আজকের দেশব্রতী : ১৮ আগস্ট ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-18-aug-22

Conference of All India Kisan Mahasabha

সারা ভারত কিষান মহাসভার নবম রাজ্য সম্মেলন আগামী ৩০-৩১ আগস্ট নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনে অনুষ্ঠিত হবে। শুরুতে ৩০ আগস্ট এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিষয় – ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের ৭৫ বছর এবং তার প্রেক্ষিতে বর্তমানে বাংলার কৃষক আন্দোলন। বিভিন্ন বামপন্থী কৃষক সংগঠন, কৃষক আন্দোলনের মঞ্চের নেতৃবৃন্দ এবং কিষাণ মহাসভার সর্বভারতীয় নেতৃত্ব এই আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখবেন। সম্মেলন স্থানের নামকরণ করা হয়েছে কৃষ্ণনগরের খাদ্য আন্দোলনের শহীদ আনন্দ হাইতের নামে। সভাগৃহ ও মঞ্চের নামকরণ হয়েছে যথাক্রমে নদীয়ার বিপ্লবী বামপন্থী নেতা বিমান বিশ্বাস ও সুবিমল সেনগুপ্তের নামে।

কৃষক সম্মেলনের মূল আওয়াজ থাকবে কৃষি-ব্যবস্থাকে দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের স্বার্থে পুনর্গঠিত করার বিরুদ্ধে কৃষকের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু ওরা কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি নীতি লাগু করে চলেছে। আর এ রাজ্যে তৃণমূল সরকার ঘুরপথে সেই একই নীতি গ্রহণ করে চলেছে। রাজ্য সরকার কৃষি থেকে সম্পূর্ণ হাত গুটিয়ে নিয়েছে, কৃষি উৎপাদনে সহায়তা করা বা কৃষি পণ্যের বিপণন প্রভৃতি সমগ্র ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতি কৃষি-উপকরণ থেকে শুরু করে কৃষি পণ্যের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো। সাম্রাজ্যবাদীরা এমনকি কৃষি-উৎপাদনকেও নিয়ন্ত্রণ করছে, কৃষি কাজের অভিমুখ পাল্টে দিচ্ছে। কৃষক আন্দোলনের মঞ্চের পক্ষ থেকে এ রাজ্যে কৃষি-পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে আইন তৈরির দাবি জানানো হয়েছিল। এ জন্য একটা খসড়া বিল তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কারণ আইন ছাড়া ফসলের দাম নির্ধারণে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। কিন্তু রাজ্য সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। এ রাজ্যে ধানের পরই প্রধান অর্থকরী ফসল আলু। এছাড়া নানাবিধ সব্জি, যার চাষাবাদ সম্প্রতি বেড়ে চলেছে, রাজ্য সরকার এ সমস্ত ফসলের সরকারি দর নির্ধারণ করে বেচাকেনা করা এবং বাজারে ন্যায্যমূল্যের দোকানের মাধ্যমে বিক্রি করার উদ্যোগ নিতে পারতো। এ জন্য ‘সুফল বাংলা’ নামক একটি সরকারি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে সীমিত করতে করতে প্রায় উঠিয়েই দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে প্রায় ২০/২৫ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে চলেছে। এ জন্য ব্লকে ব্লকে কিষাণ মান্ডি বা নিয়ন্ত্রিত বাজার তৈরি করা ও হিমঘর স্থাপন করার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তার কোনও সরকারি প্রচেষ্টা নেই। সম্প্রতি এ রাজ্যে কৃষিপণ্যের বিপণনে বেসরকারি কোম্পানিগুলির তৎপরতা বেড়ে চলেছে। যেমন বাঁকুড়া জেলা থেকে চুক্তি চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত গাজর বা কুন্দ্রী সব্জি ওরা নিয়ে যাচ্ছে আরব দেশে। অথচ এ কাজ সরকারি উদ্যোগে করা যেতে পারতো।

কৃষকের আয়বৃদ্ধির যে কল্পকথা সরকার প্রচার করে থাকে তার বাস্তবতা নিয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যা কৃষক সম্মেলনে চর্চা হবে। কৃষি পরিবারগুলির মোট আয়ের কতটা কৃষি থেকে, আর কতটা নানাবিধ পশুপালন থেকে আসছে, কিংবা পরিযায়ী হিসাবে ভিন্ন রাজ্যে বা দেশে কাজ করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের আয় থেকে আসছে! সাদা চোখে এ বিষয়টা বিবেচনা করলে সহজেই বোঝা যায় কৃষিতে আদৌ লাভ হচ্ছে না। কৃষি কাজে নিয়োজিত অত্যধিক মাত্রায় পারিবারিক শ্রমশক্তির দাম কোনোরকমে উঠছে বলা যেতে পারে।

বর্তমানে পরিবর্তিত কৃষি উৎপাদনের প্রেক্ষিতে কৃষি উপকরণের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের সংকট বিরাট মাত্রায় বেড়ে গেছে। চাষের ধরন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে খরচ বড় আকারে বেড়ে গেছে। যেমন বৃষ্টিপাতের অভাবে পাট চাষে জল কিনে পাট ভেজাতে হচ্ছে, আগের তুলনায় সারের ব্যাবহার বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। অন্যান্য চাষাবাদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু রাজ্য সরকার সমবায়ের মাধ্যমে স্বল্প দামে সার বীজ সরবরাহ করে, বিশেষত গরিব মাঝারি চাষিদের কিছুটা সুরাহা করতে পারতো। কিন্তু এ সমস্ত কিছুই এখন প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাদী চাষে প্রয়োজনীয় উপাদান পুঁজি। গরিব মধ্য চাষিদের বিনা সুদে বা নামমাত্র সূদে কৃষিঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা আগে কিছু মাত্রায় হলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ। কৃষি সমবায়গুলির কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই, সেগুলি সীমাহীন দুর্নীতির আখরা হয়ে উঠেছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এ রাজ্যে কোটি কোটি টাকার সমবায় দুর্নীতি ধরা পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা মজুত রয়েছে। সারের চোরাকারবার একেবারে প্রকাশ্যে চলছে। খোলা বাজারে এমআরপি বা ছাপানো দামের থেকে ২০০/২৫০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। সরকারি মদতেই এসব ঘটে চলেছে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে তৃণমূল সরকারের আদৌ কোনো পরিকল্পনা নেই। ভূপৃষ্ঠ সেচ – জল উত্তোলন প্রকল্পগুলি অর্ধেকই বন্ধ। বিগত ১০ বছরে সেচের নতুন কোনো প্রকল্প হয়নি। এ বছর সেচের জল সরবরাহ না করার ফলে বেশ কিছু এলাকায় বোরো চাষ মার খেয়েছে। জলাধারগুলি সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ মাশুলে ভর্তুকির দাবি দীর্ঘদিন ধরে তুলে ধরা হলেও সরকার তাতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। অথচ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকার কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে।

কৃষিতে আংশিক ভূমি সংস্কার হলেও ক্ষুদ্র মধ্য চাষিরা তাদের কৃষি কাজের বিকাশে পরবর্তী আর কোনও সরকারি সহায়তা পায়নি, বরং এ ক্ষেত্রে এক উল্টোযাত্রার প্রক্রিয়া চলছে। সম্প্রতি প্রজাস্বত্বের ধরনে একটা বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে৷ ভালো পরিমানে কৃষি জমিতে চুক্তিচাষের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। কৃষি উৎপাদনে এদের শ্রমশক্তি বিরাট মাত্রায় যুক্ত অথচ এই গরিব চুক্তিচাষিদের স্বার্থ রক্ষায়, তাদের সরকারি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নে সরকারের কোনো ভাবনা নেই। এই প্রশ্নগুলি সম্মেলনে আলোচিত হবে। সম্মেলনে এক প্রস্থ দাবিসনদ তৈরি করা হবে, যেটা হয়ে উঠবে কিষাণ মহাসভার পরিচিতি। গ্রামাঞ্চলে পশুপালন, দুগ্ধ উৎপাদন, ফল ফুল প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বাগিচা চাষ, মৎস্য উৎপাদন প্রভৃতি নানাবিধ ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষ যুক্ত। এদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নগুলিও সম্মেলনে আলোচিত হবে, এদের দাবিগুলিও দাবিসনদে যুক্ত হবে। কর্পোরেটের কব্জা থেকে মুক্ত ক্ষুদ্র কৃষি অর্থনীতির বিকাশের লক্ষ্যে কৃষিনীতি প্রণয়নের দিশায় সম্মেলন এক সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে সদস্য সংগ্রহ অভিযান চলছে৷ বৃষ্টিপাতের অভাব, চাষের মরসুম শুরু হয়ে যাওয়া এসমস্ত কিছু জটিলতার মধ্যেও কর্মীরা গণসংযোগ অভিযান সংগঠিত করছেন। ব্লক স্তরে কিষান মহাসভার কাঠামো তৈরি করে সংগঠক ও কর্মীরা সম্মেলনকে সফল করে তোলার প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন।

Left wing should be strengthened

পশ্চিমবাংলায় বামপন্থার উদ্যোগ ও সক্রিয়তাকে গ্রামমুখী জোরদার করতে হবে। এটা ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেমন, তেমনি বামপন্থার সংগ্রামী মর্যাদার পুনরুত্থানের জন্যও। সংগ্রামে অবিরত থাকার আদর্শগত দৌলতেই মিলতে পারে সংগ্রামী মর্যাদা। এটা কেবল কোনও এক বিশেষ সংগঠনের জন্য নয়, সব ধরনের বাম ধারার সংগঠনের জন্যই প্রযোজ্য। দেড়-দুদশক আগে ‘কৃষি ভিত্তি, শিল্প ভবিষ্যৎ’ বলে কার্যত কৃষির গুরুত্বকে অতীত করে দেওয়া হয়েছিল, কৃষিজমি কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার ‘সরকারি বামপন্থা’-র দাপট দেখাতে যাওয়া হয়েছিল। ঐ মারাত্মক ভুল পথের ওকালতি করা হয়েছিল এই বলে যে, কিছু ‘ডোল’ দেওয়া ছাড়া কৃষিকে কেন্দ্র করে কৃষক জীবনের স্বার্থে আর নাকি কিছুই করার নেই! আর তার প্রতিক্রিয়ায় কৃষক বিদ্রোহের ঝড়ে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে যায়। শুধু তাই নয়, তারপর থেকে গ্রামবাংলায় বড় পরিধিতেই বামপন্থার মাটিতে ধ্বস নামে, মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হয়। সেই জমির দখল প্রধানত পায় টিএমসি। কিছু পর থেকে কিছু কিছু পেতে থাকে বিজেপিও ।

পক্ষান্তরে, লাল পুনরুত্থানের এক মরীয়া চেষ্টা চালানো হয়েছিল সশস্ত্র এ্যাকশনকে ভিত্তি করে। অধিবাসী জনতার জীবন-জীবিকার অধিকার ও জ্বলন্ত বিষয়গুলো নিয়ে লড়াই করার গুরুত্বকে মনে করা হয়েছিল তুচ্ছ। সেই দুঃসাহসিকতাবাদও বিরাট দমনের সামনে জনগণ থেকে ব্যাপক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে ধাক্কা খেয়েছে। সেইসব জায়গাও চলে গেছে কোথাও টিএমসি, কোথাও বিজেপির প্রভাবে।

গ্রামবাংলায় লাল ঝান্ডার যা কিছু ভাবমূর্তি রয়েছে সেটা কৃষি ও কৃষকের ইস্যুগুলি নিয়ে সংগ্রামী বামধারার। কিন্তু এই ধারার সামাজিক ভিত্তি এখনও খুবই সীমিত, দুর্বল, থাকছে অঞ্চল বা এলাকা ভিত্তিক। এর বিষয়ীগত প্রয়াস চালানোর প্রশ্নে বড় মাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন বা পুনর্বিন্যাস সংগঠিত করা দরকার। চিন্তাশীল প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোগ ও সমবেত প্রত্যাঘাত সংগঠিত করার সমন্বয় গড়ে তোলা দরকার। স্বাধীন একক উদ্যম ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে যুক্ত উদ্যোগ – সবই চলতে পারে, চলুক আর পাঁচটা ফ্রন্টে। যেখানেই অন্যায়, অবিচার, আক্রমণ – সেখানেই প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগঠিত হোক। কর্মপ্রার্থী শিক্ষকদের সমর্থনে জনপথে কনভেনশন, স্বাধীনতা দিবসে মানববন্ধন, যুদ্ধবিরোধী দিবসে শান্তিমিছিল – সবই ঐকান্তিকভাবে হোক। কিন্তু প্রধান রণভূমি হল গ্রামবাংলা, সেখানে ঝাঁপাতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে। উত্তর ভারতের ২০২০-২১-এর বছরব্যাপী কৃষক আন্দোলনের খবর এখানকার গ্রামাঞ্চলে পৌঁছেছে। এখানে অধিকাংশ বাম দলের কৃষক সংগঠন আছে। উত্তরের আদলে এখানেও কৃষক সংগঠনগুলির সংগ্রামের ভিত্তিতে একতার মঞ্চ গঠন হয়েছে। প্রতিটি কৃষক সংগঠন স্বাধীন ভূমিকা নিতে পারে। কেন্দ্র-রাজ্যের উভয় শাসকের কৃষি ও অন্যান্য সংস্কারনীতি ও প্রকল্পে হস্তক্ষেপ করা, সেসবের স্বরূপ উন্মোচন করা ও তা থেকে সূত্রায়িত দাবি নিয়ে হকের আন্দোলন গড়ে তোলার ইস্যুর অভাব নেই। কেন্দ্রের মোদী সরকারের ‘কৃষক সম্মাননা’ আর রাজ্যের মমতা সরকারের ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের ঢাক পিটিয়ে বিজেপি এবং টিএমসি গ্রামীণ রাজনীতিতে খেয়োখেয়ি চালাচ্ছে। ফলে বামপন্থীদের সামনে পরিস্থিতি প্রতিকূল, সন্ত্রাসময়, পরিসর সম্প্রসারণ করা কঠিন। তবু এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিস্থিতিতে যুঝেই যা করার করতে নাছোড় হতে হবে। সেইমতো বামপন্থী চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লেগে পড়তে হবে। এরকম কমজোরী অবস্থা থেকে গতিশীল পরিকল্পিত গণসম্পর্কের অনুশীলন, সংগঠন ও আন্দোলনের ধারায় গ্রামবাংলায় বামপন্থার আত্মঘোষণা করতে হবে।

