“ন্রেগা”য় (জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনে) মোদ্দা কথায় “একশো দিনের কাজের প্রকল্পে” নারী কেন্দ্রীক শ্রমদিবস সৃষ্টিতে আরও জোর দিতে সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েতরাজ মন্ত্রকের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। তার জন্য কমিটির মতে, স্বনিযুক্তি প্রকল্পে, খামারে বা পশুপালনে নিয়োজিত নারী শ্রমকে ন্রেগার আওতায় গণ্য করা যেতে পারে। কমিটি আরও কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে। যেমন, মূল্যবৃদ্ধির সূচক বৃদ্ধি অনুপাতে ন্রেগাশ্রমের মজুরিবৃদ্ধি দীর্ঘকাল যাবত অবহেলিত থাকছে, তার এবার নিস্পত্তি করা দরকার। ন্রেগায় মজুরি স্থির করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যভিত্তিক ও লিঙ্গগত বৈষম্য রয়েছে, তার সমাধান নিশ্চিত করা জরুরি। সেটা করতে এক অভিন্ন মজুরি কাঠামো স্থির করা উচিত, যা মানতে কেন্দ্র-রাজ্য সব তরফকেই বাধ্য থাকতে হবে। নারী মজুরদের কাজের এলাকায় তাদের পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের রাখারও সুপারিশ করেছে কমিটি, বলেছে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে স্বনিযুক্তি সদস্যাদের নিয়োগ করা যায়, যাদের কিনা ন্রেগায় শ্রম দেওয়া হিসাবেই এই কাজের নির্ধারিত মজুরি দিতে হবে।
ন্রেগায় কাজ বণ্টন সংক্রান্ত ঘোষিত বিশেষ একটা পলিসি হল, মোট শ্রমদিবসের এক-তৃতীয়াংশ কাজ দিতে হবে নারী-মজুরদের। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নারীশ্রমের অংশগ্রহণ ছিল গড়ে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। নারীশ্রমের এই অংশ নেওয়ার ভাগ ২০১৮-১৯-এ মোট ২৬৭.৯৬ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ছিল ৫৪.৫৯ শতাংশ, ২৯১৯-২০-তে ২৬৫.৩৫ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ছিল ৫৪.৭৮শতাংশ, ২০২০-২১-এ ৩৮৯.০৯ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ছিল ৫৩.১৯ শতাংশ, ২০২১-২২-এ ৩৬৩.০৪ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ৫৪.৬৭ শতাংশ। আর, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে এখনাবধি সৃষ্ট ১৪১.৩৫ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে নারীশ্রমের অংশগ্রহণের ভাগ থেকেছে ৫৬.০৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে গত তিন বছরে এই ভাগটা ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে না গেলেও, কাছাকাছি ছিল। ২০২০-২১-এ ছিল ৪৫.০২, ২০২১- ২২-এ ৪৬.৬৯, ২০২২-২৩-এ ৪৮.১২ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানে জল মেশানো না থাকলে তো রীতিমতো ধর্তব্য। বুঝিয়ে দিচ্ছে সুযোগ দিলে ন্রেগায় শ্রম দেওয়ায় নারীশ্রম পুরুষশ্রমকে ছাপিয়ে যেতে পারে। তার আরও সম্প্রসারণের বা বৃদ্ধির সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা যাচ্ছে, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশ করা রিপোর্টে সেই ছাপ রয়েছে।
