দেশের পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে নতুন বিতর্ক হল। এইবার জাতীয় পতাকা নিয়ে। ঘরে ঘরে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার নিদান দেওয়া হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত মেসেজও অনেকের মোবাইলে এসেছিল। প্রতিটি মানুষ যাতে দেশের পতাকাকে সম্মান করেন, দেশের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন, তার জন্যেই নাকি এই ব্যবস্থা। যে সরকার কালো টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য নোটবন্দী করেছিল, যে সরকার কোভিড পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার নাম করে, চার ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন ঘোষণা করেছিল, সেই সরকারের যে কোনও পদক্ষেপের পিছনেই কোনও না কোনও উদ্দেশ্য থাকে। এমনিতে হয়তো মনে হবে, এইভাবেই ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ পালন করা প্রয়োজন, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলা উচিত, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদযাপন করা দরকার। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টা বোঝা যাবে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে আবারও প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিশেষ এক বন্ধু — এক বিশিষ্ট শিল্পপতির ব্যবসা যাতে আরও বৃদ্ধি পায়, তার ব্যবস্থাই করেছিলেন। নিন্দুকেরা তাই প্রশ্ন করেছিলেন, এই জাতীয় পতাকার বিতরণ কি শুধুমাত্র দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্যে, না কী এরমধ্যে আরও কোনও উদ্দেশ্য আছে? অনেকে দুর্নীতির কথাও বলছেন।
ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরি করা, প্রদর্শন করার একটা নিয়ম প্রচলিত আছে, যা ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ২২ জুলাই গৃহীত হয়েছিল। তাতে তিনটি ভাগ আছে — যার একটি অংশে বলা আছে, ভারতের জাতীয় পতাকা একমাত্র খাদিবস্ত্র থেকেই বানাতে হবে, পতাকার মাপ এবং অশোক চক্রেরও মাপ বলা আছে, কীভাবে কখন এই প্রদর্শন করতে হবে, সেই বিষয়েও স্পষ্ট করে বলা আছে। খাদিবস্ত্রেও একমাত্র সূতি, সিল্ক এবং উল ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করা যাবে না, যদিও কখনো কখনো কাগজের পতাকা ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু তাও যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না, ফেলা হলে, তা জাতীয় পতাকার অবমাননা বলে ধরা হবে। কেন খাদিবস্ত্রই একমাত্র ব্যবহার করতে হবে, তাও বলা আছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যেহেতু গান্ধীজীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এবং যেহেতু গান্ধী নিজে খাদিবস্ত্র পরিধান করতেন, খাদির সূতো কাটা, সেই সূতোয় খাদি পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করা ও পরার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের দেশচেতনা গড়ে তোলা হোত, তাই ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে, নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্বে প্রথম সরকারের আমল থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জাতীয় পতাকার জন্য খাদির কাপড় ব্যবহার করতে হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে আরও সুবিধা হবে, বহু মানুষ কাজ পাবেন, স্বনির্ভর হবেন। যাঁরা স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, বিদেশী দ্রব্য বয়কট আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাই এই খাদির জন্য আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন।
আজ যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন, তাঁদের যেহেতু এই স্বদেশী আন্দোলনের কোনওদিনই কোনও যোগাযোগ ছিল না, তাই তাঁদের এই খাদির আন্দোলনের প্রতি কোনও সহানুভুতি নেই। তাই তাঁরা এবার জাতীয় পতাকা তৈরি করার আইনটিকে সংশোধন করে, খাদির কাপড়ের পাশাপাশি পলিয়েস্টার কাপড় ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। এরফলে পরিবেশের কী ক্ষতি হবে, সেটাও যেমন তাঁরা ভাবেননি, তেমনই একটি ব্যবহার করা পতাকা, নোংরা কিন্তু ছেঁড়া নয়, তার কী গতি হবে, সেটাও ভাবেননি, শুধু ভাবা হয়েছে, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বন্ধুর পলিয়েস্টার কাপড়ের ব্যবসা আছে, তাই এই সিদ্ধান্তের ফলে তাঁর ব্যবসা আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে। অনেকেই এই দেশপ্রেমকে ‘পলিয়েস্টার প্রেম’ বলেছেন।