India at 75

৭৫ তম স্বাধীনতা বার্ষিকীর দু’দিন আগে ভারত আরেকবার দেখে নিল জাতের নিপীড়ন কী ভয়ঙ্করভাবে ঘটমান বাস্তবতা। ইন্দ্র মেঘওয়াল, রাজস্থানের জলোর জেলার সুরানা গ্রামের ‘ডালি’ সম্প্রদায়ের ৯ বছরের বালক। স্কুলে উঁচু জাতের জন‍্য সংরক্ষিত কুঁজো থেকে জল খাওয়ায় গত ২০ জুলাই শিক্ষক তাকে নির্মমভাবে পিটিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে মারা গেল সেই আঘাতে। স্কুলটা হল সরস্বতী শিক্ষামন্দির। দেশ জুড়ে আরএসএস যে স্কুল নেটওয়ার্ক চালায় সেই স্কুল। একই দিনে উড়িষ‍্যার নবরংপুর জেলায় আদিবাসী গ্রামে ভয়ানক হামলা নেমে আসার খবর ভেসে এল। বনের জমি বাঁচানোর নামে বেশ কিছু আদিবাসী পরিবারের মাথা গোঁজার আশ্রয় জ্বালিয়ে দেওয়া হল আর তাঁদের জমির ফসল নষ্ট করে দেওয়া হল। ইউপির সিতাপুর জেলার হরগাঁওয়ের সিপিআই(এমএল) নেতা তথা জেলা পরিষদ সদস‍্য অর্জুন লালকে স্থানীয় থানা লকাপে চরম অত‍্যাচারের শিকার হতে হল কারণ তিনি তাঁর জেলা পরিষদ ক্ষেত্রে ঘটা এক দলিত নিপীড়নের ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করতে থানায় গেছিলেন। হরিয়ানা থেকে এল গরিব মানুষ তিরঙ্গা কিনতে না পারায় তাদের রেশন দিতে অস্বীকার করার ভিডিও।

১৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি যখন স্বাধীনতা দিবসের নিয়ম মাফিক বক্তব‍্য রাখছিলেন, দীর্ঘ ৮০ মিনিটের বক্তব‍্য, ভারতের নারীশক্তির কথা বড় মুখ করে বলছিলেন, তখন নির্বাচনাসন্ন গুজরাটের বিজেপি সরকার ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকে মুক্ত করে দিল যারা আজীবন কারাদণ্ডের সাজা পেয়েছিল ২০০২ সালের গোধরা পরবর্তী গণহত‍্যার সময় বিলকিস বানোকে নৃশংসভাবে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও বিলকিসের সদ‍্যজাত শিশু সন্তানটি সহ পরিবারের সাতজনকে হত‍্যা করার অপরাধে। ধর্ষণ আর খুনের সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি ও সংবর্ধনা দিচ্ছে, আর মানবাধিকার প্রচারক লেখক ও গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীদের বছরের পর বছর জেলে পচিয়ে মারছে এবং সারা দেশে প্রত‍্যহ আরও বেশি বেশি করে এই ধরনের মানুষদের দোষারোপ করে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক নাগরিকেরা তাই ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা বার্ষিকীকে কোনও উৎসবে পর্যবসিত করে ফেলতে দেয়নি। বরং স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াকু ঐতিহ‍্য ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শপথ নিয়েছে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার, যেমন ভারতের কল্পনা ব‍্যক্ত হয়েছে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায়।

৭৫তম বার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে বিহার এক বড় ধরনের রাজনৈতিক পুনর্বিন‍্যাস দেখল গত ৯ আগস্ট, ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৮০ তম বার্ষিকীতে। নীতীশ কুমার আরেকবার বিজেপির সংসর্গ ত‍্যাগ করে আরজেডি ও মহাগঠবন্ধনের সাথে হাত মেলালেন এবং বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে অপসারন ও একটি অ-বিজেপি সরকার গড়ায় নেতৃত্ব দিলেন। বিহার এইভাবে বিজেপির সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আগ্রাসী ‘অপারেশন পদ্ম’ অভিযানকে প্রতিহত করে দিল। এবং সম্প্রতি মোদি-শা মহারাষ্ট্রে শিবসেনার বহুসংখ‍্যক বিধায়ককে ভাঙিয়ে নেওয়ার মধ‍্যে দিয়ে যা লাভ করেছিল তাকে ঘুরিয়ে দিল বিহার। বিজেপি ও জেডিইউ'র মধ‍্যে টানাপোড়েন বেশ কিছুদিন ধরেই বেড়ে চলেছিল। গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে ইউপি নির্বাচনে বিজেপির জয়ের পর ইউপির অনুকরণে বিহারেও বুলডোজার রাজ চালানো হবে বলে প্রকাশ‍্য চেচামেচি শোনা যাচ্ছিল এবং বেশ কিছু বিজেপি নেতাকে বিহারের সম্ভাব‍্য মুখ‍্যমন্ত্রী হিসেবে আলাদা রকমভাবে দেখা হচ্ছিল। বিধানসভার ভেতরে মুখ‍্যমন্ত্রী ও স্পীকারের বাগবিতণ্ডাও ঘটে যায় এবং ৩০-৩১ জুলাই পাটনায় বিজেপির মহা সভা চলাকালীন পার্টি-প্রেসিডেন্ট জেপি নাড্ডা এতদূর অবধি বলে বসেন যে আঞ্চলিক দলগুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পথে এবং খুব দ্রুতই দেশে একমাত্র বিজেপি দলটিই থাকবে। বিজেপির বুলডোজার রাজ ও দেশে একদলীয় শাসন কায়েমের ছকের বিরুদ্ধে বিহার প্রতিরোধ খাড়া করতে পেরেছে।

ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার রাগে বিজেপি অবশ‍্যই এখন সব ধরণের কলাকৌশল চালাবে নতুন সরকারকে নড়বড়ে করে দিতে। ওরা নিশ্চয় ওদের ঘৃণা, হিংসা আর মিথ‍্যাচারের অভিযান জোরালো করতে চাইবে বিহারের বুকে। তাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। মহামারী ও লকডাউনের ভয়ানক ক্ষতি এখনও বিহার সামলে উঠতে পারেনি। ঘৃণাপরাধ বাড়ছে। গরিব মানুষেরা নিজেদের বাড়িঘর ও জমিজায়গা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ক্রমবর্ধমান বিপদের মুখে রয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ‍্যসেবা বহুলাংশে বেসরকারি ও ভীষণ মাত্রায় ব‍্যয়বহল হয়ে পড়েছে। আর প্রতিশ্রুত ১৯ লক্ষ চাকরিও কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বাস্তব কিছু সুফল ফলাতে হলে নতুন সরকারকে দৃঢ়তা ও দূরদর্শীতার সাথে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করতে হবে। সেই লক্ষ‍্যে এক অভিন্ন ন‍্যুনতম কর্মসূচি গ্রহণের মাধ‍্যমে নতুন ব‍্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, পরামর্শ ও তদারকির ব‍্যবস্থার জন‍্য সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে, এবং শাসনকে ঢেলে সাজাতে এক বিস্তৃততর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জরুরি ভিত্তিতে খাড়া করা দরকার যার মধ‍্যে বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন গঠনও থাকবে। সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন ও যথাযথ সহযোগিতা করতে এবং বিজেপির বুলডোজার থেকে সারা ভারতকে মুক্ত করার লক্ষ‍্যে গণআন্দোলন ও প্রতিরোধের শক্তিঘর হিসেবে বিহারের ভূমিকাকে পরিবর্ধিত করতে সিপিআইএমএল এবং অন‍্যান‍্য বামপন্থী পার্টিগুলি এই নতুন প্রেক্ষিতে নিজেদের সর্বাত্মক ভূমিকায় বদ্ধপরিকর।

এমএল আপডেট এডিটরিয়াল, ১৭ আগস্ট ২০২২

Must Answer

১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে, ৭ জন মুসলমানকে হত্যা এবং গর্ভবতী বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া ১১ জন ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে, কারণ গুজরাট সরকার তাদের সাজা মাফ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম বিরোধী গণহত্যার সময় উক্ত অপরাধ সংগঠিত হয় (এই সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল ছিল)। ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট দিনটিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের “অমৃত কাল” বলে উদযাপন করতে বলছে। এই দিনে উক্ত অপরাধীদের মুক্ত করার জন্য গুজরাট সরকারের সিদ্ধান্তের ভিত্তি কী? ক্ষমা ও মুক্তি কি মুসলমানদের ধর্ষণ ও হত্যার পুরস্কার? এই ভিত্তিতেই কী ২০০২ সালের গণহত্যায় নিহত বা ধর্ষিত মুসলমানদের বিচারের জন্য লড়াই করা নারীদের একজন, তিস্তা শীতলবাদকে কেন কারাগারে বন্দী করা হলো? কারণ, তিনি জাকিয়া জাফরিকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে সাহায্য করেছিলেন এবং সেদিনের সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র পুলিশকে দোষী প্রমাণ করার আশা করেছিলেন যারা ক্ষমতার লোভে নিজেদের দায়িত্ব বর্জন করে গণহত্যা সংগঠিত করতে সহযোগিতা করেছিল। সাম্প্রদায়িক খুনি এবং ধর্ষকদের শাস্তি দেওয়া আজকের ভারতে সর্বোপরি একটি স্খালন, নিয়ম নয়। সাম্প্রদায়িক খুনি ও ধর্ষকদের সাজা মাফ করা এবং গলায় মালা পরিয়ে তাদের মুক্তি উদযাপন করা, ধর্ষক আর গুন্ডারাজের শাসন জারি করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কী! আজকে হিন্দু-আধিপত্যবাদীদের কাছে প্রকাশ্যে মুসলিমদের গণহত্যা ও ধর্ষণের ডাক দেওয়ার ব্যাপারটা জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরণের অপরাধমূলক কাজের জন্য সরকার বা আইনের হাতে শাস্তিমূলক পরিণতির সম্ভাবনা আজকের দিনে বিরল। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্ত করার সিদ্ধান্ত এই ধরনের পুরুষ এবং তাদের চ্যালাদের সাম্প্রদায়িক উদ্দ্যেশ্য প্রণোদিত অপরাধ করতে আরো উৎসাহিত করবে।
ভারতে, “গোদি মিডিয়া” সঞ্চালকরা (মোদী সরকার এবং বিজেপির পক্ষে প্রচারকারী) নারীবাদী কর্মী এবং নারী আন্দোলনের সংগঠনগুলিকে “ধর্ষকদের প্রতি নরম” বলে অভিযুক্ত করে থাকে, কারণ আমরা ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করি। এই ক্ষেত্রে, বিলকিস নিজেই বলেছিলেন যে তিনি মৃত্যুদণ্ড দাবি করবেন না, কারো তিনি নীতিগতভাবে মৃত্যুদন্ডকে ধর্ষণের সমাধান বলে মনে করেন না। আজ যখন বিলকিসের গণধর্ষণকারীরা মাত্র কয়েক বছর জেল খাটার পর মুক্তি পাচ্ছে, এমনকি তাদের যাবজ্জীবন সাজাও হচ্ছে না, গোদী-মিডিয়ার সঞ্চালকদের মুখে ণতালা কেন? কেন তারা বিলকিসের ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে না? প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কী মন্তব্য করার ফুরসৎ পাবে কি? আমাদের কি এটা বিশ্বাস করতে হবে যে বিজেপির এই দুই শীর্ষ নেতার ইন্ধন ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে?

#IndiaAt75 ভারতের মেয়েদের জন্য চরম হতাশার দিন হয়ে উঠেছে, কারণ ক্ষমতাসীন বিজেপি এই দিনটিকে বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্ত করার দিন হিসাবে বেছে নিয়েছে।

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি
রতি রাও, সভাপতি,
মীনা তিওয়ারি, সাধারণ সম্পাদক,
কবিতা কৃষ্ণান, সম্পাদক

Salman Rushdie

সলমন রুশদির ওপর আঘাত এল। এই আঘাত আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিলো যে সমস্ত বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান ও ক্রমবর্ধমান ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে আমাদের আরো জোরের সঙ্গে লড়াই চালাতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক সভায় তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। সেখানেই তিনি ভয়াবহভাবে আততাতীর হাতে আক্রান্ত হন। আমরা এই বর্বর আক্রমণের তীব্র নিন্দা করি, তাঁর দ্রুত ও সম্পূর্ণ নিরাময় কামনা করি।

গত তিনদশক জুড়েই ধারাবাহিকভাবে রুশদিকে মেরে ফেলার হুমকি ছিল। তাঁর বিভিন্ন অনুবাদক ও প্রকাশকদের ওপরেও ছিল একই রকম হুমকি। নরওয়ে, ইতালি, জাপান প্রভৃতি জায়গায় তাঁরা বিভিন্ন সময়ে আক্রান্তও হয়েছেন। জাপানি অনুবাদক হিতোশি ইগারাশি এই ধরনের আক্রমণে মৃত্যুবরণও করেছেন। এইসব কথা মাথায় রেখে যে ধরনের নিরাপত্তা রুশদির জন্য দরকার ছিল, তা এই সভায় না থাকাও এক উৎকন্ঠার বিষয়।

ইরানের আয়াতোল্লা ইসলামকে রক্ষার নামে রুশদির ওপরে ফতোয়া জারি করেন। শুধু রুশদির জন্যই নয়, ফতোয়া সম্প্রসারিত হয়েছিল তাঁর বইয়ের অনুবাদক প্রকাশকদের জন্যও। ভারতেও গৌরী লঙ্কেশ, পানসারে, দাভোলকর, কালবুর্গির মতো মানুষদের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দু ধর্মকে রক্ষার নামে খুন হতে দেখেছি আমরা। এই সমস্ত খুনি ও হামলাকারীদের কঠোর শাস্তি দরকার। দরকার তাদের উষ্কানিদাতাদের শাস্তিও, যে উষ্কানিদাতারা ধর্ম রক্ষার নামে মানুষকে সন্ত্রাসবাদী হওয়ার পথ বেছে নিতে বলছে।

বিশ্বের নানা দেশের মধ্যে ভারতই প্রথম স্যাটানিক ভার্সেসকে নিষিদ্ধ করেছিল। এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করা দরকার। রুশদীর ওপর আক্রমণের ঘটনা থেকে যেন ইসলামোফোবিয়া না ছড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে রুশদি সাহসের সঙ্গে সমস্ত ধরনের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেই বলেছেন, বলেছেন ভারতের হিন্দু আধিপত্যবাদী ফ্যাসিবাদ নিয়েও।

- সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন্দ্রীয় টিম

75th year of independence

১৫ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে রাজ্যের জেলায় জেলায় অঞ্চলে অঞ্চলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান “আমরা ভারতের জনগণ, আমাদের একটাই লক্ষ্য – আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে রক্ষা করা” পাঠ করে শোনানো হয়। দিবসের শপথ নেওয়ার বিষয়গুলি শ্লোগান আকারে তুলে ধরা হয়। প্রদর্শিত করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতিকৃতি, জাতীয় পতাকা সহ লাল পতাকা। পার্টির রাজ্য সম্পাদক জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন শিলিগুড়ির কর্মসূচিতে। পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল ছিলেন কলকাতার বেলেঘাটায় গান্ধী ভবনের সামনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বাম দলগুলির যুক্ত কর্মসূচিতে। এদিন পার্টি কর্মীরা পার্টি পরিসরের বাইরে গিয়েও স্বাধীনতা ৭৫ উদযাপনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। যেমন, উত্তর ২৪ পরগণার একটি গ্রামীণ এলাকায় সংখ্যালঘু মেয়েদের নিয়ে নাচ-গান-আবৃত্তি-ভাষ্যে স্বাধীনতার বাণী প্রচার করা হয়।

