আজকের দেশব্রতী : ২৮ জুলাই ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-28-july-2022

Charu Mazumdar and the Glorious Legacy
charu mazumdar

৫০তম শহিদ বার্ষিকীতে কমরেড চারু মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য

কলকাতায় লালবাজার লক-আপে কমরেড চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সেই সময় ভারতীয় রাষ্ট্র নিশ্চয় এক পরম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল, ভেবেছিল তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল নকশালবাড়ি থেকে গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়া বিপ্লবী উত্থানের ঢেউ। কিন্তু পাঁচ দশক পর আজ যখন মোদি সরকার সব রকম প্রতিবাদ দমন করতে চায় তখনও তাঁকে প্রতিবাদীদের ওপর নিপীড়ন নামাতে আমদানি করতে হয় ‘আর্বান নকশাল’ শব্দবন্ধ। স্পষ্টতই, মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও, নকশালবাড়ি ও চারু মজুমদার আতঙ্ক এখনও ভারতের শাসকদের তাড়া করে ফেরে।

১৯৬৭ সালের মে মাসে নকশালবাড়ি যখন কৃষক অভ্যুত্থানে ফেটে পড়েছিল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাকে ‘ভারতের বুকে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ বলে বর্ণনা করে স্বাগত জানিয়েছিল। নকশালবাড়ি যে কৃষি বিপ্লবের দিশায় পথ হেঁটেছিল তার অনেকখানিই ছিল চীন বিপ্লবের গতিপথ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণায়। চারু মজুমদার, নকশালবাড়ি এবং দু’বছর বাদে স্থাপিত সিপিআই(এমএল) এইভাবে চীন, চীন বিপ্লব ও মাও সে তুং পরিচালিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে এক বন্ধনীতে চর্চিত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু বহু দিক দিয়ে বহু ভাবে সিপিআই(এমএল) ভারতের সমাজ ও ইতিহাসের মাটির গভীর থেকে গভীরে সাম্যবাদী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়। মার্ক্সবাদের ভারতীয়করণের পথে, মার্ক্সবাদের বিশ্বজনীন বিপ্লবী নীতিমালাকে ভারতের সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিত ও পরিস্থিতিতে প্রয়োগে, নকশালবাড়ি ছিল এক বিশাল অগ্রগামী উল্লম্ফন।

নকশালবাড়ি হঠাৎ একদিন ঘটে যায়নি। সন্দেহাতীতভাবে এর শেকড় ছিল ভারতে কৃষকের জঙ্গী আন্দোলন ও সাম্যবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের গভীরে। চারু মজুমদার ছিলেন ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠকদের অন্যতম। অবিভক্ত বাংলার ৫০ তম শহিদ বার্ষিকীতে কমরেড চারু মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য চারু মজুমদার ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গৌরবময় ধারা নিপীড়িত কৃষক সমাজের জমি ও ফসলের ওপর অধিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল তেভাগা আন্দোলন এবং সে’সময়কার অনেক কমিউনিস্ট নেতাদের মতো চারু মজুমদারকেও জেলে পোরা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর। জেল থেকে বেরনোর পর তিনি উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলাতে তেভাগা আন্দোলনের লাগাম ধরেন। তেভাগার দিনগুলির সময় থেকে জঙ্গী কৃষক আন্দোলনের সাথে এই সুগভীর ও সুদীর্ঘ সংযোগই চারু মজুমদারকে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানকে অনুধাবন করতে ও তাকে এক ব্যাপক ভিত্তিক কৃষি বিপ্লবের পথে পরিচালনা করতে দিশা যুগিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের অভ্যন্তরে চলা মহাবিতর্ক তাঁর কাছে নিছক কোনো একটা পক্ষ নেওয়ার বিষয় ছিল না, বরং তার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণছিল ভারতে নিজের দেশে চলা শ্রেণী সংগ্রামের ময়দানে বৃহত্তর বৈপ্লবিক গতিময়তার রাস্তা খুলে দেওয়া।

ভারতের প্রথম দিককার কমিউনিস্ট নেতাদের অনেকেই এসেছিলেন অভিজাত পৃষ্ঠভমি থেকে। এবং বিদেশে পড়াশোনা করার সময় তাঁরা কমিউনিস্ট মতাদর্শে দিক্ষিত হন। চারু মজুমদার শিক্ষা পেয়েছিলেন ভিন্ন ধারায়। তিনি অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কমিউনিস্ট ধারার সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন এবং কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান ছাত্রসমাজের মধ্যে বিপ্লবী জাগরণের ঢেউ তুললে চারু মজুমদার কালবিলম্ব না করে ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বান রাখেন গ্রামে গিয়ে ভূমিহীন কষকদের সাথে একাত্ম হওয়ার। তিনি আদতে তাঁর নিজের তরুণ বয়সের পথচলাকেই ফিরে দেখছিলেন। তরুণদের প্রতি এই আহ্বান ভগৎ সিংও রেখেছিলেন - ভারতের নিপীড়িত শোষিত জনতার কাছে পৌঁছে যাওয়ার আহ্বান।

নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানে সমগ্র ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সর্বভারতীয় স্তরে সমন্বয় গড়ে তোলার এবং শেষে একটি নতুন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। নতুন পার্টি প্রতিষ্ঠার কাজ চলার সময় পার্টির বিপ্লবী উত্তরাধিকার নিয়ে খুব স্পষ্ট ও জোরালো মত ছিল চারু মজুমদারের। তিনি নতুন পার্টিকে দেখেছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী ধারা হিসেবে যা কেরালার কায়ুর ও পুন্নাপ্রা-ভায়ালার, অন্ধ্রের ঐতিহাসিক তেলাঙ্গানা ও অবিভক্ত বাংলার তেভাগা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নকশালবাড়ি ও সিপিআই(এমএল) ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন পর্যালোচনার এক নতুন গভীরতর ধারারও সূত্রপাত ঘটায় যা আদিবাসী বিদ্রোহগুলির ইতিহাস সামনে নিয়ে আসে, যে বিদ্রোহগুলি বিদেশী শাসন থেকে স্বাধীনতালাভের অদম্য আকাঙ্খা জাগিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতে এক ব্যাপক ও মহান গণজাগরণের সূচনা করেছিল।
নকশালবাড়ির ঝঞ্ঝাপূর্ণ পর্বে এবং তার অব্যবহিত পরে চারু মজুমদার ও নকশালবাড়ি-অনুপ্রাণিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা প্রজন্ম নিজেদের নজর ও উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল মূলত কৃষকের গেরিলা যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে। ফলস্বরূপ নির্বাচন হয়েছিল বয়কট, আর গণ সংগঠনের সমস্ত রূপ ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম চলে গেছিল পেছনের সারিতে। চারু মজুমদারের কাছে এটা ছিল ব্যতিক্রমী এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ জরুরি ভূমিকা নেওয়া, তা কখনই নতুন কোন স্ট্র্যাটেজি ছিল না যা চিরকাল চালিয়ে যেতে হবে। নকশালবাড়ির আগে চারু মজুমদার কখনই গণসংগঠন ও গণ সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকে খারিজ করেননি, এবং তিনি নিজেই শিলিগুড়ি কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থিহিসেবে বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন।

ভারতীয় রাষ্ট্রের চরম সামরিক দমনের মুখে দাঁড়িয়ে এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতের জয়, গরিবী হটাও শ্লোগান, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ও রাজন্য ভাতার অবসান ইত্যাদির মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধির ক্ষমতা দৃঢ়তর হওয়ায় পরিস্থিতিতে যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে তার পরিপ্রেক্ষিতে চারু মজুমদার তাঁর শেষ লেখাগুলিতে ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে পার্টিকে জীবন্ত রাখা, জনগণের স্বার্থকেই পার্টির সর্বোচ্চ স্বার্থ হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, এবং কেন্দ্রে ইন্দিরা সরকার ও রাজ্যে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের স্বৈরতান্ত্রিক হামলার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের বামপন্থী ও লড়াকু শক্তির সাথে ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো – এগুলোই ছিল কমরেডদের প্রতি চারু মজুমদারের সর্বশেষ আহ্বান।

চারু মজুমদারের এই শেষ কথাগুলিই বিপ্লবী কমিউনিস্টদের পুনরায় সংগ্রামের ময়দানে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বিহারের নিপীড়িত গ্রামীণ গরিব জনতার উত্থানের অমিত শক্তি ও অসীম সাহসে ভর করকমরেড চারু মজুমদারের দ্বিতীয় শহীদ বার্ষিকীতে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হয়। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের সমগ্র সঞ্চারপথ ও চারু মজুমদারের রাজনৈতিক যাত্রাপথের শিক্ষা ও প্রেরণা পুনর্গঠিত সিপিআই(এমএল)-কে যে কেবলমাত্র ধাক্কা কাটাতে ও জরুরি অবস্থার দমনপীড়নের দিনগুলি মোকাবিলা করতেই সফল করেছে তা নয়, বরং সুদৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে বহুবিধ গণতান্ত্রিক উদ্যোগ ও সংগ্রাম গড়ে পার্টির বিস্তার ঘটাতে সমর্থ করেছে।

আজ আধুনিক ভারত যখন এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়ানক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তখন চারু মজুমদারের অদম্য প্রেরণা, দিশা ও প্রজ্ঞা ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে এক নতুন তাৎপর্য পায়। গণতন্ত্রকে নিলম্বিত ও দমিয়ে রাখাটা জরুরি অবস্থার সাথে যুক্ত ছিল, আজ তা এমন সর্বব্যাপ্ত ও স্থায়ী চেহারা নিয়েছে যে প্রথাগতভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা আর দরকার পড়ছে না। আধিপত্যকারী সংবাদ মাধ্যমকে আপাদমস্তক এমন নাটকীয়ভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে যে আজ সেন্সরশীপ চালানোও অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। আজকের এক্সেকিউটিভ কার্যত সাধারণতন্ত্রের অন্য তিনটি স্তম্ভকে নিয়ন্ত্রণ করছে – বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও মিডিয়া, এবং যেটুকু যুক্তরাষ্ট্রীয় সাম্য আমাদের ছিল তা এক্সেকিউটিভের চারপাশে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সম্পূর্ণ অস্থির করে তুলেছে।

এই সীমাহীন কেন্দ্রীকতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সাথে আসছে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ঘৃণা ও মিথ্যার ব্যাপক বিস্তার। ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বুনট এরকম আক্রমণের শিকার দেশভাগের বিভীষিকার পর কখনও হয়নি। এবং এই বিষাক্ত ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের সাথে হাত ধরাধরি করে আছে দেশের সমস্ত সম্পদ ও পরিকাঠামো ও মানবসম্পদের নিরন্তর কর্পোরেট লুট। দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার পরবর্তী ৭৫ বছরের সাংবিধানিক সাধারণতন্ত্রের অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে ভারতের জনগণ যা যা অধিকার অর্জন ও নির্মাণ করেছিল তার সবকিছুই আজ বিপন্ন। কমরেড চারু মজুমদারের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও একবার আমাদের সঞ্চিত ঐতিহাসিক সম্পদের গভীরে অনুসন্ধান চালাতে হবে এবং বিপ্লবী উদ্যোগ ও জনতার কল্পনার দ্বার খুলে দিতে হবে ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনাকে প্রতিহত করে গণতান্ত্রিক পুনর্ভ্যুদয়ের এক নবযুগ আনতে।

এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৬ জুলাই - ১ আগস্ট

(চারু মজুমদারের মুখাবয়বটি এঁকেছেন রাঁচির কমরেড বাসির আহমেদ। তাঁর মৃত্যুর মাত্র দশ দিন আগে স্কেচটি করেন তিনি)

urgent call

গত ২৫ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির স্ট্যান্ডিং কমিটি জরুরি ভিত্তিতে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকে রাজ্য পরিস্থিতির জরুরি কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করে জানানো হয়েছে –

