প্রতিবেদন
বকেয়া মজুরি, ন্যায্য মজুরি, কাজের দাবিতে বাংলা সোচ্চার
Bangla is vocal

২০২২-২৩’র মধ্যে মোদী কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার যে কান ঝালাপালা করার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন, তা দেশের মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। ঠিক যেমন রাজ্যবাসী ভুলে যায়নি, “ইতিমধ্যেই রাজ্যের কৃষকদের আয়কে তিনগুণ করে ফেলার” মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা। ক্ষমতার অলিন্দে রাজ্য-কেন্দ্র বা রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান কর্ণধারেরা এই সমস্ত নির্জলা মিথ্যাভাষণ যতই দিক না কেন, কিছু অপ্রিয় তেতো তথ্য এই সমস্ত দাবির অসাড়তাকেই নির্মমভাবে বে-আব্রু করে দিল।

বাস্তব কি বলে?

মূল্যস্ফীতির হার বেশ উঁচুতে থাকলেও ২০২১-২২এ কৃষিক্ষেত্রে মজুরি বেড়েছে ৩ শতাংশেরও কম। ২০১৯-এ ভারতে কৃষির সাথে যুক্ত একটি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ১০,২১৩ টাকা। (সূত্র: ইকনমিক সার্ভে, ২০২১-২২)। এই যৎসামান্য আয়ের উপর ৪-৫ জনের এক কৃষক পরিবারকে সামাল দিতে হয় যাবতীয় অত্যাবশক প্রয়োজনগুলো।

পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ২০২২’র জুন মাসে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ এলাকায় বৃহত্তম রোজগেরে বর্গটাই হল স্বনিযুক্ত কর্মী। আর, তাঁরা হলেন কৃষক। কৃষিকাজে একজন পুরুষ যদি মাসে ১০,২২৮ টাকা পেয়ে থাকেন, মহিলারা ওই একই কাজে পান অর্ধেকেরও কম — মাত্র ৪,৫৬১ টাকা! ওই রিপোর্ট দেখাল, গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট তারতম্য, পুরুষ ও মহিলাদের আয়ে বিরাট বৈষম্য, নিয়মিত বেতনভুক কর্মী ও ক্যাজুয়াল বা স্বনিযুক্ত কর্মীদের মধ্যে আয়ের অনেক ফারাক।

পরিবার পিছু মজুরি বৃদ্ধির হার বছরের পর বছর ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। ২০১২- ২০১৬-তে মজুরির হার ৮.২ শতাংশ থেকে কমে ২০১৭-২১এ ৫.৭ শতাংশে নেমে গেছে। বিভিন্ন রেটিং সংস্থার রিপোর্ট থেকেই তা দেখা যাচ্ছে। আর, মূল্যস্ফীতিকে যুক্ত করলে এই বৃদ্ধির হার আরও কমে ১ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। মজুরির এই মন্থর বৃদ্ধি গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলে একই সাথেই ঘটেছে। গ্রামীণ এলাকায় মজুরি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেড়েছে ২.৮ শতাংশ, আর শহরাঞ্চলে ৫.৫ শতাংশ, কিন্তু মূল্যস্ফীতির সাথে তা যুক্ত করলে বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হবে।

ইতিমধ্যে যে চর্চাটা খুব সামনে এসেছে, তা হল, বিগত ত্রৈমাসিকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি যুক্তরাজ্যকে (ইউকে) টেক্কা দিয়ে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু, বাস্তব এটাই যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি রূপায়ন মন্ত্রকের প্রকাশ করা তথ্য দেখাচ্ছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়েনি, বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে, লাফ দিয়ে বেড়েছে অল্প বয়সী তরুণ ও বেকার দিনমজুরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। স্বনিযুক্ত, কর্মহীন, কৃষক, দিনমজুর — সব মিলিয়ে এই বর্গের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৫২.৮৫ শতাংশ ! ২০২০’র সাপেক্ষে ২০২১-এ পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৭.২ শতাংশ। দিনমজুরদের আত্মহত্যার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০২০’র তুলনায় গতবছর তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১১.৫২ শতাংশ হারে। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার দাবি যে কতবড় প্রবঞ্চনা তা এই তথ্যই উন্মোচিত করল।