​independence the program siliguri

এদিন এক আলোচনা সভা আয়োজিত হয় পার্টির বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে সংগঠনের জেলা অফিসে। দু’টি বিষয়ে, স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের ও বামেদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শতাব্দী দাশ ও পার্থ ঘোষ (পার্টি পলিটব্যুরোর সদস্য)। সঙ্গীত পরিবেশন করেন অয়ন্তিকা ও সায়ন, আবৃত্তি পরিবেশন করেন সৌমী কুণ্ডু।

শতাব্দী দাশ তাঁর মনোগ্রাহী বক্তব্যের শুরুতেই প্রশ্ন রাখেন, অসংখ্য নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীকে বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রশাসন কীভাবে দেখতো। কারণ তাঁরা অনেকেই সাম্রাজ্যবাদী শাসন উৎখাত করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আজ মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, তিস্তা শেতলবাদ দেশদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রতিবাদী ছাত্রী ও গবেষক নাতাশা, দেবাঙ্গনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে আটক করা হয়েছিল। এরা কিন্তু নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে ছিলেন। আজ যদি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তরা থাকতেন, তাদের কি সন্ত্রাসবাদী বলা হোত? স্বাধীনতা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণে বাধা এসেছিল – নারীরা যুক্ত হলে পুরুষদের মনসংযোগে নাকি বিঘ্ন ঘটবে। এমনকি ডান্ডী অভিযানে গান্ধীজীও মহিলাদের নিতে চাননি। তাঁর মনে হয়েছিল বৃটিশ রাজশক্তি ভাববে আন্দোলনকারীরা মহিলাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে।

শতাব্দী সশস্ত্র ও অহিংস, আদিবাসী ও মুসলিম বীরাঙ্গনাদের দুর্বার সংগ্রাম, অনন্য সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভার কথা তুলে ধরেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, কল্যাণী দাস, বীণা দাস, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ইলা সেন, সুলতা কর, কমলা দাশগুপ্ত ... বহু মহিলা আন্দোলন যোগ দেন। অরুণা আসফ আলী ৯ আগস্ট বোম্বাই (মুম্বাই) গোয়ালিয়র ট্যাঙ্ক ময়দানে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার তাকে জেলে যেতে হয়েছে। ননীবালা দেবী, দুকড়ি বালা দেবী, মাতঙ্গিনী, সরোজনী নাইডু সহ আর মাত্র কয়েকজনের নামই ইতিহাস বইয়ে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ইউরোপিয়য়ান ক্লাবের সামনে লেখা থাকত ‘কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। সেখানে বিপ্লবীরা সশস্ত্র অভিযান চালালে পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলেছিল। পুরুষসঙ্গীদের বার করে দিয়ে সাইনাইড খেয়ে মাত্র একুশবছর বয়সে শহীদ হয়েছিলেন প্রীতিলতা।

বহু মুসলমান মহিলাও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেন। বেগম হজরত মহল, মুহাম্মদী খনম, কানপুরের গণিকা আজিজুন বাঈ, বি আম্মা প্রমুখ। আদিবাসী বিপ্লবী মহিলা কুইলি, ভেলু নাছিয়া, লক্ষ্মী বাঈয়ের সহকারী ঝনকারী বাঈ, মন্দিরা, সুন্দর বৌ, মুন্ডারি বাঈ, মতি বাঈ এরা পুরুষ বিপ্লবীদের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না।

ব্রিটিশ পুলিশ মহিলা বিপ্লবীদের উপর থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করতো। যৌন নির্যাতন, মলদ্বারে রুল ভরে দেওয়া, চোখে পিন ফুটিয়ে দেওয়া, আঙ্গুলের নখ তুলে দেওয়ার মতো অমানুষিক নির্যাতন চালানো হত। বিপ্লবী বীরাঙ্গনারা তা সহ্য করেছেন কিন্তু কখনও নতি স্বীকার করেননি।

independence the program was held

শতাব্দী আক্ষেপের সুরে বলেন, বেশিরভাগ নারী বিপ্লবী উপেক্ষিত থেকে গেছেন, হয়তো নারী, মুসলমান বা গণিকা বলে। বাদ গেছেন দলিত, আদিবাসী নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। তাঁদের অতুলনীয় দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাও মহিলা লেখিকাদের কলম থেকেই। ইদানীং অবশ্য নতুন করে নারী বিপ্লবীদের নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে।

পার্থ ঘোষ বলেন, আর এস এস ও কমিউনিস্ট পার্টি – উভয়েরই জন্ম ১৯২৫ সালে। আর এস এস জন্মলগ্নেই ঘোষণা করল হিন্দুদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়ে শক্তিক্ষয় করা উচিত হবে না। বরং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। কিন্তু কমিউনিস্টরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ সরকার ‘কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র’ মামলায় মোট আটজন কমিউনিস্ট নেতাকে অভিযুক্ত করে। তাদের মধ্যে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, মুজফ্‌ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্ত, গুলাম হোসেন, সিঙ্গারাভেল্লু, শওকত ওসমানি, আর এল শর্মা। এঁদের দীর্ঘদিনের কারাবাস হয়। বিপরীতে আরএসএস ব্রিটিশের দালালি করেছে, মুচলেকা দিয়েছে। এরপর তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলেন, মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসন দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রকে হত্যা করছে। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন পার্টির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য সৌভিক ঘোষাল।

(ঋণ স্বীকার ‘অন্য স্বর’)

Kashipur-Baranagar massacre

১৯৭১ সালের ১২-১৩ আগস্ট কাশীপুর বরানগরে তৎকালীন কংগ্রেসী গুন্ডারা এক নির্মম গণহত্যা সংগঠিত করেছিল। নকশালপন্থী রাজনীতি করার অপরাধে শতাধিক যুবক ও তরুণকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে এই রাজ্যে সিদ্ধার্থ রায়ের নেতৃত্বে এক কেয়ারটেকার মন্ত্রীসভা ছিল। বিপ্লবী রাজনীতিকে শেষ করার জন্য এই ঘৃন্যতম হত্যালীলা সংগঠিত হয়েছিল। এত বড় গণহত্যার আজও কোনও বিচার হয়নি। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের শাসনকালে কোন বিচার করেনি। ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জি সরকার ক্ষমতায় এসে ডি পি সেনগুপ্ত কমিশন তৈরি করে। সমস্ত সাক্ষ্য সহ কমিশন রিপোর্ট জমা দিলেও তা আজও বর্তমান সরকার প্রকাশ করেনি। এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা চলেছে বহুভাবে। প্রতিবেশি বাংলাদেশে আজও একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করে সাজা দেওয়া হয়। কিন্তু এপার বাংলায় সেটা করা হয় না।

গত ১৩ আগস্ট কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার বিচারের দাবির পুনর্ঘোষণা করে সিঁথির মোড়ে শহীদ বেদীর সামনে শ্রদ্ধা জানানো হয়। মাল্যদান করে পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল সহ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শহীদদের স্মৃতিতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার।

in Dhaniakhali block

থানায় বিক্ষোভ ডেপুটেশন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের

ধনেখালি থানার পার্শ্ববর্তী যদুপুর মৌজায় দরিদ্র আদিবাসী বর্গাদার পরিবার সিদ্ধেশ্বর মুর্মু, রাসমনি মুর্মুদের উপর অত্যাচার চলছে। এই আদিবাসী পরিবারটি প্রবাসী জমিদার মৃত যামিনী মুখোপাধ্যায়ের যদুপুর মৌজার জমি বর্গাদার হিসাবে দীর্ঘ ৬০/৭০ বছর চাষাবাদ করে চলেছেন। এঁদের পিতা মৃত গোবর্ধন মুর্মুর নামে জমিটি ভূমি দপ্তরে নথিভুক্ত। বরাবর যেভাবে চাষাবাদ করেন সেভাবেই এই বর্ষার শুরুতেই রাসমনিরা ঐ জমিতে ধানের চারা বপন করেন। গত ৩ আগস্ট সকালে রাসমনিরা দেখেন তাঁদের চাষ করা ঐ জমিতে পাশের গ্রামের প্রোমোটার মিলন আলি ও তার দলবল ট্রাক্টর দিয়ে রোয়া ধান নষ্ট করে দিচ্ছে। রাসমনিরা দৌড়ে জমিতে নেমে বাধা দিতে গেলে তাঁদের অশ্লীল ভাষায় জাত তুলে গালিগালাজ করে ওরা। রাসমনির গায়ে হাত তোলে। এরপরেও রাসমনি ফসল রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠলে তার উপর ট্রাক্টর চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ওই দুষ্কৃতীরা। রাসমণি কোনক্রমে প্রাণ বাঁচান। ঐ অবস্থায় নিরুপায় রাসমনিরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাতর আবেদন নিয়ে কাদা মাখা, আহত অবস্থায় ছুটে আসেন পার্শ্ববর্তী ধনেখালি থানায়, জমির ফসল সহ আইন রক্ষার আবেদন করেন।

এই ঘটনায় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে রাসমনি তাঁদের চাষ করা জমির ফসল নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ করেন। রাসমনিকে অশ্লীল ভাষায় এবং জাত তুলে গালিগালাজ করার অভিযোগ করেন। তাঁর উপর দিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার উল্লেখ করেন। তাঁকে মারধর করা, তাঁর গায়ে হাত তোলার অভিযোগ করেন।

Attempts to grab the land

এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ধনেখালি থানা একটি জিডিই করে। কিন্তু আদিবাসী কৃষক মহিলার গুরুতর অভিযোগগুলি সত্ত্বেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন না করে, ঐ সময়ে দায়িত্বে থাকা অফিসার উল্টে রাসমনিকে বোঝাতে থাকেন যে ঐ জমিতে রাসমনির চাষ করার অধিকার নেই। কোনও এফআইআর হয় না। পুলিশ ঘটনাস্থলেও যায় না। অভিযুক্তদের আইনি হেফাজতে আনা হয় না। এরপর রাসমণিরা বিএল অ্যান্ড এলআরও-তে অভিযোগ জানান এবং ধনেখালি গ্রামীণ হসপিটালে চিকিৎসা করান। পরদিন রাসমনি চুঁচুড়া আদালত থেকে তাঁর জমিতে আইন রক্ষায় আদালতের নির্দেশ নিয়ে আসেন। এরপরও ঐ প্রোমোটারের দলবল রাস্তাঘাটে রাসমনিকে অশ্লীল গালিগালাজ করছে, হুমকি দিচ্ছে।

গত ১২ আগস্ট ধনেখালি থানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত করে পার্টির ধনেখালি লোকাল সম্পাদক সজল দে ও রাজ্য কমিটি সদস্য সজল অধিকারির স্বাক্ষরিত ডেপুটেশনে সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরা হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়,

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন চলছে। এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় পুলিশ প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বলছেন। বিপরীতে, দীর্ঘ কয়েক দশক নিরুপদ্রবে চাষ করে আসা ধনেখালির আদিবাসী বর্গাদার পরিবারটি উচ্ছেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনও কার্যকর পুলিশী সহায়তা পেলেন না। শুধুমাত্র রাসমনিরা নন, ঐ যদুপুর মৌজায় অনুপস্থিত জমিদার মৃত যামিনী মুখোপাধ্যায়ের জমিতে কয়েক দশক চাষাবাদ করা অসংখ্য আদিবাসী বর্গাদার উচ্ছেদের আশংকায় দিন কাটাচ্ছেন। পার্টি তাঁদের পাশে সর্বশক্তি নিয়ে থাকবে।

Kawakhali-Porajhar Bhumi Raksha Committee

শিলিগুড়ি সংলগ্ন কাওয়াখালি-পোড়াঝাড় এবং তিস্তা-মহানন্দা সেচ এলাকার ভূমিহারা কৃষকেরা দীর্ঘদিন লড়ছেন উচ্ছেদের বিরুদ্ধে, জমি ফিরিয়ে দেওয়ার ও ন্যায্য পুনর্বাসনের দাবিতে। এই দুই এলাকায় গড়ে ওঠা দুটি ভূমি রক্ষা কমিটির যৌথ উদ্যোগে গত ১৭ আগস্ট শিলিগুড়ি মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে শান্তিপূর্ণ আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ ও প্রশাসনিক দপ্তরগুলিকে অনেক আগেই চিঠি দিয়ে জানানো ছিল। এতৎসত্ত্বেও, শহরের কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের ক্যান্টিনের সামনে থেকে মিছিল সংঘটিত করার জমায়েত থেকে মিছিল শুরুর আগেই হুমকি ও বলপ্রয়োগ করে পুলিশ ভূমি রক্ষা কমিটির বিভিন্ন নেতা সহ শতাধিক কৃষককে গ্রেপ্তার করে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বিবৃতি দিয়ে টিএমসি সরকারের পুলিশ বাহিনীর এই অযাচিত ও গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের তীব্র নিন্দা জানান এবং গ্রেপ্তারকৃত আন্দোলনকারীদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। জমি হস্তান্তর সম্পর্কিত দুর্নীতি, তোলাবাজি, উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সমস্ত স্তরের নাগরিকদের সোচ্চার হতে আহ্বান জানিয়েছেন অভিজিৎ মজুমদার।

 in Bishnupur municipality

বিষ্ণুপুর পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের বেশিরভাগ অংশটাই বস্তি অঞ্চল। ৬-৭ বছর আগে থেকে সরকারি বাড়ির জন্য কাগজ বহুবার জমা নেওয়া হলেও এখনো পর্যন্ত অধিকাংশ বাড়িই কাঁচা। কোনো বাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়েছে, আবার কোনো বাড়ির ভিতরে জল ঢুকে যাচ্ছে। ফলে বাড়ির ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা থেকে শুরু করে রান্নবান্না এবং নিত্যব্যবহারিক অন্যান্য দিকগুলি সমস্যার মুখে পড়ছে। গত ৫ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে মহকুমা শাসকের দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। পরবর্তীতে পাড়ার সাধারণ মানুষের উদ্যোগে ত্রিপলের প্রয়োজন, এমন বেশকিছু পরিবারের নাম তালিকাভুক্ত করে গত ১৫ আগস্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে জমা করলে তিনি জানান, ওয়ার্ডে ত্রিপল বিলিবন্টন হয়ে গেছে। অথচ তালিকাভুক্ত কোনো ব্যাক্তির কাছেই ত্রিপল পৌঁছায়নি। কাউন্সিলরের কাছে সঠিক তথ্য না পেয়ে আজ ওয়ার্ডবাসীরা মিউনিসিপালিটি চেয়ারম্যানের কাছে আবার ত্রিপলের জন্য আবেদন করেন এবং ‘ত্রিপলের বিলিবণ্টনের’ নামে যে দুর্নীতি হয়েছে, তার সঠিক তদন্ত করে দোষী ব্যাক্তিদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। পৌরসভার চেয়ারম্যান আশ্বস্ত করেন যে সরজমিনে তদন্ত করে বঞ্চিত গরিব মানুষের হাতে ত্রিপল তুলে দেবেন। কিন্তু দুর্নীতির তদন্তের প্রশ্নে কোনো জবাব দেননি। ঘুরপথে প্রতিটি সরকারি প্রকল্প, তা সে আবাস যোজনা হোক কিম্বা ত্রিপল বন্টন সবই দলবাজির মধ্যে দিয়ে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। তাই আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো আশানুরূপ ফল না পাওয়া গেলে “দুর্নীতিতে তৃণমূল-বিজেপি, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই বলে প্রমানিত হবে” – দাবি করেন পার্টির নেতা এবং ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফারহান খান।

