সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিক মোদী সরকারের তল্পিবাহক না হলে সরকারের রোষে পড়াটা অবধারিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর থেকে উত্তরপ্রদেশ থেকে জাতীয় রাজধানী দিল্লী, হেন রাজ্য নেই যেখানে সরকারের অন্যায় ও অপকীর্তি নিয়ে লেখালেখি করা সাংবাদিকরা সরকারের রক্তচক্ষুকে এড়াতে পেরেছেন। এরকমই এক সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান যিনি সরকারের সাম্প্রদায়িক বৈরিতাকে তুলে ধরে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোয় এক বছর দশ মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলে রয়েছেন। তাঁর ওপর অভিযোগের বোঝা ক্রমেই আরও বেশি করে চেপে বসছে এবং আদালতের বিচারপতিরা তাঁর জামিন খারিজ করে চলেছেন।
ঠাকুর সম্প্রদায়ের যুবকদের হাতে হাথরসে দলিত তরুণীর ধর্ষণ ও মৃত্যুতে উদ্ভুত পরিস্থিতির খবর করতে হাথরস যাচ্ছিলেন কাপ্পান। কিন্তু ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর যোগী সরকারের পুলিশ তাঁকে মথুরায় গ্ৰেপ্তার করে এবং গাড়িতে থাকা তাঁর আরও তিন সঙ্গীকে — যাদের মধ্যে কেউ-কেউ বুঝিবা মুসলিম সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন — জেলে পোরে। কাপ্পান কেরলের সাংবাদিক এবং কেরলের ইউনিয়ন অব ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস সংগঠনের দিল্লী শাখার সম্পাদক। তিনি যে তাঁর প্রতিবেদনগুলোতে সরকারের সংখ্যালঘু বিদ্বেষী মনোভাবকে ফাঁস করে দিতেন এবং মুসলিম বিরোধী অনাচারগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেন সে খবর সরকার এবং বিজেপির কাছে অজানা ছিল না। আর তাই হাথরস যাওয়ার পথে তাঁকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হল যে, তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর জন্যই হাথরস যাচ্ছিলেন। পরে আরও অভিযোগ এনে বলা হয়, তিনি সন্ত্রাসবাদী কাজের জন্য অর্থ জোগাড় করছিলেন, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতা উস্কিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। ক্রমে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ইউএপিএ’র ধারা তাঁর ওপর চেপেছে এবং বিচারপতিরা তাঁর জামিন মঞ্জুরি থেকে হাত গুটিয়ে রাখলেন।
মথুরার আদালত ২০২১ সালের জুলাই মাসে কাপ্পানের জামিনের আবেদন খারিজ করেছিল। এবার আবার এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চের বিচারপতি কিসান পাহাল গত ৪ আগস্ট তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করলেন। আর তা করতে গিয়ে চার্জশিটে উল্লিখিত অভিযোগগুলোকে অমোঘ সত্য বলে জ্ঞান করলেন, অভিযোগগুলো কতটা যথার্থ তার বিচারে গেলেনই না। বিচারপতি তাঁর রায়ে বললেন, “আবেদনকারীর নিজের সমর্থনে করা একজন সাংবাদিক হওয়া এবং পেশার কাজের জন্যই হাথরসের অকুস্থলে যাওয়ার দাবি খারিজ হয়ে যাচ্ছে চার্জশিটে বিধৃত অভিযোগের প্রমাণ থেকে এবং তাঁর সঙ্গে গ্ৰেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পরিচিতি থেকে।” এইভাবে কাপ্পানের মুসলিম পরিচিতি এবং পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার (পিএফআই) অনুষঙ্গকে প্রশাসন যেমন কাপ্পানের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগের মূল ভিত্তি করছে, আদালতও কাপ্পানের জামিনের আবেদন খারিজ করতে গিয়ে ঐ বিষয়টাকেই তাদের অবস্থানের কেন্দ্রীয় যুক্তি হিসাবে দাঁড় করাচ্ছে। কাপ্পানের সঙ্গে গাড়িতে থাকা সহযাত্রীরা পিএফআই’এর সদস্য হতে পারেন, কিন্তু সেটা তো সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের যোগের প্রমাণ হতে পারে না। পিএফআই রাষ্ট্রের মুসলিম বৈরিতা নিয়ে লড়াই করে ঠিকই, কিন্তু সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে তাদের যোগের কোনো তথ্য ও প্রমাণ নেই এবং সেটা কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, তাছাড়া কাপ্পান নিজেও পিএফআই’এর সদস্য নন। এইভাবে একটা ভিত্তিহীন বিষয়কেই প্রশাসন কাপ্পানের বিরুদ্ধে তাদের অস্ত্র করেছে এবং আদালতও তারসঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করছে। মথুরা আদালতে কাপ্পানের হয়ে সওয়াল করা আইনজীবী মধুবন দত্ত চৌধুরী বলেছেন, “তিনি পিএফআই’এর সদস্য বলে প্রমাণ না থাকলেও, যে সংগঠনটা নিষিদ্ধ নয় — গোটা মামলাটাকেই দাঁড় করানো হয়েছে তাঁর পিএফআই সদস্য হওয়ার তথাকথিত পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে।”
ভারত ‘রেজিলিয়েন্ট ডেমোক্র্যাসিস স্টেটমেন্ট ২০২২’এ স্বাক্ষর করে গণতন্ত্রের প্রতি পৃষ্ঠপোষণের কথা জাহির করতে চেয়েছে বিশ্বের দরবারে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সংবাদ জগতের উপর নেমেছে অভূতপূর্ব আক্রমণ — প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে ফেলাটা অপরাধ হয়ে উঠছে, সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাটা প্রশাসনের শীর্ষস্তরে অনধিকার চর্চা বলে গণ্য হচ্ছে, সরকারের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করালে স্পর্ধা বলে বিবেচিত হচ্ছে, সরকার হুইসিল ব্লোয়ারদের তার বৈরি বলে জ্ঞান করছে। গোডি মিডিয়ার পাশে দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমকে সরকার দুশমন বলেই সাব্যস্ত করছে। সংবাদ জগতের বিশ্বসূচকে ভারতের স্থান ক্রমেই আরও নিম্নগামী হয়ে ১৮০টা দেশের মধ্যে ১৫০তম যে হয়েছে, তা একেবারে অমূলক নয়। কেরল ইউনিয়ন অব ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস সংগঠনে কাপ্পানের সহকর্মীরা বলেছেন, তাঁরা কাপ্পানের জামিনের জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাবেন। কিন্তু মহম্মদ জুবেরের জামিন পাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি ঘটবে? বিচার বিভাগের বর্তমান হালচাল তাতে খুব একটা ভরসা জোগায় না।