এসএসসি দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রী তথা টিএমসির মহাসচিবের গ্রেপ্তার ও বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধারের ঘটনা টিএমসি শাসনের এক বড় ধরনের সংকট সামনে নিয়ে এসেছে। তৃণমূলের রাজত্বে সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমানসে প্রবল ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি, বর্তমান সময়ে তীব্র বেকারত্ব, দীর্ঘদিন ধরে শূন্যপদে নিয়োগ না করার বিষয়টি প্রাধান্যে রয়েছে। রাজ্য মন্ত্রীসভার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকা সম্পর্কে মূখ্যমন্ত্রী নীরব থেকে নিজের দায় এড়াতে চাইছেন। বিজেপি ঘোলা জলে মাছ ধরতে ময়দানে নেমে পড়েছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ধর্না মঞ্চের পক্ষ থেকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কাছে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে তারা আন্দোলনের সমর্থনকারী হিসাবে এই সংগঠনকে নির্ভরযোগ্য শক্তি বলে বিবেচনা করে। রাজ্য পরিস্থিতির এই আশু ও প্রধান দিকগুলি বিবেচনায় রেখে বাম বিরোধীপক্ষ সামনে আনার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। নির্ধারিত কর্মসূচিগুলি চলবে, বিশেষত গ্রামীণ জনসংযোগ অভিযানের গতি বাড়াতে হবে, কিন্তু পাশাপাশি এই চলমান ইস্যুতে যত বেশি সম্ভব শক্তি সমাবেশিত করে বর্ধিত সংখ্যায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত করতে হবে। এসএসসি ধর্ণামঞ্চের সাথে আরও শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আগামী ১ আগস্ট - ৬ আগস্ট প্রতিবাদ সপ্তাহ পালনের জন্য রাজ্যের সমগ্র সংগঠনকে সক্রিয় কর্মসূচি নিতে হবে। তৃণমূলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সাথে সাথে বিজেপির ফয়দা তোলার অপচেষ্টাকে উন্মোচিত করতে হবে।

Two burning demands

রাজ্যে স্কুল শিক্ষাক্ষেত্রে উন্মোচিত হল নিয়োগ দুর্নীতিতে কামিয়ে নেওয়া গোপনে দেরাজবন্দী করে রাখা কোটি কোটি টাকা। এ নিয়ে রাজ্য রাজনীতি এখন গরম। একদিকে পাঁচশো দিন পেরোনো অবস্থানরত হাজার হাজার শিক্ষা- কর্মপ্রার্থীদের প্রাণান্তকর অবস্থা। শেষ নেই তাদের বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-দুঃখ-যন্ত্রণার। ধর্ণা-অবস্থানে মাঝেমধ্যেই নেমে আসে পুলিশী রক্তচক্ষু ও বলপ্রয়োগ, আবার কখনো দেখা দিয়ে প্রবোধ দেন ‘মাননীয়া’। অন্যদিকে যখন সন্দেহাতীত হওয়া যাচ্ছে – বিক্রি হয়েছে চাকরি, আর অভিযোগের কাঠগড়ায় খোদ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী অধুনা শিল্পমন্ত্রী, তখন কর্মপ্রার্থীরা আশা প্রকাশ করছেন দোষীরা শাস্তি পাক, একইসাথে আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন দুর্নীতির তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার নামে নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে না তো? তাই আরও জোরালোভাবে দাবি তুলতে হবে – কর্মপ্রার্থীদের আর রাস্তায় বসিয়ে রাখা চলতে পারে না। অবিলম্বে যথাযোগ্যতার ক্রমানুসারে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এটা দেখতে হবে রাজ্য সরকারকে ও আদালতকে। এই দাবি কেন্দ্রে রেখে আসা যাক রাজ্য পরিস্থিতির কাটাছেঁড়ায়।

এই দুর্নীতির ঘটনা তৃণমূল সরকারের মুখে চূণকালি লেপে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুললেন অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হওয়ার ক’দিন পরে। তৃণমূলের দু’নম্বর নেতা এবিষয়ে এখনও অন্তরালে। তৃণমূল বস্তুত খোলা রাখছে দু’দিকের দরজা। সম্ভব হলে অভিযুক্ত নেতা-মন্ত্রীকে ‘ভুল করার শিকার’, ‘চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের শিকার’ ইত্যাদি বলে দলে রেখে দিতে পারে, এরকম যে এর আগে কখনও করেনি তা নয়, করেছে, ফের করতে পারে। তা সম্ভব না হলে তখন বরখাস্ত করে দিতে পারে। যে কারণে দলনেত্রী ও তাঁর পারিষদবর্গ বলেই রেখেছেন যদি কিছু ঘটে থাকে তার সাথে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই, দায় নেই, আর অভিযোগ প্রমাণ করতে তদন্ত ও বিচার হোক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণ হয় তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হোক, দল দেখতে যাবে না। এসব বলার পেছনে একটাই লক্ষ্য – যে কোনো মূল্যে দলের ভাবমূর্তিকে দুর্নীতির কলঙ্কস্পর্শ থেকে বাঁচানো। তবে এবার সেটা খুব কঠিন। কারণ সে ব্যাপারে নিঃসংশয় হতে হলে দলের ভেতর থেকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ যাওয়ার তথ্য ফাঁস হওয়া ঠেকাতে হবে। এ থেকে নিস্কৃতি অতো সহজে পাওয়ার নয়। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে কিছুই না জানার কথা বলছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্যতা পেতে পারে না। দলের শৃংখলা রক্ষা কমিটির শীর্ষাসনে থাকা নেতামশাই অভিযুক্ত দুর্নীতিতে, সামাল দেওয়া খুব মুশকিল, তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ট বলয়ে থাকা অন্যতম মুখ। আজ বোঝা যাচ্ছে তাঁকে শিক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়েছিল দুর্নীতির কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে। বারবার অভিযোগের আঙ্গুল উঠলেও কোন আমল দেওয়া হয়নি। এই দুর্নীতি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই সংঘটিত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে ‘সারদা’-’নারদ’ কেলেঙ্কারি, একশ দিনের কাজের মজুরির পুকুরচুরি, গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়ে যাওয়া ঘর তৈরির বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ করার ধারায়। সুতরাং কোনো হম্বিতম্বি বা কোনো অজুহাত দেখিয়ে তৃণমূল এই সমস্ত দুর্নীতি থেকে নিজেকে দায়মুক্ত দাবি করতে পারে না।

তৃণমূল আমলে এইসব দুর্নীতির ঘটনায় বিজেপি আবার খুব লাফাতে শুরু করেছে। কিন্তু হিন্দুত্বের বিদ্বেষ-বিভাজন ঘৃণার রাজনীতির কারবারি দল বিজেপি দুর্নীতিতে ভারত সেরা চূড়ামণি। বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে রেড্ডী ভাইদের কয়লা খনি বণ্টন কেলেঙ্কারি বা মধ্যপ্রদেশে মেডিক্যাল ছাত্রভর্তি সংক্রান্ত ‘ভ্যাপম কেলেঙ্কারী’র কুকীর্তি হল দৃশ্যমান শিলাখণ্ড মাত্র। কেলেঙ্কারি রয়েছে আরও – বিজেপি হল ‘পি এম কেয়ার্স’ আর ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ ভাঙিয়ে অন্যদলের ‘ঘোড়া’ কিনে চলা কেলেঙ্কারীর মূর্তিমান প্রতীক। অতএব বিজেপিকে এতটুকু ফাঁকা জমি দেওয়া চলবে না।

Judicial Injustice_0

একজন আদিবাসী মহিলা দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। ঠিক একই সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারের এক সুপারিশ গ্রহণ করেছে। কী সেই সুপারিশ? সেই সব আদিবাসী মহিলা যারা পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার বিচার চেয়েছেন, তাদের ষড়যন্ত্র কারী ও অপরাধী হিসাবে গণ্য করতে হবে! বিজেপি শ্রীমতী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পছন্দের উমেদারি করেছে প্রতীকী অন্তর্ভুক্তির একটি বিষয় হিসেবে। সেই একই বিজেপি, রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তির বিধিবদ্ধ হিংস্রতার বিরুদ্ধে আদিবাসী নারীদের ন্যায় বিচার চাওয়ার যে কোনো চেষ্টাকে ‘অপরাধ’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে! এটা নিয়ে দ্বিতীয়বার সুপ্রিম কোর্ট তার নিজের আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থীদেরই ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করল। প্রথম রায়ে, ২০০২তে গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন যারা, তাদের জন্য বিচার চাওয়ার ‘অপরাধে’ তিস্তা শেতলবাদ সহ গুজরাট পুলিশের প্রাক্তন আধিকারিকদের ‘দোষী’ সাব্যস্ত করেছিল। ১৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট গান্ধীবাদী সমাজকর্মী হিমাংশু কুমার এবং ১২ জন আদিবাসী মানুষ, যারা বস্তারে ২০০৯-এ আদিবাসী গণহত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত চাইতে গিয়েছিলেন শীর্ষ আদালতে, তাদেরই দোষী সাব্যস্ত করল।

এই রায়ে আদালত এই যুক্তি দেখিয়েছে : যেহেতু রিট আবেদনকারীদের পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে বিভিন্ন থানায় দায়ের করা এফআইআরগুলির তদন্ত হয়েছে এবং তদন্তকারী সংস্থা এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে পুলিশবাহিনী নয়, বরং মাওবাদীরাই এই গণহত্যা ঘটিয়েছে, তাই “আপাতদৃষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে এটা বলা যায় যে তথাকথিত পুলিশবাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে প্রথম সংবাদদাতারা পুলিশকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল”।

এই যুক্তি এক বিপজ্জনক পূর্বনজির তৈরি করল যা গণহত্যাকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া মানুষ ও সাক্ষীদের এফআইআর নথিবদ্ধ করতেও বাধা দেবে, যদি তারা সেই ঝুঁকি নেয় তো সেজন্য তাদের শাস্তি পেতে হবে। তা ছাড়াও, ভারত সরকার শীর্ষ আদালতে যে বিবৃতি দাখিল করেছে তা পরস্পরবিরোধী দাবি তৈরি করেছে। এতে হিমাংশুকে, এক সংঘর্ষে নিহত মাওবাদীদের মিথ্যাভাবে “নিরাপত্তাবাহিনীর দ্বারা নিহত আদিবাসী মানুষ জন” বলে তুলে ধরার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আবার একই সময়ে তাঁকে, মাওবাদীদের সংঘটিত গণহত্যাকে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা বলে চালানোর চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই হলফনামা কার্যত দাবি করছে যে গোস্পদ গ্রামে এক এনকাউন্টারে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী সশস্ত্র মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। এও বলা হয়েছে যে মাওবাদীরা তাদের আহত কর্মীদের সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ আহত হয়নি। আবেদনকারীরা দাবি করেছে, গণহত্যার শিকার যারা হয়েছেন, তারা সাজানো ভুয়ো “সংঘর্ষে” নিহত নিরস্ত্র গ্রামবাসী। সরকার উল্লিখিত গণহত্যা স্থলে তার বাহিনীর উপস্থিতির কথা স্বীকার করেছে এবং দাবি করেছে গণহত্যার বলি মানুষজন ছিল “সংঘর্ষে” নিহত মাওবাদী। এরপর সুপ্রিম কোর্ট কী করে সরকারের এই পরস্পরবিরোধী অভিযোগ গ্রহণ করতে পারে যে, আবেদনকারীরা মাওবাদীদের দ্বারা “নিরীহ আদিবাসীদের” হত্যাকে আড়াল করার জন্য রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর দোষ চাপানোর ষড়যন্ত্র করেছিল?

যদিও সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে আদিবাসী আবেদনকারী ও তাদের হিমাংশু কুমারের মত শুভানুধ্যায়ীদের গ্রেফতার ও নিগ্রহ করার ব্যাপারে উৎসাহদাতার ভূমিকায় রয়েছে, ছত্তীশগড়ের একটি এনআইএ কোর্ট, ৫ বছর ইউএপিএ-তে আটক থাকার পর ১২১ জন আদিবাসীকে, ২০১৭ সালে বস্তারে কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনীর ২৫ জন কর্মীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাওবাদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। নিরপরাধ আদিবাসী গ্রামবাসীরা তাদের জীবনের পাঁচটি বছর হারিয়ে ফেলেছেন কারা প্রাচীরের অন্তরালে। আর যে পুলিশ ও প্রশাসন তাদের বলির পাঁঠা বানিয়েছিল, তাদের কোনো শাস্তি হবে না, ক্ষমা চাইতেও বলা হবে না, ক্ষতিপূরণের বিষয়টি তো ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না!