Naihati Jute Mill

১৫ আগস্ট, স্বাধীনতার ৭৫ বছর। বিসিএমএফ অন্তর্ভুক্ত নৈহাটি জুটমিলের ১১ তম শ্রমিক সম্মেনন অনুষ্ঠিত হল। শুরুতে তেরঙ্গা ও লাল ঝান্ডা উত্তোলন করা হয়। শহীদদের স্মরণ করে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করার পর, সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ ও বিসিএমএফ নেতৃবৃন্দ শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ওম প্রকাশ রাজভর, মাজাহার খান, কৃষ্ণা বেহারা, মহঃ আলি, উজ্জ্বল বেহারা, নারয়ণ দে ও নবেন্দু দাশগুপ্ত। ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত ও লোকাল কমিটি সম্পাদক দেবজ্যোতি মজুমদার। ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মী প্রদীপ দাস।

সম্মেলনে শ্রমিকদের উৎসাহ ছিল এবং নিজেরাই এলাকা লাল পতাকা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন। শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক। প্রতিটি বিভাগ থেকেই শ্রমিক প্রতিনিধি এসেছিলেন। তরুণ শ্রমিকদের উপস্থিতি ভালো ছিল। দশজন শ্রমিক কারখানার বেহাল দশা, কর্তৃপক্ষের শ্রমিকদের উপর বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের কথা তুলে ধরেন। ইউনিয়ন জোড়ালোভাবে প্রতিবাদ করতে পারছে না, এর জন্য দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন।

সম্মেলন ৩৩ জনের কার্যকরী কমিটি এবং ১৩ জনের অফিস বেয়ারা নির্বাচিত করে। নবেন্দু দাশগুপ্ত সভাপতি, সহ সভাপতি শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহম্মদ জহিম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। ইউনিয়ন ও পার্টি নেতৃবৃন্দ দেশ ও রাজ্য পরিস্থিতি তথা শিল্প পরিস্থিতি এবং শ্রমিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

village of Kadambagachi

এ গ্রামে রাস্তায় আলো নেই। জল আনতে মেয়েদের যেতে হয় নিজের গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে। এখানে নেই সার্বিক শিক্ষার মুক্তির পথ। এখানে মেয়েরা জীবনের একটি মাত্র ধরণই জানে, তা হল সর্বোপরি বিবাহ। খুশবু, প্রিয়া, সুমৈয়ারা হারিয়ে যায় অন্ধকারে।

কিন্তু তবু শহুরে ক্ষয়িষ্ণুতা ওদের পাট চাষের আবাদ জমিকে দখল করতে পারেনি এখনো। তাই হয়তো বনস্পতিই ওদের শিল্পের প্রতি উদার হতে শিখিয়েছে।

দেশ কি বা কেন সে অনেক পরের কথা, “আমি” বলে যে কিছু হয় তাই ওদের বোধ করতে দেওয়া হয়নি কখনো।

স্বাধীনতা দিবসে উত্তর ২৪ পরগণার আইপোয়ার উদ্যোগে এই গ্রামে নতুন কিছু ঘটলো। নিষিদ্ধতায় আটকে পড়া মেয়েরা প্রথমবার নাচ শিখল, গাইল গান মন খুলে। ছেলেরা আবার মেয়েদের সাথে নাচবে নাকি? এই মিথ ভেঙে কিশোর-কিশোরীরা রোকেয়া, আম্বেদকর, সাবিত্রী, ফাতিমার ছবি নিয়ে ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ নাচলো। ১০ বছরের সুমাইয়া আর নেহা নেচে উঠলো অন্নদাশংকর রায়ের বুড়ো খোকাদের ভারত ভেঙে ভাগ করার গানে। পঞ্চকের দল সব হো হো করে বেরিয়ে এসে ভাঙল অচলায়তন। গ্রামের গৃহবধূ সাবিনা খাতুন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলল স্বাধীনতা সংগ্রামে রেজিয়া, রোকেয়া, অরুনা আসফ আলির লড়াইয়ের ইতিহাস।

আইপোয়ার পক্ষ থেকে তিথি দত্ত শোনালো সাবিত্রী বাই ফুলে আর ফাতিমা শেখের গল্প, বেখৌফ আজাদী গানের সাথে নাচ করলেন স্নেহ নন্দি। আবৃত্তি করেন শোভনা নাথ। বক্তব্য রাখেন জেলা সভাপতি অর্চনা ঘটক ও নাট্যকার প্রশান্ত গাঙ্গুলি। সিপিআইএমএল পার্টির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন দিলীপ দত্ত। নৃত্য পরিচালনায় স্নেহ নন্দি ও সমগ্র অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় ছিলেন জেলা সম্পাদিকা মিতালি বিশ্বাস।

ধর্ম যখন বলছে এসব হারাম, ওরাও তখন বলছে আমরা বন্ধ নই, আমরা গাইব, নাচব, বলব যা ইচ্ছে তাই করব, আমরা বাঁধনহীন। একপাল ঝড়ের মতন দাপটে ওরা সেদিন বাঁচল, সীমাহীন আনন্দে, এই কি স্বাধীনতা নয়?

বর্তমান কালের যখন হিংসা বিদ্বেষ ও বিভেদের রাজনীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে বিজেপি-আরেসএস সরকার, তখন কালসারায় এই গ্রামে গড়ে উঠছে যৌথতার সম্প্রীতি, একত্রিত হচ্ছে মানুষ।

- স্নেহ নন্দি

massacre in Baruipur Jail

বারুইপুর সংশোধনাগারে এ মাসের গোড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চারজন বন্দীর অস্বাভাবিক ঘটনা রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের মুখে দাড় করায়। মৃত ব্যক্তিরা হলেন আব্দুর রজ্জাক দেওয়ান, জিয়াউল লস্কর, আকবর খান এবং সাইদুল মুন্সী। সকলের বয়স মধ্য তিরিশ। হাসপাতালের মর্গ থেকে বের করে দেখা যায় গায়ে প্রচুর প্রহারের দাগ। পিটিয়ে কষ্ট দিতে দিতে স্যাডিস্ট কায়দায় মেরে ফেলা হয়েছে।

মানবাধিকার আন্দোলনকারী সংগঠনগুলির চাপেও রাজ্য সরকারের সময় খারাপ যাচ্ছে বলে, জেলা অধিকর্তা নিহতদের পাঁচ লাখ করে টাকা ও পরিবার পিছু একজনকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফলে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা অবধি এগোনো বাস্তবে অধরাই থেকে যাবার সম্ভাবনা।

প্রাথমিক তদন্তে প্রতিবাদীরা জেনেছেন আসামীদের নামে বারুইপুর, বিষ্নুপুর ও মহেশতলা থানার আলাদা আলাদা ঘটনার কেসে আলিপুর ও বারুইপুর কোর্টের মারফৎ তারা বারুইপুর জেলে এসেছিলেন। এডমিনিস্ট্রেটিভ এরেস্ট। ডাকাতির প্রস্তুতির ধারা ৪৯৯ এবং ৪০২ নং। থানায় মার খেয়েও জেলে গিয়ে বাড়ির লোককে সাক্ষাৎ করার সময় তাঁরা ভালো থাকার কথাই জানান। তার কয়দিনের মধ্যেই মারা গেলেন এবং বাড়িতে খবর গেল দুদিন পর!

পর্যবেক্ষণের ফল ইঙ্গিত দিচ্ছে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সংঘ পরিবার কর্তৃক হিন্দুরাষ্টের জন্য যে ইসলাম-বিরোধী অবস্থানের “পরিশীলিত” বীভৎসতার রিহার্সাল শুরু হয়েছিল, এটা তারই তাক লাগানো আর এক কিস্তি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে ফ্যাসিস্ট শক্তি জনপ্রিয় পন্থার বাইরেও পাশাপাশি একটা ষড়যন্ত্র মূলক ভীতিপ্রদর্শনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে দিয়ে সংখ্যালঘুদের হত্যা করানোর জন্য আদিম নরভক্ষণের প্রবৃত্তিকে উস্কানি দিচ্ছে। পরিস্থিতি তাই সুশীল সমাজের দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই জঘন্য পরিকল্পনার অন্তর্জলীযাত্রা দাবি করছে।

against BSF

বিএসএফ’এর জুলুমবাজির বিরুদ্ধে ১৬ আগস্ট জলপাইগুড়ি জেলার সদর ব্লকের বেরুবাড়ি এলাকার সীমান্তের ওপারের ভারতীয় নাগরিক জনতা জলপাইগুড়ি-হলদিবাড়ি সড়ক অবরোধ করেন। অবরোধে সামিল হন ৫টি গ্রামের মানুষ। এর আগে বহুবার জেলাশাসক, মহকুমাশাসক ও পুলিশ প্রশাসনকে অভিযোগ জানালেও এই প্রশ্নে নির্লিপ্ত থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে সীমান্তের মানুষজন পথ অবরোধে নামেন। নাগরিকদের এই আন্দোলনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির সদস্য হবিবর রহমান নেতৃত্ব দেন। এই অঞ্চলের বাসিন্দা জেলা কমিটির আরেক সদস্য হিমাংশু মজুমদারও ছিলেন। জেলাশাসক সীমান্ত রক্ষী বাহিনীদের সাথে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। আগামীদিনে যদি আবার বিএসএফ অত্যাচার চালায় তাহলে সীমান্তের মানুষজন বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হবে।

Gujarat Govt orders

গুজরাট সরকার সমস্ত শিক্ষা অধিকর্তা ও স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছে ১ আগস্ট ২০২২ থেকে দেবীমাতা জ্ঞানে ‘ভারতমাতা’র প্রাত্যহিক উপাসনা শুরু করতে হবে। কেন্দ্রের মোদী সরকার স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে যে ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ পালনে উদ্যোগী হয়েছে তারই পরিবর্দ্ধিত রূপ হিসাবে নামানো হচ্ছে ‘ভারতমাতা’র আরাধনা কর্মসূচি। গুজরাট রাজ্য শিক্ষামন্ত্রক তার অধীনস্থ বিভাগীয় অধিকর্তাদের আদেশ করেছে, সমস্ত স্কুল ছাত্রদের এই কর্মসূচিতে সামিল করাতে হবে, যাতে তাদের মধ্যে ‘জাতিয়তাবাদ’এর চেতনা সৃষ্টি হতে পারে।

গুজরাটের জমিয়ত উলেমা এই নির্দেশের বিরোধিতা করেছে, দাবি করেছে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত ‘অসাংবিধানিক ও অযৌক্তিক’। তারা বলেছেন, স্বাধীনতার ৭৫ উদযাপন অবশ্যই স্বাগত, তারা এতে অংশ নিতে অসীম আগ্রহী, কিন্তু বিদ্যালয়ে ‘ভারতমাতা’র পুজার্চনা ইসলামী ধর্মমতের বিরুদ্ধে যায়, তাই গুজরাট সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক।

এবার বিষয়টা ধর্মনিরপেক্ষতার আতসকাচের নিচে ফেলে বিচার করা যাক।

গুজরাট সরকার আসলে স্বাধীনতার ৭৫ পালনের নামে আরএসএস-বিজেপি’র প্রকল্প নামাচ্ছে। মোদী সরকারের ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’এর সাথে স্বাধীনতার ৭৫ উদযাপনের কোন সম্পর্ক থাকতে পারেনা। এই দুটো ব্যাপার বরং প্রকৃত চেতনা ও ধারণাগত বিচারে পরস্পর বিপরীত প্রবাহের। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সাহসের সাথে আত্মবলিদান করতে দেশমাতৃকার বা মাতৃভূমির নামে শপথ নেওয়ার একটা ধারা গড়ে উঠেছিল। তা উদ্বুদ্ধ করত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার দেশচেতনায়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখে কখনই ‘ভারতমাতা’র নামে কোনও ধ্বনি শোনা যায়নি। ‘ভারতমাতা’র উদগাতা হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেপি। সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতরাষ্ট্রকে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকেই উগরে দেওয়া হচ্ছে ‘ভারতমাতা’র গরল। এই ‘ভারতমাতা’র নামে বিশবছর আগে সংগঠিত করা হয়েছিল গুজরাট সাম্প্রদায়িক গণহত্যা। আজও এই শ্লোগানে সংঘটিত হয় হিন্দুত্বের বিদ্বেষ-বিভাজনের উলঙ্গ উৎপীড়ন, সংখ্যালঘুদের বধ্যভূমি। এই বিষবাস্পে যে জাতিয়তাবাদ ছড়ানো হয় তারসাথে প্রকৃত দেশপ্রেম — দেশকে ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে রাষ্ট্রশক্তিকে সাম্প্রদায়িক দানবিক রাষ্ট্রবাদী করে তোলার। এই উদ্দেশ্যে স্কুলশিক্ষায় গৈরিকীকরণের নানা অনুপ্রবেশ, এমনকি জবরদস্তি প্রবেশের প্রক্রিয়া আরএসএস-বিজেপি কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে শাসন কায়েমের জোরে শুরু করে দিয়েছে। গুজরাটে ওদের দু’দশকের রাজত্ব। সামনে রয়েছে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে স্কুলে ‘ভারতমাতা’র উপাসনার ফতোয়া জারিতে ধরা পড়ছে দ্বৈত উদ্দেশ্য — একদিকে শিক্ষায় গৈরিককরণ, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি।

burnt in Odisha

ওড়িশার নবরঙ্গপুর জেলার বুর্জা পঞ্চায়েতে ২৫টি আদিবাসী পরিবারের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিল, ভুট্টাখেত ধ্বংস করে দিল ‘বন সুরক্ষা কমিটি’।

ওড়িশার নবরংপুর জেলার উমরকোট ব্লকের বুর্জা পঞ্চায়েতের অধীনে কোপাসাভটা, সারিয়াভটা এবং লখটিপাখনা গ্রামের একশ’রও বেশি আদিবাসী পরিবার প্রায় ৩০ একর জমিতে ভুট্টাচাষ করে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

