৩ মার্চ রাঁচি শহরে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। দুমকা জেলার রামগড়ে একটি ৬ বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত ৩ জনকে রাঁচির আদালত ফাঁসির আদেশ দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ চার্জশিট দাখিল করার মাত্র পাঁচদিনের মাথায় ধর্ষণে অভিযুক্ত অপরাধীদের চরম শাস্তি ঘোষণায় ও অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ এই শাস্তির সপক্ষে অনেকেই যেমন উচ্ছ্বসিত, আবার বেশ কিছু মানুষ এনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, এতো তাড়াহুড়ো করে যেভাবে রায় দেওয়া হল তাতে কি আইনের সমস্ত কিছু অনুসৃত হয়েছে? প্রাণদণ্ড কি দেশে ধর্ষণের অপরাধকে কমাতে সাহায্য করেছে? নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত অনেক সংগঠকই মনে করছেন, সরকারের ঘাতক মনোবৃত্তি মহিলাদের জন্য আদৌ নিরাপদ নয়। প্রশ্ন উঠেছে, কিছু কিছু কোর্টের তরফ থেকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে নির্মম শাস্তি দেওয়া সত্ত্বেও কি ধর্ষণ কমেছে? ফাঁসি কি ধর্ষণ রোখার প্রতিষেধক?
বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, নারী বা শিশুদের উপর বর্বোরচিত হিংসা, গণধর্ষণ, খুন, তারপর তথ্য প্রমাণ লোপাট করার পাশবিক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে জনমত এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে তৎক্ষণাৎ ধর্ষকদের প্রাণদণ্ড দেওয়ার জোরালো দাবি ব্যাপকতা লাভ করে। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ক্রমেই ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, আদালতগুলোর মধ্যেও এই ঘাতক মানসিকতা গ্রাস করছে। ২০১৮-১৯ সালে মধ্যপ্রদেশে অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে ৩৫ জন ধর্ষককে ফাঁসিতে ঝোলানোর কোর্টের আদেশ এই লক্ষণকেই প্রমাণ করে। এই ঘটনার পর ওই রাজ্যের পাবলিক প্রসিকিউশন’এর ডিআইজি রাজেন্দ্র কুমার বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেন, “অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে এতজনকে চরম শাস্তি দেওয়াটা ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় একটা ইতিহাস তৈরি করেছে”।
অধিকাংশ নারী আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন, ফাঁসি ধর্ষণকে রুখতে পারে না। এনসিআরবি’র তথ্য বলছে, ভারতে এখন প্রতি ঘন্টায় দু’জন করে মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন। দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আদালতগুলো সর্বোচ্চ শাস্তি ঘোষণা করা সত্ত্বেও ধর্ষণকে রোখা গেল না। নারী আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন, রাজ্য সরকারগুলো ঘাতক মনোবৃত্তি নিয়ে চললে ধর্ষণ তো কমবেই না, নারীরাও নিরাপদে থাকতে পারবেন না।
দেশের আদালতগুলোর কাছে এখন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ যৌন হেনস্থার নানা ঘটনা বিচারাধীন। এরমধ্যে যদি মাত্র দুই শতাংশ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে প্রতিবছর সরকার বা রাষ্ট্র কি ২,০০০ জন আসামীকে ফাঁসি দেবে? এই প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ’এর কর্মী রঞ্জনা কুমারী।
দেখা যাচ্ছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ট্রায়াল কোর্টযে ৩০ শতাংশ ফাঁসির আদেশ দেয় তা পরবর্তীতে লঘু করে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়েছে। আরও ৬৫ শতাংশের অভিযোগ অনেকাংশেই লঘু করে দেওয়া হয়েছে। খুব সম্প্রতি গুজরাটে বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তাঁর তিন বছরের কন্যা সহ পরিবারের সদস্যদের খুনে অভিযুক্ত ১১ জন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের গুজরাট সরকার শুধু মুক্তি দিল তাই নয়, সেই ঘৃণ্য অপরাধীর দল জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁদের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি যে কত বড় ধোঁকা তা এই ঘটনাই দেখিয়ে দেয়। তথ্য এটাও দেখায় যে ট্রায়াল কোর্টে যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে (বা সেই আদেশ এখনও বহাল রয়েছে) তাদের অধিকাংশই সমাজের পিছিয়ে পড়া দুর্বল স্তর থেকে আগত, আর তাঁদের আর্থিক অবস্থা এতোই করুণ যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একজন আইনজীবীকেও তাঁরা নিজেদের মামলা লড়তে নিয়োগ করতে পারেন না।
বিচারপতি ভার্মা কমিটির রিপোর্টের উপর কাজ করেছেন আইনীবী শ্বেতাশ্রী মজুমদার। তিনি দেখিয়েছেন প্রতিবেশি দেশ, যেমন বাংলাদেশ-পাকিস্থান-আফগানিস্তানে ধর্ষণের মতো অপরাধে তারা সর্বোচ্চ শাস্তি, প্রাণদণ্ড দিয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই দেশগুলোতে ধর্ষণ কমেনি।
এই মারাত্মক অপরাধকে ঠেকাতে হলে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। একেবারে নিম্নস্তর থেকে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজাগরণের পাশপাশি পুলিশ প্রশাসনকে এ প্রশ্নে সর্বোচ্চ সজাগতা তৎপরতা, এবং নানা সামাজিক সংগঠনকে এর বিরুদ্ধে পথে নামানোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
- স্বপ্না চক্রবর্তী