বিজেপি-আরএসএসের ভারতে দলিত শিশুর তৃষ্ণার জল চাওয়া অপরাধ নারীর প্রাপ্তি লাঞ্ছনা আর অপমান
Dalit children's thirst for water is a crime

ঠিক এই মুহূর্তে পরিবার ও সমাজে সাধারণ মেয়েরা কতটা অসহায়, বিপন্ন, নিরাপত্তাহীন? কী রকম হিংসার বাতাবরণে তাদের প্রাত্যহিক যাপন? তা নিয়ে আর আলাদা চর্চার প্রয়োজন নেই। প্রভাতী দৈনিক আর দূরদর্শনে দূরবাহিত হয়ে সেসব খবর রোজ, বছরভর, বছরের পর বছর মনের কোণে ক্রোধ জাগিয়ে তুলছে। জাতবর্ণ, সাম্প্রদায়িক হিংসা, লিঙ্গবৈষম্য – কমে তো নি, বরং লেলিহান হয়ে পুড়িয়ে মারছে গোটা দেশটাকে, বিশেষ করে গত প্রায় এক দশকের মোদী জমানায়। লালকেল্লায় চড়ে মোদী ‘নারী শক্তি’র যতই ‘বন্দনা’ করুন- সেটা অভিনেতা হিসেবে তার খ্যাতি বাড়ালেও, সেই বক্তব্য যে নিছক বাগাড়ম্বর তা আর বুঝতে বাকি নেই! তিনি, ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারের কথায়, এক ‘সীমাবদ্ধ’, ‘সংকীর্ণ’ দেশের কথাই ভাবেন, ঘোষিত হিন্দুত্বের পথে দেশ পরিচালনা করেন ‘যা জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন তথা স্বাধীন ভারতের নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী’।

আবহমান কালের সামাজিক ব্যাধি – এই হিংসা ও নারীবিদ্বেষ যখন কোনও বিশেষ মতাদর্শের সওয়ার হয়ে, বিশেষ রাষ্ট্রিক উদ্দেশ্যে বিশেষ গতি পায়? যখন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করে? এতকালের নারী আন্দোলনের সমস্ত অর্জনকে যখন নস্যাৎ করে গোটা সমাজকে পশ্চাদমুখী করতে চায়? মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে?

আমরা দেখেছি সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনে প্রতিবাদী ছাত্রী-গবেষক নাতাশা, দেবাঙ্গনা, সাফুরা জারগরদের কীভাবে মিথ্যা মামলায় ইউএপিএ-তে আটক রাখা হয়েছিল। বিজেপি’র আইটি সেল তথা নেতা-মন্ত্রীরা মহিলা প্রতিবাদীদের কীভাবে চরিত্র হনন থেকে শুরু করে লাগামহীনভাবে তাদের বিরুদ্ধে কুৎসিত মন্তব্য করে গেছে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় একইভাবে সুধা ভরদ্বাজ (সম্প্রতি গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় জামিন মিলেছে), সোমা সেন সহ অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীকে দানবীয় আইনে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে। আটক রাখা হয়েছে আদিবাসী মহিলাদের, যারা নিজেরাই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত, নিগৃহীত, লুণ্ঠিত হয়েছেন।

রাজস্থানের জালোর জেলার সুরানা গ্রামের সরস্বতী বিদ্যামন্দির স্কুলের ৯ বছর বয়সী এক দলিত শিশু ইন্দ্র মেঘওয়ালকে গত ২০ জুলাই ‘উচ্চবর্ণের’ জন্য ‘সংরক্ষিত’ পাত্র থেকে জল খাওয়ার অভিযোগে শিক্ষক চৈল সিং নির্মমভাবে মারধর করে এবং সেই আঘাতে ১৩ আগস্ট ইন্দ্র মারা যায়। এর দু’দিন পরে, যখন নরেন্দ্র মোদী ভারতের উন্নয়নের জন্য নারী শক্তিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন এবং মহিলাদের প্রতি যে কোনো অবমাননার জন্য শূন্য সহনশীলতার নীতির কথা বলছিলেন, তখন গুজরাটের বিজেপি সরকার এগারোজন কুখ্যাত অপরাধীকে মুক্তি দিচ্ছে যাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল গুজরাটের গোধরা-পরবর্তী গণহত্যায় বিলকিস বানোকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও তাঁর তিন বছরের মেয়ে সহ তাঁর পরিবারের চৌদ্দজন সদস্যকে হত্যা করার অপরাধে। গোধরার বিজেপি বিধায়ক সহ একগুচ্ছ বিজেপি নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি এই মুক্তির সুপারিশ করে। সুপারিশে দোষীদের ‘সু-সংস্কার সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পুরুষ’ হিসাবে সার্টিফিকেট দেওয়া হয় হয়।