কার ফ্রিজে গোমাংস রাখা আছে, বা কোনও মানুষকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলানোর জন্য, নানান জায়গায় সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর অত্যাচারের খবর যখন আসছিল, তখন সারা দেশে একদিনে একই সময়ে একটা আন্দোলন হয়েছিল, মূলত নাগরিকদের উদ্যোগে, যাঁর নাম ছিল ‘নট ইন মাই নেম’, অর্থাৎ ‘আমার নাম করে নয়’, সংখ্যাগুরু মানুষের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘু মানুষদের পিটিয়ে মারা যাবে না। দেশের মূল মূল শহরের প্রাণকেন্দ্রে বহু মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন সেদিন, তাঁদের অনেকের হাতেই ছিল জাতীয় পতাকা, বেশিরভাগের গলায় ছিল একটা প্ল্যাকার্ড, লেখা — ‘নট ইন মাই নেম’। সেই সমাবেশে বহু মানুষের সঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশ কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাঁরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁদের অনেকেরই পরনে ছিল খাদির পোশাক, সঙ্গে ছিল খাদির ব্যাগ। আসলে খাদি একটা লড়াই, একটা ঐতিহ্য, যা দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করতে চান না, আর করবেনই বা কী করে, তিনি যে দলের প্রতিনিধি, তাঁদের সঙ্গে তো ব্রিটিশ বিরোধিতার কোনও সংযোগ নেই, ফলে তাঁরও কোনও দায় নেই। তিনি সবরমতী আশ্রমে গান্ধীর চড়কার সামনে বসে ছবি তুলে তাঁর ‘দেশপ্রেম’ এবং গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারেন, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কে যে সাভারকার আছে, যিনি ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন, তাঁর বা তাঁর দলের মানুষদের মুখে যতই ‘রাম’ থাকুক, তার অন্তরে যে আছে নাথুরাম, তা তাঁরা ভালোই জানেন। তাই গান্ধীর জন্মদিন বা শহীদ দিবসে, যখন সারা দেশে গান্ধী স্মরণ হয়, তখন তার বিপরীতে কোনো কোনো জায়গায় নাথুরাম গডসেকেও পুজো করা হয়।
নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যখন শাহীনবাগ থেকে শুরু করে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে সংখ্যালঘু মহিলাদের নেতৃত্বে অবস্থান শুরু হয় তখন তাঁরা বলেছিলেন, এটা দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ, সেদিনও তাঁদের হাতে ছিল দেশের জাতীয় পতাকা। দেশকে সেদিন যাঁরা ভালবেসে বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আজকে যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছেন — এঁদের মধ্যে মিলের জায়গাটা হল — জাতীয় পতাকা। বহু সাংবাদিক শাহীনবাগ বা দেশের নানান প্রান্তে গিয়ে যখন প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আপনারা জাতীয় পতাকা নিয়ে আন্দোলন করছেন? তখন সবাই একবাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, এই লড়াই আসলে মীরজাফরদের হাত থেকে, অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে জাতীয় পতাকার আসল উত্তরাধিকারের লড়াই। যে আরএসএস-বিজেপি’র ইতিহাসে জাতীয় পতাকার কোনও অস্তিত্ব নেই, যাঁরা কোনোদিন স্বাধীনতার পরবর্তীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেনি, তাঁরাই যদি অন্যদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেয়, তবে তাঁদের থেকে সেই পতাকা ছিনিয়ে নেওয়ার নামই আসলে দেশপ্রেম। প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামেও খাদি ছিল, আজ দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইতেও খাদি আছে।
এমনিতেই ঝাঁ চকচকে শপিং মলের চাকচিক্যে, খাদি কাপড়ের চাহিদা কমেছে, তারমধ্যে দু’বছর লকডাউনে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। অনেকেই ভেবেছিলেন যে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে হয়তো প্রচুর সরকারি বরাত পেয়ে খাদি আবার একটু মাথা তুলে দাঁড়াবে। কিন্তু মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে বিভিন্ন খাদি কাপড় তৈরির কারখানায় শ্রমিকেরা মুষড়ে পড়েছেন। স্বনির্ভরতাই একমাত্র কারণ, যার জন্য খাদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করা হয়েছিল, অথচ মেশিনে তৈরি পলিয়েস্টারের মধ্যে কোথাও কোনও আত্মনির্ভরতা নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী সব জেনে বুঝে আবারও দেশবাসীকে বোকা বানাতে চাইলেন, পাশাপাশি অনেকে বলছেন, ঘরে ঘরে কাজ দেওয়াই যখন সরকারের দায়িত্ব ছিল, তখন ঘরে ঘরে তিরঙ্গা পতাকা দিয়ে সেই দাবি ঘুরিয়ে দেওয়ার এটা একটা চক্রান্ত নয়তো? অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন নরেন্দ্র মোদী চান না, মানুষ সমষ্টিতে বাঁচুক, তাই প্রতিটি মানুষকে একলা করে, ঘরে ঘরে তেরঙ্গা পতাকা তুলিয়ে তাঁর ছবি সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করানোর মধ্যে দিয়ে সেই কাজটাও হাসিল করতে চেয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিভিন্ন পাড়ায়, বিভিন্ন বিরোধী দলের রাজনৈতিক অফিসে জাতীয় পতাকা তোলার মধ্যে দিয়ে তাঁর সেই চক্রান্ত আটকানো গেছে।
- সুমন সেনগুপ্ত