আমাদের রাজ্য — মজুরির হাল

রিজার্ভব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্ট (২০২১) বলছে, এই রাজ্যে গ্রামীণ জনসংখ্যার দৈনিক মজুরির হার মাত্র ২৮৮.৬০ টাকা, যা জাতীয় হার ৩০৯.৯০ টাকা থেকে কম। অ-কৃষিকাজের সাথে যুক্ত মজুরদের মজুরি এ’রাজ্যে বেশ কম। এ’রাজ্যে এই মজুরির হার ৩০৭.৫০ টাকা, যেখানে জাতীয় হার হল ৩০৯.১০ টাকা।

একশ দিন কাজের প্রকল্প এই রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়ায় রাজ্য সরকার আরেকটা বেআইনি ও অন্যায্য পথ অবলম্বন করতে শুরু করেছে। একশ দিনের প্রকল্পে কাজ দিতে না পারায় এবার শ্রমের অবমূল্যায়ন করতে শুরু করল মমতা সরকার। এখন, সরকারি দফতরে জব কার্ডধারী শ্রমিকদের নিযুক্ত করা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির অর্ধেক অঙ্কের বিনিময়ে! খবরে প্রকাশ, রাজ্যের এগারোটি জেলায় রাজ্য সরকারের নানা দফতরের প্রকল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মেলেনি, অন্তত দু’টি জেলায় মিলেছে সরকার নির্দিষ্ট মজুরির অর্ধেকেরও কম। এই মজুরি প্রদানেও বেশ তারতম্য রয়েছে। জলপাইগুড়িতে তাঁরা পাচ্ছেন দৈনিক ৫৮ টাকা, আর মালদহে ৯৯ টাকা। আরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কলকাতার আশপাশের জেলাগুলিতে মজুরির হার বেশি, আর প্রান্তিক জেলাগুলিতে কম। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার এখানে শ্রমের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ না করে বাজারের অন্যায্য অন্ধ বিধির কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। গোটা এই ব্যবস্থাই এখন ঠিকাদারদের কব্জায়। সরকারের অন্যান্য দফতরগুলো এখানে শুধু মৌন মূক দর্শকই নয়, ঘোরতর এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।

রাজ্যে একশ দিনের কাজ — গভীর সংকটে

“যত ধর্ম বাদ দাও, ভুখা পেটে ভাত দাও” — এই স্লোগানকে সামনে রেখে কয়েকশ আদিবাসী বিক্ষোভকারী, যাদের মধ্যে বেশিরভাগটাই মহিলা, পুরুলিয়ার পুঞ্চা ব্লকে বিক্ষোভ দেখালেন ২৫ জুলাই, ঠিক যেদিন দেশের প্রথম আদিবাসী মহিলা দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলেন। তাঁরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন একশ দিনের কাজে তাঁদের বহু মাস বকেয়া মজুরির দাবিতে।

মজুরির দাবিতে। গোটা রাজ্যেই একশ দিনের কাজ এখন প্রায় থমকে। কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে উতর-চাপান খেলায় অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত একাধিক প্রকল্প, সেচ, বাঁধ নির্মাণের মতো জরুরি কাজগুলো সবই থমকে রয়েছে। দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে রুটি রুজি জোটানোর জন্য ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার দৈনন্দিন আখ্যান।