মাত্র কিছু দিন আগে আমরা দেখেছি কীভাবে গুজরাট গণহত্যায় নিহত প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরির নিম্ন আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন শীর্ষ আদালতে খারিজ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, আইনজীবী তিস্তা শেতলবাদকে ‘উস্কানি’ ও ‘মিথ্যা তথ্য’ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার করা হল। মহিলা রাজনৈতিক মানবাধিকার কর্মী, সমাজ কর্মীদের (অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও) দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক রেখে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। অথচ সম্প্রতি ‘অমৃত মহোৎসব’ পালনের অঙ্গ হিসাবে যে ১১ জন পৃথিবীর সর্বকালের ঘৃণ্য, নৃশংস ধর্ষক-খুনীকে গুজরাট সরকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মুক্তি দিয়েছে, তারা কারাভোগের থেকে বেশি সময় প্যারোলে ছুটি উপভোগ করেছে! তুচ্ছ কারণে মাসের পর মাস বাড়িতে কাটিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের প্রতি অসীম দয়াপরবশ হয়ে জেলে ফিরে আবার লম্বা ছুটির আবেদন করেছে।

সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় আমরা আরও উদ্বিগ্ন। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারক প্রতিভা এম সিং ফিকি-র (এফআইসিসিআই) এক সভায় মহিলাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পোদ্যোগ, গণিতের ক্ষেত্রে ‘কী অদৃশ্য বাধা’র সম্মুখীন হতে হয় সে প্রসঙ্গে বলতে অনুরুদ্ধ হয়ে বলেন “আমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘মনুস্মৃতি’ মহিলাদের আদর ও সম্মান দিয়েছে”। তিনি গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধান-রক্ষক হয়ে এমন কথা কী করে বলেন, তা নিয়ে বহু ব্যক্তি ও সংগঠন প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। এই গ্রন্থ বর্ণবৈষম্য তথা নারীর অবমাননা, সর্বপ্রকার অধিকার হরণের এক অভিশপ্ত দলিল। এর মতো নারীবিদ্বেষী-বর্ণবিদ্বেষী সংহিতা বুঝি দুটি নেই। মনুসংহিতায় নারীর প্রতি পুরুষকে যা যা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই বর্তমান ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাহলে, যার দায়িত্ব ন্যায় রক্ষকের, তিনি সেই বিশিষ্ট অবস্থান থেকে যদি সেই সংহিতার প্রশংসা করে সমাজের উদ্দেশে এমন একটি প্রতিক্রিয়াশীল নারীবিদ্বেষী বার্তা দেন, তা শুধু দুঃখের নয়, ভয়েরও।

সম্প্রতি কেরালার কোঝিকোড জেলার দায়রা আদালতের বিচারক এস কৃষ্ণকুমার লেখক-সমাজকর্মী সি চন্দ্রণের বিরুদ্ধে আনা দুই তরুণীর দুটি আলাদা যৌন হেনস্থার অভিযোগে অভিযুক্তকে আগাম জামিন মঞ্জুর করেছেন অদ্ভুত যুক্তিতে। প্রথম ক্ষেত্রে তিনি মন্তব্য করেছেন “ঘটনার দিন অভিযোগকারিণী খোলামেলা উত্তেজক পোশাক পরেছিলেন। তাই স্বভাবতই সেক্ষেত্রে ৩৫৪এ ধারায় আনা অভিযোগ গ্রাহ্য হতে পারে না।” এই নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সঙ্গত কারণেই। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিনি জামিন মঞ্জুর করেছেন এই পর্যবক্ষেণের ভিত্তিতে, “যেহেতু অভিযুক্ত আগে থেকেই জানতেন অভিযোগকারিণী দলিত সম্প্রদায়ের, তাই তাকে স্পর্শ করার বিষয়টি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়”। ন্যায় রক্ষকের আসনে বসে এমন সংবিধানবিরোধী অসংবেদনশীল মন্তব্য! প্রসঙ্গত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাজস্থানের সরকারি কর্মী ভাঁওরী দেবীর ধর্ষণ মামলাতেও একই যুক্তিতে গুজ্জর সম্প্রদায়ের উঁচুজাতের পাঁচ ধর্ষককে বেকসুর খালাস দিয়েছিল আদালত। অথচ এনসিআরবি’র রিপোর্ট বলছে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন দলিত মহিলা ধর্ষণের শিকার হন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলির সমীক্ষা বলছে ৮০%-এর জন্য দায়ী উচ্চবর্ণ। এক বিচারকের এই নারীবিদ্বেষী জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য সমাজের কাছে কী বার্তা পৌঁছাবে?

দলিত কৃষক-মজদুর নেত্রী পরমজিৎ কাউর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কৃষক আন্দোলন শিখিয়েছে, পিতৃতন্ত্র ও জাতপাতের বৈষম্যের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়তে হয়-এই দুই বৈষম্যের (লিঙ্গ ও বর্ণ) বিরুদ্ধে সেটা হেনেছিল এক বিরাট আঘাত।

৭৫ বছর বয়সী ভারতকে অবশ্যই বিজেপি-আরএসএসের ক্ষমতার এই দাম্ভিক অপব্যবহার ও অবিচারকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে উঠে দাঁড়াতে হবে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-33