পঁচাত্তরে এসে ভারত এখন ফ্যাসিবাদী হিংস্রতা থেকে স্বাধীনতার জন্য আর্তনাদ করছে
India at 75 Cries Out for Freedom

“হর ঘর তিরাঙ্গা”। ১৩-১৫ আগস্ট ঘরে ঘরে তেরঙ্গা পতাকা তোলার জন্য মোদী সরকার এই আহ্বান করেছিল। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীর বহুল প্রচারিত ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর আনুষ্ঠানিক উদযাপনের সর্বোচ্চ বিন্দু হওয়ার কথা ছিল এই আহ্বান। প্রভাবশালী মিডিয়া যখন এই অভিযান এবং লাল কেল্লার অলিন্দ থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর একাদিক্রমে নবম স্বাধীনতাদিবস-ভাষণের উচ্চকিত প্রচারে নিমগ্ন ছিল তখন রাজস্থান এবং গুজরাট থেকে ভেসে আসা দুটি খবর আজকের ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্দেশ দিয়ে গেল।

রাজস্থানের জালোর জেলার সুরানা গ্রামের সরস্বতী বিদ্যামন্দির স্কুলের ৯ বছর বয়সী এক দলিত শিশু ইন্দ্র মেঘওয়ালকে গত ২০জুলাই ‘উচ্চবর্ণের’ জন্য ‘সংরক্ষিত’ পাত্র থেকে জল খাওয়ার অভিযোগে শিক্ষক চৈল সিং নির্মমভাবে মারধর করে এবং সেই আঘাতে ১৩ আগস্ট ইন্দ্র মারা যায়। এর দুই দিন পরে, যখন নরেন্দ্র মোদী ভারতের উন্নয়নের জন্য নারী শক্তিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন এবং মহিলাদের প্রতি যে কোনও অবমাননার জন্য শূন্য সহনশীলতার নীতির কথা বলছিলেন, তখন গুজরাটের বিজেপি সরকার এগারোজন কুখ্যাত অপরাধীকে মুক্তি দিচ্ছে যাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল গুজরাটের গোধরা-পরবর্তী গণহত্যায় বিলকিস বানোকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও তাঁর তিন বছরের মেয়ে সহ তাঁর পরিবারের চৌদ্দজন সদস্যকে হত্যা করার অপরাধে। গোধরার বিজেপি বিধায়কসহ একগুচ্ছ বিজেপি নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি এই মুক্তির সুপারিশ করে। সুপারিশে দোষীদের ‘সু-সংস্কার সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পুরুষ’ হিসাবে প্রত্যয়িত করা হয়।

জাতবর্ণের নিপীড়ন নিবারণের লক্ষ্যে এই ধরনের অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি নিশেষ আইন থাকা সত্বেও জাতবর্ণের নিপীড়ন স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতকে সর্বদা তাড়া করে ফিরেছে। এখন যা ঘটছে তা হল দলিতবিরোধী সহিংসতার ক্রমবৃদ্ধি। সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনীর অভূতপূর্ব রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালী সবর্ণ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যে অধিকারবোধ ও রক্ষাকবচ পাওয়ার নিশ্চিন্তি জন্মেছে তার ফলেই দলিত-বিরোধী সহিংসতার এই ক্রমবৃদ্ধি। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ঘৃণামূলক অপরাধ অবশ্যই বিজেপির হিন্দু আধিপত্যবাদী রাজনীতির একটি কেন্দ্রীয় উপাদান এবং আমরা গত তিন দশকে বিজেপির উত্থানের পর থেকে, বিশেষত কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর থেকে এই ধরনের অপরাধের মাত্রা ও তার তীব্রতার উত্তরোত্তর উদ্বেগজনক বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। অপরাধ আকছার ঘটলেও দোষী সাব্যস্ত হওয়া বিরল। বিলকিস বানো মামলাটি এমনই একটি বিরল মামলা যেখানে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে চলা সিবিআই তদন্তের ফলশ্রুতিতে মহারাষ্ট্রের ট্রায়াল কোর্টের বিচারে আসামীরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল এবং ২০১৭ সালের মে মাসে বোম্বে হাইকোর্ট ও তার পর ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট সেই বিচারের রায়কে বহাল রেখেছিল।