সংঘর্ষের এলাকায় আদিবাসীদের গণ কারাভোগ, গণহত্যা ও গণধর্ষণের উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়। কিন্তু তাদের পক্ষে এই হিংস্র ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে আদালতের দরজায় বিচারপ্রার্থী হয়ে পৌঁছানো সম্ভব হত না, যদি না মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা এগিয়ে আসতেন যাঁরা এই কাজে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটা দলিত এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রেও সত্য যাদের অন্যায় গণ কারাভোগ ও পরিকল্পিত গণহত্যার শিকার হতে হয়। তিস্তা শেতলবাদ, যাঁর সহায়তা ও হস্তক্ষেপে গুজরাট দাঙ্গার ৮৮টি মামলায় ১২০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছিল, তিনি নিজেই আজ কারারুদ্ধ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ‘সৌজন্যে’, যে প্রতিষ্ঠান এখন রাজনৈতিক শীর্ষ কর্তাদের ‘হাত’ হয়ে কাজ করছে! সুধা ভরদ্বাজ এবং স্ট্যান স্বামী, দু’জনেই ভীমা কোরেগাঁও মিথ্যা মামলায় ‘অভিযুক্ত’ হয়েছিলেন। এঁরা উভয়েই যথাক্রমে ছত্তীশগড় ও ঝাড়খণ্ডে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল জেলে পচতে থাকা আদিবাসীদের মুক্ত করার উদ্যোগের জন্যই সুপরিচিত।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা কথা প্রসঙ্গে এই সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, “আমাদের অপরাধের বিচার পদ্ধতিতে, প্রক্রিয়াটিই একটি শাস্তি। তড়িঘড়ি নির্বিচারে গ্রেফতার থেকে জামিন পাওয়ার সমস্যা পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াটা বিচারাধীনদের দীর্ঘ কারাবাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিষয়টিতে অবিলম্বে নজর দেওয়া দরকার। “প্রশ্ন উঠছে, কেন ভারতের প্রধান বিচারপতির সহকর্মী বিচারপতিরা একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারকে অপরাধের বিচার পদ্ধতিকে হাতিয়ার করে সেই মানবাধিকার কর্মীদেরই শাস্তি দেওয়ার সুযোগ করে দিলেন একমাত্র যারা এই অপরাধের বিচার পদ্ধতিটার মেরামতি চেয়েছিলেন, যেটা ভেঙে গেছে বলে স্বয়ং ভারতের প্রধান বিচারপতি স্বীকার করে নিয়েছেন? বাথানিটোলা (১৯৯৬) এবং লক্ষ্মণপুর বাথে (১৯৯৭)-র ঘটনার শিকার হয়েছিলেন যেসব নির্যাতিত জাতি ও সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তারা সেই ২০১২ থেকে অপেক্ষা করে আছেন সুপ্রিম কোর্ট কবে তাদের আবেদন শুনবেন! পাটনা হাইকোর্ট ঐ সব ঘটনার সমস্ত অপরাধীকে গণ খালাস দিয়েছিল। সেই রায়কে উল্টে দেওয়ার আবেদন নিয়ে নির্যাতিতরা প্রতীক্ষায় আছেন। সেইসব সাক্ষী আর বেঁচে যাওয়া নিগৃহীতরা যারা আবেদন দাখিল করেছিলেন, তাদের কি আজ ভয় পেতে হবে যে সুপ্রিম কোর্ট শুধু তাদের ন্যায় বিচারকে প্রত্যাখ্যানই করবে না, তাদের শাস্তি দেবে, আর তাদের ও যেসব আন্দোলন তাদের ন্যায় বিচারের খোঁজকে সম্ভব করেছিল সেগুলিকেও ‘অপরাধী’র তকমা দেবে?

এই সরকার-পোষিত বিচার বিভাগীয় অবিচারের মুখে দাঁড়িয়েও মানুষের ন্যায়ের তালাশ বেঁচে থাকবে আর শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে!

এম এল আপডেট সম্পাদকীয়
খণ্ড- ২৫, সংখ্যা-৩০, ১৯-২৫ জুলাই, ২০২২

We want an impartial and free investigation

এসএসসি নিয়োগের দাবিতে যুব-ছাত্র অধিকার মঞ্চের ধর্ণাস্থলে সিপিআই(এমএল) নেতৃবৃন্দ

স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগের দাবিতে যুব-ছাত্র অধিকার মঞ্চের আন্দোলন আজ ৪৯৯ দিনে এসে উপস্থিত। তাদের ধর্ণা স্থলে ২৬ জুলাই যান ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী- লেনিনবাদী) লিবারেশন এবং যুব-ছাত্র-মহিলা ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের প্রতিনিধি দল।

অল মেরিটের উপর ভিত্তি করে স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে সকল উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীদের রাস্তায় দিনের পর দিন বসে থাকতে হচ্ছে। দেশে বেকারত্ব লাগাম ছাড়া। রাজ্যে শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংখ্য শূন্য পদ রয়েছে। নগদ টাকার বিনিময়ে দুর্নীতিকে আশ্রয় করে রাজ্যে মেধা পরিত্যক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়গুলির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বক্তব্য রাখলেন, সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি তথা পলিটব্যুরো সদস্য পার্থ ঘোষ ও কার্তিক পাল, নিলাশিস বসু (রাজ্য সভাপতি, আইসা), মহিলা সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রানী দত্ত এবং এআইসিসিটিইউ রাজ্য নেতৃত্বের নবেন্দু দাশগুপ্ত ও মীনা পাল, আরওয়াইএ-র রাজ্য সম্পাদক রণজয় সেনগুপ্ত।

আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে যান নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে কী সুরাহা করা হয়েছে তা জানতে। অনেক টালবাহানার পর, চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার দেখা করতে সম্মত হন এবং জানান তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। বিচারপতি যদি নিয়োগের রায় দেন, তাহলে পরবর্তী তিনদিনের মধ্যে তারা নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দকে তাদের নিয়োগের দাবি নিয়ে বিচারপতিকে একটি চিঠি দেওয়ার প্রস্তাব জানান। প্রতিনিধিদল সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে। বিচারপতি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এসএসসি-র নিয়োগে দুর্নীতি বিরুদ্ধে এবং স্বচ্ছতার নীতি অনুসারে সমস্ত প্রার্থীর চাকরি নিয়োগের দাবিতে চিঠি দেবেন। পার্টি নেতৃত্ব তাদের এই লড়াইকে সংহতি জ্ঞাপন করেন এবং আগামীদিনেও এই লড়াইয়ে সঙ্গে থাকার অঙ্গীকারের কথা বলেন।

এসএসসি দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যের হাইকোর্ট নির্দেশিত তদন্তের সূত্রে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার ২৩ জুলাই এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ছাত্র ও যুব সংগঠন আইসা ও আরওয়াইএ-র পক্ষ থেকে শিক্ষক চাকরি প্রার্থীদের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়া চলেছে। এমনকি মিছিল ও সভা করার জন্য রাজ্য পুলিশের হাতে উপর্যুপরি হেনস্থা ও গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। ইতিপূর্বে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য দপ্তর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি পেশ করে জোরালো ভাষায় নিয়োগ দুর্নীতির অবসান ঘটানো ও যোগ্য প্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগপত্র দেওয়ার জন্য ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তাকে কার্যকরী করার দাবি জানানো হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এই ন্যায্য দাবিগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন এবং তাঁর ক্যাবিনেট সদস্যদের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি আড়াল করতে সচেষ্ট থেকেছেন। তৃণমূলের রাজত্ব ব্যাপক দুর্নীতি, তোলাবাজি ও অপশাসনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এসএসসি সহ সমস্ত নিয়োগ দুর্নীতির কার্যকরী তদন্ত ও তদন্ত সাপেক্ষে দোষী প্রমাণিত মন্ত্রী ও আধিকারিকদের কঠোর শাস্তিদানের প্রক্রিয়াকে অবাধ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পরেশ অধিকারী সহ সংশ্লিষ্ট তৃণমূল নেতা, মন্ত্রী ও সমস্ত অভিযুক্ত আধিকারিকদের অবিলম্বে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছে পার্টি।

– অনন্যা

Deocha-Pachami villagers

অযোধ্যা পাহাড়ে সরকারি সমীক্ষক দলকে ফেরত পাঠাল গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ

দেওচা-পাচামি

২৫ জুলাই দেওচা-পাচামির গ্রামবাসীরা সিউড়ি শহরে এক দৃপ্ত মিছিল সংগঠিত করে জেলাশাসকের দপ্তর অভিযানে যায়। জেলাশাসক প্রথমে প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করলেও প্রায় দুঘন্টা অবরোধের পর ডেপুটেশন জমা নেন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও হাজার দুয়েক গ্রামাবাসী তীর ধনুক ইত্যাদি প্রথাগত হাতিয়ার হাতে দৃপ্ত মিছিল করে জানিয়ে দেয় যে তাঁরা কয়লাখনি চাইছেন না। গত ১৩ এপ্রিল নবান্নে গ্রামবাসীদের সাথে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে গ্রামবাসীরা না চাইলে জোর করে প্রকল্প হবে না এবং আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো মামলা প্রত্যাহার করে নেবে সরকার। কিন্তু তিনমাস অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও সরকার মামলা তোলার কোনও উদ্যোগ নেয়নি, অন্যদিকে নানা অছিলায় গ্রামবাসীদের মতামত অগ্রাহ্য করে গায়ের জোরে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। এদিনের মিছিল থেকে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত হয় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। বীরভূম জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঠুড়গা

গত ২৪ জুলাই সরকারি সমীক্ষক দল পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্টের সার্ভের কাজে অযোধ্যা পাহাড়ে গেলে গ্রামবাসীরা তাদের বাধা দেয় ও ফিরে যেতে বলে। গ্রামবাসীরা বিগত কয়েক বছর ধরে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আদালতে ও রাস্তায় আন্দোলন করছেন। এই প্রকল্প ওই এলাকার জনবসতির ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, বহু অরণ্য সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে, চারপাশের চাষজমিও নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া এই পাহাড় আদিবাসী সান্তাড় সমাজের পবিত্র স্থান বলেও পরিচিত। আদিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই প্রকল্প করতে চাইছে সরকার। গ্রামবাসীরা এবার সরাসরি বাধা দেয় সরকারি সমীক্ষা দলকে। খবর পেয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী এলে তাদেরও ঘিরে ধরে গ্রামবাসীরা। ব্যাপক ক্ষোভের মুখে পুলিশ ও সমীক্ষা দল ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

PUCL in protest

২০০২ সালের গুজরাটের গণহত্যার সুবিচার প্রার্থনা করার ‘অপরাধে’ সমাজকর্মী আইনজীবী তিস্তা শেতলবাদকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ২০০৯ সালে ছত্তিশগড়ে ১৭জন আদিবাসীদের মিথ্যা এনকাউন্টারের নামে হত্যার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন গান্ধীবাদী সমাজকর্মী হিমাংশু কুমার। তার আবেদন শুধু খারিজই করা হল না, উপরন্তু তাঁকে ৫লক্ষ টাকা জরিমানা করা হল। এই দুই ক্ষেত্রেই যে ভয়ঙ্করতা লক্ষ্যনীয় তা হল রায়দানের সময় জানিয়ে দেওয়া হল যে এই দুজনের বিরুদ্ধেই রাজ্য প্রশাসন ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা দায়ের করতে পারবে। যার ভিত্তিতে রায়দানের পরেরদিনই গুজরাটের পুলিশ মুম্বই গিয়ে তিস্তা শীতলবাদকে গ্রেফতার করল এবং মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে জেলে পাঠিয়ে দিল। মহম্মদ জুবেরকে গ্রেপ্তার করে হাজতে ফেলে রাখা হয়েছিল কেবলমাত্র সত‍্য সাংবাদিকতার জন‍্য। তাঁর সংবাদ সংস্থাকেও এখন টার্গেট করা হচ্ছে বিদেশি ফাণ্ডের ষড়যন্ত্র তকমা দিয়ে। অন্যদিকে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মেধা পাটকার সহ অন্যান্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। তাঁরা নাকি নিজেদের তহবিল তছরুপ করে দেশবিরোধী কার্যকলাপে খরচ করেছে! এই পরিস্থিতিতে হিমাংশু কুমারের উপর থেকে জরিমানা প্রত্যাহার ও তিস্তা শীতলবাদ সহ প্রতিটি রাজ্যে মিথ্যা মামলায় বন্দী সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তির দাবিতে এআইএলএজে এবং পিইউসিএল গত ২২ জুলাই প্রতিবাদ সভা করে যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ডে। শুরুতে গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান নীতীশ রায়। সভায় বক্তব্য রাখেন ডাঃ বিনায়ক সেন, মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র, প্রাক্তন বিচারক মাননীয় শ্রী তপন দাস, আইনজীবী পার্থ ব্যানার্জী, আইনজীবী অভিজিৎ দত্ত, পিইউসিএল অম্লান ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ।

