স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির এক সপ্তাহ আগে, ২০২২ এর ৯ আগস্ট দেশবাসী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৮০ তম বর্ষপূর্তি স্মরণ করছে। ব্রিটিশ শাসকদের ভারত ছাড়ো ডাক দেওয়ার পরে মুম্বইয়ে দলের সর্বভারতীয় অধিবেশন থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু এই আন্দোলনের আহ্বান দেশের বহু জায়গায় গণ জাগরণ উস্কে দেয় এবং চার চারটি স্থানে সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা হয় – উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, বাংলার তমলুক, ওড়িশার তালচের ও মহারাষ্ট্রের সাতারায়। সাতারার সমান্তরাল সরকারটি ১৯৪৭ অবধি টিকে ছিল, ফলত এই সরকারটিই ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন আর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দেশ ছাড়ার ঘটনার ঐতিহাসিক যোগসূত্র।
এত কিছুর পরেও ভারতবর্ষ আজ ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাসের মুখোমুখি। আজ দেশের শাসনক্ষমতা এমন এক শক্তির হাতে যার পূর্বসূরীরা যে কেবল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে সরে থেকেছিল তাই নয় বরং তারা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের দিনগুলো থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের মদত দিয়েছে। ২০১৪ সালে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার আওয়াজ তুলে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসে। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দম্ভের সাথে পঞ্চাশ বছর যাবৎ ভারতে বিজেপির শাসন চলার কথা বলছেন এবং বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা বলছেন যে, বিজেপিই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল। বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলিকে একের পর এক দুর্বল করে ফেলে দেওয়ার খেলা চলছে, বিরোধী দলগুলির অফিস পুলিশ দিয়ে ঘিরে তল্লাশি অভিযান চালানো হচ্ছে এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের মাধ্যমে বিরোধী নেতৃত্বকে অবিরাম হেনস্থা করা চলছে।
স্বাধীন ভারতে যখন সংবিধান ও জাতীয় পতাকা গৃহীত হয় তখন আরএসএস স্পষ্টতই এই দুটি বিষয়কে খারিজ করে দেয় এবং মনুস্মৃতিকে দেশের গঠনবিধি ও গেরুয়া পতাকাকে ভারতের জাতীয় পতাকা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে প্ররোচনা দিয়েছিল। স্বাধীন ও আধুনিক ভারতবর্ষ গঠনের সাংবিধানিক দিকনির্দেশের বিরুদ্ধে কেবল মতাদর্শগত বিতর্কেই আটকে থাকেনি আরএসএস, বরং সদ্যোজাত সাধারণতন্ত্রকে দুর্বল ও পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। গান্ধী হত্যা ছিল এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অপরিহার্য অংশ। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারী ঘোষিতভাবে সংবিধান কার্যকর করার এক মাস আগেই ১৯৪৯-এর ২২ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে অযোধ্যায় আরেকটা ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা ঘটে, যখন বাবরি মসজিদে গোপনে রামের একটি বিগ্রহ স্থাপন হয় অযোধ্যা সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরু দত্ত সিং ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে কে নায়ারের সহযোগিতায়, যারা পরবর্তীতে ভারতীয় জনসংঘের পতাকাতলে এসে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন, যে সংঘ হল আজকের বিজেপির সাংগঠনিক পূর্বসূরী।
ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের কথা স্মরণযোগ্য এই কারণে যে, গান্ধীর হত্যার প্রেক্ষাপটে তিনি আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ভারত সরকারের জারি করা বিবৃতিতে সাফ জানানো হয় যে, দেশকে বিপদে ফেলা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো শক্তিগুলোকে সমূলে উৎখাতের লক্ষ্যেই ঐ নিষিদ্ধকরণ জরুরি ছিল। শ্যামাপ্রসাদ ও গোলওয়ালকরকে লেখা চিঠিতে প্যাটেল আরএসএসের ছড়ানো সাম্প্রদায়িক বিষের কথা উল্লেখ করেন যার বিধ্বংসী পরিণতিতে গান্ধী সহ বহু মানুষের প্রাণহানি হয়। দেশের সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে আরএসএস মেনে নেওয়ার কথা লিখিতভাবে জানানোর পরে ঘটনাচক্রে ১৯৪৯-এর ১১ জুলাই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয় যে, আরএসএস তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবরকম হিংসা ও গুপ্ত অভিসন্ধি পরিত্যাগ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরে যথারীতি আরএসএস তার আগের পথেই ফিরে যায় যার মূল্য চোকাতে বহু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেশকে চলতে হয়।