একশ দিনের কাজের মর্মান্তিক পরিণতির দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। কেন্দ্রীয় সরকারের একশ দিনের কাজ সংক্রান্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, এ’রাজ্যে রয়েছে ৩.৪২ কোটি নথিভুক্ত শ্রমিক আর ১.৫৭ কোটি জবকার্ড ধারী পরিবার। ২০২১-২২এ তৈরি হয়েছিল ৩৬.৪২ কোটি কর্মদিবস, যা রাজস্থানের পর দেশের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম। এরমধ্যে ২০২১- ২২এ সমগ্র শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেকই (৪৬.৬৯ শতাংশ) ছিলেন মহিলা, আর ২০২২-২৩-এ ৪৮ শতাংশ মহিলা। কিন্তু, মজুরি দিতে না পারায় ২০২২-২৩’র ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মদিবস একেবারে নিচে নেমে দাঁড়ায় ৩.৪৩ কোটিতে। অর্থাৎ মাত্র একবছরের মাথায় কর্মদিবস হ্রাস প্রাপ্ত হল ৩৩.৩৯ কোটি! যা রীতিমতো অভাবনীয়। ২০ জুলাই রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক জানায়, একশ দিনের প্রকল্পে গোটা দেশে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ৩,৯৮৯.৫৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধু এ’রাজ্যের বকেয়া হল ২,৬০৫.৮২ কোটি, অর্থাৎ সমগ্র বকেয়ার প্রায় ৬৫ শতাংশই পশ্চিমবাংলার! এ’রাজ্যে কেন বকেয়া টাকা দেওয়া বন্ধ করল কেন্দ্রীয় সরকার, এই প্রশ্নের জবাবে রাজ্যসভায় মন্ত্রী বলেন, মনরেগা আইনের ২৭নং ধারায় বলা আছে, “কেন্দ্রের নির্দেশ ঠিক মতো অনুসৃত না হলে এই প্রকল্পের জন্য ধার্য তহবিল থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিবেচনাযোগ্য সময়সীমার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তার ঠিকঠাক রূপায়নের লক্ষ্যে যথাযথ সংশোধনী পদক্ষেপ নেবে।” এখন, এই সমস্ত শব্দবন্ধ “বিবেচনাযোগ্য সময়সীমা”, বা “যথাযথ সংশোধনী পদক্ষেপ”এর অন্তর্নিহিত অর্থ একমাত্র আমলাতন্ত্রের কাছেই বোধগম্য, কিন্তু এই সার কথাটার উত্তর মেলে না — যারা কাজ করলেন, শ্রম দিলেন, তাঁদের শ্রমের মূল্য কেন দেওয়া হবে না সময় মতো।

করে ১০০ দিনের শ্রমিকদের মজুরি ঠিক সময়ে প্রদানের জন্য ঝাড়খন্ড সরকার ৫০০ কোটি টাকার এক বাফার তহবিল তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, আমাদের রাজ্য সরকার কেন সেই পথ অবলম্বন করতে পারে না? যে দুর্নীতির কারণ দেখিয়ে এই কেন্দ্রীয় তহবিল বন্ধ রয়েছে, সেই দুর্নীতি ঠেকাতে সোশ্যাল অডিটের পদক্ষেপ এ’রাজ্যে বন্ধ রাখা হয়েছে। রাজ্যের সোশ্যাল অডিট নির্দেশক বা ডিরেক্টর জানিয়েছেন, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩এ একশ দিনের সোশ্যাল অডিটের জন্য কোনও বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সিএজি কেন ২০১১-১২’র পর কোন অডিট করলনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার ও অভিযুক্ত পঞ্চায়েতদের কাছ থেকে আত্মসাৎ হওয়া টাকা পুনরুদ্ধার করার কেন্দ্রীয় নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্য সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে এফআইআর দায়ের করলেও টাকা আদৌ উদ্ধার করা যাবে কিনা তা নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ রয়েছে। (তথ্যসূত্র: ডিলে, ডেট অ্যান্ড ডিস্ট্রেস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল, দ্য হিন্দু)।

এনসিআরবি’র রিপোর্ট উল্লেখ করেছে যে পশ্চিমবাংলা সহ একাধিক রাজ্য জানিয়েছে, তাদের রাজ্যে কৃষক বা কৃষি মজুরের আত্মহত্যার ঘটনা নাকি শূন্য! শুধু উক্ত সংস্থাকেই নয়, রাজ্য বিধানসভা থেকে প্রায় সমস্ত মঞ্চে মমতা সরকার জানিয়েছে এ’রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। এদিকে, কিছুদিন আগে তথ্য জানার অধিকার আইনের সাহায্যে জানা গেল, ২০২১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ১২২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে, ২০২১ সালে ঘাটাল থানার অধীনে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা সর্বাধিক (৬৩), তারপর রয়েছে গোয়ালতোড়ের নাম। সেখানে আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪।

শ্রমের ন্যায্য মূল্য না দেওয়া অপরাধ, শ্রমের মূল্য বকেয়া রেখে না প্রদান করা আরও বড় অপরাধ! আর এই দু’টো অপরাধে সমান দুষ্ট মোদী-মমতা সরকার। তাই, ন্যায়সঙ্গত ভাবে আজ গ্রাম বাংলায় দাবি উঠেছে — কেন্দ্র রাজ্য বুঝিনা। কাজ করেছি, মজুরি দাও।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-38