ডাঃ বিনায়ক সেন বক্তব্যে বলেন, “আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে বর্তমান সময়ে চলেছি। উদ্বেগের কারণ, পূর্বের ভারতীয় বিচার-ব্যবস্থার যে ঐতিহ্যময় দিনগুলি স্মরণে আসে তার সাথে আজকের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝের ৭৫সনের ২১ মাসের জরুরি অবস্থা বাদ দিলে, ভারতীয় বিচার-ব্যবস্থাই মানুষের শেষ ভরসা। ৮০র দশকে প্রসার ভারতী প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের জনস্বার্থ মামলা করার অধিকার, জনগনের খাদ্যের অধিকার, নাগরিকের ভোটাধিকারের প্রশ্নে নোটার অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারতীয় বিচার-ব্যবস্থার যে সহযোগিতা ও সুদৃঢ মতামত আমরা পেয়েছি, আজ সেই বিচার বিভাগের অন্য ভূমিকা দেখছি। আজ নাগরিক-অধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রই শেষ কথা বলছে। বর্তমানে তিস্তা শীতলবাদ, হিমাংশু কুমার, মেধা পাটেকর, ফাদার স্ট্যান স্বামী সহ আরো অনেক সমাজকর্মীর প্রশ্নে সুপ্রীম কোর্টের রায় আমাদের মনে প্রশ্ন তুলেছে। নাগরিক সমাজের মনে বিচার বিভাগ সম্পর্কে এই প্রশ্ন দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করবে বলে আমরা মনে করি। ইতিমধ্যে বহু সমাজ-কর্মী গণতান্ত্রাতিক মানূষকে নানা মামলায় হয়রানি হতে হয়েছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, বিচারের প্রার্থীকেই বিচারক দোষী সাব্যস্ত করছে, যা এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ভয়ঙ্কর। এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তাই আজকের এই সভা।” আইনজীবী লিটন ভাদুড়ি, আইনজীবী মালা সেন চৌধুরী সহ বুদ্ধিজীবীরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভা পরিচালনা করেন এবং বক্তব্য রাখেন এআইএলএজে-র সর্বভারতীয় সহসভাপতি আইনজীবী দিবাকর ভট্টাচার্য।

CPIML seeks information

(৭ জনের টীম বিষমদ কান্ডে মৃত ব্যক্তিদের পরিবার, প্রতিবেশী ও মালিপাঁচঘরা থানার আইসি-র সাথে কথা বলে তৈরি করেছেন এই রিপোর্ট)

গত ১৯ জুলাইয়ের রাতটা হাওড়ার মালিপাঁচঘরা থানার অন্তর্গত গজানন বস্তি এলাকার মানুষের কাছে এখন দুঃস্বপ্নের অন্য নাম। মূলত বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে কাজের খোঁজে আসা কয়েকশো পরিবারের অস্থায়ী ঠিকানা এই বস্তি। আর পাঁচটা বস্তির মতোই এখানেও নিকাশি অবস্থার হাল চরম বেহাল, স্থানীয় পরিবারগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিই অর্থনৈতিক দিক থেকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত এবং সারাদিন চরম খাটুনির পরে বাড়ি ফিরে দেশি মদের নেশা করা এক স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছিল এখানে। যেখানে তাদের ন্যূনতম রেশন নেই, স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই, মুটে-মজদুরি খাটার মতো পেশারও কোনও নিশ্চয়তা নেই – সেখানে হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবেই এই কঠোর বাস্তব থেকে নিজেকে খানিকক্ষণ বিচ্ছিন্ন রাখার তাগিদে থেকেই হয়তো কেউ কেউ শুরু করেছিলেন নেশা করা। তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। প্রত্যেকদিনের এই অবিরত আবর্তেই চলতে থাকে গজানন এবং এদের মতো আরোও অনেক বস্তির জীবনচক্র।

আপাত শান্ত এই এলাকার সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল গত ১৯ জুলাই থেকে।

স্বপন দাস পেশায় স্থানীয় লোহার কারখানায় ঠিকামজুর। অন্যদিনের মতো এ দিনও তিনি তার বাড়ির থেকে দুপা দূরে গত ৪০ বছর ধরে চলা মদের বেআইনি ঠেকে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়িতে টলমল পায়ে ঢুকতে ঢুকতেই শুনতে পেলেন তার মেয়ে (যে এইবার উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে) ফর্ম ফিলআপ করেছে কলকাতার এক কলেজে। স্বপন দাস নিজে কখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি, তার মনের মধ্যে আনন্দ আর দুশ্চিন্তা একসাথেই ভর করেছিল কিনা তা আর জানার উপায় থাকেনি। সেই রাত্রেই খিচুনি উঠে তার একমাত্র মেয়ে স্নেহার সামনেই কাতরাতে কাতরাতে নিথর হয়ে যায় তার দেহ। অনেক আকুতি মিনতির পরে এক প্রাইভেট ডাক্তার এসে ১০০০ টাকার বিনিময়ে লিখে দেন স্বপন দাস মৃত। “মদ খেয়ে মরেছে” – এই কারণে কার্যত এক অসহায় মহিলা ও তার মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নিকটাত্মীয়েরা !!

সেই রাতেই একের পর এক ঘরে আলো জ্বলে উঠতে থাকে। হাহাকার আর কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।

তিন বছর ও দেড় বছরের দুই শিশুকে ফেলে রেখে মারা গেলেন ২০ জুলাই রাত্রে নীতীশ সিং। বিহার থেকে জনমজুরির কাজে আসা ‘বিস্কুট লাল’ (এই নামেই সে পরিচিত) এর দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্যাকেট বন্দী করে ছাপরা জেলায়।

সরকারি হিসাব বলছে মৃতের সংখ্যা ৯, বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা মোটেই ৯ নয়।

স্বপন দাসের স্ত্রীর দাবি তার স্বামীর দেহের সামনে তাকে কাঁদার সময়টুকু দেয়নি আমাদের উর্দীধারী পালোয়ানেরা! পোস্টমর্টেম না করেই তড়িঘড়ি সালকিয়া বাঁধাঘাটে অন্ত্যেষ্টি শেষ করা হয় তার।

এখনও বার্নিং ঘাটের একটা স্লিপ ছাড়া কোনও সরকারি নথি পাননি তার স্ত্রী। নীতীশ সিং-এর ভাইয়ের দাবি হাসপাতাল ও সৎকার বাবদ ১৫০০০ টাকা খরচ করার পরেও পুলিশ তার ভাইয়ের দেহ পাড়ায় আনতে দেয়নি। ছোটো ছোটো দুটো শিশু যারা সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে তারা টলমল পায়ে আজকেও এঘর ওঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের বাবা কে।

ওই বস্তির ওই নকল দেশী মদের ব্যাবসা চালাতো প্রতাপ নামে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এক স্থানীয় গুণ্ডা। ঘটনার পরে সে সহ আরোও কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। শাসকদলের ও পুলিশের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে দিনের পর দিন নকল মদ বানিয়ে ভাটির ব্যবসা চলতো রমরমিয়ে। তার খেসারত দিত হল এতোগুলো পরিবারকে, মানুষকে তাদের জীবন দিয়ে। এখনও প্রায় ৪০ জন মৃত্যুর সাথে লড়ছেন সত্যবালা/হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে!!

অনুসন্ধান শেষে প্রতিনিধিদল গিয়েছিল ঘটনাস্থল থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে থাকা হাওড়া মালিপাঁচঘরা থানায়। সেখানে আই সি-র সাথে বিস্তারিতভাবে কথা হয় অনুসন্ধানকারী দলের রিপোর্টনিয়ে। এই ঘটনায় পুলিশ কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছে। ১৯/২০ জুলাই রাতে পুলিশের ভূমিকা, ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বপন দাসের দেহ সৎকারের প্রসঙ্গে আইসি জানান হাসপাতালের ডাক্তার নাকি ময়নাতদন্তের জন্যে না লিখলে সেটা করা যায়না। অনুসন্ধানকারী দল পরিস্কারভাবে ক্ষোভের কথা আইসিকে জানাতে তিনি অনুরোধ করেন এরকম কোনও অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট পরিবার এসে থানায় এফআইআর দায়ের করতে চাইলে তিনি সহযোগিতা করবেন। আইসি-র সামনে কেসের ডিটেলস সহ অন্যান্য নানা বিষয়ে আমাদের ও স্থানীয়দের অসন্তোষ এর কথা তুলে ধরা হয়। আইসি কথা দেন যে আর এই মদের ভাটি চলতে দেওয়া হবে না। তিনি অনুসন্ধানকারী দলের দাবি মেনে থানার কমিউনিটি ডেভলপমেন্টে কর্মসূচির মাধ্যমে এলাকায় নেশামুক্তির প্রচার করবেন ও দরকারে এলাকার যুবদের এই কর্মসূচিতে যুক্ত করবেন বলেন। পার্টি প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আর্থিক ক্ষতিপূরণ/পিতাহারা ছেলে/মেয়েদের বিনামূল্যে স্কুল/কলেজে ভর্তি ও পড়াশোনার জন্যে সরকারি সাহায্যের দাবি স্বামীহারা মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলা ও সরকারি ভাতার দাবি নিয়ে জেলাশাসকের কাছে স্মরকলিপি জমা দেওয়া হবে।

সরকারি সাহায্যের দাবিতে লড়াই জারি রাখার পাশাপাশি আইসা হাওড়া জেলা কমিটি বিষমদে প্রয়াত স্বপন দাসের মেয়ে স্নেহা দাসের কলেজে ভর্তী ও পড়াশোনার সমস্ত খরচের দায়িত্ব নেয়। এই অঙ্গীকার করা হয়েছে। পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে যাতে এখনও দায়ের হয়নি এমন মামলাগুলো থানায় নথিবদ্ধ হয়। অনুসন্ধানকারী প্রতিনিধি টীমে ছিলেন পরিতোষ ব্যানার্জি, কল্যাণী গোস্বামী, অঙ্কিত মজুমদার, রতন দত্ত, প্রণব মন্ডল, এ কে গুপ্তা, ও কার্তিক পান্ডে।

- অঙ্কিত

Cultural Stages

দেশব্যাপী কট্টর সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের আক্রমণ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকের সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম নিয়ে প্রতিবাদী প্রতিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গত ৮ মে বারাসাত তিতুমীর সভাকক্ষে আহুত কনভেনশনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছিল “প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চ”। সেই কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এই মঞ্চের শাখা বা এর সাথে যুক্ত সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এরকম দুটি আঞ্চলিক ইউনিট আত্মপ্রকাশ করল বনগাঁ ও বারাসাতে।

