গভীর আর্থিক সংকটের আবর্তে খাবি খাচ্ছে মমতার সরকার। রাজ্য সরকারের রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ হতে পারে ৬২,৩৯৭ কোটি টাকা আর চলতি অর্থবর্ষে আনুমানিক রাজস্ব ঘাটতি ২৮,২৭৯ কোটি টাকায় এসে দাঁড়াবে। এরমধ্যে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘স্বাস্থ্য সাথী’, ‘কন্যাশ্রী’ সহ নানা ধরনের কল্যাণকর প্রকল্পের জন্য রাজ্যের রাজকোষ থেকে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে ২৮,০০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’এর জন্য ব্যয় হচ্ছে ১৪,০০০ কোটি টাকা, ৭,০০০ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে ‘কৃষক বন্ধু’ ও ৪,৫০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে ‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পের জন্য। এ’ছাড়া, রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতি মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের উপর বড্ড বেশি নির্ভরশীল। এই মরাপন্ন অবস্থায় এবার হাইকোর্টের রায় খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াল। আদালতের রায় মেনে ৩১ শতাংশ ডিএ দিতে খরচ হতে পারে প্রায় ২৩,০০০ কোটি টাকা।
এই যখন হাঁড়ির হাল, তখন রাজ্য সরকার সস্তায় জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে পুজো-পার্বনে ক্লাবকে দরাজ হাতে অর্থবিতরণ বজায় রেখেই চলল শত সমালোচনাকে থোড়াই কেয়ার করে। এটা বাস্তব যে মমতা সরকারকে বিপাকে ফেলতে একশ দিনের প্রকল্প বাবদ যে তহবিল এই রাজ্যের জন্য ধার্য করার কথা তা নির্দয়ভাবে ছাঁটকাট করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রকল্পটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে মোদী সরকারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এই প্রকল্প খাতে অর্থবরাদ্দ না করায় ২০২১’র ডিসেম্বর থেকেই বেশ কিছু রাজ্যে ১০০ দিনের কাজ থমকে রয়েছে। আর, কেন্দ্রীয় গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের রিপোর্টথেকেই দেখা যাচ্ছে, এই একশ দিনের কাজ বাবদ সারা দেশে বিভিন্ন রাজ্যের জন্য যে বকেয়া রয়েছে, তার ৬৫ শতাংশই হল এ’রাজ্যের! কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে আরও নির্দেশ দিয়েছে, যে পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েতের হোমড়া-চোমড়া ওই বরাদ্দ টাকা নয়ছয় করেছে, তাদের কাছ থেকেই টাকা উদ্ধার করে বকেয়া খরচ মেটাতে হবে।
ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো মমতা সরকার এবার নিল দ্বিমুখী কৌশল। এক, ফিসকাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’কে সংশোধন করে আরও বেশি ঋণ নেওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করল, আর দুই, মোদীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজ্য সরকারের সম্পত্তি বেচে রাজকোষ ঘাটতি পূরণ করতে জমি বেচার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল। জমি বেচার মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকার ৮,০০০ কোটি টাকা নিজের কোষাগারে তুলে নেবে এমনই রয়েছে তার পরিকল্পনা। আর সেই টাকা দিয়ে মমতা সরকার তার কল্যাণমুখী প্রকল্পগুলো চালু রাখতে চাইছে।
গোটা রাজ্য জুড়ে এখন পর্যন্ত ৩২টি জমির খন্ড চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ স্তরে — মমতার আর্থিক উপদেষ্টা ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, মুখ্যসচিব, অর্থসচিব ও মুখ্যমন্ত্রী নিজে। এরআগে, আর্থিক সংকট যুজতে রাজ্য সরকার বাণিজ্যিক ও আবাসন ক্ষেত্রের জন্য লিজে জমি দেয় বেসরকারি সংস্থার হাতে। কিন্তু এ’বার সরাসরি রাজ্যের সম্পদকে বিক্রি করার মনিটাইজেশন পাইপলাইনের বঙ্গীয় সংস্করণ বেছে নেওয়া হল। ২০১৩ সালে রাজ্য পরিবহন দপ্তর বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য কলকাতা ট্রাম কোম্পানির ‘অব্যবহৃত’ জমি নিলামে চড়ায়। কিন্তু এই প্রথম এতো বিপুল পরিমাণ জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার।
কোথায় কোথায় এই সমস্ত জমিকে চিহ্নিত করা হয়েছে? কলকাতা কর্পোরেশনের ১০৮নং ওয়ার্ডেচৌবাগা রোডে ১০ একর জমি, আলিপুরে ৫.৫ একর প্রাইম ল্যান্ড, এছাড়া বেলুড়-দুর্গাপুর- বর্ধমান-ডানকুনি সহ রাজ্যের আরও নানা প্রান্তে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আকন্ঠ ঋণজর্জর রাজ্য সরকারের সমান্তরালে চলছে বিরাট এক ধূসর জগতের পঙ্কিল অর্থনীতি। যার, নেপথ্য নায়কেরা রাজ্যের মন্ত্রিসভা সহ ক্ষমতার অলিন্দে থাকা দাপুটে রাজনীতিবিদ সহ এক শক্তিশালী কায়েমী চক্র। পুলিশের নানা স্তরের কর্তাব্যক্তিরাও যারসাথে জড়িত। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায় অস্বীকার করতে পারেন না।
সরকারি সম্পত্তি বেচে কোষাগার ভরানোর মোদীর অনুসৃত মনেটাইজেশন পাইপলাইনের এই বঙ্গীয় সংস্করণ আগামী দিনে কী ফল (নাকি বিষ ফল) ফলাবে তার অপেক্ষায় চোখ রাখা যাক।