পশ্চিমবাংলায় বামপন্থার উদ্যোগ ও সক্রিয়তাকে গ্রামমুখী জোরদার করতে হবে। এটা ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেমন, তেমনি বামপন্থার সংগ্রামী মর্যাদার পুনরুত্থানের জন্যও। সংগ্রামে অবিরত থাকার আদর্শগত দৌলতেই মিলতে পারে সংগ্রামী মর্যাদা। এটা কেবল কোনও এক বিশেষ সংগঠনের জন্য নয়, সব ধরনের বাম ধারার সংগঠনের জন্যই প্রযোজ্য। দেড়-দুদশক আগে ‘কৃষি ভিত্তি, শিল্প ভবিষ্যৎ’ বলে কার্যত কৃষির গুরুত্বকে অতীত করে দেওয়া হয়েছিল, কৃষিজমি কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার ‘সরকারি বামপন্থা’-র দাপট দেখাতে যাওয়া হয়েছিল। ঐ মারাত্মক ভুল পথের ওকালতি করা হয়েছিল এই বলে যে, কিছু ‘ডোল’ দেওয়া ছাড়া কৃষিকে কেন্দ্র করে কৃষক জীবনের স্বার্থে আর নাকি কিছুই করার নেই! আর তার প্রতিক্রিয়ায় কৃষক বিদ্রোহের ঝড়ে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে যায়। শুধু তাই নয়, তারপর থেকে গ্রামবাংলায় বড় পরিধিতেই বামপন্থার মাটিতে ধ্বস নামে, মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হয়। সেই জমির দখল প্রধানত পায় টিএমসি। কিছু পর থেকে কিছু কিছু পেতে থাকে বিজেপিও ।
পক্ষান্তরে, লাল পুনরুত্থানের এক মরীয়া চেষ্টা চালানো হয়েছিল সশস্ত্র এ্যাকশনকে ভিত্তি করে। অধিবাসী জনতার জীবন-জীবিকার অধিকার ও জ্বলন্ত বিষয়গুলো নিয়ে লড়াই করার গুরুত্বকে মনে করা হয়েছিল তুচ্ছ। সেই দুঃসাহসিকতাবাদও বিরাট দমনের সামনে জনগণ থেকে ব্যাপক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে ধাক্কা খেয়েছে। সেইসব জায়গাও চলে গেছে কোথাও টিএমসি, কোথাও বিজেপির প্রভাবে।
গ্রামবাংলায় লাল ঝান্ডার যা কিছু ভাবমূর্তি রয়েছে সেটা কৃষি ও কৃষকের ইস্যুগুলি নিয়ে সংগ্রামী বামধারার। কিন্তু এই ধারার সামাজিক ভিত্তি এখনও খুবই সীমিত, দুর্বল, থাকছে অঞ্চল বা এলাকা ভিত্তিক। এর বিষয়ীগত প্রয়াস চালানোর প্রশ্নে বড় মাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন বা পুনর্বিন্যাস সংগঠিত করা দরকার। চিন্তাশীল প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোগ ও সমবেত প্রত্যাঘাত সংগঠিত করার সমন্বয় গড়ে তোলা দরকার। স্বাধীন একক উদ্যম ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে যুক্ত উদ্যোগ – সবই চলতে পারে, চলুক আর পাঁচটা ফ্রন্টে। যেখানেই অন্যায়, অবিচার, আক্রমণ – সেখানেই প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগঠিত হোক। কর্মপ্রার্থী শিক্ষকদের সমর্থনে জনপথে কনভেনশন, স্বাধীনতা দিবসে মানববন্ধন, যুদ্ধবিরোধী দিবসে শান্তিমিছিল – সবই ঐকান্তিকভাবে হোক। কিন্তু প্রধান রণভূমি হল গ্রামবাংলা, সেখানে ঝাঁপাতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে। উত্তর ভারতের ২০২০-২১-এর বছরব্যাপী কৃষক আন্দোলনের খবর এখানকার গ্রামাঞ্চলে পৌঁছেছে। এখানে অধিকাংশ বাম দলের কৃষক সংগঠন আছে। উত্তরের আদলে এখানেও কৃষক সংগঠনগুলির সংগ্রামের ভিত্তিতে একতার মঞ্চ গঠন হয়েছে। প্রতিটি কৃষক সংগঠন স্বাধীন ভূমিকা নিতে পারে। কেন্দ্র-রাজ্যের উভয় শাসকের কৃষি ও অন্যান্য সংস্কারনীতি ও প্রকল্পে হস্তক্ষেপ করা, সেসবের স্বরূপ উন্মোচন করা ও তা থেকে সূত্রায়িত দাবি নিয়ে হকের আন্দোলন গড়ে তোলার ইস্যুর অভাব নেই। কেন্দ্রের মোদী সরকারের ‘কৃষক সম্মাননা’ আর রাজ্যের মমতা সরকারের ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের ঢাক পিটিয়ে বিজেপি এবং টিএমসি গ্রামীণ রাজনীতিতে খেয়োখেয়ি চালাচ্ছে। ফলে বামপন্থীদের সামনে পরিস্থিতি প্রতিকূল, সন্ত্রাসময়, পরিসর সম্প্রসারণ করা কঠিন। তবু এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিস্থিতিতে যুঝেই যা করার করতে নাছোড় হতে হবে। সেইমতো বামপন্থী চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লেগে পড়তে হবে। এরকম কমজোরী অবস্থা থেকে গতিশীল পরিকল্পিত গণসম্পর্কের অনুশীলন, সংগঠন ও আন্দোলনের ধারায় গ্রামবাংলায় বামপন্থার আত্মঘোষণা করতে হবে।