গত ৯ জুলাই বনগাঁর কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের অতীশ বিশ্বাস সভাকক্ষে গড় উঠল “বনগাঁ সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চ”। এই উদ্যোগে বনগাঁর শতাধিক সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের মানুষ উপস্থিত হন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বরিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী অনাথবন্ধু ঘোষ। সভায় প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষে সম্পাদক দীপক মিত্র প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার যে প্রয়াস চলছে তার বিরুদ্ধে লেখক শিল্পী কলাকুশলীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে। বনগাঁ সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষে প্রস্তুতি কমিটির সম্পাদক দেবাশিস রায়চৌধুরী মঞ্চ গঠনের উদ্দেশ্য লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, বর্তমান সময়ে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কর্মীর শাসক ঘনিষ্ঠতা, সুবিধাবাদী প্রবণতা পরোক্ষভাবে দেশে সার্বিক স্বৈরাচার, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত ঘটাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। এই প্রেক্ষিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি আরো বলেন, এই মঞ্চ সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে আলোচনা সভা, বিতর্কসভা, পথনাটিকা সহ অনান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে এবং সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করবে। অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় নৃত্য, মূকাভিনয় “রামমোহন” পরিবেশন করে বনগাঁ কালুপুর হিন্দোল সংস্থা, গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান বাবুনি মজুমদার। সবশেষে, “রামমোহন রায় : অনির্বাণ অগ্নিশিখা” শীর্ষক আলোচনা করেন বিশিষ্ট গবেষক কণিষ্ক চৌধুরী। এক কথায় এই মঞ্চের আত্মপ্রকাশ বনগাঁর সাহিত্য সংস্কৃতির ভূগোলে আত্মসমর্পণের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আপোষহীন প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বার্তা দিল।

২০ জুলাই নাট্যশহীদ প্রবীর দত্তকে স্মরণ করে বারাসাত সুভাষ ইন্সটিটিউটে আত্মপ্রকাশ করল প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের দ্বিতীয় ইউনিট “বৃহত্তর বারাসাত প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চ”। এদিনের অনুষ্ঠানে বারাসাত অঞ্চলের সাহিত্য সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের উপস্থিতি ছিল সার্বিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। কমবেশি দেড়শোর মতো দর্শক ও শিল্পী সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন বরিষ্ঠ গণসঙ্গীত শিল্পী দুলাল চ্যাটার্জি। নবগঠিত মঞ্চ গঠনের উদ্দেশ্য বিষয়ে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন সমীর চক্রবর্তী, যিনি এই মঞ্চের নবনির্বাচিত সম্পাদক। “বিশে জুলাই, প্রবীর দত্ত ও আজকের প্রাসঙ্গিকতা” শীর্ষক আলোচনা করেন নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবাশিস চক্রবর্তী। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই কার্জন পার্কে যেভাবে প্রবীর দত্তকে পিটিয়ে মেরেছিল, আজও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিভিন্ন ইস্যুতে হত্যা, নিপীড়ন চালাচ্ছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে। প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলায় জেলবন্দী করছে। এর বিরুদ্ধে সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন অনুপম সেনগুপ্ত, মহীউদ্দীন মণ্ডল এবং পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের মধ্যমগ্রাম শাখা। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার, সৌমেন রায় ও জনগণমন সংস্থার সদস্যরা। মূকাভিনয় পরিবেশন করেন মছলন্দপুর ইমন মাইম সেন্টার। সবশেষে তিনদিক দর্শক পরিবেষ্টিত অঙ্গনে 'আয়না' নাট্য সংস্থা করে দেখায় নাটক – “না"।

এই দুটি সংস্থার আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আরও কিছুটা বাড়তে সফল হল। এই লক্ষ্যে প্রতিবাদী সাহিত্য সংস্কৃতি মঞ্চের আরও ইউনিট গঠনের উদ্যোগ চলবে।

The BJP government

বিজেপি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রক আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে কোনও নিয়োগই করেনি। কেন্দ্রীয় শিক্ষা দপ্তরের অধীনে এসটিদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ৯২% ফাঁকা। এসসিদের ক্ষেত্রে শূন্য ফেলে রেখেছে ৮২% পদ। কেন্দ্রীয় রাজস্ব দপ্তরে শূন্য পড়ে আছে এসটি ও এসসিদের যথাক্রমে ৯৩% ও ৮৫% পদ। তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় করা প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে এসসি- এসটিদের জন্য সংরক্ষণ চালু করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মোদি সরকার জানিয়েছে যে, কর্পোরেট কোম্পানিরা সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে কোনও সমাধান হিসেবে দেখে না। সরকারি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ যখন খুবই কমে এসেছে তখন বিজেপি সরকার এসটি ও এসসিদের সংরক্ষণের সুযোগ প্রসারিত করার বদলে সংকুচিত করছে।

unemployment, underdevelopment

চাকরি নিয়ে তুমুল মস্করা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে নাকি ৩০ হাজার চাকরি তৈরি! সরকার নাকি শুধুমাত্র নিয়োগপত্র দেওয়ার অপেক্ষায়। একই নিঃশ্বাসে শিল্প নিয়ে বলে গেলেন অবান্তর, আবোলতাবোল কিছু কথা “শিল্প শুধুই কি কাঠ-খড়? শুধু বালি-সিমেন্ট? শিল্প মাটি-ঘাস-গাছ থেকে হয়”। এটা বলতে তিনি কোন ধরনের শিল্পের কথা বোঝালেন, কর্মসংস্থানের কোন বিকল্প ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করলেন তা ধোঁয়াশাই থেকে গেল। এদিকে, রাজ্যে কর্মসংস্থানের মর্মান্তিক ছবি দিন কয়েক আগে ফুটে বেরোলো। সংবাদে প্রকাশ, মালদায় সরকারি কর্মসংস্থান কেন্দ্র পরিচারিকাদের জন্য একটা প্রশিক্ষণ শিবির সংগঠিত করে, যাতে অংশ নেন ৪০ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মহিলারা! তিনদিন ধরে চলা মালদা যুব আবাস কেন্দ্রে এই প্রশিক্ষণ শিবিরে শেখানো হল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শুশ্রূষা, শিশু ও বৃদ্ধদের কিভাবে দেখভাল করতে হয়, ফার্স্ট এইড, ঘর গোছানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পদ্ধতি ইত্যাদি। তিনদিনের প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা পেলেন ৬৫০ টাকা ভাতা, একটা ব্যাগ ও সার্টিফিকেট! রাজ্যের কর্মসংস্থানের হাল যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা এই ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয়।

মুখ্যমন্ত্রীর এই ৩০ হাজারের শিল্প মানচিত্রই বা কি? দেউচা-পাঁচামী কয়লা ব্লক অধিগ্রহণের সময় তিনি তখনও বিপুল কর্মসংস্থানের গপ্পো শুনিয়েছিলেন। এযেন সব শিয়ালের এক রা! ক্ষমতার সিংহাসনে বসা সমস্ত রঙ বেরঙের শাসক কর্মসংস্থান নিয়ে যে সুরে কথা বলেন, মমতার কন্ঠেও তার প্রতিধ্বনি! কিন্তু, একবারের জন্যেও তিনি জানালেন না, রাজ্য সরকারের দপ্তরগুলোতে কত শূন্যপদ রয়েছে, সেগুলো পূরণের জন্য সরকার কী ভাবছে, সরকারি দপ্তরগুলোতে অনেক কম মাস মাইনের বিনিময়ে বেলাগাম অস্থায়ী, ক্যাজুয়াল কর্মী নিয়োগের যে অনিয়ন্ত্রিত খেলা চলছে, এটাই কি তবে রাজ্যে কর্মসংস্থানের আসল গল্প?

দশ বছর পর রাজ্য শ্রমদপ্তর বাড়ালো ১০ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য। দশ বছরের মূল্যস্ফীতি যদি এই মজুরি বৃদ্ধির সাথে যুক্ত করা হোত তবে তা বেশ কিছুটা বাড়তো। অত্যন্ত কম মজুরির জন্য রাজ্যে এখন পড়ে থাকা দু’ই শ্রম ঘন শিল্প – চটকল ও চা এ শ্রমিকরা অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ তাই রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে।

সেন্সাস ২০১১ (এটাই সর্বশেষ) থেকে জানা যায়, ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রায় ৫.৮ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে, যা উত্তরপ্রদেশ (৩৭.৩ লক্ষ), বিহার (২২.৬ লক্ষ) ও রাজস্থানের (৬.৬ লক্ষ) ঠিক পরেই। আর, শহর ও গ্রাম – এই দু’টো জায়গা থেকেই মানুষ গেছেন, যা প্রমাণ করে, আর সেন্সাস রিপোর্টও বলছে, এরাজ্যে কাজ না পাওয়ার জন্য। মনোজ দেবনাথ ও ডি কে নায়েক তাঁদের এক গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন, বর্ধমান (অবিভক্ত), নদীয়া, হুগলির মতো উন্নত চাষাবাদের জেলাগুলো থেকে, আর তারসাথে মুর্শিদাবাদও রয়েছে, এই পরিযানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আরও একটা সমীক্ষায় (ডেল্টাস্, ভালনারিবিলিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জঃ মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাডাপ্টেশন) দেখা যাচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৫১টি ব্লকের ৬৪ শতাংশ মানুষ আর্থিক কারণে, অলাভজনক কৃষির জন্য অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন স্রোতের মতো।

in the grip of unemployment

গ্রামীণ ও শহুরে বেকারত্বের সংখ্যা ২০১০’র পর থেকে হুহু করে বাড়তে থাকে। এনএসও ২০১৯’র সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ বেকারির হার দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং গত তিন দশকে তা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। সেন্সাস ২০১১’র রিপোর্ট বলছে ২০০০ সালে এই প্রথম পশ্চিমবাংলায় পরিযান পরিস্থিতি ঋণাত্বক হয়ে দাঁড়ায়, যার অর্থ হল, ভিনরাজ্য থেকে এরাজ্যে আসার বদলে এরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার সংখ্যা অনেক ছাপিয়ে গেছে। এমনকি, বিদেশে, বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ায় যে সমস্ত রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা রুটি রুজির তাগিদে পাড়ি দেয় তারমধ্যে প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবাংলা রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, অতিমারীর প্রকোপ নিয়ে এক সমীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়েছে উল্টো বা বিপরীতমুখী পরিযানে যারা একসময়ে এরাজ্যে ফিরে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আবার ফিরে যেতে চাইছে, কারণ এরাজ্যে তাঁদের উপার্জন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০০০ সালে এই পরিযান প্রবণতা ঋণাত্বকে নেমে আসার পর এখন অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী দিনগুলোতে আরও অনেক অনেক মানুষ এরাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে পা রাখবে উন্নত কাজ ও মজুরীর সন্ধানে। দিনের পর দিন বাড়তে থাকছে গ্রামীণ বেকারির হার। ২০০৯-১০ সালে যে গ্রামীণ বেকারির হার ছিল ১.৯ শতাংশ, তা ২০১৭- ১৮তে লাফ দিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৮ শতাংশে। গ্রামীণ বেকারির হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে যা বিগত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ঠেকেছে।

সেন্সাস রিপোর্ট বহিঃপরিযানের যে সাতটা কারণকে চিহ্নিত করেছে, তারমধ্যে ‘কাজ/কর্মসংস্থান’ অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সেন্সাস রিপোর্ট দেখিয়েছে যে এরাজ্য থেকে ভিনরাজ্যে চলে যাওয়ার যে ঢল তার প্রধান কারণ হচ্ছে এরাজ্যে কাজ না পাওয়া। ১৯৯১ সালে এই বাইরে যাওয়ার হার ছিল ২১ শতাংশ যা ২০০১এ বেশ অনেকটা বেড়ে হয়ে দাঁড়ালো ৩৭.২ শতাংশ। সামান্য হ্রাসপ্রাপ্ত হয় ২০১১ সালে (৩৪.২ শতাংশ)। আর, শহরের (৩১ শতাংশের) তুলনায় ক্রমে বেড়ে চলা গ্রামীণ (৩৮ শতাংশ) পরিযান রাজ্যের কৃষি অর্থনীতির চরম দুরাবস্থাকেই প্রতিফলিত করে।

এরাজ্য থেকে কী বিপুল পরিমাণে পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে চলে যায়, তার হদিস পাওয়া গেল কোভিডকালীন লকডাউনের সময়ে। সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একটি ভিডিও কনফারেন্সে সরকারিভাবে ঘোষণা করেন যে ১০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরে এসেছেন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রাজ্যে কর্মসংস্থানের ঘোর সংকটের জন্যই রাজ্যের মানুষ অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছেন, এটা নতুন ব্যাপার নয়।

পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস) ২০১৭-১৮ অনুযায়ী (এটি কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, শ্রমিক সংখ্যার অনুপাত, বেকারত্বের হার সম্পর্কিত প্রধান প্রধান সূচক) এরাজ্যে বেকারত্বের হার হল ৪.৬ শতাংশ, যা ২০১১-১২’র ৩.২ শতাংশ থেকে বেশ খানিকটা বেশি। ২০১১’র সেন্সাস অনুযায়ী, এই রাজ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমজীবী মানুষ (৬৯ শতাংশ) কৃষিকাজের সাথে যুক্ত, আর শিল্পক্ষেত্রে নিয়োজিত ২২ শতাংশ মানুষ। ক্ষেত্রভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ ও বিকাশ নির্ভর করে রাজ্যের সামগ্রিক আর্থিক বৃদ্ধির উপর। ১৯৯০ ও তার কিছুদিন পর পর্যন্ত আয়ের দিক থেকে পশ্চিমবাংলার অবস্থান বেশ ভালো থাকার পর তা নীচে গড়াতে শুরু করল ২০০০’র পর থেকে। আর, ২০১০’র মধ্যে তা সম্পূর্ণ গতিরুদ্ধ হয়ে যায়। গ্রামীণ ক্ষেত্রে বিরাজমান গভীর সংকট আয় বৃদ্ধির সব রাস্তাকেই একে একে বন্ধ করে দিচ্ছে। রাজ্যের শিল্পক্ষেত্র এমন এক বদ্ধজলায় পরিণত হয় যেখানে গ্রামীণ শ্রমশক্তিও আর এইক্ষেত্রে কোন স্থান করতে পারলনা। পরিষেবা ক্ষেত্রটি তুলনামূলক ভাবে দক্ষ শ্রমের জন্য সংরক্ষিত থাকায় অগণন অদক্ষ শ্রমকে এরাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে জীবন জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিতে হচ্ছে। (এই প্রতিবেদনে সাহায্য নেওয়া হয়েছে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’তে প্রকাশিত গবেষণালব্ধ একটি মনোজ্ঞ লেখা – মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল সিন্স ১৯৯১, অভিজিত মিস্ত্রী, ১৭ জুলাই ২০২১)।

২০০১-২০০৬’র বুদ্ধবাবুর আমলে বাম সরকার পুরোপুরি গতিরুদ্ধতায় পড়ে। নতুন কর্মসংস্থানের সমস্ত সম্ভাবনা বেশ ধাক্কা খায়। রাজ্য বিরাট এক সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। আর, সার্বিক অর্থনৈতিক গতিরুদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ পেতে বুদ্ধদেববাবুর সরকার তখন যে আগ্রাসী শিল্পায়নের রাস্তা ধরল, তা ৩৪ বছরের বাম জমানাকে ঠেলে দিল অস্তাচলে। বাম জমানার শেষ লগ্নে আর্থিক সংকট থেকে শুরু করে নতুন কর্মসংস্থানের যে করুণ চলচ্ছবি ফুটে উঠে, তা তৃণমূলের তৃতীয় দফার জমানায় আরও মর্মান্তিকভাবে প্রকট হয়েছে। এই আর্থিক অবরুদ্ধতা তৃণমূলী শাসনের সর্বাঙ্গে চরম অধঃপাতের দগদগে ঘা নিয়ে হাজির। অর্থনৈতিক বিকাশের পথে কোন জনবিরোধী শাসন যদি তার অন্তরায় হয়ে ওঠে, তবে বিকাশের অমোঘ নিয়মে ইতিহাসই তাকে উপড়ে ফেলবে। আর, অনাগত সেই অধ্যায়ে কান্ডারীর ভূমিকা পালন করতে রঙ্গমঞ্চে যাতে বামেরা উপস্থিত থাকতে পারে তারজন্য আজ থেকে সলতে পাকানো শুরু করতে হবে।

- অতনু চক্রবর্তী

economic inequality

অপপুষ্টি -মানে অপুষ্টি, অতিপুষ্টি, অসমপুষ্টি।

কিছুউন্নয়নশীল দেশে অপুষ্টির মতো অতিপুষ্টিও দেখা দিতে শুরু করেছে। পৃথিবীতে অন্তত তিনজনের মধ্যে একজন অপপুষ্টির শিকার। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যে প্রোটিন ভিটামিন বা খনিজ পদার্থের ঘাটতি, অতিরিক্ত ওজন, স্থূলতা, বা খাদ্য-সম্পর্কিত অসংক্রামক রোগ। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অপুষ্টিজনিত রোগ বেশি দেখা যায়। অপুষ্টি সম্পর্কিত গবেষণায় জনসংখ্যাকে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, কিশোর, গর্ভবতী মহিলা, প্রাপ্তবয়স্ক এবং বয়স্ক মানুষসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার

২০২০ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৪৯ মিলিয়ন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশর মধ্যে, ৪৫ মিলিয়ন শিশুর ওজন এবং উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম ছিল; প্রায় ৩৮.৯ মিলিয়ন শিশু স্থূলতা বা অতিপুষ্টির শিকার হয়। ২০২১-এ প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু-মৃত্যুর কারণ ছিল অপুষ্টি। ভিটামিন এ-এর অভাবে সারা বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এক তৃতীয়াংশ অন্ধত্বের শিকার হয়। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত, প্রায় ১.৯ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্কের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ছিল এবং ৪৬২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্কের ওজন ছিল কম। গত এক দশকে বিশ্বে অপুষ্টির পরিমান বেড়েছে। ২০১৫ সালে, প্রায় ৭৯৫ মিলিয়ন মানুষ (পৃথিবীতে প্রতি দশজনের মধ্যে একজন) অপুষ্টিতে ভুগছিল। ২০২০ সালে সেখানে ৮২০ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টির শিকার, অর্থাৎ বিশ্বের নয়জনের মধ্যে একজন। এই বৃদ্ধি চলমান কোভিড- ১৯ অতিমারির সঙ্গে আংশিকভাবে সম্পর্কিত। এছাড়াও, ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্রমাগত খরা, কোভিড১৯-এর চলমান অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্বব্যাপী শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর বিশাল ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।

ভারত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মাত্রা অর্জন করলেও বিশ্বের সর্বাধিক অপুষ্টিরুগ্ন শিশু ভারতেই রয়েছে । অপুষ্টি কারণে দেহের উচ্চতা ও ওজন দুটিই কমতে থাকে। এটি দীর্ঘস্থায়ী শৈশবকালীন এমন একটি রোগ, যা অপুষ্টির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ এবং এর ফলে শিশুদের শারীরিক তো বটেই মানসিক দিক থেকে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এই রোগ স্টান্টিং নামে পরিচিত। এন.এফ.এইচ. এস- এর (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে) গবেষণা থেকে জানা যায় যে, (বিশ্বব্যাপী প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) বহু ভারতীয় শিশু এই স্টান্টিং রোগের শিকার। শিশু-অপুষ্টি মোকাবিলায় একটি বহুমুখী উদ্যোগের প্রয়োজন, উদাহরণস্বরূপ খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ এবং গুণমান উন্নত করা, স্যানিটেশনের মাত্রা বৃদ্ধি, মাতৃস্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি। একইভাবে, পরবর্তী সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিবর্তনটি হলো মায়েদের। শিশুদের মধ্যে বিশেষত মেয়েদের বেশি পুষ্টির প্রয়োজন, কারণ শৈশবে স্টান্টিং-এ আক্রান্ত মায়েদের রক্তাল্পতা ও স্বল্পোন্নত জরায়ুর কারণে তারা পরবর্তীতে স্টান্টিং-আক্রান্ত শিশুদের জন্ম দেয়।

Another violent bite of economic inequality_0

ভারতে অপুষ্টির একটি প্রধান কারণ হল অর্থনৈতিক বৈষম্য। দারিদ্র্যের কারণে, তাদের খাদ্যে প্রায়শই গুণমান এবং পরিমাণ উভয়েরই অভাব থাকে। যেসব মহিলা অপুষ্টিতে ভোগেন তাদের সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা কম। পুষ্টির ঘাটতি ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়েরই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফ.এ.ও) মহাঅধিকর্তা কু ডংইউ- এর মতে, “(২০২০ সাল পর্যন্ত) অর্থনৈতিক প্রভাব ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০৭ কোটি মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী সুষম আহার পায়নি।” ভারত, বিশ্বের দ্বিতীয় জনসংখ্যার দেশ, বিশ্ব- জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এফএও-এর মতে, ভারতে পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য প্রতিমাসে জনপ্রতি প্রায় ১৯০০ টাকার প্রয়োজন। অর্থাৎ একটি চার সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৭,৬০০ টাকা খাদ্য খরচ। ৭০.৫ শতাংশ ভারতীয় পুষ্টিকর খাবারের খরচ যোগাতে অক্ষম, যেখানে শ্রীলঙ্কায় ৪৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮৩.৫ শতাংশ এবং নেপালে ৮৪ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর ও সুষম আহার গ্রহণে অক্ষম। এফএও-র মতে, কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের কৃষি,খাদ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা এবং আমাদের সমাজে বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে, যা বিশ্বকে ক্ষুধা ও মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার দিকে পরিচালিত করেছে। ২০২২ সালের প্রথমার্ধে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করেছে এবং শস্য, সার ও জ্বালানির দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এর ফলে খাদ্যের দাম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও জলবায়ুর চরম অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরিবেশের শান্তি শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করেছে। প্রায় ৮০ কোটি বা প্রায় ৬০ শতাংশ ভারতীয়, সরকারি ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য রেশনের উপর নির্ভরশীল। তারা ২- ৩ টাকা কেজি দরে প্রতি মাসে মাত্র পাঁচ কেজি গম ও চাল পান, বিশেষত অতিমারির সময় থেকে। কিন্তু এই কর্মসূচিটি প্রায়ই সমালোচিত হয়। কারণ, পর্যাপ্ত ক্যালোরি সরবরাহ করার অর্থ কিন্তু পর্যাপ্ত পুষ্টি নয়।

ভারতে ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগজনক ছবি ‘স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (এসওএফআই) -এর সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে, যা ৬ জুলাই যৌথভাবে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টে বলা হয় যে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ৫৬ কোটি ভারতীয় (যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০.৬ শতাংশ) মাঝারি বা গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। ২০১৮-২০ সালে যারা চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, ২০১৯-২১ সালে তার সংখ্যা ২০.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.৩ শতাংশ হয়েছে। এছাড়াও এই বছরের শুরুর দিকে ওয়ার্ল্ড ওবেসিটি ফেডারেশনও জানিয়েছে যে ভারতে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২৭ মিলিয়নেরও বেশি শিশু স্থূলতায় ভুগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর খাবারের সামর্থ্যের উপর একটি তুলনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ৯৭ কোটিরও বেশি ভারতীয়, বা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭১ শতাংশ পুষ্টিকর খাবারের সামর্থ্য রাখতে অক্ষম।

একটি গবেষণায়, অনুপ্রিয়া সাক্সেনা এবং তাঁর সহকর্মীদের পর্যবেক্ষণ – রাজস্থানের একটি আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের ২১১ জনের দুই-তৃতীয়াংশ তাদের পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমান খাবার না থাকার কথা উল্লেখ করেছে। তাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের কাছে খাবার কেনার মতো টাকা নেই।

ভারতের শিশুরা অপুষ্টি এবং অতিপুষ্টি দুয়েরই শিকার। তাই মনে রাখতে হবে শুধু ক্যালোরি নয় শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক সকলকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম আহার এবং নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।

