ভারতের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সংগ্রাম অথবা স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক দীর্ঘস্থায়ী ও বহুবিচিত্র অধ্যায়। এটি যেন অযুত সংগ্রামের বুননে তৈরি এক নকশীকাঁথা যা এক আধুনিক ভারতের অন্বেষণকে গভীরতর ও সমৃদ্ধ করেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ও বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন আশু দাবি ও প্রেক্ষিতগুলি — যেমন জমিদারি ও মহাজনীর বিরুদ্ধে, স্থানীয় রাজাদের বিরুদ্ধে, জাতি ও লিঙ্গ ভিত্তিক অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে, এবং ভাষাগত অধিকার ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য সংগ্রাম — সব সংযুক্ত হয়ে গেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভরবেগ ও চিত্রপটের সঙ্গে। বিভিন্ন ধরনের সমাবেশ আর বিভিন্ন পদ্ধতির সংগ্রাম, যেগুলির নেতৃত্ব দিয়েছেন গান্ধীবাদী ও আম্বেদকরপন্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মত ও পথের কমিউনিস্ট ও সমাজবাদীরা — এই সবগুলিকেই মিলিতভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান আখ্যানের বহুবিচিত্র বর্ণময় তটভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কী অদ্ভুত পরিহাস, যে শাখাটি স্বাধীনতা সংগ্রামে লক্ষণীয় ভাবে অনুপস্থিত ছিল, আর এখন হিন্দু আধিপত্যকামিতার ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তৈরির নিজস্ব প্রকল্পে ব্যস্ত, তারাই আজ ভারত শাসন করছে, যখন দেশ স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকী উদযাপন করছে!
শুধু ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির উত্থান ও আধিপত্যরই তিন শতকের বেশি দীর্ঘ এক ইতিহাস আছে- সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকে পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক কাজকর্ম বাড়িয়ে তোলা ও আধিপত্যের জাল ছড়িয়ে দেওয়ার পর্ব, তারপর চলেছে এক শতাব্দীব্যাপী কোম্পানি শাসন (১৭৫৭- ১৮৫৮); আর ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রত্যক্ষ শাসনের চূড়ান্ত পর্ব হল ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। নিষ্ঠুর লুণ্ঠন ও অপহরণ থেকে অত্যাচার ও কৌশলে বশে আনার প্রাতিষ্ঠানিক রাজত্ব। ঔপনিবেশিক শাসনের এই গতিপথে প্রথম নথিভুক্ত বিদ্রোহ ১৭৮৪ সালে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে আদিবাসী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে চলেছে নিরন্তর প্রতিরোধ আর থেকে থেকেই ঘটেছে বিদ্রোহ। প্রতিরোধের এই গোটা ইতিহাসকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে মান্যতা দিতে হবে।
১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৭৬৪’র বক্সার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে কোম্পানির শাসন বেশ ভালোরকম সুসংহত হয়। এরপর শাসকরা চায় এই শাসনকে আরও চাঙ্গা করার লক্ষ্যে এক বাধ্য জমিদার শ্রেণী তৈরি করতে যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা কর্নওয়ালিস কোড নামে পরিচিত। কিন্তু এই চেপে বসা ঔপনিবেশিকতা ও জমিদারি, তার সঙ্গী নিষ্ঠুর মহাজনী জুলুম গ্রামীণ জনতার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে, কৃষকদের বিশেষ করে আদিবাসীদের ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। বিদ্রোহের আগুন মাঝে মধ্যেই জ্বলে উঠছিল আর সেটাই এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছালো ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল হুল এবং ১৮৫৭-তে মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এর পর ব্রিটিশ রাজশক্তি শুধু তার প্রত্যক্ষ শাসন কায়েম করেই ক্ষান্ত থাকল না, তার রণকৌশলেও বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এল।