কিন্তু পাশাপাশি প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে এর সমস্ত সম্ভাবনা সংকোচনের শঙ্কাও। কারণ, খোদ কেন্দ্রের মোদী সরকার এই কর্মসংস্থান নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে। প্রথমত, এর ২০২২-২৩ বাৎসরিক কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধরা হয়েছে ৭৩,০০০ কোটি টাকা। বিগত ২০২১-২২ বাৎসরিকে সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ছিল ৯৮,০০০ কোটি টাকা। এবছরের জন্য যে বরাদ্দ ধার্য হয়েছে তার থেকে আবার ১৮,৩৫০ কোটি টাকা মেটাতে হবে গত বছরের বকেয়া মজুরি বাবদ। তার মানে, কার্যত বরাদ্দ তহবিল কমে ঠেকেছে ৫৪,৬৫০ কোটি টাকায়। ফলে গতবারের তুলনায় কাজ করানো হবে ২৫শতাংশ কম ব্যয়ে। ভাঁড়ারের সংকোচন প্রক্রিয়া এমনই যে, ফি-বছর মাত্র সাত মাসের মধ্য বরাদ্দের ৯০শতাংশ অর্থ ফুরিয়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির ক্রমাগত সূচক বৃদ্ধি মাথায় রেখে মাথাপিছু যদি ন্যূনতম মজুরি ধরতে হয় একটু মানানসই, তাহলে জব কার্ডধারীর মোট যা সংখ্যা তাতে তাদের সবাইকে কাজ দিতে হলে মোট বরাদ্দ টাকায় মাথাপিছু কাজের সুযোগ দেওয়া সম্ভব বছরে মাত্র ১৫- ১৬ দিন। এর বেশি শ্রমদিবস তৈরি করতে হলে মাস্টার রোলে জল মেশাতে হবে, কাজ না করিয়েও ‘করানো হয়েছে’ দেখাতে হবে, মজুরিমান নিকৃষ্টতর স্তরে রাখতে হবে, মাসের পর মাস, পরের বছর পর্যন্ত মজুরি বকেয়া রাখতে হবে। কার্যত এই রীতিনীতিই চলে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোপ মারে মোট বরাদ্দে, আর সেটা আরও পরের পর কোপ খায় রাজ্য স্তর থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত সব প্রশাসনিক পরিচালনায়। রাজ্যে রাজ্যে রয়েছে মজুরি বৈষম্য – দক্ষ ও অদক্ষ শ্রম ও লিঙ্গগত শ্রম ভেদে। ৩৪টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ২১টি রাজ্যে মজুরি বেড়েছে ৫শতাংশেরও কম, ১০টি রাজ্যে মজুরি বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশের ওপর। কয়েকটি রাজ্যে কোনোভাবেই মজুরি বাড়েনি। সর্বোচ্চ মজুরি বেড়েছে ৭.১৪ শতাংশ এবং গোয়ায়, গত বছরের ২৯৪ টাকা থেকে এবছর হয়েছে ৩১৫ টাকা; মজুরি সবচেয়ে কম বেড়েছে ১.৭৭ শতাংশ এবং মেঘালয়ে, ২২৬ টাকা থেকে হয়েছে ২৩০ টাকা। সবচেয়ে বেশি মজুরি হার রয়েছে ৫টি রাজ্যে – হরিয়ানা (৩৩১ টাকা), গোয়া (৩১৫ টাকা), কেরালা (৩১১ টাকা), কর্ণাটক (৩০৯ টাকা), আন্দামান ও নিকোবর (৩০৮ টাকা)। সবচেয়ে কম মজুরি হার রয়েছে ৬টি রাজ্যে – ত্রিপুরা (২১২ টাকা), বিহার ও ঝাড়খন্ড (২১০ টাকা), ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ (২০৪ টাকা)।
কেন্দ্রের বরাদ্দ বড় মাত্রাতেই ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। যে প্রকল্পের ঘোষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, চাহিদা ভিত্তিক কর্মসংস্থানের, তার পরিণতি করে দেওয়া হচ্ছে বরাদ্দ ভিত্তিক কোটার শ্রমদিবস। তাই রাজ্য রাজ্যে মজুরি বৈষম্য প্রকটভাবেই থাকছে, আর, কোনও রাজ্যেই ন্যূনতম সম্মানজনক মজুরিমান নেই। প্রকল্প গোটানোর নতুন নতুন ফন্দি আঁটতে মোদী সরকার অতি সক্রিয়। তার জন্য বাহানা করছে বিশেষ করে বিরোধীদল শাসিত রাজ্যে চলা ‘ন্রেগা দুর্নীতি’কে। ওইসব রাজ্যে নামিয়েছে দুর্নীতি ধরার অভিযান। ইডি-সিবিআই হানার মতো কেন্দ্রের আলাদা ‘দুর্নীতি-দমন দল’ দেশের ১২টি রাজ্যের ১১৫টি জেলায় হানাদারি চালাচ্ছে। দুর্নীতি যে নেই তা নয়, কথা হল, দুর্নীতির উন্মোচন হোক প্রকল্পের স্বাস্থ্য ফেরানোর সদিচ্ছা থেকে। কিন্তু মোদী সরকার সে বান্দা নয়। কেন্দ্রের মতিগতি বুঝিয়ে দিচ্ছে ন্রেগাকে শুকিয়ে মারাই নিশানা। এর বিরুদ্ধে তাই চাই গরিব জনতার চ্যালেঞ্জ, চাই সংগঠিত আন্দোলন।