প্রতিবেদন
১৩.৫ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গল্প
GDP growth of 13 percent

সপ্তাহ খানেক আগে দেশের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের অর্থনৈতিক কাজকর্ম সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রকাশ করা হয়েছে, যদিও ওই তথ্যাদি আনুমানিক ও তা বারতিনেক পাল্টাতে থাকে। তবুও মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি এবং মোট মূল্যযোগ বা জিভিএর পরিসংখ্যান দিয়ে মাপার চেষ্টা হয় যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দিক থেকে দেশ কতটা এগোলো বা পিছোলো। ওই জিডিপি বা জিভিএ জাতীয় আয়ের একটি পরিমাপ। যদিও জাতীয় আয় শেষ পর্যন্ত মাপা হয় নীট জাতীয় আয় বা নেট ন্যাশনাল ইনকাম বা এনএনআই দিয়ে। এমনটা নয় যে, ওইসব জিডিপি, জিভিএ বা এনএনআই ধারণাগুলি দেশের জনসাধারণের কাছে খুব বোধগম্য হয়, কিন্তু সেই ১৯৯১ সালের নরসিমহা রাও-মনমোহন সিং-চিদাম্বরমের কাঠামোগত সংস্কার বা নয়া আর্থিক নীতি গ্রহণের পর থেকে জিডিপি ও তার বৃদ্ধির হার নিয়ে ক্রমাগত ঢক্কানিনাদের মাধ্যমে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার পেটে স্বাস্থ্যকর খাদ্য, মাথায় ছাদ, পরণে বস্ত্র, হাসপাতালে শয্যা ও ওষুধ, বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকুক আর নাই থাকুক জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়লে দেশ এগিয়ে চলেছে ভেবে ফুর্তিতে ডগমগ হতে হয়।

গত ২০১৪ সালের পর থেকে তো আর কথাই নেই জিডিপি দিয়েই কেবল দেশের অগ্রগতি মাপা শুরু হয়েছে। দেশ জোড়া অর্থনৈতিক বৈষম্য, নারী নিগ্রহের বৃদ্ধি, বেকারি, মুল্যস্ফীতি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার হ্রাস, সার্বিক গণতন্ত্রহীনতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন এসব চলতে থাকলেও জিডিপির পরিসংখ্যান প্রকাশিত হলেই বিজেপির আইটি সেল লাফিয়ে ঝাপিয়ে আমরা কত ভালো আছি, কত উন্নতি করেছি তা নিয়ে লাফালাফি করতে থাকে। এমনিতেই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধি সাধারণ জনগণের উন্নয়নের কোনো মাপকাঠি নয়, দেশের ১০ শতাংশ মানুষের আয় বিপুল পরিমাণে বেড়ে দেশজোড়া বৈষম্য সৃ্ষ্টি করলেও জিডিপি বৃদ্ধি পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দেশের কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেওয়া বয়স্ক নাগরিকদের কথা ভাবা যেতে পারে। এদের অনেকেই অবসরকালীন পাওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটির অর্থের উপরে পাওয়া সুদের উপর নির্ভর করে জীবননির্বাহ করেন। সেই সুদ গত ৮ বছরে ক্রমাগত কমেছে। ফলে তাদের আয় কমেছে চলতি টাকার অঙ্কে। অপরদিকে ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য প্রভৃতির মূল্যস্ফীতি ঘটেছে হুহু করে। সামগ্রিকে ওই বয়স্ক মানুষদের প্রকৃত আয় কমেছে, হযতো বা গত ৮ বছরে অর্ধেক হয়েছে। জিডপি বৃদ্ধি যতই ঘটুক না কেন, তাতে ওঁদের আয় সঙ্কুচিতই হয়েছে। একইভাবে এদেশের রাজ-অনুগ্রহে থাকা শিল্পপতি এশিয়ার ও পৃথিবীর তৃতীয় সম্পদশালী হলেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা বিপুল (মোটের ৯০ শতাংশ) জনসাধারণ নোট বাতিল ও জিএসটির ধাক্কায় দরিদ্রতর হয়েছেন। তাই জিডিপির বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নতির বুদবুদ তৈরি করতে পারে কিন্তু তা একদিন ফাটবেই।

এতদসত্বেও যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে মোদী বাহিনী হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছে সেই পরিসংখ্যানের দিকে একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিলেও বোঝা যাবে যে বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হারের মিথ কতটাই মিথ্যে। ২০২২-২৩-এর এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিক বা প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি বেড়েছে গত বছরের অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় ১৩.৫শতাংশ হারে; ২০২১-২২-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে অনুরূপ বৃদ্ধির হার ছিল ২০.১শতাংশ; ২০২০-২১ ত্রৈমাসিকে -২৩.৫শতাংশ (অর্থাৎ ওই ত্রৈমাসিকে তার আগের বছরের অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় জিডিপি ২৩.৫শতাংশ কম ছিল), ২০১৯-২০র প্রথম ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ছিল ৫.১শতাংশ। এসব হিসেবে খুব কিছু বোঝা যায় না। তবে ২০১৯-২০র প্রথম ত্রৈমাসিকে, যেটি করোনাহীন বছরের প্রথম ত্রৈমাসিক, মোট জিডিপি ছিল স্থির মূল্যে ৩৫.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। সেটি ২০২২-২৩-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে বেড়ে হয়েছে ৩৬.৮৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ অঙ্কের হিসেবে ৩ বছরে বেড়েছে বার্ষিক ১.৪শতাংশ হারে। ওই যে ১৩.৫শতাংশ হারে বৃদ্ধির কল্পকথা তা যে কত বড় মিথ্যে তা বোঝা যাচ্ছে এবারে। বৃদ্ধির হারটি আরো দুর্বিসহ হবে বিজেপির কাছে যদি স্থির মূল্যে মাথাপিছু জিডিপিকে হিসেব করা যায়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে জনসংখ্যা ছিল ১৩৩ কোটি, ২০২২ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭ কোটি। ফলে ২০১৯-২০ সালের মাথাপিছু জিডিপি (স্থির মূল্যে) ২৬,৬৮০ টাকা, যা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২৬,৯০০ টাকা। অর্থাৎ বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৩শতাংশ।

২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান

story of economic prosperity

পরিসংখ্যানের ছানবিন করতে করতে মনে পড়ছে যে, সম্পাদক মশাই সপ্তাহ দুয়েক আগে বলেছিলেন, এই যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, স্টেট ব্যাঙ্ক বলছে যে প্রথম ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ১৬ শতাংশের আশেপাশে থাকবে (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনুমান করেছিল ১৬.২শতাংশ, স্টেট ব্যাঙ্কের অনুমান ছিল ১৫.৯শতাংশ) সেটা কীভাবে হবে? অর্থাৎ জিডিপি বৃদ্ধির যে অনুমান করা হযেছিল তার তুলনায় বৃদ্ধিতে ঘাটা হয়েছে ২.৫শতাংশের মত। তাই এই যে বৃদ্ধি সেটাতেও হ্রাস। কিন্তু যে বিজেপি মিথ্যা ছাড়া সত্য বলে না, তাদের সরকারকে বোঝাবে কে! অপরদিকে ২০২২-২৩ সালের সারা বছরের বৃদ্ধির হারের যে অনুমান ছিলে স্টেট ব্যাঙ্কের তাকেও ৭.৫শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৮শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা। মুডিজও নামিয়ে এনেছে ৮.৮শতাংশ থেকে ৭.৭শতাংশে, পরের বছরের অনুমান আরো কম, ৫.২শতাংশ। সিটি গ্রুপ বৃদ্ধির হারের অনুমানকে ৮শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৭শতাংশ করেছে। শিল্পোৎপাদনের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে আটটা মূল পরিকাঠামো শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে ৪.৫শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে আগামীতে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমার আশঙ্কা রয়েছে।

এসব তো গেল জিডিপি, শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির হ্রাসের কথা। সরকারের তথ্যে বেকারত্বের হার জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকের ৯.৫শতাংশ থেকে কমে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ৭.৬শতাংশ হয়েছে। কিন্তু ওই সমীক্ষা অনুযায়ীই কর্মী-জনসংখ্যা অনুপাত ওই দুই ত্রৈমাসিকেই মোটামুটি একই রয়েছে। এর অর্থ হল, লোকে হতাশ হয়ে কাজ খোঁজাও ছেড়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে সিএমআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমি)র পরিসংখ্যানে আগস্ট মাসে দেশে বেকারত্বের হার তার আগের মাসের ৬.৩শতাংশের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে ৮.৩শতাংশ হয়েছে। শহরাঞ্চলে তা ৯.৭শতাংশ, গ্রামে ৭.৬শতাংশ। আরো ভয়ানক হল যে, যুবকদের কর্ম সংস্থানের হার ২০২১-২২ অর্থবর্ষে গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে, ১০.৪শতাংশ; ২০১৬-১৭ সালে তা ছিল ২০.৯ শতাংশ।

ভারতের রফতানি কমেছে, আমদানি বেড়েছে। ফলে আগস্ট মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ২৮৬৮ কোটি ডলারের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিদেশি মুদ্রা ভান্ডার ৩০১ কোটি ডলার কমে আগস্টের শেষ সপ্তাহে দাঁড়িয়েছে ৫৬১০৪ কোটি ডলারে, তার আগের সপ্তাহে (১৯ আগস্ট শেষ হওয়া) তা তার আগের সপ্তাহের থেকে ৬৬৯ কোটি ডলার কমেছিল। ফলে ওই ভান্ডার ক্রমাগত কমছে। অর্থনৈতিক কাজকর্মের আরো কয়েকটি সূচকও দেশের অর্থনীতির সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করছে। ডিজেলের ব্যবহার ৪.৯শতাংশ কমে আগস্ট মাসে ৬১ লক্ষ টন হযেছে, রান্নার গ্যাসের বিক্রিও ১শতাংশ কমেছে। তবে পেট্রলের বিক্রি জুলাইএ ৫শতাংশ কমেছিল, আগস্টে হয়েছে ৫.৮১শতাংশ। কেন্দ্রের উৎপাদন শুল্ক সংগ্রহও জুলাই মাসে আগের মাসের তুলনায় ২৬শতাংশ কমেছে। আগস্ট মাসের জিএসটি সংগ্রহ জুলাইএর ১.৪৯ লক্ষ কোটি টাকার থেকে কমে ১.৪৩ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে।

সব মিলিয়ে জিডিপির ১৩.৫শতাংশ বৃদ্ধিকে নিয়ে যে হৈচৈ করা হচ্ছে তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, বরং শঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু আরএসএস-বিজেপির তো দেশের সঙ্কটেই আনন্দ। ওই যে কী যেন বলে না মোদীজী, সঙ্কটকে সুযোগে পরিণত করা। দেশের জনসাধারণের কাজ না থাকা, জিনিসপত্তরের দাম বাড়ার মত সঙ্কটকে ওরা আদানির মুনাফার সুযোগে রূপান্তরিত করতেই আগ্রহী।

– অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-35