেক। ছোট ব্যবসা করবে! ট্রেড লাইসেন্স ফী কতগুণ বেড়েছে দ্যাখো! দুর্নীতিময় সমাজের দেহে পারার মতো বিষ ফুটে বেরোচ্ছে – বাড়ছে নানা সামাজিক অপরাধ। তারই বলি ঐ কিশোর দ'টি। এই অপরাধ প্রবণতাকে আরও ইন্ধন যোগাচ্ছে অঢেল মদের যোগান, সরকারের সদিচ্ছা ও ব্যবস্থাপনায়। সরকার এখন দেশি মদের ৩০০ মিলি লিটারের বোতল বাজারে ছাড়ার কথা ভাবছে – গরিব মানুষের ‘সুবিধার্থে’! আহা! এটাও তো একরকম জনসেবা! ভুখাপেটে দেদার মদ গিল আচ্ছাসে মা মেয়ে-বৌ, শিশু সন্তানকে পেটাও! এই জন্যেই না এনসিআরবি এবার পশ্চিমবঙ্গকে গার্হস্থ্য হিংসায় একেবারে শীর্ষে ঠাঁই দিয়েছে!

এ তো গেল সাধারণের কথা। ও দিকে সমাজের অসাধারণ, মহামান্য মন্ত্রী আমলা নেতারা যে সব পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অতুলনীয় কীর্তি গড়ে রেখেছেন, তা আজকের ‘স্বপনকুমার’দের আগামী পঞ্চাশ বছর ধরে রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের খোরাক যোগাবে। আর গোদী মিডিয়ার সান্ধ্য চণ্ডীমণ্ডপের আসর তো জমিয়েই চলেছে যারা ভুলেও কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ডাকাতি’র কথা বলে না। না, একটা শব্দও তারা খরচ করে না সুধা ভরদ্বাজ, তিস্তা শেতলবাদ বা বিলকিস বানোর জন্যে!

তাহলে! খবরের কাগজ, মিডিয়া, রাস্তায় ঘাটে জটলায় এই সব মুচমুচে কেচ্ছ-কেলেংকারির কথা শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে দুর্নীতির বিষবাষ্পের মধ্যে যারা বড় হয়ে উঠছে – তাদের মুখ্যমন্ত্রী কী নীতিশিক্ষার পাঠ পড়াবেন? এতদিন চোখ বুজে থেকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিয়ে যে বিষবৃক্ষ বড় করে তুলেছেন আজ তাকে নির্মূল করবেন কীভাবে! তার শিকড় যে বহুদূর ছড়িয়েছে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-35