‘বন সুরক্ষা সমিতি’ গত ১৩ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে হঠাৎ এসে এই আদিবাসী পরিবারগুলির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং গরু, মহিষের দঙ্গল নামিয়ে তাঁদের ভুট্টা ফসল নষ্ট করে দেয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে মধুসূদন এই অমানবিক ও অসাংবিধানিক ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এই হামলায় যাদের ঘরবাড়ি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই ২৫টি আদিবাসী পরিবারকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

বুর্জা পঞ্চায়েতের কোপাসাভটা গ্রামের আদিবাসীরা একমাস আগে উমরকোট থানায় বন সুরক্ষা কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল যে ওরা আদিবাসী পরিবারগুলোকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার এবং অন‍্যথায় ফসল নষ্ট করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। পুলিশ উভয় পক্ষকে ডেকে বন সুরক্ষা কমিটিকে বিরত থাকতে বলেছিল। কিন্তু বন সুরক্ষা কমিটি আদিবাসীদের ওপর এই হামলা নামাল।

বিভিন্ন জায়গাতেই ‘বন সুরক্ষা কমিটি’ আসলে স্থানীয় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি ও বনের অফিসারদের আঁতাতে তৈরি হওয়া অত‍্যাচারি সংস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। ২০০৬’র বনাধিকার আইন অনুযায়ী বনের জমি ও গৌণ বনজ সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু বন সুরক্ষার নামে কমিটিগুলি আসলে আদিবাসীদের বিতাড়িত করার কাজ করছে। আমাদের রাজ‍্যে বাঁকুড়া বা উত্তরের তরাই-ডুয়ার্সের আদিবাসীরা বন সুরক্ষা কমিটিতে আদিবাসী ও বনগ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার দাবি তুলেছেন। সম্প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নতুন ‘বন সংরক্ষণ বিধি’ আনতে চলেছে যা বনাধিকার আইনকে এড়িয়ে গিয়ে বনাঞ্চলের আদিবাসীদের অধিকারকে চরম খর্ব করবে। এই নতুন বিধির খবরে উৎসাহিত হয়েই কি উড়িষ‍্যাতে আদিবাসীদের ওপর এরকম হামলা চলল? উড়িষ‍্যায় বিজেপির জোটসঙ্গীর সরকার। আদিবাসী স্বার্থের চরম প্রতিপন্থী এই নতুন বন সংরক্ষণ বিধিটিতে দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি যেন স্বাক্ষর না করেন সেই দাবি ইতিমধ‍্যেই বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন তুলেছে।

Independence_slavery

তামিলনাড়ুর পঞ্চায়েতে অনেক দলিত নেতাকেই জাতীয় পতাকা তোলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল। দলিত পঞ্চায়েত প্রধানদের নামে কোনো সাইনবোর্ড রাখা হয় না, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে তাঁদের বসতে দেওয়াও হয়না এবং এমনকি পঞ্চায়েতের নথিপত্রেও হাত দিতে দেওয়া হয়না। এই ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনা সামনে আসায় তামিলনাড়ু আনটাচেবিলিটি ইরাডিকেশন ফ্রন্ট (অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ফ্রন্ট) এনিয়ে একটা সমীক্ষা চালায়। ঐ সংস্থার কর্মকর্তা কে সামুভেল রাজ জানিয়েছেন, “সমীক্ষার ফল খুবই হতাশাজনক, কেননা, দেশ যখন ৭৫তম স্বাধীনতা বার্ষিকী উদযাপন করতে চলেছে সেই সময় (দলিত) পঞ্চায়েত সভাপতিদের জাতীয় পতাকা তোলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। ২০টা পঞ্চায়েতে এই ধরনের সমস্যা রয়েছে।” এটা হিমশৈলের চুড়া বলেই অনেকে অভিমত পোষণ করছেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেছে নেওয়া ১,৬০০টা পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩৮৩টা দলিতদের জন্য সংরক্ষিত, এবং সবকটিতেই দলিতদের ক্ষমতা খর্বীকৃত। প্রজাতন্ত্র, স্বাধীনতা ও গান্ধী জয়ন্তীতে দলিতদের জাতীয় পতাকা তুলতে না দেওয়াই রীতি হয়ে রয়েছে। দলিত সভাপতিরা কি তবে জাতীয় পতাকা তুলতে পারবেন না? সেটাকে আটকাতে কাল্লাকুরিচু জেলার এক দলিত প্রধান সুধা ভরদারাজি ৩ আগস্ট জেলার পুলিশ সুপারকে চিঠি লিখে জানালেন — “আমার আগে আরও দশজন পঞ্চায়েত সভাপতি ছিলেন যাঁদের সবাইকেই জাতীয় পতাকা তুলতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাকে সেই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আমি দাবি জানাচ্ছি, যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হোক যাতে এবছর স্বাধীনতা দিবসে আমি আমার অধিকার প্রয়োগ করতে পারি।” অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ দূরে থাক, চলতি জমানায় বর্ণ পীড়নকে আরও বাড়িয়ে চলাই হচ্ছে।

Struggle Against Illegal Lockout

পুডুচেরির লারসেন-ও-টুব্রো কর্পোরেট সংস্থার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে লড়াই চালিয়ে আসছেন। তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে — সমকাজে সমমজুরি এবং উৎপাদন কার্যকলাপে ঠিকাশ্রমের বিলোপ। পুডুচেরিতে লারসেন-ও-টুব্রোর যে চারটে শাখা রয়েছে, তার সবকটিতেই এ বছরের ১৫ মার্চ থেকে ২২ দিন সর্বাত্মক ধর্মঘট সংগঠিত হয়।

পুডুচেরিতে লারসেন-ও-টুব্রোর চারটে উৎপাদন শাখায় ১০০০’র বেশি শ্রমিক কাজ করেন আর এদের নিয়োগের প্রকৃত ধরণটা হল ছদ্ম ঠিকাশ্রমিকের। যথাযথ আইনি ভাষায় বলতে গেলে এরা হলেন স্থায়ীপদে কাজ করা শ্রমিক, কেননা, এই কারখানাগুলোতে কোনো লাইসেন্সপ্রাপ্ত ঠিকাদার নেই এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা কারখানাগুলোতে ৫ থেকে ২৫ বছর ধরে কাজ করে আসছেন। কিন্তু শ্রম আইনের পুরোদস্তুর লঙ্ঘন ঘটিয়ে এদের ঠিকাশ্রমিক করে রাখা হয়েছে। আরও ন্যক্কারজনক ব্যাপার হল, শ্রমিকদের যথাযথ মজুরি দেওয়া হয়না এবং ১২ ঘন্টা ধরে চলা শিফটে কাজ করতে হয়।

সমকাজে সমমজুরির সঙ্গে শ্রমিকরা আরও দাবি তুলেছেন — ওভারটাইমে কাজ করা সময়ের জন্য দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে, যথাযথ পরিমাণে ইএসআই ও পিএফ কেটে সেই অর্থকে নির্দিষ্ট দফতরের কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়মিত ভাবে জমা করতে হবে, দু’বছর ধরে কাজ করছেন এমন সমস্ত শ্রমিককে স্থায়ী করতে হবে, ইত্যাদি। বিগত কয়েক বছর ধরে এই দাবিগুলো তুলে ধরা হলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কোনো গুরুত্বই দেয়নি।

স্থায়ী বলে স্বীকৃত নন এমন শ্রমিকরা (অর্থাৎ, ঠিকা শ্রমিকরা) প্রায় চার বছর আগে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত লার্সেন-ও-টুব্রো জননায়কা থোঝিলালার সঙ্গম ইউনিয়ন গড়ে তুলে বিধিবদ্ধ অধিকার দাবি করতে থাকেন। দাবিগুলো উপেক্ষিত হতে থাকায় ইউনিয়ন অবশেষে কর্তৃপক্ষের কাছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের নোটিস দেয়। ১৫ মার্চ শুরু হয়ে টুলস-ডাউন ধর্মঘট চলে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এই ধর্মঘটে অন্যান্য ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ১৫০ জন স্থায়ী শ্রমিক-সহ সমস্ত বর্গের শ্রমিকরাই সমর্থন জানান।

ইতিমধ্যে, শ্রম দফতরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিন দফা আলোচনা চলে। কারখানা পরিচালক কর্তৃপক্ষ কিন্তু শ্রম দফতরের কর্তাদের পরামর্শকেও মানতে অস্বীকার করে, অন্যায্য শ্রমরীতি প্রয়োগ করতে থাকে এবং লকআউট ঘোষণা করে।

বেআইনি লকআউট অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং সমস্ত শ্রমিককে পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়ে শ্রমিকরা গত ৮ জুলাই রাজভবন মার্চ সংগঠিত করেন। আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। সমস্ত শ্রমিক এবং এআইসিসিটিইউ নেতৃত্বাধীন ইউনিয়ন সংগ্ৰামকে চালিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

slum movement in Odisha

উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক ‘সামালেই পরিকল্পনা’ ঘোষণা করলেন, যার ঘোষিত উদ্দেশ্য নাকি বিখ্যাত সামালেশ্বরী মন্দির ও তার সংলগ্ন এলাকার উন্নয়ন। কিন্তু সামালেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন ঘুঙ্ঘুটি পাড়ার বস্তিবাসীরা পরে জানতে পারলেন যে, বস্তি থেকে তাদের উচ্ছেদও এই ‘সামালেই পরিকল্পনা’রই অঙ্গ। বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ ঐ পরিকল্পনার নিহিত বিষয় হলেও তাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের কোনো কথা ঐ পরিকল্পনার বিষয় হয়নি।

ঘুঙ্ঘুটি পাড়া বস্তির মানুষজন বংশ পরম্পরায় ৪৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাস করছেন; যুগ-যুগ ধরে যেটা তাঁদের বাসভূমি হয়ে থেকেছে, সেখান থেকে তাঁদের উচ্ছেদ কি আদৌ ন্যায়সঙ্গত হতে পারে? কোনো-কোনো স্থান থেকে বুলডোজার দিয়ে কেন দলিতদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের গৃহহীন করা হচ্ছে, আর তারজন্য কোনো পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের পদক্ষেপ কেন নেওয়া হচ্ছে না?

বস্তির মানুষজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিজেদের ক্ষোভের কথা জানিয়ে ছিলেন, কিন্তু জেলার প্রশাসনিক প্রধান তাতে কোনো গুরুত্বই দেননি। এরপর ন্যায়বিচারের আশায় বস্তিবাসীরা উড়িষ্যা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলেন। হাইকোর্টের বিচারপতি ২৭ জুন এক অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশিকায় সরকারকারকে নির্দেশ দিলেন, আন্দোলনকারী তথা বস্তিবাসীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা পাল্টে যেতে দেরি হল না। কোনো অজ্ঞাত কারণে হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ ১২ জুলাই আবারও একটা নির্দেশিকা দিলেন যাতে আগের নির্দেশিকায় দেওয়া ঘুঙ্ঘুটি পাড়া বস্তিকে ধূলিসাৎ করার ওপর স্থগিতাদেশকে তুলে নেওয়া হল, সামালেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে সরকারকে অনুমতি দেওয়া হল।

ঘুঙ্ঘুটি পাড়া বস্তির রক্ষায় দলিত, আদিবাসী ও বহুজনদের ১৮টি সংগঠন ১২ জুলাই তৈরি করলেন ‘বহুজন মিলিশিয়া মঞ্চ’। হাজার-হাজার বস্তিবাসী আম্বেদকার স্কোয়ার থেকে সম্বলপুর কালেক্টোরেট অফিস পর্যন্ত সংগঠিত করলেন দীর্ঘ ৮ কিমি পদযাত্রা, ব্যাপক আকারের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হল সামালেই পরিকল্পনার নামে ঘুঙ্ঘুটি পাড়া বস্তির ধ্বংসের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে।

জনৈক ছাত্রনেতা মধুসূদন জানিয়েছেন, উচ্চবর্ণের মানুষরা দেবতা জগন্নাথের নামে উড়িষ্যার ২৪টা জেলায় ৬০,৪০২ একর জমি জবরদখল করে রেখেছে, যে জমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক মানুষদের সরকারের দেওয়ার কথা; আর এখানে এই ঘুঙ্ঘুটি পাড়ায় ধর্ম ও আধ্যাত্মিকথার নামে ৪৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাস করে আসা মানুষদের বঞ্চিত করা হচ্ছে জীবিকা, আয়, শিক্ষা ও নিরাপত্তা থেকে। বস্তিবাসী ও অন্যান্য নিপীড়িত মানুষদের এই সংগ্ৰাম আশাভরসা ও অস্তিত্বের লক্ষ্যে চালিত সংগ্ৰাম; ধর্মীয় ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে উচ্ছেদের পরিকল্পনা দমনেরই নামান্তর। ছাত্রনেতা আরও বলেন, “ঘুঙ্ঘুটি পাড়ার অধিবাসীদের জমির দলিল ও পাকা বাড়ি না দেওয়া হলে এবং তাদের জন্য স্বাস্থ্য ও কল্যাণের সুবন্দোবস্ত করা না হলে মর্যাদাপূর্ণ ও সম অধিকারের নাগরিকত্বের জীবনের জন্য সংগ্ৰামকে আমরা তীব্রতর করে তুলব। রাস্তার আন্দোলন থেকে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে আমরা এই উৎপীড়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করব।”

There is no rain

বলার অপেক্ষা রাখে না, আজও পাট কৃষকের কাছে অর্থকরী ফসল হিসাবে গণ্য। অন্যদিকে পাটকল শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার সাথে রাজ্যের পাট উৎপাদন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। পরিবেশ দূষণ রোধে বিশ্বজুড়ে পাটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতীয় ক্ষেত্রে নিমিত্ত মাত্র। ভারতে সিনথেটিক ব্যবহারের সরকারি অনুমোদন পরিবেশকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। একদিকে এই অনুমোদন বাতিল করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি পাটের তৈরি ব্যবহার্য সমস্ত জিনিস উৎপাদনের জন্য কলকারখানা তৈরি করা জরুরি। কিন্তু করবে কে? দিল্লীর কৃষক আন্দোলন বুঝিয়ে দিল, দেশের সরকার কৃষকের ভালো হোক এটা একান্তই চায় না, চায় তাদের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে রাখা আদানি ও আম্বানির মত কর্পোরেট মালিকদের উন্নতি। পশ্চিমবাংলার রাজ্য সরকারও সেইমুখী। মোদী সরকারের কাছে অপাংক্তেয় হলেও চাষিরা ভয়ংকর লকডাউনের মধ্যে উৎপাদন অব্যাহত রেখে দেশের মানুষের অন্ন যুগিয়েছিল, অন্যান্য কৃষি পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের আবাদ সহ পাট চাষও করেছিল।