আজ ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির মুহূর্তকে মোদী সরকার ইতিহাস বিকৃত করার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিখ্যাত চরিত্রগুলোকে আত্মসাৎ করার এক বড় মওকা হিসাবে কাজে লাগাতে চাইছে। জাতীয় পতাকাকে একটি ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করতে পতাকা সংক্রান্ত আইনকানুন পরিবর্তন করেছে, ফলস্বরূপ জাতীয় পতাকা এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক গরিমা হারাতে চলেছে, যে ইতিহাস ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা ব্রিটেনের কাপড় কলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার ফলে শেষ হতে বসা ভারতের হাতে চালানো সমৃদ্ধ তাঁতশিল্পের পুনরুদ্ধার ও দেশীয় শিল্পের স্বনির্ভরতার লড়াইয়ের চিহ্ন। মোদী সরকার আজাদী শব্দটির প্রকৃত অন্তর্নিহিত অর্থকেও নস্যাৎ করছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদী শব্দটির অর্থ শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এটার অর্থ ছিল সমস্ত রকম সামাজিক বাধা ও শোষণ থেকে মুক্তি। “আমরা ভারতের জনগণ” – বিষয়টি আসলে ব্রিটিশ ও অন্যান্য রাজত্বের অধীনে থাকা প্রজা থেকে স্বাধীন দেশের সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন নাগরিক হয়ে ওঠার ব্যঞ্জনা। আজ দেশবাসীর সমস্ত স্বাধীনতা যেন শাসকের কাছে বন্ধক রাখা আছে। সত্য বলার জন্য, ন্যায়বিচার চাওয়ার জন্য, অধিকার দাবি করার জন্য নাগরিকদের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। দেশভাগের বিভীষিকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরেও ভারত তার নির্দিষ্ট সামাজিক গঠনের বৈচিত্র্য ও মিশ্র সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে এগিয়ে চলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজ সেই সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার সাংবিধানিক লক্ষ্য ও প্রতিজ্ঞার উল্টোপথে গিয়ে আরএসএসের শতাব্দীপ্রাচীন লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের বাস্তবিক কাজকর্ম জোরকদমে চলছে।
‘আমরা ভারতের জনগণ’ এই দীর্ঘস্থায়ী প্রচারাভিযানের অংশ হিসাবে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি পালন করছি, তাই ৯-১৫ আগস্ট সপ্তাহব্যাপী বিশেষ প্রচার সংগঠিত করে আসুন আমরা পুনরায় মহান শহীদদের স্বপ্নের দেশ গড়ার শপথ নিই। *আমরা ভারতের জনগণ, আমাদের লক্ষ্য একটাই – স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা করা!*
-- কেন্দ্রীয় কমিটি
সিপিআই(এমএল)লিবারেশন
কেন্দ্রে আসীন মোদী সরকার ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে আজাদী কি অমৃত মহোৎসবের নামে দেশজোড়া এক উগ্র জাতিয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি করতে উদ্যত। অসংখ্য শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র, যুব, মহিলাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের সূত্রে অর্জিত দেশের স্বাধীনতার অন্যতম প্রতীক তেরঙ্গা ঝান্ডাকে বিজেপি সরকার আত্মসাৎ করে ভারতীয় সংবিধান সম্মত সমস্ত মৌলিক অধিকারগুলিকে ধারাবাহিকভাবে নস্যাৎ করে চলেছে। পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করা আরএসএস ‘ভারত মাতা’র নামে জয়ধ্বনি দিয়ে গেরুয়া পতাকাকে তাদের স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি-আরএসএস।
দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধানের উপর এই সার্বিক হামলার মোকাবিলায় সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সমস্ত স্তরের কর্মীবাহিনী সজাগ, সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ৯ আগস্টের আহ্বান ও ১৫ আগস্টের অঙ্গীকারপত্র প্রকাশ্যে পাঠ করে প্রতিরোধী কর্মসূচিকে রাস্তায় সংগঠিত করবে।
ঘরে ঘরে জাতীয় পতাকা তোলার ফরমান জারি করে মোদী সরকার দেশের গরিব মানুষের উপর আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের হেনস্থা করা এমনকি শারীরিক হামলা নামিয়ে আনার চক্রান্ত করছে। আমরা বিনামূল্যে পতাকা সরবরাহের দাবি সম্বলিত চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছি, পাশাপাশি মোদী সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারের পাল্টা প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আমাদের কর্মসূচিগুলিতে জাতীয় পতাকা থাকবে, লাল পতাকা থাকবে। প্রতিটি জেলায় ও ব্লকে কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
* ভগত সিং, ক্ষুুদিরাম, মাতঙ্গিনী হাজরার স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে চলো।
* সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলো।
* দেশের সাংবিধানিক ভিত্তির উপর ফ্যাসিষ্ট হামলার বিরুদ্ধে এক হও।
* আমাদের দেশের মিশ্র সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির সপক্ষে এক হও।
* নাগরিকদের ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় এক হও।
* স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে আজও কোটি কোটি মানুষ অনাহার অর্ধাহারে কেন জবাব দাও।
* কৃষি ও কৃষকের অধিকার খর্ব করে অন্নদাতাদের কর্পোরেটের গোলামে পরিনত করা চলবে না।
* শ্রম আইনের অধিকার কেড়ে নিয়ে শ্রমিককে ক্রীতদাসে পরিণত করা চলবে না।
* নারীর নির্ভয় স্বাধীনতার দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ এক হও।
* শিক্ষা ও কাজের অধিকারের দাবিতে এক হও।