১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ দু'টি কারণে ব্রিটিশ শাসককে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম বিভেদ এবং খণ্ডিত ভারতীয় জনসমাজের ব্রিটিশ প্রত্যাশার বিপরীতে, ১৮৫৭’র জাতীয় গণজাগরণ এক মহত্তম সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল যেখানে হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যরা, কৃষকরা, ব্যবসায়ীরা, এমনকি অভিজাত বর্গও বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়েছিলেন। ১৮৫৭’র পর, ব্রিটিশ শাসক তাই ‘ভাগ করে শাসন করো’-কে তাদের ঘোষিত নীলনকশা হিসেবে গ্রহণ করে এবং দেশীয় রাজ্যগুলিকে বিশ্বস্ত মিত্রশক্তিতে উন্নীত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এই ‘ভাগ করে শাসন করো’ – কৌশলকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে অবশ্য ‘ঐক্যবদ্ধ হও, প্রতিরোধ করো’ – এই নীতিকে বিকশিত করার চেষ্টা চলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই চরম কষ্টের দেশভাগ আর তার সঙ্গী বিপুল রক্তস্নান, বাধ্যতামূলক দেশান্তর, ধ্বংস আর ক্ষতিকে রোখা যায়নি। ‘ভাগ করে শাসন করো’ কৌশল তখন পরিণত হয়েছে তার অন্তিম রূপে – ‘দেশভাগ করে, পালাও’।
আরএসএস, যে সংগঠন বর্তমানে বিজেপি’র মাধ্যমে ভারত শাসন করছে আর নিজের মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে শাসকের মতাদর্শ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, তারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে ‘দেশভাগের’ যন্ত্রণার আখ্যানে পরিণত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আজ তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত নেতাদের, বীরদের আত্মসাৎ করে নিজেদের দরকার মতো কাজে লাগানোর ধান্দাবাজি করছে, কয়েকজনকে আবার বিকৃত করে তাদের কালিমালিপ্ত করছে। এসব আসলে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই দিগগজ আরএসএস এবং হিন্দুত্বের অন্যান্য প্রবক্তাদের আসল ভূমিকার হীন বাস্তব চেহারাটা চাপা দেওয়ার একটা ধূর্ত কূটকৌশল। হিন্দুত্ব লবি তখন স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে সরে ছিল। তাদের প্রধান আইকন সাভারকরের এখন সবচেয়ে বেশি পরিচিতি তার ব্রিটিশ শাসকের কাছে মার্জনা ভিক্ষার আধ ডজন চিঠির জন্যে! আরএসএস তখন মুসোলিনি ও হিটলারের প্রতি ভক্তি গদগদ। গোলওয়ালকর লিখেছিলেন, ‘জাতির পবিত্রতা ও গৌরব’-এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হিটলারের ‘নাজি জার্মানি’ মডেল অনুসরণ করলে ভারতের কতটা লাভ হবে! সাভারকর তখন হিন্দু ভারতের মডেলকে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর যেখানে হিন্দুরা, ব্যাপকার্থে যারা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং ভারতে উদ্ভুত কোন ধর্মের অনুসারী, তারাই সমস্ত রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে শাসন ও পরিচালনা করবে।
ভারতের দেশভাগে আরএসএস-এর জবাব হল, এক অখণ্ড ভারতের পুনর্গঠন, যার অন্তর্ভুক্ত হবে শুধু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশই নয় — যে তিনটি দেশ তৈরি হয়েছে ১৯৪৭-এর পরে; সেই অখণ্ড ভারতে উত্তর-পশ্চিমে থাকবে আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্বে থাকবে মায়ানমার, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা এবং উত্তরে নেপাল, ভূটান এবং তিব্বত। এটাকে পুনর্মিলনের ইচ্ছার (যেমন জার্মানির পুনর্মিলনের ইচ্ছা বা কোরিয়ার পুনর্মিলনের ইচ্ছা) সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না! এটা খুব স্পষ্টভাবে একটি সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যবাদী স্বপ্ন (যেমন পুতিনের ‘বৃহত্তর রাশিয়া’ যা ইউরেশীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে থাকবে)। আরএসএস-এর ওকালতির অখণ্ড ভারতের কোনো ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিল না। এটা কাল্পনিক অতীতের অলীক গৌরবের এক উপস্থাপনা যা বর্তমানের সমস্যা ও দুর্দশা থেকে মানুষের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে এক বিষাক্ত স্বপ্নের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গালগল্পের মাধ্যমে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হিসাবে রয়েছে। বাংলাদেশেরও বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। তিনটি দেশের অতীত অভিজ্ঞতায় অনেক মিল আছে। তাদের সাধারণ স্বার্থও আছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একটি