পশ্চিমবঙ্গে মূলত নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার একাংশে এবার ব্যাপক পাট চাষ হয়েছে। ধান বা অন্য কোনো চাষে লোকসান হলেও পাট চাষ কৃষককে পুষিয়ে দেয়। গত মরশুমে পাটের সর্বোচ্চ মূল্য ৯,০০০ টাকা কুইন্টাল হয়েছিল। এবছর বর্তমানে বাজারে পাটের মূল্য কুইন্টাল প্রতি ৪,০০০ থেকে ৫,৫০০ টাকা। কিন্তু সারের মূল্যবৃদ্ধি, সেচের জন্য ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি চাষের খরচ বেড়ে গেছে, বাড়তি টাকা খরচের কোন উপায় নেই। একবিঘা পাট চাষের খরচ গড়পড়তা ১৬,০০০ টাকা। গড়ে বিঘা প্রতি সাড়ে তিন কুইন্টাল পাট উৎপাদন হলে বিক্রীর দাম দাঁড়াবে ১৯,২৫০ টাকা। চার মাস ধরে এই উৎপাদনে প্রতিমাসে কৃষকের আয় ৩,২৫০ টাকা। কৃষকের মাথায় হাত, শ্রাবণ মাস শেষ হতে গেল, এখনো আকাশে বৃষ্টি নেই বললেই চলে। নিম্নচাপে বৃষ্টি হবার আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত কৃষকদের হতাশায় পরিণত করেছে। পাট ভেজানোর জন্য পুকুর, ডোবা, খাল, বিল এমনকি নদীগুলোতে জল নেই, পানি নেই। বহু জায়গায় পাট জলের অভাবে শুকিয়ে গেছে অথবা পাটগাছ অপুষ্টিতে ভুগছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে রাজ্যের সরকার শুধু কৃষকের সর্বনাশ হতেই দেখছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে, চিন্তা কী? ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আগে পাট ভেজানোর জন্য জলা জায়গাগুলিতে সরকার নিজস্ব খরচে মাটির নিচ থেকে জল তোলার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে অথবা গঙ্গার জল সরবরাহ করে পাট ভেজানোর ব্যবস্থা করলে কৃষি বাঁচে, কৃষক বাঁচে। কেন্দ্রের মোদী সরকার ফসলের লাভজনক দামের গ্যারান্টি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কৃষকদের সাথে বেইমানি করেছে। তেমনি রাজ্য সরকার দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে ক্ষমতায় এসে কৃষকদের কথা ভুলে যাচ্ছে। গত ২৭ জুলাই সারা ভারত কিষাণ মহাসভার পক্ষ থেকে নদীয়া জেলা শাসকের কাছে নিখরচায় পাট ভেজানোর জন্য জলের ব্যবস্থা করার দাবি নিয়ে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সেই পরিপেক্ষিতে গত ২৮ জুলাই নদীয়া জেলাশাসকের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে সমস্ত ব্লক উন্নয়ন আধিকারীকে “প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করুন” বলে জানানো হয়েছে। এই বিষয়ে নাকাশীপাড়া ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কোথায় কোথায় কোন দাবি আছে সেটা কৃষকদের তথ্য দিয়ে তাঁকে জানাতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জানানো হয়, তেঘরি মৌজায় প্রায় পাঁচ বিঘা জলা জায়গা সরকারি খাস হিসাবে থাকলেও সেখানে কয়েকজন তৃণমূলের লোক ঐ জমি ভোগ করছে, কৃষকদের পাট ভেজেতে সমস্যা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একসময় পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সমিতির নেতা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে এই জলা জায়গা দখল করে জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য করা হয়েছিল। ব্লক আধিকারিক তথ্য আকারে কৃষকদের পক্ষ থেকে জানাতে বলেন। কালীগঞ্জ ব্লকে এই বিষয় নিয়ে ডেপুটেশন দিলে, বিডিও একই কথা বলেন। আমরা বলি, ঢেঁরা পিটিয়ে বা মাইক বাজিয়ে গ্রামে গ্রামে সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হোক আর তথ্য সংগ্রহ করা হোক — কোনও ডোবা-খানায় জল লাগবে, কত টাকা খরচ হবে, যা সরকার মিটিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত কে কার কথা শোনে, নিচের তলা থেকে উচু পর্যন্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই সরকার। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল নদীয়া জেলায় এল, পাট চাষিদের দুর্দশার কথা শোনা দূরের ব্যাপার, দুর্নীতির নির্দিষ্ট অভিযোগগুলোই বুঝতেই পারে না, করবে ঘোড়ার ডিম।

- কৃষ্ণপদ প্রামানিক

The tricolor is in the house

দেশের পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে নতুন বিতর্ক হল। এইবার জাতীয় পতাকা নিয়ে। ঘরে ঘরে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার নিদান দেওয়া হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত মেসেজও অনেকের মোবাইলে এসেছিল। প্রতিটি মানুষ যাতে দেশের পতাকাকে সম্মান করেন, দেশের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন, তার জন্যেই নাকি এই ব্যবস্থা। যে সরকার কালো টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য নোটবন্দী করেছিল, যে সরকার কোভিড পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার নাম করে, চার ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন ঘোষণা করেছিল, সেই সরকারের যে কোনও পদক্ষেপের পিছনেই কোনও না কোনও উদ্দেশ্য থাকে। এমনিতে হয়তো মনে হবে, এইভাবেই ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ পালন করা প্রয়োজন, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলা উচিত, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদযাপন করা দরকার। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টা বোঝা যাবে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে আবারও প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিশেষ এক বন্ধু — এক বিশিষ্ট শিল্পপতির ব্যবসা যাতে আরও বৃদ্ধি পায়, তার ব্যবস্থাই করেছিলেন। নিন্দুকেরা তাই প্রশ্ন করেছিলেন, এই জাতীয় পতাকার বিতরণ কি শুধুমাত্র দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্যে, না কী এরমধ্যে আরও কোনও উদ্দেশ্য আছে? অনেকে দুর্নীতির কথাও বলছেন।

ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরি করা, প্রদর্শন করার একটা নিয়ম প্রচলিত আছে, যা ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ২২ জুলাই গৃহীত হয়েছিল। তাতে তিনটি ভাগ আছে — যার একটি অংশে বলা আছে, ভারতের জাতীয় পতাকা একমাত্র খাদিবস্ত্র থেকেই বানাতে হবে, পতাকার মাপ এবং অশোক চক্রেরও মাপ বলা আছে, কীভাবে কখন এই প্রদর্শন করতে হবে, সেই বিষয়েও স্পষ্ট করে বলা আছে। খাদিবস্ত্রেও একমাত্র সূতি, সিল্ক এবং উল ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করা যাবে না, যদিও কখনো কখনো কাগজের পতাকা ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু তাও যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না, ফেলা হলে, তা জাতীয় পতাকার অবমাননা বলে ধরা হবে। কেন খাদিবস্ত্রই একমাত্র ব্যবহার করতে হবে, তাও বলা আছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যেহেতু গান্ধীজীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এবং যেহেতু গান্ধী নিজে খাদিবস্ত্র পরিধান করতেন, খাদির সূতো কাটা, সেই সূতোয় খাদি পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করা ও পরার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের দেশচেতনা গড়ে তোলা হোত, তাই ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে, নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্বে প্রথম সরকারের আমল থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জাতীয় পতাকার জন্য খাদির কাপড় ব্যবহার করতে হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে আরও সুবিধা হবে, বহু মানুষ কাজ পাবেন, স্বনির্ভর হবেন। যাঁরা স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, বিদেশী দ্রব্য বয়কট আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাই এই খাদির জন্য আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন।

আজ যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন, তাঁদের যেহেতু এই স্বদেশী আন্দোলনের কোনওদিনই কোনও যোগাযোগ ছিল না, তাই তাঁদের এই খাদির আন্দোলনের প্রতি কোনও সহানুভুতি নেই। তাই তাঁরা এবার জাতীয় পতাকা তৈরি করার আইনটিকে সংশোধন করে, খাদির কাপড়ের পাশাপাশি পলিয়েস্টার কাপড় ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। এরফলে পরিবেশের কী ক্ষতি হবে, সেটাও যেমন তাঁরা ভাবেননি, তেমনই একটি ব্যবহার করা পতাকা, নোংরা কিন্তু ছেঁড়া নয়, তার কী গতি হবে, সেটাও ভাবেননি, শুধু ভাবা হয়েছে, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বন্ধুর পলিয়েস্টার কাপড়ের ব্যবসা আছে, তাই এই সিদ্ধান্তের ফলে তাঁর ব্যবসা আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে। অনেকেই এই দেশপ্রেমকে ‘পলিয়েস্টার প্রেম’ বলেছেন।

কার ফ্রিজে গোমাংস রাখা আছে, বা কোনও মানুষকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলানোর জন্য, নানান জায়গায় সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর অত্যাচারের খবর যখন আসছিল, তখন সারা দেশে একদিনে একই সময়ে একটা আন্দোলন হয়েছিল, মূলত নাগরিকদের উদ্যোগে, যাঁর নাম ছিল ‘নট ইন মাই নেম’, অর্থাৎ ‘আমার নাম করে নয়’, সংখ্যাগুরু মানুষের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘু মানুষদের পিটিয়ে মারা যাবে না। দেশের মূল মূল শহরের প্রাণকেন্দ্রে বহু মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন সেদিন, তাঁদের অনেকের হাতেই ছিল জাতীয় পতাকা, বেশিরভাগের গলায় ছিল একটা প্ল্যাকার্ড, লেখা — ‘নট ইন মাই নেম’। সেই সমাবেশে বহু মানুষের সঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশ কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাঁরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁদের অনেকেরই পরনে ছিল খাদির পোশাক, সঙ্গে ছিল খাদির ব্যাগ। আসলে খাদি একটা লড়াই, একটা ঐতিহ্য, যা দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করতে চান না, আর করবেনই বা কী করে, তিনি যে দলের প্রতিনিধি, তাঁদের সঙ্গে তো ব্রিটিশ বিরোধিতার কোনও সংযোগ নেই, ফলে তাঁরও কোনও দায় নেই। তিনি সবরমতী আশ্রমে গান্ধীর চড়কার সামনে বসে ছবি তুলে তাঁর ‘দেশপ্রেম’ এবং গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারেন, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কে যে সাভারকার আছে, যিনি ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন, তাঁর বা তাঁর দলের মানুষদের মুখে যতই ‘রাম’ থাকুক, তার অন্তরে যে আছে নাথুরাম, তা তাঁরা ভালোই জানেন। তাই গান্ধীর জন্মদিন বা শহীদ দিবসে, যখন সারা দেশে গান্ধী স্মরণ হয়, তখন তার বিপরীতে কোনো কোনো জায়গায় নাথুরাম গডসেকেও পুজো করা হয়।

what is the work in the house

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যখন শাহীনবাগ থেকে শুরু করে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে সংখ্যালঘু মহিলাদের নেতৃত্বে অবস্থান শুরু হয় তখন তাঁরা বলেছিলেন, এটা দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ, সেদিনও তাঁদের হাতে ছিল দেশের জাতীয় পতাকা। দেশকে সেদিন যাঁরা ভালবেসে বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আজকে যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছেন — এঁদের মধ্যে মিলের জায়গাটা হল — জাতীয় পতাকা। বহু সাংবাদিক শাহীনবাগ বা দেশের নানান প্রান্তে গিয়ে যখন প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আপনারা জাতীয় পতাকা নিয়ে আন্দোলন করছেন? তখন সবাই একবাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, এই লড়াই আসলে মীরজাফরদের হাত থেকে, অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে জাতীয় পতাকার আসল উত্তরাধিকারের লড়াই। যে আরএসএস-বিজেপি’র ইতিহাসে জাতীয় পতাকার কোনও অস্তিত্ব নেই, যাঁরা কোনোদিন স্বাধীনতার পরবর্তীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেনি, তাঁরাই যদি অন্যদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেয়, তবে তাঁদের থেকে সেই পতাকা ছিনিয়ে নেওয়ার নামই আসলে দেশপ্রেম। প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামেও খাদি ছিল, আজ দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইতেও খাদি আছে।

এমনিতেই ঝাঁ চকচকে শপিং মলের চাকচিক্যে, খাদি কাপড়ের চাহিদা কমেছে, তারমধ্যে দু’বছর লকডাউনে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। অনেকেই ভেবেছিলেন যে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে হয়তো প্রচুর সরকারি বরাত পেয়ে খাদি আবার একটু মাথা তুলে দাঁড়াবে। কিন্তু মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে বিভিন্ন খাদি কাপড় তৈরির কারখানায় শ্রমিকেরা মুষড়ে পড়েছেন। স্বনির্ভরতাই একমাত্র কারণ, যার জন্য খাদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করা হয়েছিল, অথচ মেশিনে তৈরি পলিয়েস্টারের মধ্যে কোথাও কোনও আত্মনির্ভরতা নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী সব জেনে বুঝে আবারও দেশবাসীকে বোকা বানাতে চাইলেন, পাশাপাশি অনেকে বলছেন, ঘরে ঘরে কাজ দেওয়াই যখন সরকারের দায়িত্ব ছিল, তখন ঘরে ঘরে তিরঙ্গা পতাকা দিয়ে সেই দাবি ঘুরিয়ে দেওয়ার এটা একটা চক্রান্ত নয়তো? অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন নরেন্দ্র মোদী চান না, মানুষ সমষ্টিতে বাঁচুক, তাই প্রতিটি মানুষকে একলা করে, ঘরে ঘরে তেরঙ্গা পতাকা তুলিয়ে তাঁর ছবি সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করানোর মধ্যে দিয়ে সেই কাজটাও হাসিল করতে চেয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিভিন্ন পাড়ায়, বিভিন্ন বিরোধী দলের রাজনৈতিক অফিসে জাতীয় পতাকা তোলার মধ্যে দিয়ে তাঁর সেই চক্রান্ত আটকানো গেছে।

- সুমন সেনগুপ্ত

St. Jevier's University

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কর্তৃপক্ষ সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত এক শিক্ষিকাকে তার কাজ থেকে বরখাস্ত করে কোনোরকম নোটিশ ছাড়াই। বেআইনি বরখাস্ত হওয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষিকা যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। কিছুদিনের মধ্যে কলেজ কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠান। জবাব হিসাবে জেভিয়ার্স কর্তৃপক্ষ ৯৯ কোটি টাকার মানহানির মামলা করে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। শিক্ষিকা ইন্সটাগ্রাম নামক একটি সামাজিক মাধ্যমে নিজের কয়েকটি ছবি দিয়েছিলেন। ছবিতে তিনি সাঁতারুর স্যুট ও হটপ্যান্ট পরে ছিলেন। এই ছবি ইন্সটাগ্রামে দেখে এক পড়ুয়ার অভিভাবক জেভিয়ার্স কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানান এই মর্মে যে, অধ্যাপিকার স্বল্পবাস ছবি দেখা অভিভাবক হিসাবে তার কাছে লজ্জার বিষয় এবং একজন পড়ুয়ার কাছে নিজের শিক্ষিকাকে স্বল্প পোশাকে দেখা অশ্লীল ও অনুচিত। বরখাস্ত হওয়া শিক্ষিকা সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার ব্যক্তিগত ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডেলের ছবি ডাউনলোড করে কাগজে প্রিন্ট করিয়ে শিক্ষিকাকে ডাকা হয় জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ফিলিক্স রাজের অফিসে। প্রিন্ট করা ছবিগুলি শিক্ষিকাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, এই ছবিগুলি তার কিনা। শিক্ষিকা সম্মতিসূচক উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে তাকে বরখাস্তের নিদান জানানো হয়। বলা হয় অধ্যাপিকার ছবি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি ও পোশাকবিধির অনুকূল নয়। শ্লীলতার কথা তোলা অভিভাবক ও হর্তাকর্তাদের কাছে প্রশ্ন হল, শ্লীল আর অশ্লীল বিচার করার তাঁরা কে? কার স্বার্থে কে আচরণ আর পোশাক বিধি নির্ধারণের ক্ষমতাধর? একজন নারীর ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে তার ছবি চাউড় করে চরিত্র হনন করা কী অসমীচীন নয়? কর্মক্ষেত্রের বাইরে ব্যক্তি-জীবনে একজন নারীর পোশাক নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে তার কাজ কেড়ে নেওয়া কী অনুচিত নয়? শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার পদে বসে থাকা পুরুষদের ক্ষমতার সিঁড়িতে অনেক নীচের অবস্থানে থাকা সহকর্মী নারীর ব্যক্তি-জীবনের পোশাক নিয়ে জ্ঞান দেওয়া কী অশ্লীল নয়?