সাজা মকুবের এই আদেশ দেওয়া হয়েছে ১৯৯২ সালের নীতির ভিত্তিতে। ১৯৯২-এর এই নীতি ২০১৪ সালে পরিবর্তন করা হয়েছিল। ডিসেম্বর ২০১২’র দিল্লীর ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনের ফলে ধর্ষণ-বিরোধী আইন আপডেট করে সাজা মকুবের সুযোগ থেকে ধর্ষণের অপরাধীদের বাদ দেওয়ার নীতি এসেছিল। গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে এবং অতি সম্প্রতি ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে মোদী সরকার কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা নীতিতে বিশেষভাবে ধর্ষণ বা হত্যার মতো জঘন্য অপরাধে দণ্ডিত আসামীদের এ ধরনের ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ বাদ দেওয়া আছে। যেহেতু বিচার মহারাষ্ট্রে হয়েছিল, তাই মহারাষ্ট্র সরকারের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল এবং যেহেতু তদন্তটি সিবিআই করেছিল, তাই কেন্দ্র সরকারের সম্মতিও প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ, সমস্ত বিদ্যমান সরকারি নীতি ও বিচার-নির্দেশিকার নিরিখে দেখলে সাজা মকুবের আদেশটি ধোঁপে টেকে না।

Freedom from Fascist Violence

বিলকিস বানো মামলা গুজরাট গণহত্যার সাথে জড়িত মামলাগুলির মধ্যে অন্যতম বিরল একটি মামলা যেখানে খানিক সুবিচার পাওয়া গেছিল। গণহত্যা সংগঠিত হওয়ার সময় বিলকিসের বয়স ছিল মাত্র ঊনিশ বছর এবং পুরো পরিবারের সাথে নিরাপত্তার খোঁজে যখন তাঁরা পালাচ্ছিলেন তখন তাঁদের ওপর আক্রমণ হয়। তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং তাঁকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর মৃত ভেবে ফেলে গিয়েছিল দুস্কৃতিরা। তাঁর মা, বোন এবং তিন বছরের মেয়ে সহ তাঁর পরিবারের ১৪ জন সদস্যকে হামলাকারীরা হত্যা করেছিল, হামলাকারীরা ছিল তাঁর নিজের এলাকারই লোক। বিলকিস সেই আগাত ও আতঙ্ক থেকে বেঁচে ফেরে এবং দৃষ্টান্তমূলক সাহস ও দৃঢ়তার সাথে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে কিছুটা ন্যায়বিচার অর্জন করতে পেরেছিল। যেদিন স্বাধীন ভারত পঁচাত্তরে পরিণত হল সেদিনই এই জঘন্য অপরাধের অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পষ্টতই একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ যার উদ্দেশ্য সমস্ত ন্যায় বিচার প্রত্যাশীদের কাছে এক হিমশীতল বার্তা পাঠানো এবং একইসাথে ধর্ষক-ও-ঠ্যাঙাড়ে স্কোয়াডগুলিকে আরও উত্সাহিত করা যারা মোদির এই নয়া ভারতে প্রকাশ্যে এই ধরনের হুমকি দেয় ও এরকম অপরাধ সংগঠিত করে। জাকিয়া জাফরির আবেদন খারিজ হওয়া এবং তিস্তা শেতলবাদের প্রতিশোধমূলক গ্রেপ্তারির সাথে সাথে বিলকিস বানো রায়ের এই প্রত্যাহার বিশ্বকে জানান দিচ্ছে যে ভারত এখন সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের গুজরাট মডেল দ্বারা শাসিত হচ্ছে যেখানে গণহত্যার নৃশংস অপরাধীরা উপভোগ করবে লাগামহীন ক্ষমতা ও দায়মুক্তি।

৭৫ বছর বয়সী ভারতকে অবশ্যই ক্ষমতার এই দাম্ভিক অপব্যবহার ও অবিচারকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে উঠে দাঁড়াতে হবে এবং কোনো বিলম্ব ছাড়াই এই মকুবনামা প্রত্যাহার করার জন্য আরও জোর দিতে হবে। গুজরাটে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মালা পরিয়ে মিষ্টি খাওয়ানোর দৃশ্য এবং রাজস্থানে ৯ বছর বয়সী ইন্দ্র মেঘওয়ালের হত্যাকারীর সমর্থনে জমায়েত খুব স্পষ্টভাবেই দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে ফ্যাসিবাদী শাসন কেবল নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষের ওপর ক্রমাগত ভয়ঙ্কর সহিংসতাই চালিয়ে যায় না, অধিকন্ত সেই সহিংসতাকে বৈধতা দেয় ও উদযাপন করে। এই ফ্যাসিবাদী সহিংসতার কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য জনগণের সুসমন্বিত এক গণআন্দোলন গড়ে তোলা ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে আমাদের সামনে সবচেয়ে জরুরি কাজ।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৩ আগস্ট ২০২২

খণ্ড-29
সংখ্যা-33