বরখা দত্ত
(শিরোনাম আমাদের। ভাষান্তরঃ অভিজিৎ বসু)
আমার এই বক্তব্য একজন মেয়ে হিসাবে অন্য সমস্ত মেয়েদের কাছে আমি রাখছি। সকলের কাছেই আমি কথাগুলো বলতে চাইছি।
কল্পনা করতে পারেন, আপনি পাঁচমাসের গর্ভবতী আর কিছু হিংস্র লোক আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, একে একে এসে আপনাকে ধর্ষণ করে যাচ্ছে? কখনো ভাবতে পারেন আপনাকে স্বচক্ষে ধর্ষিত হতে দেখার পর আপনার মাকেও ধর্ষিত হতে হচ্ছে এবং আপনাকে সে দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হচ্ছে ! আর ঠিক এরপরই আপনার দুই বোনের ধর্ষিত হওয়ার পালা! যদি ভেবে থাকেন এটাই শেষ, তাহলে ভুল করবেন। কল্পনা করুন, আহত রক্তাক্ত অবস্থায় আপনি পড়ে আছেন — আপনার হাতখানা বদমাইশরা ভেঙে দিয়েছে — ঠিক তখনই আপনার তিন বছরের মেয়েটাকে ওরা পাথরে আছাড় মেরে মাথা ভেঙ্গে দিল! এরা কিন্তু কেউ আপনার অপরিচিত নয়, সবাই প্রতিবেশি। আপনার পরিবারের কাছে ওরা রোজ দুধ কিনতো! আর আপনি কিনা ভেবেছিলেন ওরা আপনার মিত্র!
এবার ভাবুন, ১৭ বছর ধরে আপনি ন্যায়বিচারের জন্য দেশের আদালতগুলোতে মাথাকুটে মরেছেন! আর যেহেতু মামলা আপনার নিরাপত্তার জন্য ভিন রাজ্যে বদলি করা হয়েছিল, আপনাকে ছোটাছুটি করতে হয়েছে কুড়িগুণ বেশি! এরপর, যখন আপনি সবে ধ্বংসস্তুপ থেকে আবার উঠে দাঁড়াবার কথা ভাবছেন, ১১ জন ধর্ষককে রাজ্য প্রশাসনের আদেশে মেয়াদ শেষের আগেই জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল। খুব ঘাগু নিস্পৃহ লোককেও কিন্তু এই ঘটনা একেবারে ব্যক্তিগত স্তরে গিয়ে আঘাত করবে। বিলকিস বানো আমার কাছে সেরকমই একটা ঘটনা।
২০ বছর আগের এক রাত্রে গোধরায় বিলকিসের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। কেরোসিনবাতির টিমটিমে আলোয় ত্রিপলের ছাউনির তলায় আরো অনেক মেয়ের সঙ্গে তাকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল। এক বিধ্বস্ত শূন্যতার চাউনি ছিল তার চোখে, একটা ভাঙাচোরা অভিব্যক্তি — যেন কিছু একটা মরে গিয়েছে তার মধ্যে! বিলকিসের স্বামী ইয়াকুব আমাকে বললো, ১১ জনের মুক্তির খবর আর জেলের বাইরে তাদের মালা পরানো, মিষ্টি খাওয়ানোর সংবাদ পাওয়ার পর থেকে বিলকিস ওইরকম নিঃসাড় হয়ে গেছে। কোনো কথা বলছে না — একেবারে একা হয়ে গেছে!
আপনারা ভাবতেই পারেন বিলকিসের দুঃখের কাহিনী এখানেই শেষ। না, তা নয়! রাজ্যের যে কমিটি অভিযুক্তদের মুক্তির সুপারিশ করেছিল তাদেরই একজন, বিজেপি নেতা সি কে রাউলজি আমাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘মোজো স্টোরি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “অভিযুক্তরা সকলেই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণরা খুব সংস্কারী হয়। জেলে ওরা নিশ্চয়ই খুব ভালো আচরণ করেছিল।” আমার সহকর্মীর নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটি ভাইরাল হয়ে যাওয়াতে বিজেপির সমর্থকরা পর্যন্ত অস্বস্তিতে পড়েছিল।
এই সাক্ষাৎকার অবশ্য একটা জিনিস সংশয়াতীতভাবে প্রমাণ করেছে। কোনও শোধনপ্রক্রিয়ার বশে অভিযুক্ত ধর্ষকদের কারামুক্তি ঘটেনি। রাউলজি বলেছিল, “ক্রাইম কিয়া ইয়া নেহি কিয়া, পতা নেহি !” একটা অকথ্য নোংরা আইনি ভ্রষ্টাচারের খেলা চলছে! কারাদন্ডের মেয়াদ কমিয়ে মুক্তি দেবার যে নির্দেশিকা ২০২২’র গ্রীষ্মে দেওয়া হয়েছিল, তাতে পরিষ্কার বলা ছিল ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তরা এর আওতায় আসবে না। আইনজ্ঞদের মতে, গুজরাট সরকার যদি ১৯৯২’র আইন অনুযায়ী এই কর্মটি করে থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কোন ব্যক্তি কোন সরকারি স্তর থেকে এই অনুমতি দিয়েছিল সেটি রহস্যাবৃত। বিলকিস বানোর আইনজীবী শোভা গুপ্ত বছরের পর বছর ধরে ধর্ষিতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে তিনি বললেন তিনি একেবারে বিধ্বস্ত। বিলকিসকে মুখ দেখাতে পারছেন না! আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম বিলকিস এই রায়ের বিরুদ্ধে পিটিশন করবে কিনা, তিনি বললেন, “একজন মানুষের আর কত সাহস থাকতে পারে! এবার অন্য কেউ এসে লড়াই জারি রাখুক। সিবিআইয়ের উচিত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত . হস্তক্ষেপ করা!”
আমরা অবশ্য পুরো বিষয়টা উপেক্ষা করতেই পারি। ভাবতেই পারি যে সমস্যাটা আমাদের নয়। কিন্তু একজন মেয়ে হিসেবে আমার বলার যে এটা আমাদের সকলের সমস্যা।
শোভা গুপ্ত আমাকে বললেন, আরেকজন ধর্ষিতা এই খবর পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর মামলাটি তিনি তুলে নেবেন কিনা।
যে হাল্লাবোল ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর উঠেছিল তার রেশ কী কিছু অবশিষ্ট নেই! ওই নোংরা লোকগুলোর কী বাকি জীবন জেলের মধ্যেই পচে মরা উচিত নয়! মেয়েদের সুবিচার পাওয়ার যে কোনও লড়াই কী এভাবেই শেষ হবে! এই সব প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই মিলে কতটা চেঁচাতে পারবো তার ওপর নির্ভর করছে।
তবে আসুন, আমরা চেঁচিয়ে আওয়াজ তুলি, সবকিছু নরক করে দিই !