- অবন্তী

equal education

শিক্ষক নিয়োগ, পাঠক্রম তৈরি, শিক্ষণ প্রণালী, বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো, ছাত্রীছাত্রদের উপস্থিতি, শিক্ষক-ছাত্রীছাত্র যোগাযোগ, ছাত্রীছাত্রদের মূল্যায়ন এই সমস্ত মিলিয়ে বিদ্যালয় শিক্ষাকে সামগ্রিকে দেখার ভাবনা তৈরি করা দরকার। তেমনটা কী হয়? পাঠক্রম তো বহুলাংশেই রাজনীতিপ্রসূত। কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলো ও তাদের সমাজ সম্পর্কে ভাবনা কতটা উদার, বৈজ্ঞানিক অথবা রক্ষণশীল ও মৌলবাদী তার উপরে পাঠক্রম নির্ভর করেই থাকে। এছাড়াও সব ছাত্র সমগুণমানের শিক্ষা পাবে কিনা বা তারা সকলে তেমন শিক্ষা পাওয়ার যোগ্য কিনা সেটিও নির্ভর করে সমাজ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর উপরে। এদেশের বা রাজ্যের শিক্ষা প্রশাসক তথা এতাবতকাল পর্যন্ত শাসক রাজনৈতিক দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গীই ছিল যে দরিদ্র সাধারণ পরিবারের ছাত্রীছাত্রদের কেবল বিদ্যালয়ে হাজির করাতে হবে, সাক্ষর করে তুলতে হবে। ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মিড ডে মিল ও পরবর্তীতে শিক্ষার অধিকার আইনের সুবাদে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে বিদ্যালয়ে আনা বাধ্যতামূলক করা হয়, একই সঙ্গে শিক্ষার অধিকার আইন মেনে ছাত্রীছাত্রদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ফেল না করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যাস, ওই বিদ্যালয়ে আনা, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধরে রাখা, দুপুরে যেমন তেমন পেট ভরার মত খেতে দেওয়া – এভাবেই দায় সারা হয়ে আসছে সরকারের। লক্ষণীয় যে, প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সরকার সকলেই যে তেমনটাই মনে করে তা প্রকাশ পায় যখন কোনো অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রী বা ছাত্র তেমন কোনো খুব ভালো ফল করে, প্রচার মাধ্যম বা সরকার তা নিয়ে খুব ফলাও করে বলতে থাকে। অর্থ করা হয় যে, ওই ছাত্রী বা ছাত্র সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে ভালো ফল করেছে। কিন্তু এটাও মেনে নেওয়া হয় যে, সকলের জন্য সমগুণমানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়নি, যদিও তেমনটা করা প্রয়োজন মনে করেন না, কারণ সরকারপক্ষের মতে, যে ব্যবস্থাটি আছে তাতেই ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে ভালো ফল করতে পারে।

বিদ্যালয় স্তরে সরকারি বিদ্যালয়ে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রাথমিকে টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ডিএলইড পাশ করতে হবে। ডিএলইড পড়ার ন্যূনতম যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল্য পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ (বিশেষ ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ছাড় আছে) পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকতার জন্য ন্যূনতম বিএড পাশ করতে হবে ও বিএড পড়ার জন্য স্নাতকে ৫০ শতাংশ (এক্ষেত্রেও ছাড় আছে) পেতে হবে। এই যে বিএড, ডিএলইড, পূর্বে পিটিটিআই উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যিক করা হোল, যা আগে ছিল না, তার ফলে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার কী উন্নতি হল তা যাচাই করা হয়েছে কখনো? যদি তেমন কোনো উন্নতি না হয়ে থাকে তাহলে ওই সব বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখা হচ্ছে কেন? কেনই বা দেশের তথা রাজ্যের বিভিন্ন জেলা সদর ও মফস্বল শহরে গাদা গাদা বিএড, ডিএলইড পড়ানোর বেসরকারি (বানিজ্যিক?) প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে গেল? প্রকাশ্যে ওই কোর্সগুলি পড়ার খরচ দুবছরে ২ লক্ষ টাকা বা তার বেশি। পিছনের দরজায় কত দিতে হয় কে জানে! ফলে, যে সমস্ত সাধারণ ঘরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাত্রীছাত্ররা শিক্ষকতার পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে নিযুক্ত হচ্ছিলেন তাঁদের পক্ষে সেটা অসুবিধেজনক হয়ে গেল। অন্যদিকে ওই সমস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির রমরমা শুরু হল। ওগুলির অনুমোদনের জন্য শাসক দলের মন্ত্রীসান্ত্রীরা ‘অনুদান’ও পেলেন। যে অর্থের একাংশ হয়তোবা সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া ২০-২২কোটির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

বিদ্যালয়স্তরে শিক্ষক নিয়োগের শুরুতেই যে যোগ্যতার বিধিনিষেধ শুরু করা হয়েছে, কেবল এরাজ্যে নয়, সারা দেশে, উৎসুক ছাত্রীছাত্রদের এক বড় অংশই তার ফলে শিক্ষকতা করার জন্য পাথেয় যোগাড় করতে না পেরে অসহায় হয়ে পড়ছে। যারা থাকছে তাদের বৃহদাংশ অর্থের বিনিময়ে যোগ্যতা অর্জন থেকে শুরু করে টেটএসএলএসটি পাশ করা ও চাকরি পাওয়ার জন্য অর্থ দিতে রাজি হয়ে যাচ্ছে। কেবল নিয়োগই নয়, তার পরে নিজের সুবিধে মতো জায়গায় পোস্টিং পেতে বা বদলি হতেও টাকা হাত ফিরছে।

শিক্ষক নিয়োগের প্রাক শর্ত হওয়া উচিত যে বিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য নিজ পছন্দের সুযোগকে কর্মপ্রার্থী ব্যবহার করবেন সেখানেই তিনি শিক্ষকতা করবেন আন্তরিকতার সঙ্গে। সরকারকে ওই শিক্ষিকা বা শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের অনতিদূরে থাকার যথাযোগ্য বন্দোবস্ত করতে হবে, অবশ্যই তার জন্য কোনো প্রাপ্য বেতন বা সুবিধের কাটছাঁট করা চলবে না। নিয়োজিত শিক্ষককেও দায়বদ্ধ হতে হবে যে বিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষেই পাঠক্রমকে ছাত্রীছাত্রদের সম্পূর্ণ অনুধাবন করানোর। পাঠক্রম প্রস্তুতের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা সর্বোচ্চ হতে হবে। রাজ্য তথা দেশের শিক্ষানীতি প্রনয়ণের বিষয়েও একদম সর্বনিম্ন শ্রেণী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সব শ্রেণীর শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ও সার্বিক ক্ষমতা দিতে হবে। এমনভাবে পাঠক্রম তৈরি করা দরকার যাতে একটি শ্রেণীর জন্য বন্টিত পাঠক্রম সেই শ্রেণীতে পাঠরত সকল ছাত্রীছাত্রদের বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষেই সম্পূর্ণশেখাতে শিক্ষকরা সমর্থ হন। ওই পাঠক্রমের সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের সময় ও শ্রেণীকক্ষ পিছু ছাত্রীছাত্র সংখ্যা ও শিক্ষিকা-শিক্ষক সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। মোদ্দা কথা পড়ুয়ারা পড়বে শিখবে লিখবে বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে, বাড়িতে কোনো পড়াশোনার দরকার পড়বে না। সর্বনিম্ন শ্রেণী থেকে প্রথমে এমনটাই শুরু করতে হবে ও সেই শ্রেণীর শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের দায়বদ্ধ করতে হবে যাতে সব ছাত্রীছাত্র যথাযথ শেখে। পরবর্তী বছরে অনুরূপে পরবর্তী শ্রেণীর শিক্ষিকা-শিক্ষকদের অনুরূপ দায়িত্ব নিতে হবে। এইভাবে ১০-১২ বছর পরে সকল শ্রেণীর পড়ুয়ারাই যথাযথ শিখে বিদ্যালয়ের দরজা পার করবে। পড়ুয়াদের না শেখার দায় শিক্ষিকা শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনকেই নিতে হবে। অনেকেই, বিশেষত শিক্ষকরা বলবেন যে, এমন দায় তাঁরা নেবেন কেন, যেখানে উপযুক্ত শিক্ষা পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত নেই। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে, পাঠক্রম তৈরির অধিকার ও দায় মূলত শিক্ষকদের, উপযুক্ত পরিকাঠামো যোগানের দায় সরকারের, তা পাওয়ার অধিকার পড়ুয়া ও শিক্ষকদের। ওই পরিকাঠামোর জন্য সরকারকে দায়ী করানোর অধিকার ও দায়িত্ব জনগণের।

উপরের অনুচ্ছেদে যা লেখা হয়েছে তা আজকের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অবাস্তব ও অনেকের কাছে অনাকাঙ্খিত মনে হতে পারে। তারা ধরে নেন কেবল বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষেই শিশু কিশোররা লেখাপড়া করে সব শিখবে এমনটা ভাবাই যায় না। গৃহশিক্ষক বা কোচিং ব্যতিরেকে পড়াশোনাও অবাস্তব শোনায়। এদেশে সব থেকে ‘বুদ্ধিমান’ ছাত্রীছাত্র বলে পরিগণিত আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার যোগ্য পড়ুয়াদের কোচিং না নিলে চলে না। তার জন্য ফিটজি, আকাশ, সুপার থার্টি সমেত কোটার মত গোটা একটা শহর ‘করে খাচ্ছে’। ফলে আমাদের মত অর্বাচীনরা শ্রেণীকক্ষে পড়া শেষ করার কথা বললে শুনবে কে? তবুও বলতে হবে, কারণ সেটাই হতে পারে একমাত্র সর্বজনীন সমমানের শিক্ষার পথ।

- অমিত দাশগুপ্ত

Allowance of cooks

শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার পরিচিতা অর্পিতা মুখোপাধ্যায় গ্রেপ্তার। অর্পিতার কাছ থেকে উদ্ধার ২২ কোটি টাকা। বিপরীতে স্কুলের রন্ধনকর্মীরা মাসে ১৫০০ টাকা সাম্মানিকে কাজ করে চলেছেন। বেশ কয়েকটি দৈনিকে মিড ডে মিল কর্মীদের দুরবস্থা নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর পর সিটু রন্ধনকর্মীদের সাম্মানিক ভাতা নিয়ে মুখ খুলেছে। খবরে প্রকাশিত হয়েছে সিটু অনুমোদিত ‘পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়নের’ সাধারণ সম্পাদিকা মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় রন্ধনকর্মীদের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বর্তমানে রন্ধনকর্মীরা মাসে সাম্মানিক ভাতা হিসাবে মাত্র ১৫০০ টাকা পান। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা যেখানে রন্ধনকর্মীর কাজ করেন সেখানে এই ১৫০০ টাকা ভাগ হয়ে গিয়ে মাসে এক এক জন রন্ধনকর্মী পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। সিটু নেতৃত্বের বিলম্বিত বোধোদয় ও বক্তব্যকে স্বাগত জানাচ্ছি। রন্ধনকর্মীদের কেন এই দুরবস্থা? জানতে হলে একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক।

‘মিড ডে মিল’ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয় পুষ্টি সহায়তা প্রকল্প’-র অধীনে ১৯৯৫ সালে চালু হয়। সেই সময় রান্না করা খাবার দেওয়ার পরিববর্তেবেশির ভাগ রাজ্যে শিশুদের মাথা পিছু মাসে তিন কেজি চাল ও তিন কেজি গম দেওয়া হত। ২০০১ সালে পিইউসিএল-এর মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট রান্না করা খাবার দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক পরে মিড ডে মিল চালু হয়। তাও আবার ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে।

তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার আর্থিকভাবে ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে গ্রাম ও শহরে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলে। কিছুদিন চলার পর দেখা গেল এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, এমনকি এই গোষ্ঠীগুলোর তৈরি পণ্যের বিপণনের ব্যবস্থাও করা হল না। ইতিমধ্যে সারা দেশে মিড ডে মিল প্রকল্প চালু হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাজার হাজার মহিলাকে মিড ডে মিল প্রকল্পে ঢুকিয়ে দিল। ফল দাঁড়াল প্রয়োজনের বেশি মহিলা স্কুলে রান্নার কাজে যুক্ত হলেন। এবং মাসের সাম্মানিক টাকা বহুর মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। এই সব মহিলাকর্মীদের কাজে নিয়োগের জন্য কোনো নিয়োগপত্রও দেওয়া হল না। গ্রুপের নামেই কাজ চলতে থাকল। অন্য কোনো রাজ্যে এই নিয়ম চালু নেই। এই অনিয়মের জন্য সিটু পরিচালিত ‘পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন’ নেতৃত্বের আত্মসমালোচনা করা উচিত। বামফ্রন্ট সরকারের সেই সময়কার ভুল সিদ্ধান্তের ফলে হাজার হাজার রন্ধনকর্মীর জীবিকা অনিশ্চিয়তার মধ্যে চলে গেছে। রন্ধনকর্মীদের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমান রাজ্য সরকার এই নিয়ম পরিবত্তর্নের কোনও সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। এরা ধরে নিয়েছেন ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প দিয়েই শ্রমজীবী মহিলাদের ক্ষোভ সামলে নেবেন।

