কেরলে তীব্র প্রতিবাদের মুখে আদানির বন্দর
protests in Kerala

কেরলের রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের ২০ কিমি দক্ষিণে ভিজিনযাম শহরে নির্মীয়মান সমুদ্র বন্দরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ তীব্রতর হয়ে উঠছে। বন্দরটি নির্মাণ করছে আদানি গোষ্ঠী। এই বন্দর নির্মাণের পরিণামে বেশ কয়েকটা সৈকত বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বহু ঘর সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে গেছে, বহু জেলের জীবিকা ধ্বংস হয়েছে, এফসিআই’এর পড়ে থাকা গুদামকে ত্রাণ শিবিরে পরিণত করে সেখানে ঘর হারানো মানুষদের রাখা হয়েছে। বন্দরটি নির্মাণের কাজ অবিলম্বে বন্ধের এবং পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবি এতটাই জোরালো হচ্ছে যে তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কেরলের সিপিএম নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষতিগ্ৰস্ত মৎসজীবী ও উপকূলবাসীদের কিছু দাবি মেনে নিলেও বন্দর নির্মাণ বন্ধের দাবি কখনই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে।

বন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়া সচল হয় ২০১৫ সালে, যে বছরের আগস্ট মাসে ওমান চাণ্ডির কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে আদানি ভিজিনযাম পোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড’এর ৭,৫২৫ কোটি টাকার পিপিপি মডেলের চুক্তি হয়। ঐ বছরের ডিসেম্বরেই শুরু হয় বন্দর নির্মাণের কাজ এবং কাজ শেষ হয়ে বন্দর চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালে। কিন্তু নানা কারণে নির্মাণ কাজ গতি লাভ করেনি এবং আনুমানিক হিসাব হল নির্মাণ কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু কাজ যতটা এগিয়েছে তাতেই সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস করা মানুষদের জীবন-জীবিকায় ক্ষতির প্রভাব যথেষ্ট বলে সুস্পষ্ট হয়েছে। সৈকত-গ্ৰাম-ঘরবাড়ি সমুদ্র গর্ভে চলে যাওয়ার কারণ বলে চিহ্নিত হচ্ছে ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণ। ব্রেকওয়াটার হল সমুদ্রের ঢেউ’এর আঘাত থেকে জাহাজগুলোকে রক্ষার জন্য সমুদ্র বক্ষে নির্মিত পাথরের প্রাচীর (যার নির্মাণ কিছুটা হয়েছে এবং কিছুটা নির্মাণ এখনও বাকি)। এই প্রাচীরের নির্মাণ সমুদ্র স্রোত এবং বায়ু প্রবাহের ধারাকে পাল্টে অনেক বেশি গতিশীল করেছে এবং সমুদ্রের ঢেউ অনেক বেগবান হয়ে আছড়ে পড়ে সৈকতের বেলাভূমি এবং ঘরবাড়ির সলিল সমাধি ঘটাচ্ছে। জেলেরা জীবিকা হারাচ্ছেন এবং ঢেউয়ের তীব্রতায় মৎসজীবীদের নৌকা উল্টে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। বন্দর নির্মাণ থেকে ঘটা বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়ে স্থানীয় জনগণ এবছরের ১৬ আগস্ট থেকে সংগঠিত প্রতিবাদ শুরু করেছেন (অবশ্য, প্রকল্প উপকূলের মানুষের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চলেছে আঁচ করে কেউ-কেউ শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছেন, যেমন, এনজিও ‘কোস্টাল ওয়াচ’)। তাঁরা দিন-রাত ধর্ণা সংগঠিত করেছেন, বন্দরস্থল ঘেরাও করেছেন, আদানির কুশপুতুল পুড়িয়েছেন, বন্দর নির্মাণের কাজ বন্ধের দাবিকে জোরদার করেছেন। এইসব প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছে ল্যাটিন ক্যাথলিক চার্চ। প্রতিবাদ তীব্রতা লাভ করায় বিজয়ন সরকার প্রতিবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিবাদীরা সরকারের কাছে যে দাবিগুলো রেখেছেন সেগুলো হল –

