অগত্যা রাজ্য বিজেপি সম্পাদকের কথা থেকে বোঝা গেল এখানে ওরা অপেক্ষায় থাকছেন “মহারাষ্ট্র মডেল” প্রয়োগের, যার জন্য প্রত্যাশায় থাকতে হচ্ছে শাসক তৃণমূলের ভেতর থেকে কোন এক ‘শিন্ডে’-র আত্মপ্রকাশ ঘটে কিনা, যার উপর নির্ভর করে ভিতর থেকে ভাঙন ঘটিয়ে মমতা সরকারের পতন ত্বরান্বিত করাতে পারা যাবে। এরাজ্যের যেন তেন প্রকারে দখল নেওয়ার উদ্দেশ্যে তৃণমূলকে ভেতর থেকে ভাঙার অপচেষ্টা বিজেপি এর আগেও চালিয়েছে। প্রথমে মুকুল রায়কে পুঁজি করে কিছু উল্লেখযোগ্য ভাঙন ঘটাতে সফল হয়, তবে সেসব হাসিল করতে পেরে উঠেছিল বিগত পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের আগে-পরে। অর্থাৎ, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ও পৌরসভার স্তর পর্যন্ত ক্ষমতার দখল পেতে। তারপরে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে ভাঙতে, টক্কর দিতে বিজেপির আরও সুবিধা হয় শুভেন্দুকে পেয়ে যাওয়ায়। তাতে আবারও কিছু ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয় বিধায়ক ও সাংসদ স্তরে। কিন্তু যাবতীয় সমস্ত হীন কৌশল চালিয়েও বিজেপিকে বাংলায় ক্ষমতার দখল পাওয়া থেকে বহু দূরেই থেকে যেতে হয়েছে। তবু নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরপর বিজেপি ফের পুনরুত্থান ঘটানোর চেষ্টা চালায়। কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে রাজ্যের কিছু পরিচিত মন্ত্রীকে ঝটিতি গ্রেপ্তার করে মামলা ঠুকে পরিস্থিতি ঘোরানোর কসরত করে। কিন্তু সফল হয়নি। কাজেই বিজেপি রাজ্য সম্পাদকের অতি সাম্প্রতিক ‘মহারাষ্ট্র মডেল’ প্রয়োগের প্রসঙ্গ উত্থাপন কোনো বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত গলাবাজি নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সুপরিকল্পিত। এই উদ্দেশ্যে আবার হুমকি দিতে শুরু করেছে। কেন্দ্রের মদতে ও আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সির একের পর এক হানাদারীকে বিজেপি তার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। এইসব অভিযান থেকে ফায়দা তুলতে প্রচারে মরীয়া হচ্ছে। নিশানা করছে বিরোধীপক্ষের দল শাসিত রাজ্যগুলিকে। কোথাও সফল হচ্ছে, কোথাওবা সুবিধা করে উঠতে পারছে না, কোথাও আবার ব্যুমেরাং হচ্ছে, যেমন এনডিএ-র শাসক জোটের অ-বিজেপি পক্ষকে সাঁড়াশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে বিহারে।
পশ্চিমবাংলায় শাসক তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়া থেকে আগাগোড়া চালিয়ে আসছে যথেচ্ছ দুর্নীতি। সম্প্রতি পুরানো এক জনস্বার্থ মামলা সূত্রে কলকাতা উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি সমন্বয়ে এক ডিভিশন বেঞ্চ এক বিচিত্র আদেশ দিয়েছে তৃণমূলের সাংসদ-বিধায়ক সহ একগুচ্ছ নেতাদের আয়ের সঙ্গে সম্পত্তির অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে! বিচিত্র এই যে বিস্ময়করভাবে এই মামলায় ইডি-কে যুক্ত করেছে! মানুষের দাবি আছে এইসব অভিযোগের স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হোক, ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায় পাক, দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করার যুক্তিও রয়েছে। কারণ, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি যেখানে কোন অংশে কম দুর্নীতি অভিযুক্ত নয়, তবু সেখানে কখনও ইডি-সিবিআই মার্কা কেন্দ্রীয় এজেন্সি নিয়োগ করা হয়না। এখানেও নারদ কেলেঙ্কারীতে অন্যতম অভিযুক্ত, অধুনা বিজেপি বিধায়ক দলনেতা, শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে কোনো কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তের নামগন্ধ নেই! তাই এইসব পক্ষপাতিত্বের মধ্যে উন্মোচিত হয়ে যায় বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সেটা হল, কোনো বিরোধীপক্ষকে কোনও ক্ষমতায় থাকতে না দেওয়া। এটা ফ্যসিবাদেরই লক্ষণ।
তৃণমূলও ক্ষমতায় থাকার দাপট বোঝাতে এক সময়ে বামেদের ও কংগ্রেসের হাতে থাকা বহু পঞ্চায়েত ও পৌর ক্ষমতা জোরজবরদস্তি ভাঙিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে তান্ডব চালিয়েছিল। তার প্রাপ্য রাজনৈতিক শাস্তি অবশ্যই সময়ের সাথে সাথে বুঝিয়ে দিতে হবে, এবং সেটা করতে হবে নতুন চিন্তায় নতুন আশাবাদ জাগিয়ে তুলে, লড়াইয়ের ঢেউ তুলে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে – বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে। তার সুযোগ কখনই বিজেপিকে নিতে দেওয়া যায় না, কারণ বিজেপি একটা ফ্যাসিবাদী দল, মত্ত হয়েছে ঔপনিবেশিক দখলদার শাসকের মতো একের পর একের রাজ্য দখল করতে, সংবিধান-গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করে দেশটাকে বিরোধীশূন্য প্রজাদাসত্বের হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে।