১৫ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে রাজ্যের জেলায় জেলায় অঞ্চলে অঞ্চলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান “আমরা ভারতের জনগণ, আমাদের একটাই লক্ষ্য – আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে রক্ষা করা” পাঠ করে শোনানো হয়। দিবসের শপথ নেওয়ার বিষয়গুলি শ্লোগান আকারে তুলে ধরা হয়। প্রদর্শিত করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতিকৃতি, জাতীয় পতাকা সহ লাল পতাকা। পার্টির রাজ্য সম্পাদক জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন শিলিগুড়ির কর্মসূচিতে। পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল ছিলেন কলকাতার বেলেঘাটায় গান্ধী ভবনের সামনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বাম দলগুলির যুক্ত কর্মসূচিতে। এদিন পার্টি কর্মীরা পার্টি পরিসরের বাইরে গিয়েও স্বাধীনতা ৭৫ উদযাপনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। যেমন, উত্তর ২৪ পরগণার একটি গ্রামীণ এলাকায় সংখ্যালঘু মেয়েদের নিয়ে নাচ-গান-আবৃত্তি-ভাষ্যে স্বাধীনতার বাণী প্রচার করা হয়।
এদিন এক আলোচনা সভা আয়োজিত হয় পার্টির বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে সংগঠনের জেলা অফিসে। দু’টি বিষয়ে, স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের ও বামেদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শতাব্দী দাশ ও পার্থ ঘোষ (পার্টি পলিটব্যুরোর সদস্য)। সঙ্গীত পরিবেশন করেন অয়ন্তিকা ও সায়ন, আবৃত্তি পরিবেশন করেন সৌমী কুণ্ডু।
শতাব্দী দাশ তাঁর মনোগ্রাহী বক্তব্যের শুরুতেই প্রশ্ন রাখেন, অসংখ্য নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীকে বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রশাসন কীভাবে দেখতো। কারণ তাঁরা অনেকেই সাম্রাজ্যবাদী শাসন উৎখাত করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আজ মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, তিস্তা শেতলবাদ দেশদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রতিবাদী ছাত্রী ও গবেষক নাতাশা, দেবাঙ্গনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে আটক করা হয়েছিল। এরা কিন্তু নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে ছিলেন। আজ যদি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তরা থাকতেন, তাদের কি সন্ত্রাসবাদী বলা হোত? স্বাধীনতা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণে বাধা এসেছিল – নারীরা যুক্ত হলে পুরুষদের মনসংযোগে নাকি বিঘ্ন ঘটবে। এমনকি ডান্ডী অভিযানে গান্ধীজীও মহিলাদের নিতে চাননি। তাঁর মনে হয়েছিল বৃটিশ রাজশক্তি ভাববে আন্দোলনকারীরা মহিলাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে।
শতাব্দী সশস্ত্র ও অহিংস, আদিবাসী ও মুসলিম বীরাঙ্গনাদের দুর্বার সংগ্রাম, অনন্য সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভার কথা তুলে ধরেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, কল্যাণী দাস, বীণা দাস, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ইলা সেন, সুলতা কর, কমলা দাশগুপ্ত ... বহু মহিলা আন্দোলন যোগ দেন। অরুণা আসফ আলী ৯ আগস্ট বোম্বাই (মুম্বাই) গোয়ালিয়র ট্যাঙ্ক ময়দানে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার তাকে জেলে যেতে হয়েছে। ননীবালা দেবী, দুকড়ি বালা দেবী, মাতঙ্গিনী, সরোজনী নাইডু সহ আর মাত্র কয়েকজনের নামই ইতিহাস বইয়ে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ইউরোপিয়য়ান ক্লাবের সামনে লেখা থাকত ‘কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। সেখানে বিপ্লবীরা সশস্ত্র অভিযান চালালে পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলেছিল। পুরুষসঙ্গীদের বার করে দিয়ে সাইনাইড খেয়ে মাত্র একুশবছর বয়সে শহীদ হয়েছিলেন প্রীতিলতা।
বহু মুসলমান মহিলাও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেন। বেগম হজরত মহল, মুহাম্মদী খনম, কানপুরের গণিকা আজিজুন বাঈ, বি আম্মা প্রমুখ। আদিবাসী বিপ্লবী মহিলা কুইলি, ভেলু নাছিয়া, লক্ষ্মী বাঈয়ের সহকারী ঝনকারী বাঈ, মন্দিরা, সুন্দর বৌ, মুন্ডারি বাঈ, মতি বাঈ এরা পুরুষ বিপ্লবীদের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না।
ব্রিটিশ পুলিশ মহিলা বিপ্লবীদের উপর থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করতো। যৌন নির্যাতন, মলদ্বারে রুল ভরে দেওয়া, চোখে পিন ফুটিয়ে দেওয়া, আঙ্গুলের নখ তুলে দেওয়ার মতো অমানুষিক নির্যাতন চালানো হত। বিপ্লবী বীরাঙ্গনারা তা সহ্য করেছেন কিন্তু কখনও নতি স্বীকার করেননি।
শতাব্দী আক্ষেপের সুরে বলেন, বেশিরভাগ নারী বিপ্লবী উপেক্ষিত থেকে গেছেন, হয়তো নারী, মুসলমান বা গণিকা বলে। বাদ গেছেন দলিত, আদিবাসী নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। তাঁদের অতুলনীয় দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাও মহিলা লেখিকাদের কলম থেকেই। ইদানীং অবশ্য নতুন করে নারী বিপ্লবীদের নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে।
পার্থ ঘোষ বলেন, আর এস এস ও কমিউনিস্ট পার্টি – উভয়েরই জন্ম ১৯২৫ সালে। আর এস এস জন্মলগ্নেই ঘোষণা করল হিন্দুদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়ে শক্তিক্ষয় করা উচিত হবে না। বরং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। কিন্তু কমিউনিস্টরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ সরকার ‘কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র’ মামলায় মোট আটজন কমিউনিস্ট নেতাকে অভিযুক্ত করে। তাদের মধ্যে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, মুজফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্ত, গুলাম হোসেন, সিঙ্গারাভেল্লু, শওকত ওসমানি, আর এল শর্মা। এঁদের দীর্ঘদিনের কারাবাস হয়। বিপরীতে আরএসএস ব্রিটিশের দালালি করেছে, মুচলেকা দিয়েছে। এরপর তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলেন, মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসন দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রকে হত্যা করছে। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন পার্টির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য সৌভিক ঘোষাল।
(ঋণ স্বীকার ‘অন্য স্বর’)