শরীর ও যৌনতার স্বাতন্ত্র‍্যে বিশ্বাসী মেয়েরা সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (যেমন, পরিবার, কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্র)-এর কাছে ভয়ের কারণ। শঙ্কা এই কারণে যে, মেয়েরা নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তারা সমাজের মাতব্বর পুরুষদের সুবিধার্থে বানানো পিতৃতান্ত্রিক নিয়মনীতির ভিত নাড়িয়ে দিতেও সক্ষম। মেয়েরা যদি নিজের শরীরকে লজ্জ্বার উৎস মনে না করে, কাল সে সন্তান জন্ম দেওয়ার থেকে বেশি গুরুত্ব দেবে নিজের পেশাকে, নিজের জীবনসঙ্গী বাছতে চাইবে নিজের শর্তে, তথাকথিত সম্ভ্রমের বদলে বাছবে স্বাধীনতা, রক্ষাকর্তার বদলে পুরুষকে দেখতে চাইবে সহ-নাগরিকের চোখে। এক্ষেত্রে কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট জেভিয়ার্সের ক্ষমতার আস্ফালন মেয়েটির কর্মসংস্থান কেড়ে নেওয়াতে সীমিত থাকেনি। কাজ হারানো মেয়েটি আইনি পথে নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের বিচার চাইলে সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯৯ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছে মেয়েটির বিরুদ্ধে। সোজা কথায়, ‘ঘর’এর (অর্থাৎ যেকোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের) মধ্যে হিংসা চলবে কিন্তু ‘ঘর’এর কথা বাইরে গেলে সম্মানহানির ভয়ে দাঁত নখ বের করে আক্রমণ চলবে প্রতিবাদী স্বরের বিরুদ্ধে।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একজন নারীর ব্যক্তিগত পরিসর ও পোশাকের স্বাধীনতার উপর এহেন নীতি-পুলিশীর নির্দশন হজম করতে কঠিন লাগলেও এটাই বাস্তব। আমাদের আশেপাশে, কর্মস্থলে, পরিবারে, রাস্তায়, পার্কে, স্কুল ও কলেজে মেয়েদের পোশাক-বিধি জারি করা থুরি শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ থরে থরে সাজানো। মেয়েদের শরীর কতটুকু ঢাকা যাবে আর কতটুকু যাবে না তার সীমারেখা তৈরির দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাতব্বরেরা। অথচ, নারীর শরীরকে উপভোগ্য আর নিয়ন্ত্রণযোগ্য বস্তু ভাবার মানসিকতাকে বদলানোর প্রচেষ্টা বিরল। যার শরীর তার ইচ্ছা ও স্বাতন্ত্রকে মান্যতা দেওয়ার বদলে নিয়ন্ত্রণই দস্তুর। নিয়ন্ত্রণই সহজ। তাই হিজাব হোক বা জিন্স-প্যান্ট, মেয়েদের নিজেদের বেছে নেওয়া পরিধানের উপর হস্তক্ষেপ করার বিষয় রাষ্ট্র থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র, পরিবার কেউ পিছিয়ে নেই। যে প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা যত বেশি তার আস্ফালনের মাত্রা তদুপরি ভয়ানক।

সেন্ট জেভিয়ার্সের পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার আস্ফালনকে সামনে থেকে প্রতিহত করছেন বরখাস্ত হওয়া শিক্ষিকা। তার পাশে দাঁড়িয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, পথে নেমেছেন সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রাক্তন পড়ুয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য পড়ুয়া, শিক্ষক সমাজ, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ। আগামীতে এই লড়াইকে সংঘবদ্ধ করতে ও পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার আস্ফালনকে সমূলে উপড়ে ফেলতে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন প্রয়াস প্রয়োজন ‘ঘরে’ ও ‘বাইরে’।

- সম্প্রীতি মুখার্জী

One of the most important i

প্রাথমিক উচ্চ-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম ও শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উচ্চ মধ্যবিত্ত তথা বিত্তবানদের জগতে ধরেই নেওয়া হয়েছে ইংরেজিতে দক্ষ না হলে জগৎ সভায় উচ্চাসনে বসা যাবে না। ফলে সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করাই উচিৎ। পুঁজিবাদি কাঠামোয় ধনীর ইচ্ছাই ইচ্ছা, তা নির্ধনকে যতই কোণঠাসা করুক না কেন। বরং নির্ধন কোণঠাসা হলেই সুবিধে। রাষ্ট্র বা সরকার যদি সত্যিই সকলের জন্য সমমানের শিক্ষা প্রদানে আগ্রহী হয়, তাহলে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার মাধ্যম, ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষক বাছার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কুশলী বন্দোবস্ত করতে হবে ও নিয়োগ করতে হবে। এই নিবন্ধের লেখক পড়ুয়াদের সমস্যা অনুধাবন করতে সক্ষম হলেও তার সমাধানের পথ বাতলাতে সক্ষম নয়। ভারতে সংবিধানের অষ্টম তালিকায় ২২টি ভাষা আছে, যার মধ্যে ইংরেজি নেই। কিন্তু ইংরেজির গুরুত্বকেই অভিজাত সমাজ সব থেকে বেশি দিয়ে থাকে। ফলে তালিকায় থাকলেই তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও নয়। যেমন সান্তালি বা মৈথিলি ভাষা ওই তালিকায় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ডে সান্তালি ভাষার মাধ্যমে কিংবা বিহারে মৈথিলি ভাষায় পড়াশোনা করা প্রায় অসম্ভব। ওই ভাষায় পড়ানোর শিক্ষক তৈরি করার কোনো প্রচেষ্টাই সরকারগুলি গ্রহণ করে না। ফলে ওই সমস্ত ভাষাভাষী পড়ুয়ারা অন্য ভাষায়, বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হয় ও অসুবিধেয় পড়ে।

অষ্টম তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আরো ৩৮ টি ভাষার (ইংরেজি সমেত) দাবি রয়েছে, যেমন ভোজপুরি, কামতাপুরি, কার্বি, লেপচা প্রভৃতি। ভোজপুরি ভাষার ফিল্মি জনপ্রিয়তা থাকলেও পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে তা গণ্য হয় না। লেপচা ভাষা পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় অঞ্চলে যথেষ্টই গ্রাহ্য, কিন্তু সেই মাধ্যমের বিদ্যালয় নেই। কামতাপুর বা কার্বিতে স্বায়ত্বশাসন নিয়ে প্রবল আন্দোলন হলেও ওই ভাষাগুলি ব্রাত্যই থেকেছে। সীতাকে নিয়ে যতই উন্মাদনা তৈরি করা হোক না কেন মৈথিলী নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। বর্তমান শাসক তো ‘ওয়ান ইন্ডিয়া’ করতে গিয়ে আঞ্চলিক ভাষাকে চুলোয় পাঠাতে চাইছে।

education in one's own language

উচ্চবিত্তরাও মনে করেন যে দেশে একটা সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা থাকা দরকার, সেটাকেই মূল শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে। তাঁদের ইতিহাস ভূগোল জ্ঞানের দরকার পড়ে না। ইউরোপে ৪৪টা দেশ আছে যাদের রয়েছে প্রায় অর্ধশত ভাষা। প্রায় সব দেশ বা অঞ্চলই নিজ নিজ ভাষায় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশের ২৪টি ভাষা আছে। ইইউ সুসংবদ্ধ একটি ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে, যেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচল, কাজ খোঁজা অবাধ। তাঁরা কেউই নিজেদের ভাষাকে বিসর্জন দেয়নি। মনে রাখা দরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জনসংখ্যা ৪৫ কোটি, ভারতের তিন ভাগের এক ভাগেরও কম; সামগ্রিক ইউরোপের জনসংখ্যা ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকের থেকে ৫ কোটি বেশি।

ফলে ভারতের সমস্ত শিশুকে যদি যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হয়, শিক্ষার মাধ্যমকে সেই শিশুর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে শিশু ঘরে যেই ভাষায় বাক্যালাপ করে, বিলাপ করে, আনন্দ করে, খেতে চায় সেই ভাষাতেই সে পড়তে পারে। তার জন্য শিক্ষকের বন্দোবস্ত করতে হবে।  যারা সর্বত্র লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রচারক তারা নিজেদের সন্তানকে নিজস্ব পছন্দের মাধ্যমে পড়ার বন্দোবস্ত করে, কিন্তু দরিদ্র অন্য ভাষাভাষী পড়ুয়াদের অজানা অচেনা ভাষায় পড়তে বাধ্য করে। সকলের জন্য সমমানের শিক্ষার অন্যতম বা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা।

- অমিত দাশগুপ্ত

The Supreme Court's stamp_0

গণতন্ত্রের অলঙ্ঘনীয় শর্ত হল বিরোধীপক্ষের সবল উপস্থিতি। সেই বিরোধীপক্ষের অস্তিত্বকে বিলীন করতে নিরন্তর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। আর সরকারের এই কাজে সহায়তা জুগিয়ে চলেছে গোটা বিচার ব্যবস্থা, সরকারের গোটা পীড়নযন্ত্রই পাচ্ছে আইনি মদত। যে পিএমএলএ বা আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট বা ইডি’র ক্ষমতাকে লাগামহীন করে তোলা হয়েছে, যে আইনকে সর্বোচ্চ আদালত এর আগে ‘স্বেচ্ছাচারী’ বলেছিল, সেই আইনে ইডি’র ক্ষমতায় বৈধতার স্বীকৃতি দিল সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়।

পিএমএলএ আইন তৈরি হয়েছিল ২০০২ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী জমানার শেষ দিকে, মনমোহন সিং’এর ইউপিএ জমানায় তা সচল হয় এবং নরেন্দ্র মোদী জমানায় বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে তা দানবীয় রূপ নেয়। আর্থিক তছরূপ প্রতিরোধ আইনে ইডি’র লাগামহীন ক্ষমতার বিরোধিতা করে সর্বোচ্চ আদালতে ২৪০টিরও বেশি মামলা হয়েছিল। কিন্তু সমস্ত বিরোধী যুক্তিকে খারিজ করে বিচারপতি এ এম খানউইলকর, দীনেশ মাহেশ্বরী ও সি টি রবিকুমারের বেঞ্চের রায় ইডির হাতে তুলে দেওয়া যথেচ্ছ ক্ষমতাকে ‘সংবিধান অনুগত’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা সরকারের পীড়ন অভিপ্রায়েই প্রেরণা সঞ্চারের অন্য নাম। বিভিন্ন সংশোধনীর পরিণামে আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনের দানবীয়তা কী আকার নিয়েছে তার দিকে তাকানো যাক।

গোড়ায় এই আইনে বলা ছিল, অন্য কোনো তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে এফআইআর দায়ের করলে তবেই কোনো স্থানে বা ব্যক্তির উপর ইডি তল্লাশি চালাতে ও সম্পত্তি আটক করতে পারবে। কিন্তু আইন সংশোধন করে এই সংস্থানকে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং পুলিশের এফআইআর’এর সমতুল্য ইডি’র ইসিআইআর না দিয়েই, অর্থাৎ, অভিযোগ কি তা না জানিয়েই তল্লাশি ও গ্ৰেপ্তারির অধিকারকে আইনসম্মত করা হয়েছে। কারুর অধীনে থাকা সম্পত্তির সঙ্গে আইনে উল্লিখিত অপরাধগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ থাকলেই তিনি অপরাধী বলে গণ্য হয়ে ইডি’র তদন্তের আওতায় আসবেন। বেআইনি পথে অর্জিত সম্পত্তি গোপন করলে বা সেটাকে সৎপথে অর্জিত সম্পত্তি বলে চালানোর চেষ্টা করলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অপরাধে জড়িত বলে বিবেচিত হয়ে ইডি’র নাকানি-চোবানি খাওয়ানো তদন্ত প্রক্রিয়ার মুখে পড়বেন। এছাড়া, প্রতারণা, জালিয়াতি, প্রবঞ্চনা, অপহরণ এবং এমনকি কপিরাইট লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলিও আইনে সংযোজিত অপরাধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় নিশানা বানানো মানুষের অভাব ইডি’র কখনই হবে না।

এই আইনের আর একটা দানবীয় বিধান হল — ইডি’র অফিসারদের কাছে অভিযুক্ত কোনো বয়ান দিলে তা তথ্যপ্রমাণ বলে স্বীকৃত হবে। পুলিশ বা সিবিআই’এর ক্ষেত্রে তা প্রমাণ বলে গ্ৰাহ্য হওয়ার নয়, পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তির নিপীড়নের মাধ্যমে আদায় হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে বলে। ইডি’র অফিসারদের কাজের ধারা পুলিশের কাজের অনুরূপ হলেও সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিদগ্ধ বিবেচনায় ইডি অফিসাররা পুলিশের তুল্য নন, আর তাই তাদের কাছে দেওয়া বয়ান বা স্বীকারোক্তি — তা যেভাবেই আসুক — তথ্যপ্রমাণ বলে স্বীকৃত হবে। এরসাথেই রয়েছে যে কাউকে ডেকে আনা, অর্থাৎ সমন পাঠানো ও গ্ৰেপ্তারির যথেচ্ছ অধিকার। কারুর কাছে সমন পাঠানো হলে সাক্ষী না অভিযুক্ত কী হিসাবে ডাকা হচ্ছে, তা জানানোর দায়ও ইডি অফিসারদের নেই। এই বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা ইডি অফিসারদের কেউ সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন ভোগ করা সেনাদলের সমতুল্য বলে জ্ঞান করলে তাকে বোধ হয় খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না।

এই আইনে জামিনলাভকে একরকম অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। জামিনের শর্ত হিসাবে আইনে বলা হয়েছে, গ্ৰেপ্তারের পর কেউ জামিনের আবেদন করলে বিচারক বা বিচারপতিকে আগে সেই জামিনের বিরোধিতা করার সুযোগ সরকারি পক্ষের উকিল বা পিপিকে দিতে হবে। আর সেই পিপি জামিনের বিরোধিতা করার পর বিচারক যদি মনে করেন যে, অভিযুক্তকে অপরাধী নয় বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এবং জামিনে থাকার সময় তিনি কোনো অপরাধ করবেন না, সেক্ষেত্রে অভিযুক্তের জামিন লাভ সম্ভব হতে পারে। কিন্তু পিপি জামিনের বিরোধিতা করার পর মামলার ভারপ্রাপ্ত বিচারক জামিন মঞ্জুরিতে কতটা নিঃশঙ্ক হতে পারবেন? নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্ট এবং এমনকি সর্বোচ্চ আদালতও যেভাবে রাষ্ট্রের চোখেই অভিযুক্তকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাতে জামিন ব্যতিক্রম এবং কারাবাসই নিয়ম হয়ে উঠেছে (সম্প্রতি মহম্মদ জুবেরের জামিন লাভ এক ব্যতিক্রমী ঘটনাই)। আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার যে দায় অভিযুক্তর ওপর বর্তানো হয়েছে, তার সুযোগ অভিযুক্ত কতটা পাবেন আর তাঁর বক্তব্যই বা কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে?

আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনের দানবীয়তা বাড়ে ২০১৯ সালে আইনকে সংশোধন করার পর। সে সময় রাজ্যসভায় বিজেপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সেখানে ভোটাভুটি এড়াতে অর্থবিল রূপে এই সংশোধনীগুলো পাশ হয়েছিল, এবং তা যথার্থ ছিল কিনা সুপ্রিম কোর্টের সাত সদস্যের এক বেঞ্চ তার বিচার করবে। সে যাই হোক, পরিসংখ্যান বলছে, ঐ সংশোধনীগুলোর পর মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফার দু’বছরে ইডি আগের পাঁচ বছরের তুলনায় তিনগুণ মামলা দায়ের করেছে। পরিসংখ্যান আরও জানাচ্ছে, ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জমানায় যেখানে মাত্র ১১২টি তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি, মোদী জমানায় ২০১৪ থেকে ২০২২ সালে সেখানে তল্লাশি চালানো হয়েছে ৩,০৮০টি। এই বিপুল পরিমাণ তল্লাশি ও সম্পত্তি আটকের ঘটনাকেই বিজেপি আইনটার সার্থকতা ও সাফল্য হিসাবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই বলে চালাতে চাইছে। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সঞ্জয় ভার্মা বলেছেন, “মোদী সরকারের অধীনে আর্থিক তছরূপের ঘটনায় ইডি’র হানা ২৬ গুণ বেড়েছে। অপরাধের সঙ্গে জড়িত ৯৯,৩৫৬ কোটি টাকার সম্পত্তি ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আটক হয়েছে, যেখানে ২০০৪ থেকে ২০১৪’র মধ্যে কংগ্ৰেস সরকারের আমলে আটক হয়েছিল মাত্র ৫,৩৪৬ কোটি টাকার সম্পত্তি।…” কিন্তু তল্লাশি, সম্পত্তি আটক ও গ্ৰেপ্তারির পরিমাণের ব্যাপকতাই কি আইনের সার্থকতা ও সফলতার একমাত্র নির্দেশক হতে পারে? প্রতিহিংসা ও বিরোধীদের হেনস্থা ঘটানোর অভিপ্রায়ও কি তল্লাশিকে বাড়িয়ে তুলতে পারেনা? পশ্চিমবাংলায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্ৰেপ্তারি এবং ইডি’র বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা সত্ত্বেও বাস্তব সত্য এটাই। ইডি’র চালানো মামলাগুলোয় অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হারকেই আইনের যথার্থতা এবং ইডি’র কার্যকলাপের পক্ষপাতশূন্যতা ও আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধের একনিষ্ঠতার মাপকাঠি বলে ধরা যেতে পারে। এই ব্যাপারে পরিসংখ্যান কিন্তু ইডি’র বিপরীতেই ব্যাপক হারে ঝুঁকে আছে, এই আইনে তাদের চালানো মামলাগুলোয় অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হার ১ শতাংশেরও কম, মাত্র ০.৫ শতাংশ। অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার এই অকিঞ্চিৎকর হার বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ভাষ্যকারদের এই অভিযোগকেই অভ্রান্ত বলে প্রতিপন্ন করছে যে, আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনের প্রয়োগ হচ্ছে প্রতিহিংসা চালিত হয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে এবং বিরোধীদের দমনে মোদী সরকার ইডি’কে তাদের অস্ত্র করে তুলছে। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং কংগ্রেস সাংসদ রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনের রায় সম্পর্কে অভিমত পোষণ করতে গিয়ে যা বলেছেন তা এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য — “গত বছর আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাছে জানতে চায় যে কতজন আইন প্রণেতার বিরুদ্ধে আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনে তদন্ত চলছে। মোট ১২২ জন বর্তমান ও প্রাক্তন আইন প্রণেতাদের মধ্যে মাত্র তিনটে নাম ছিল শাসক দল বিজেপির থেকে। এরথেকে কি এটাই বুঝতে হবে যে শাসক দলে অপরাধী বলতে গেলে কী নেই? তা একেবারেই নয়। এই বিষয়টা তদন্তকারী সংস্থার বেছে-বেছে অপব্যবহারকেই দেখাচ্ছে।… অভিযুক্ত নেতারা শাসক দলে যোগ দিলেই যে মামলাগুলো হিমঘরে চলে যায়, সেই ঘটনাগুলোকেও মাথায় রাখতে হবে।…”

আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনের সমস্ত দানবীয় বিধিতে সিলমোহর দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের যে বেঞ্চ, তার নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি এ এম খানউইলকর। অবসর নেওয়ার মাত্র দু’দিন আগে ২৭ জুলাই তিনি এই রায়টি দেন। তাঁর দেওয়া আগের রায়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরায় তাঁর প্রবল অনীহা, বিপরীতে, সরকারের পীড়ননীতি ও দমনস্পৃহাকে শক্তিশালী করাতেই তাঁর অভিনিবেশ। বিষয়টির প্রতিপাদনে তাঁর দেওয়া কয়েকটি রায়ের উল্লেখ যথার্থ হবে বলেই মনে হয়। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অর্থ জোগানোয় অভিযুক্ত জহুর আহমেদ সাহ ওয়াতলির জামিন আবেদনের রায়ে তিনি বললেন, জামিনের শুনানি প্রক্রিয়ায় তথ্যপ্রমাণগুলোর বিশদ বিচার বা কাটাছেঁড়া করার প্রয়োজন নেই, আর এইভাবে তিনি ইউএপিএ আইনে জামিন লাভকে একেবারেই দুরূহ করে তোলেন, যে প্রতিবন্ধকতা এখনও অব্যাহত রয়েছে। শবরিমালা মামলায় তিনি প্রথমে ঋতুমতী নারীদের মন্দিরে ঢোকার পক্ষেই দাঁড়ান। কিন্তু এর একবছর পর শবরিমালা পুনর্বিবেচনা মামলায় সম্পূর্ণ বিপরীতে ঘুরে যান, এবং বলেন তাঁর আগের অবস্থান ভুল ছিল। জাকিয়া জাফরি ও হিমাংশু কুমার মামলায় (এই মামলার রায় তিনি না লিখলেও বেঞ্চে থেকে রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন) তিনি রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে আবেদনগুলিকে খারিজ করে আবেদনকারীদেরই অভিযুক্ত প্রতিপন্ন করে তাদের গ্ৰেপ্তারে প্ররোচনা দেন এবং হিমাংশু কুমারের ওপর পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা চাপান। এই ধরনের মামলাগুলোর বিচারের ভার, যেগুলোতে রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রার্থিত, খানউইলকরের মতো বিচারপতিদের হাতে ন্যস্ত হয় কেন? কারণ, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি সেটাই চান। গত ৮ আগস্টের দ্য টেলিগ্ৰাফ পত্রিকার এক সংবাদ নিবন্ধে উদ্ধৃত হয়েছে বরিষ্ঠ অ্যাডভোকেট ও রাজ্যসভার সদস্য কপিল সিব্বলের এই প্রাসঙ্গিক মন্তব্য — “প্রধান বিচারপতি স্থির করেন কোন মামলা কার কাছে যাবে, সেটা কখন শোনা হবে। এই ধরনের আদালত স্বাধীন হতে পারে না। সংবেদনশীল মামলাগুলো, যাতে সমস্যা আছে, অবধারিতভাবে যায় গুটিকয়েক বেছে নেওয়া বিচারপতির কাছে। রায় কী হবে তা আমরা জানি।” প্রসঙ্গত, কপিল সিব্বল জাকিয়া জাফরি মামলায় আবেদনকারী জাফরির অ্যাডভোকেট ছিলেন।

কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রে ছোটো একটা খবর বোধকরি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি, ছোটো হলেও যার তাৎপর্য একটুও কম নয়। গত ৩ আগস্ট মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি বিবেক আগরওয়াল পান্না জেলার কালেক্টরকে শাসক দলের ‘রাজনৈতিক এজেন্ট’ বলে অভিহিত করেন। মামলাটা ছিল এই যে, প্রমানন্দ শর্মা ব্লকস্তরে পঞ্চায়েত সহ-সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৫টির মধ্যে সর্বাধিক ১৩টি ভোট পান। ২৭ জুলাই তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করে সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। কিন্তু জেলার কালেক্টর সঞ্জয় কুমার মিশ্র তাঁর নির্বাচনকে খারিজ করে লটারির মাধ্যমে শাসক দলের প্রার্থী রাম শিরোমনিকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করেন। বিচারপতি তাঁর নির্দেশিকায় বলেন, জেলা কালেক্টর “শাসক দলের রাজনৈতিক এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন”। এরপর বিচারপতি নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্দেশ পাঠান — সঞ্জয় কুমার মিশ্রকে নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো কাজে যেন যুক্ত করা না হয়। এই ‘রাজনৈতিক এজেন্টরা’ আজ প্রতিটি সংস্থায়, প্রশাসননিক ও সাংবিধানিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানেই ঢুকে আছে। সর্বোচ্চ আদালতই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন! সংবিধান বিশেষজ্ঞ অনুজ ভুওয়ানিয়া যখন “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংখ্যাগুরুবাদী শাসনের কাছে সুপ্রিমকোর্টের পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ”এর অভিমত পোষণ করেন, তখন তাকে একটুও অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় না।

- জয়দীপ মিত্র

tarapada lahiri smarak_1Tarapada Lahiri Memorial Speech

১৫ আগস্ট গড়িয়ার আজাদ হিন্দ পাঠাগারে “তারাপদ লাহিড়ী স্মারক বক্তৃতা”র আয়োজন করে নাকতলা-বাঁশদ্রোনী অঞ্চলের সাথিবন্ধুরা। মূল বক্তা ছিলেন মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র। এছাড়া বলেন, শ্রদ্ধেয় তারাপদ লাহিড়ীর কন্যা শ্রীমতী ভাস্বতী ঘোষাল এবং আরএসপি-র বর্ষীয়ান নেতা অশোক ঘোষ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন অভিরূপা ভাদুড়ী।

স্বাধীনতাসংগ্রামী তারাপদ লাহিড়ী রাজসাহী জেলে বন্দী থাকাকালীন ওকালতি পরীক্ষা দেন এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পেশায় আইনজীবী তারাপদ প্রথমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কমিটি এবং অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৪০ সালে যখন আরএসপি তৈরি হয়, তিনি ছিলেন এই দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া”। ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকার তাঁর নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছিল কারাগার সংস্কার বিষয়ে। তার ভিত্তিতেই স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘কারাসংস্কার’। বক্তা সুজাত ভদ্র লাহিড়ি কমিশনের সুপারিশকে আন্ততর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অগ্রণী সুপারিশ বলে অভিহিত করেন। প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের জেলের ভেতরের প্রশাসনের অংশ বানানো থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। তাদের প্রশাসনের অংশ বানিয়ে জেলখানাকে অত্যাচারের জায়গা বানিয়ে ফেলে হয়। লাহিড়ী কমিশনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল, বন্দীদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক বিচারাধীন বন্দী’-র ক্যাটেগরি প্রণয়ন। সুজাত ভদ্র বলেন, লাহিড়ীর দেওয়া রাজনৈতিক বন্দীর সংজ্ঞাই মানবাধিকার আন্দোলনের দেওয়া আধুনিক সংজ্ঞার ভিত্তি এবং বামফ্রন্ট এই রাজনৈতিক বন্দীর ক্যাটেগরিকে আইন স্বীকৃতি দিয়েছিল আর টিএমসি সরকার আসার পর ২০১৩ সালে এই ক্যটেগরিটার কার্যত বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। লাহিড়ী কমিশন সমস্ত ধরনের সাধারণ বন্দীদের মানবিক মর্যাদা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিকর খাবার, ভদ্রস্থ পোশাক, সাহায্য, যোগাযোগ ইত্যাদির সুপারিশ করেছিল। সুজাত বলেন যে, আগে একজন কয়েদি মাসে ছয়টি ফোন করতে পারত, এখন টিএমসি সরকার সেটা কমিয়ে করেছে দুটো এবং রাজনৈতিক বন্দীদের আত্মীয় ছাড়া বন্ধুবান্ধবকেও জেলে গিয়ে দেখা করতে দেওয়া হয় না। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ কয়েদিদের ছেড়ে দেওয়া, মহিলা কয়েদিদের অধিকার রক্ষা করা, যারা জেলে রয়েছেন তাদের অবমাননা না করা, সমাজের সাধারণ মানুষের চোখে জেলখানা সম্পর্কে হীন ধারণার অবসান ঘটানো ইত্যাদি সব মিলিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যে একজন অপরাধী যেন সুস্থ মানুষ হয়ে মুক্তি পান এবং জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারেন। একথা বলে সুজাত ভদ্র সভাঘরে উপস্থিত শ’খানেক শ্রোতার কাছে প্রশ্ন রাখেন, আমরা কি এই জেলখানাগুলি সম্পূর্ণ তুলে দিয়ে অপরাধকারীকে সমাজের মাঝেই সংশোধনের রাস্তা খুঁজতে পারি না?

tarapada lahiri smarak_2

প্রতিবেদন: অবন্তী

== 000 ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-32