৭৫ তম স্বাধীনতা বার্ষিকীর দু’দিন আগে ভারত আরেকবার দেখে নিল জাতের নিপীড়ন কী ভয়ঙ্করভাবে ঘটমান বাস্তবতা। ইন্দ্র মেঘওয়াল, রাজস্থানের জলোর জেলার সুরানা গ্রামের ‘ডালি’ সম্প্রদায়ের ৯ বছরের বালক। স্কুলে উঁচু জাতের জন্য সংরক্ষিত কুঁজো থেকে জল খাওয়ায় গত ২০ জুলাই শিক্ষক তাকে নির্মমভাবে পিটিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে মারা গেল সেই আঘাতে। স্কুলটা হল সরস্বতী শিক্ষামন্দির। দেশ জুড়ে আরএসএস যে স্কুল নেটওয়ার্ক চালায় সেই স্কুল। একই দিনে উড়িষ্যার নবরংপুর জেলায় আদিবাসী গ্রামে ভয়ানক হামলা নেমে আসার খবর ভেসে এল। বনের জমি বাঁচানোর নামে বেশ কিছু আদিবাসী পরিবারের মাথা গোঁজার আশ্রয় জ্বালিয়ে দেওয়া হল আর তাঁদের জমির ফসল নষ্ট করে দেওয়া হল। ইউপির সিতাপুর জেলার হরগাঁওয়ের সিপিআই(এমএল) নেতা তথা জেলা পরিষদ সদস্য অর্জুন লালকে স্থানীয় থানা লকাপে চরম অত্যাচারের শিকার হতে হল কারণ তিনি তাঁর জেলা পরিষদ ক্ষেত্রে ঘটা এক দলিত নিপীড়নের ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করতে থানায় গেছিলেন। হরিয়ানা থেকে এল গরিব মানুষ তিরঙ্গা কিনতে না পারায় তাদের রেশন দিতে অস্বীকার করার ভিডিও।
১৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি যখন স্বাধীনতা দিবসের নিয়ম মাফিক বক্তব্য রাখছিলেন, দীর্ঘ ৮০ মিনিটের বক্তব্য, ভারতের নারীশক্তির কথা বড় মুখ করে বলছিলেন, তখন নির্বাচনাসন্ন গুজরাটের বিজেপি সরকার ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকে মুক্ত করে দিল যারা আজীবন কারাদণ্ডের সাজা পেয়েছিল ২০০২ সালের গোধরা পরবর্তী গণহত্যার সময় বিলকিস বানোকে নৃশংসভাবে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও বিলকিসের সদ্যজাত শিশু সন্তানটি সহ পরিবারের সাতজনকে হত্যা করার অপরাধে। ধর্ষণ আর খুনের সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি ও সংবর্ধনা দিচ্ছে, আর মানবাধিকার প্রচারক লেখক ও গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীদের বছরের পর বছর জেলে পচিয়ে মারছে এবং সারা দেশে প্রত্যহ আরও বেশি বেশি করে এই ধরনের মানুষদের দোষারোপ করে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক নাগরিকেরা তাই ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা বার্ষিকীকে কোনও উৎসবে পর্যবসিত করে ফেলতে দেয়নি। বরং স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াকু ঐতিহ্য ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শপথ নিয়েছে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার, যেমন ভারতের কল্পনা ব্যক্ত হয়েছে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায়।
৭৫তম বার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে বিহার এক বড় ধরনের রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস দেখল গত ৯ আগস্ট, ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৮০ তম বার্ষিকীতে। নীতীশ কুমার আরেকবার বিজেপির সংসর্গ ত্যাগ করে আরজেডি ও মহাগঠবন্ধনের সাথে হাত মেলালেন এবং বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে অপসারন ও একটি অ-বিজেপি সরকার গড়ায় নেতৃত্ব দিলেন। বিহার এইভাবে বিজেপির সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আগ্রাসী ‘অপারেশন পদ্ম’ অভিযানকে প্রতিহত করে দিল। এবং সম্প্রতি মোদি-শা মহারাষ্ট্রে শিবসেনার বহুসংখ্যক বিধায়ককে ভাঙিয়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে যা লাভ করেছিল তাকে ঘুরিয়ে দিল বিহার। বিজেপি ও জেডিইউ'র মধ্যে টানাপোড়েন বেশ কিছুদিন ধরেই বেড়ে চলেছিল। গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে ইউপি নির্বাচনে বিজেপির জয়ের পর ইউপির অনুকরণে বিহারেও বুলডোজার রাজ চালানো হবে বলে প্রকাশ্য চেচামেচি শোনা যাচ্ছিল এবং বেশ কিছু বিজেপি নেতাকে বিহারের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আলাদা রকমভাবে দেখা হচ্ছিল। বিধানসভার ভেতরে মুখ্যমন্ত্রী ও স্পীকারের বাগবিতণ্ডাও ঘটে যায় এবং ৩০-৩১ জুলাই পাটনায় বিজেপির মহা সভা চলাকালীন পার্টি-প্রেসিডেন্ট জেপি নাড্ডা এতদূর অবধি বলে বসেন যে আঞ্চলিক দলগুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পথে এবং খুব দ্রুতই দেশে একমাত্র বিজেপি দলটিই থাকবে। বিজেপির বুলডোজার রাজ ও দেশে একদলীয় শাসন কায়েমের ছকের বিরুদ্ধে বিহার প্রতিরোধ খাড়া করতে পেরেছে।
ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার রাগে বিজেপি অবশ্যই এখন সব ধরণের কলাকৌশল চালাবে নতুন সরকারকে নড়বড়ে করে দিতে। ওরা নিশ্চয় ওদের ঘৃণা, হিংসা আর মিথ্যাচারের অভিযান জোরালো করতে চাইবে বিহারের বুকে। তাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। মহামারী ও লকডাউনের ভয়ানক ক্ষতি এখনও বিহার সামলে উঠতে পারেনি। ঘৃণাপরাধ বাড়ছে। গরিব মানুষেরা নিজেদের বাড়িঘর ও জমিজায়গা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ক্রমবর্ধমান বিপদের মুখে রয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বহুলাংশে বেসরকারি ও ভীষণ মাত্রায় ব্যয়বহল হয়ে পড়েছে। আর প্রতিশ্রুত ১৯ লক্ষ চাকরিও কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বাস্তব কিছু সুফল ফলাতে হলে নতুন সরকারকে দৃঢ়তা ও দূরদর্শীতার সাথে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করতে হবে। সেই লক্ষ্যে এক অভিন্ন ন্যুনতম কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, পরামর্শ ও তদারকির ব্যবস্থার জন্য সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে, এবং শাসনকে ঢেলে সাজাতে এক বিস্তৃততর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জরুরি ভিত্তিতে খাড়া করা দরকার যার মধ্যে বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন গঠনও থাকবে। সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন ও যথাযথ সহযোগিতা করতে এবং বিজেপির বুলডোজার থেকে সারা ভারতকে মুক্ত করার লক্ষ্যে গণআন্দোলন ও প্রতিরোধের শক্তিঘর হিসেবে বিহারের ভূমিকাকে পরিবর্ধিত করতে সিপিআইএমএল এবং অন্যান্য বামপন্থী পার্টিগুলি এই নতুন প্রেক্ষিতে নিজেদের সর্বাত্মক ভূমিকায় বদ্ধপরিকর।
এমএল আপডেট এডিটরিয়াল, ১৭ আগস্ট ২০২২