ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ কি উপকারে আসবে?
Bank privatization

সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ১৮ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত বুলেটিন বিতর্কের ঝড় তুলেছে। ওই বুলেটিনে “প্রাইভেটাইজেশন অফ পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কস্ — অ্যান অলটেরনেটিভ পারস্পেক্টিভ” শীর্ষক নিবন্ধ যৌথভাবে লিখেছেন স্নেহাল এস হেরভাদকর, সোনালি গোয়েল এবং রিশুকা বনশল, যারা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কিং রিসার্চ ডিভিশন, ডিপার্টমেন্ট অফ ইকনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ, আরবিআই’র সাথে যুক্ত। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই শীর্ষ ব্যাঙ্কের তরফ থেকে তড়িঘড়ি করে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি মারফত জানানো হল যে ওই বক্তব্যগুলো লেখকদের নিজস্ব, আরবিআই’এর নয়।

কী আছে ওই লেখাটিতে?

উক্ত লেখায় লেখকেরা নানা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো অতি মুনাফার লক্ষ্যেই চালিত। কিন্তু, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো পুরোপুরি এই লক্ষ্যে নিজেদের পরিচালিত না করে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো বাজারের অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে, দুর্বল ব্যালেন্স শীট থাকা সত্ত্বেও কোভিড অতিমারির পরপর নেমে আসা ছোবলকে দক্ষতার সাথে ও খুব ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে। হালে, ব্যাঙ্কগুলির যে বড় মাপের সংযুক্তিকরণ হল, তা লেখকদের মতে, ব্যাঙ্ক শিল্পকে এক মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে। সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাঙ্কিং সংস্কারের (যেমন, ন্যাশনাল অ্যাসেট রিকন্সট্রাকশন কোম্পানি লিঃ গঠনের) ফলে, লেখকদের অভিমত, ব্যালেন্স শীট থেকে অপরিশোধিত ঋণ মুছে ফেলতে সুবিধা হবে। তাঁরা মনে করেন, এরফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো আরো শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারবে। এরপর যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তাঁরা করেছেন তা হল, “এই পৃষ্ঠভূমির উপর দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার যে বিরাট বড় সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা ভালো করার বদলে বরং অনেক ক্ষতি ডেকে আনবে”। যদিও লেখক ত্রয়ী শেষ বিচারে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা না করে বরং ধাপে ধাপে, আস্তে আস্তে করার পক্ষেই নিজেদের মত ব্যক্ত করেছেন।

ওই লেখায় তাঁরা দেখিয়েছেন, অতীতে নেমে আসা আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকটকালে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো থেকে আমানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোতে চালান হয়েছে। যার অর্থ হল, আর্থিক সংকটের সময় বাজার বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর উপর নির্ভর করতে না পেরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকেই বেছে নিচ্ছে কারণ শেষোক্তদের পেছনে রয়েছে সরকারের গ্যারান্টি। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো উচ্চহারে সুদ দেওয়া সত্ত্বেও আমানত স্থানান্তরকরণের এই প্রবণতাকে রুখতে পারেনি।

প্রবন্ধটি আরও দেখিয়েছে, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো গ্রামাঞ্চল বা আধা শহরাঞ্চলে অনেক বেশি সংখ্যক শাখা খুলে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার অধীনে নিয়ে এসেছে, যার সাথে বেসরকারি ব্যাঙ্কের কোনও তুলনাই টানা যায় না। জুলাই ২০২২ পর্যন্ত গোটা দেশে ৪৫ কোটি মানুষকে ব্যাঙ্কের ছত্রছাওয়ায় নিয়ে আসা হয়েছে আর মোট ৭৮ শতাংশ অ্যাকাউন্টই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কে। গ্রামীণ ঋণ, পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের প্রশ্নে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলোর সাথে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর কোনও তুলনাই টানা যাবে না।

বোঝাই যাচ্ছে, কোনও ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যঙ্কগুলো কোনও ভূমিকাই পালন করেনি। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের পক্ষে গুপ্তা ও পানাগারিয়া, ২০২২এ একটি পলিসি প্রেসক্রিপশন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন। সেখানে স্টেট ব্যাঙ্ক বাদে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলোর বেসরকারিকরণের জোরালো সওয়াল করা হয়েছে, আর সেটাকে ভিত্তি করেই মোদী সরকার তৈরি করেছে ঢালাওভাবে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের দাওয়াই।

উল্লিখিত লেখাটিতে লেখকেরা দাবি করেছেন সর্বরোগহর দাওয়াই হিসাবে বেসরকারিকরণের এই টোটকার বিপরীতে তাঁরা তৈরি করেছেন এক বিকল্প পরিপ্রেক্ষিত।

নিজেদের অভিমত হিসাবে তা গণ্য না করার কথা বললেও বেশ গুরুত্ব দিয়েই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই প্রবন্ধটি ছাপিয়েছে নিজস্ব বুলেটিনে। বোঝাই যাচ্ছে, শীর্ষ ব্যাঙ্কের অন্দরেই রয়েছে এই বিতর্ক, প্রশ্ন।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-33