কনফেডারেশন, এবং বর্তমানের সুপ্ত ও প্রায় বিলুপ্ত এসএএআরসি (সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন)’র থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতার আরও প্রাণবন্ত ও সক্রিয় একটি কাঠামো গড়ে তোলার কথা ভাবতেই পারে। কিন্তু আরএসএস-এর অখণ্ড ভারতের কল্পনা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করা আর ভারতকে তার সব প্রতিবেশীদের থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ব্যবস্থাপত্র ছাড়া আর কিছুই নয়! অতীতের অবিভক্ত ভারতকে পুনরুদ্ধারের কথা ভুলে যান, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে একজাতীয় ও নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ভিত্তিতে সংজ্ঞা দেওয়ার যেকোন রকম চেষ্টা শুধু ভারতের বর্তমান জাতীয় ঐক্যকেই বিপন্ন করবে। তবুও যদি সংবিধান-প্রতিশ্রুত অধিকারের ব্যাপ্তি, গণতন্ত্রের গভীরতা এবং সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার ধারাবাহিকতা ও পরম্পরা এবং সার্বিক ন্যায় রক্ষায় সংবিধানে যথেষ্ট সংস্থান না থাকে, তার প্রস্তাবনা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মৌলিক চেতনাকে প্রজ্ঞাপিত করেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের বিজয়ের পর এবং আরও সুসংবদ্ধভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার ফলাফলের প্রেক্ষিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ফ্যাসি-বিরোধী গণজাগরণের অংশ হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির ভারত থেকে নিষ্ক্রমণ এবং ১৯৪৯-এ নতুন চিনের উদয় বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বের রাজনৈতিক চিত্রপটকে একেবারে নাটকীয়ভাবে পাল্টে দিয়েছিল। পরিবর্তিত এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে শুরু হয়েছিল আধুনিক ভারতের অভিযাত্রা। আজ, সেই ঐতিহাসিক ‘নিয়তি-অভিসার’-এর পঁচাত্তর বছর পর, ভারতীয় পরিক্রমা সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিমুখে এক উল্টো পথে চালিত হচ্ছে। এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসা এবং ২০১৯’এ তার বিজয়ী প্রত্যাবর্তন সঙ্ঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠানের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তার জোরেই তারা ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিগুলি পুনর্লিখনে তৎপর হয়ে উঠেছে। আর তাদের এই নতুন ব্যবস্থায় শাসক অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে আইন পরিষদ ও বিচার ব্যবস্থার ওপর আধিপত্য করছে। আর সংবিধানের বিধিগুলি নিয়ে প্রকাশ্যেই চলছে ক্রূর বিদ্রুপ আর অবজ্ঞার উদ্ধত প্রদর্শন। রাষ্ট্র এবং নাগরিকত্বকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ধারণাটি পরিত্যক্ত হচ্ছে। এক নতুন সংসদ ভবনে গণতন্ত্রকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের কঠিন নাগপাশে আবদ্ধ করার এক সময়-কয়েদে যেখানে সমালোচনা ও বিরোধিতার মৌলিক প্রকাশকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। ‘জরুরি অবস্থা’ যদি গণতন্ত্রকে দমিয়ে রাখা ও সাময়িকভাবে খারিজ করার এক নথিবদ্ধ অভিজ্ঞতা হয় যার মধ্য দিয়ে অতীতে ভারতকে যেতে হয়েছে, এখন আমরা এক স্থায়ী জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি। পুরোনো জরুরি অবস্থার শুধু একটা নিপীড়নমূলক অবস্থা ছিল। আর আজ তার নতুন ‘অবতার’ হাজির হয়েছে শাসককে বাহবা-দেওয়া এক ‘গোদী মিডিয়া’ এবং খুনী স্কোয়াডগুলোকে সঙ্গী করে যারা পথে পথে হিংস্র বিনোদন উদযাপন করছে।
স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকী মোদী সরকারকে তাদের নিজেদের অ্যাজেন্ডার প্রয়োজনে ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে বিকৃত করার ও নতুন করে লেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা, ভারতীয় জনগণ, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে অবশ্যই আবার ফিরে দেখব মুক্তি ও সাম্যের স্বপ্নকে নতুন করে জ্বালিয়ে তুলতে, যাতে ক্রমশ বেড়ে চলা ফ্যাসিস্ট আক্রমণকে আমরা প্রত্যাঘাত হানতে পারি!
সম্পাদকীয়
লিবারেশন, আগস্ট ২০২২