  • ১) পরিবেশের ওপর বন্দর নির্মাণের প্রভাব নিয়ে নতুন সমীক্ষা করতে হবে এবং সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত নির্মাণ কাজকে বন্ধ রাখতে হবে।
  • ২) ক্ষতিগ্ৰস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ৩) সমুদ্র উপকূলের ক্ষয় রোধে ফলদায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • ৪) ঝড়ঝাপটার সম্ভাবনায় যে দিনগুলোতে মাছ ধরতে যাওয়া বারণ থাকবে, সেই দিনগুলোর জন্য জেলেদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
  • ৫) মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়া জেলেদের পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
  • ৬) ভর্তুকিতে যথেষ্ট পরিমাণ কেরোসিন দিতে হবে।
  • ৭) সমুদ্রবক্ষে খননের ফলে তিরুবনন্তপুরম জেলার মুথালাপ্পোঝি মাছ ধরার বন্দরটির ক্ষতি হচ্ছে এবং তার সুরক্ষার ফলদায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় সরকার এক নম্বর দাবিটি মানা, অর্থাৎ, বন্দর নির্মাণের কাজ বন্ধ করা কখনোই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন বলেছেন, “ভিজিনযাম বন্দরের নির্মাণ কাজ বন্ধের বিবেচনা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কাজ করতে গেলে সমস্যা আসবে। এই ধরনের প্রকল্পে ঐরকম সমস্যা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ঐ সমস্যাগুলোর মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটাই আসল ব্যাপার।” সমস্যাটাকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এবং উপকূলের মানুষের ক্ষয়ক্ষতিকে তার যথার্থ মাত্রায় অনুধাবন করার পরিবর্তে বিজয়ন সরকারের দেওয়া কিছু সহায়তাকে গ্ৰহণ করে আন্দোলনরত জনগণকে সন্তুষ্ট থাকার কথা বললেন। এছাড়া, ছ’নম্বর দাবি, অর্থাৎ, ভর্তুকিতে কেরোসিন তেল দেওয়ার দাবি মানতেও সরকার অস্বীকার করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জেলেরা যে নৌকোয় সমুদ্রে মাছ ধরতে যান, সেই সমস্ত নৌকোর ইঞ্জিন কেরোসিন তেলে চলে। কেরল সরকার মৎসজীবী নৌকোর মালিককে ৯৩ টাকা লিটার দরে প্রতি মাসে ১২০ লিটার কেরোসিন দেয়। কিন্তু মৎসজীবীদের দাবি, তামিলনাড়ুর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সরকারকে ২৫ টাকা লিটার দরে ৩০০ লিটার কেরোসিন নৌকোর মালিককে প্রতি মাসে দিতে হবে। কিন্তু তামিলনাড়ুর দৃষ্টান্ত অনুসরণের কোনো আগ্ৰহ বিজয়ন সরকার দেখায়নি।

কেরল সরকারের মৎসমন্ত্রী ভি আবদুরাহিমান ১৯ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, যাঁরা ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন, সরকার ওনাম উৎসব শুরুর আগে (আগস্টের শেষে যার শুরু) তাঁদের ভাড়াবাড়িতে স্থানান্তরিত করবে এবং ভাড়ার জন্য প্রতি পরিবারকে মাসে ১৫,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু পরে সরকার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে এসে ভাড়ার পরিমাণকে ১৫,০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩,০০০ টাকা করে। আন্দোলনকারীরা এটা মানতে অস্বীকার করেছেন। এছাড়া, বিজয়ন সরকারের মন্ত্রীসভার সাবকমিটি ২২ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেয় যে, সরকার ১০ একর জমি নির্দিষ্ট করে তাতে ৩,০০০ ফ্ল্যাট বানাবে এবং সেই সব ফ্ল্যাটে বন্দর নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। সরকার এই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করে তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে।

ভিজিনযাম বন্দর প্রকল্প পরিবেশের ওপর, বিশেষভাবে উপকূল অঞ্চলের জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর কী প্রভাব সৃষ্টি করবে তার একটা মূল্যায়ন বন্দর নির্মাণ শুরুর আগেই হয়েছিল। এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ও আর্থিক বলে বলীয়ান শিল্পপতি আদানি অনায়াসেই পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়ে যান। আজ যখন প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হচ্ছে, ব্রেকওয়াটার বা সমুদ্রবক্ষে প্রাচীর নির্মাণের ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ আর থাকছেনা, তখনও পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে নতুন করে মূল্যায়নে কি নির্মাতা আদানি, কি সরকার কেউই রাজি নয়। সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র জেলেদের, উপকূলবাসীর যন্ত্রণা ও অস্তিত্ব সংকট নিয়ে ভাবনাচিন্তা এখন বিলাসিতা বলেই বিবেচ্য হয়। সরকার এবং আদানি বলবে — এটা ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প যা মানুষের জীবনধারাকে পাল্টে দেবে, প্রকল্প হবে উন্নতির দূত। আর ঘরবাড়ি হারিয়ে বসতভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া, উন্নয়নের নিমিত্তে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া মানুষরা রাষ্ট্রের চোখে অকিঞ্চিৎকর-অধিকারহীন-উপেক্ষণীয় বলেই গণ্য হতে থাকবেন!

খণ্ড-29
সংখ্যা-35