প্রতিবেদন
নারীর পক্ষে চরম অবমাননাকর কুমারীত্ব পরীক্ষার বিলোপ ঘটাতে হবে
Abolition of virginity test

রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলার ২৪ বছরের এক যুবতীর জীবনে চরম অমর্যাদাকর ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘটনাটা ঘটেছিল এ’বছরের মে মাসের ১১ তারিখে। কিন্তু এতদিন চাপা থাকলেও তার উন্মোচন ঘটল এ’মাসের, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের গোড়ায়। ঐ যুবতীর সেই আখ্যান গোটা নারী সম্প্রদায়ের কাছেই অবমাননার এক প্রতীক হওয়ায় আমরা এখানে সেই আখ্যানকে উপস্থাপিত করছি।

যুবতী সানসি উপজাতির এবং তার বিয়ে হয়েছিল ঐ জেলার বাগোরের এক যুবকের সঙ্গে। ঐ সানসি সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে এখনও চালু রয়েছে ‘কুকাডি প্রথা’র মতো নারীর পক্ষে চরম অসম্মানের এক সামাজিক রীতি। এই প্রথা আসলে নারীর কুমারীত্ব পরীক্ষা। বিয়ের পর স্বামী বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক মিলন করবেন এবং বিছানো সাদা কাপড়ে রক্তের দাগ লাগলে স্ত্রী পরীক্ষায় পাশ করবেন, অন্যথায় তিনি অক্ষতযোনির নারী নন বলে বিবেচিত হবেন। এক্ষেত্রে সেই যুবতী কুমারীত্বর পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেন না। এবং তারপর শুরু হল তাঁর ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে ঐ যুবতীকে বলতে শোনা যাচ্ছে — “বিকেলে চালানো ঐ আচার-অনুষ্ঠানে আমি পাশ করতে পারলাম না। এরপর গভীর রাত পর্যন্ত চর্চা চলল। ভয়ে আমি কোনো কথাই বলতে পারিনি। আমার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে মারধর করল।” ঘটনা হল, বিয়ের আগে স্থানীয় এক যুবক ঐ যুবতীকে ধর্ষণ করে এবং যুবতীর বাড়ির লোকজন তা নিয়ে থানায় এফআইআর’ও দায়ের করেছিলেন।

যুবতীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। তাতেই শ্বশুরবাড়ি ক্ষান্ত হল না, তারা যুবতীর বিরুদ্ধে খাপ পঞ্চায়েতে অভিযোগ জানালো। পঞ্চায়েত প্রথমে ১৮ মে বৈঠকে বসে এবং সেদিনের বৈঠকে যুবতীর পরিবারের সদস্যরা যুবতীর ধর্ষণের কথা এবং তা নিয়ে থানায় এফআইআর দায়ের সম্পর্কে পঞ্চায়েতের লোকজনদের অবহিত করেন। সেদিনের বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। পরে ৩১ মে আবার বৈঠক হয়, এবং সেদিন পঞ্চায়েত যুবতীর পরিবারের ওপর ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা চাপায়। এই জরিমানা আদায়ের জন্য যুবতীর স্বামীর পরিবার যুবতীর পরিবারের ওপর লাগাতার চাপ দিতে এবং নানান উৎপীড়ন চালাতে থাকে। উৎপীড়ন অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছলে যুবতীর পরিবার ৩ সেপ্টেম্বর তার স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করেন। পুলিশ তদন্তে নামে, যুবতীর পরিবারের অভিযোগ সত্যি বলে দেখতে পায় এবং দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় যুবতীর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে আইন বিরুদ্ধ দাবি মেটাতে নারীর ওপর জোরজবরদস্তি, জুলুমবাজির মাধ্যমে অর্থ আদায়, নারীর শালীনতার অসম্মান, ইত্যাদি। জেলা পুলিশের এক ডিএসপি সুরেন্দ্র কুমার জানিয়েছেন — যুবতীর শ্বশুর হলেন হেড কনস্টেবল এবং যুবতী যে ধর্ষিতা হয়েছিলেন সেকথা তিনি জানতেন। সেই ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও যুবতীকে কুমারীত্ব পরীক্ষার মধ্যে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তাঁর চরম অবমাননা, নির্যাতন ও হয়রানি ঘটানো হয়েছিল। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে জরিমানা আরোপ করিয়ে সেই জরিমানা আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি ও উৎপীড়ন প্রক্রিয়াও চলেছিল পাঁচ মাস ধরে। এই ঘটনাকে ধরে জাতীয় নারী কমিশনও স্ত্রীর কুমারীত্ব পরীক্ষাকে পশ্চাদগামী, নারী বিদ্বেষী প্রথা বলে অভিহিত করেছেন, এবং তার মধ্যে দিয়ে নারীর বুনিয়াদি অধিকার ও মর্যাদা লঙ্ঘন হওয়ার কথাও বলেছেন।

একুশ শতকে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যখন অনেক বড়-বড় কথা বলা হচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে নারীশক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন, তখনও কেন প্রতিদিনই নারীকে অশ্রদ্ধা, অসম্মান ও অপমানের মুখোমুখি হতে হবে? এবারের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণেও নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “আমাদের আচরণ, সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের যা কিছু নারীকে অপমানিত ও হীন প্রতিপন্ন করে, তারথেকে নিজেদের মুক্ত করার অঙ্গীকার কি আমরা করতে পারি না?” দেশে আজ এমনই এক পরিমণ্ডল বিরাজ করছে যাতে নানান নিপীড়ন ভোগ করা ও হীন প্রতিপন্ন হওয়াটাই নারীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদীর ঐ বচন অসার বলেই দেখা দিচ্ছে। নরীর কুমারীত্ব পরীক্ষার মতো প্রথা কেন আজও সমাজে বিদ্যমান থাকবে? সেই পরীক্ষায় পাশ না করলেই কেন নারী ‘অপবিত্র’ বলে গণ্য হবে ও তার মূল্য কমে যাবে? এই প্রথার বিলোপের জন্য নারী ক্ষমতার আত্মঘোষণার সামনে অবরোধ তোলা, নারীকে অসমকক্ষ ও হীন প্রতিপন্ন করার পরিমণ্ডলটাকেই পাল্টানো দরকার। সেই লক্ষ্যে কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন আন্তরিক সক্রিয়তা দেখাতে পারবে না কেন?

– জয়ন্ত মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-37