রাজ্য রাজনীতি পরিবর্তনের পর থেকে রাজ্যে বেশ কয়েকটি মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ‘পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড ডে মিল) ইউনিয়ন’ অন্যতম। যা রাজ্য শ্রম দপ্তরে নাম নথীভুক্ত (রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ২৬৪২৭) হয়ে আছে। রন্ধনকর্মী ইউনিয়ন ২০১৭ সাল থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সাম্মানিক ভাতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত দাবিপত্র পেশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন মিড ডে মিল কাজকে ১০০ দিনের কাজের সাথে যুক্ত করবেন। কর্মীরা আশ্বস্ত হলেন। হয়তো বা কিছু রোজগার বাড়বে। কিন্তু ঘোষণাই সার। বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ হল না। গত ৭-৮ জুন কয়েক হাজার রন্ধনকর্মী ধর্মতলায় বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তারা শিক্ষা দপ্তরে স্মারকলিপি জমা দিলেন। দাবি জানালেন – (১)  শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, (২) ন্যূনতম মজুরি, (৩) ন্যূনতম পেনশন ৬০০০ টাকা, (৪) ১২ মাসের বেতন, (৫) বোনাস, (৬) চিকিৎসা বীমা, (৭) ১৮০ দিনের মাতৃত্বকালীন ছুটি, (৮) জিরো ব্যালেন্সের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা, (৯) বেসরকারিকরণ ও এনজিও-দের হাতে প্রকল্প দেওয়া চলবে না, (১০) ছাত্রদের মাথাপিছু বরাদ্দ ন্যূনতম ১০ টাকা করা।

এই প্রকল্পে আর্থিক দায়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের অনুপাত ছিল ৭৫:২৫। বর্তমানে তা ৬০:৪০ হয়েছে। এইভাবে মোদী সরকার ক্রমশ মিড ডে মিল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। ৪৫ ও ৪৬তম শ্রম সম্মেলনের সুপারিশ হল, তবু রন্ধনকর্মীদের শ্রমিকের মর্যদা, মজুরি বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষার ইত্যাদি বিষয়গুলো কার্যকর করা হল না। এখন তো মিড ডে মিলের নামই পাল্টে দিয়েছে। ‘পি এম পোষণ’ নতুন নামকরণ হয়েছে।

প্রায় দুই দশক রাজ্যের ২ লক্ষ গরিব ঘরের মহিলা যারা বেশিরভাগ তপশিলিজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ, নামমাত্র সাম্মানিকে কাজ করে চলেছেন। বেশ কয়েকটি রাজ্যের রাজ্য সরকার গণ শিক্ষা প্রসারের দায় থেকে রাজ্যের তহবিল থেকে অতিরিক্ত সাম্মানিক দিচ্ছে। যেমন কেরল-৭৬০০, পুদুচেরী-৬৪৫৮, অন্ধ্রপ্রদেশ-৩০০০, মহারাষ্ট্র-৩০০০, ওড়িশা- ৩০০০, ঝাড়খণ্ড-২০০০, বিহার-১৬৫০, পশ্চিমবঙ্গ -১৫০০। পশ্চিমবঙ্গের সাম্মানিক ভাতার হার সবচেয়ে কম। রন্ধনকর্মীরা অতি সামান্য ভাতায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছেন। নিজেরা অর্ধভুক্ত অবস্থায় শিশুদের পুষ্টির জন্যে কাজ করে চলেছেন। এই সামান্য টাকাও প্রতিমাসে ঠিক সময় কর্মীরা হাতে পাননা। আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলারা কঠিন পরিস্থিতিতে মিড ডে মিল প্রকল্পে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। রন্ধনকর্মীদের পশ্চিমবঙ্গে সাম্মানিক দেশের মধ্যে নীচের দিকে, শিক্ষা দপ্তরের দুর্নীতি আকাশ ছোঁয়া। অবিলম্বে মিড ডে মিল কর্মীদের সাম্মানিক ভাতা বৃদ্ধি করুন।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত

Dilip Banerjee Memorial

গত ২০ জুলাই, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় বই-চিত্র সভাঘরে। এই সভায় “আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া সাংস্কৃতিক দীনতা ও পিঠ বাঁচানো চালাকি” নিয়ে বলেন বামপন্থী চিন্তক ও যশস্বী সাহিত্যিক কিন্নর রায় তাঁর অনুপম স্বকীয়তায়। একক গানে ছিলেন সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সুগ্রন্থিত গানের অসাধারণ সম্ভার নিয়ে।

সভার শুরু হয় নবান্ন-সম্পাদক গণশিল্পী নীতিশ রায়ের “বন্ধু রে” গানটি দিয়ে। আলোচনার শুরুতে অন্যতম আয়োজক প্রাবন্ধিক নিত্যানন্দ ঘোষ আলোচকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্নর রায় দিলীপ ব্যানার্জী প্রসঙ্গে তাঁর বৌদ্ধিক দীপ্তির সঙ্গে অত্যন্ত সংবেদনশীল, মানবিক হৃদয়-ঐশ্বর্যের কথা তুলে ধরেন। সেই জের টেনে মূল আলোচনায় এসে তিনি বলেন রাষ্ট্র কীভাবে সমস্ত অতীত ঐতিহ্য মুছে ফেলে এক ভয়ের বাতাবরণ গড়ে তুলছে বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারিতায়, অবাধ হিংস্রতায়। শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। কোভিডএর সময় লক ডাউন, ভ্যাকসিন নিয়ে চলেছে অকথ্য অনাচার। চলেছে লুঠ। সাধারণ মানুষের জীবনের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চাকরির অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সহ সমস্ত সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার নিয়ে প্রতিদিন টানাটানি করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ধর্মনিয়ে বিদ্বেষ বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। হিন্দু রাষ্ট্র চাই। তাই খৃস্টান ও সংখ্যালঘুদের উৎখাতের প্রস্তুতি চলছে। এদিকে আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যে মানুষ অনাহারে ধুঁকছে। তিনি বলেন,আমরা এমন একটা প্রতারিত সমাজে বাস করছি। প্রতারণা করছি নিজের সাথে। দ্বিচারিতা করছি নিজের সাথে। এমনকি সাহিত্য, গান, নাটক, সিনেমাতেও এই দ্বিচারিতা চলছে। হিংস্র হয়ে উঠছি আমরা ভিতরে ভিতরে। অন্যদিকে আপোসকামী। গল্পে রেল পুলিশের অত্যাচারের কথা বললেও রাজ্য পুলিশের কথা বলি না। অন্যায়ের প্রতিবাদে প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর দিতে আমাদের দ্বিধা। ভুলে থাকি আমাদের প্রতিবাদী কবি সরোজ দত্তের কথা। মুখে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা বলি, কিন্তু সুযোগ খুঁজি বড় বাজারি পত্রিকায় লেখা ছাপানোর। সাংস্কৃতিক জগতেও পচন ও স্খলন চলছে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে, মাইলাই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেদিন সমস্ত মানুষ পথে নেমেছিল। আজ যুদ্ধ বিরোধী আবেগ কোথায়? শিশির ভাদুড়ী পদ্মপুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কিন্তু জাতীয় নাট্যমঞ্চের জন্য সারাজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আজ কোথায় কল্লোল, তীর, মানুষের অধিকার-এর মতো নাটক? পোস্ট ট্রুথ-এর যুগে আমরা আপাত সরল, আপাত মিথ্যার মধ্যে ডুবে আছি। আমাদের বর্তমান শাসকরা গোয়বলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে ‘সত্যি’ করে তুলছে। আমরা নির্বাক! ক্ষমতার কাছে শিরদাঁড়া বিকিয়ে গেছে আমাদের! প্রতিদিন নগ্ন হই ক্ষমতার কাছে! তাই বিসমিল্লার মত সুরসাধক যিনি দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সানাই বাজিয়ে যেতেন, যে বাজনা শুনে আবালবৃদ্ধবনিতা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তাঁকে অনুসরণ করতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো, সেই সাধকের বাড়ি আমরা রক্ষা করতে পারিনি! আমরা রক্ষা করতে পারিনি বাবরি মসজিদ! আমরা এক সময় আওয়াজ তুলেছি-দুনিয়ার মজদুর এক হও! আজ ভুবনগ্রামে নিজের সবকিছুই হারিয়ে ফেলছি। আমরা সাহসের সঙ্গে ছোট ছোট প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে অশোক স্তম্ভের ঐ বিকৃত সিংহের হিংস্র মুখব্যাদান আমাদের দেখতে হত না! অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিলেন প্রতিভাময়ী সুকন্ঠী সংহিতা। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে অনায়াসে যেতে পারেন জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’য় কিংবা গণসংগীতের উদ্দীপনায় অথবা নিজের কথায় নিজের সুরে গাওয়া একান্ত বিভোরতায়। শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়েও রেশ রেখে যায়।

Comrade Lebachand Tudu

কমরেড লেবাচাঁদ টুডু এক সাঁওতাল দরিদ্র ও শোষিত কৃষক পরিবারের সন্তান। জন্মেছিলেন ঝাড়গ্রামে গোপীবল্লভপুরের সারিয়া অঞ্চলের ভালুকখুলিয়া নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে, ১৯৪৭ সালে। সামন্ত ও মহাজনী শোষন, অত্যাচার, অনাহার-অর্ধাহারের জীবন থেকে মুক্তির বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছে যায় একদা নয়াবসান হাইস্কুলের তাঁর মাষ্টারমশাই নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সন্তোষ রাণার মাধ্যমে। সন্তোষদা এই প্রায় ছ’ফুট উচ্চতার স্বাস্থ্যবান আদিবাসী যুবককে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান, চিন বিপ্লবের ইতিহাস ও ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের কথা জানান খুবই সহজ ভাবে। সেটা ১৯৬৯ সাল। নবগঠিত বিপ্লবী পার্টি সিপিআই(এমএল) এর কর্মসূচি জেনে নিয়ে দুরন্ত যুবকটি নিজস্ব অভিজ্ঞতায় ধনী লোকেদের মজুরি শোষন, বহিরাগত ব্যবসায়ীদের প্রতারণার সঙ্গে পার্টি কর্মসূচিকে মিলিয়ে দেখে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিতে রাজি হয়ে যায়।

লেবাচাঁদ ছিলেন খেলাধুলায় চৌখস এক যুবক। হাইজাম্প, লংজাম্প ইত্যাদিতে জঙ্গলমহলে তাঁর সমকক্ষ খুব কম ছিল। সে সময় যারা কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কনস্টেবলের চাকরীতে ঢুকতে চাইতো, তাদের হয়ে তিনি বেনামে স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতেন এবং এই চাকরীপ্রার্থীরা চাকরিতে ঢুকতে পেরেছিল লেবাদার বদান্যতায়। তিনি কিন্তু নিজে কখনও পুলিশের চাকরীর জন্য আবেদন করেননি। স্কুল ছুট হওয়ার পর বড়ো পরিবারের দায় কাঁধে নিয়ে লেবাচাঁদ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে শুয়োরের চুল সংগ্রহ করে খড়গপুরে মহাজনের কাছে বেশি পয়সায় বিক্রি করার ব্যবসায় নেমে পড়েন। এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা থাকার দরুণ তাকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্লবী রাজনীতির প্রচার ও প্রসারে ব্যাপকতা অর্জন করেছিলেন সন্তোষদা ও তাঁর সহযোদ্ধারা।

সমাজ বদলের রাজনীতি ও বিপ্লবী নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ প্রেরণায় লেবাচাঁদ টুডুর জীবন দর্শনে আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি পার্টির সর্বসময়ের কর্মীর ভূমিকায় সংগ্রামের ময়দানে অবতীর্ণ হন। অচিরেই স্বভাবজ ক্ষিপ্রতা, অসীম সাহস ও বুদ্ধিদীপ্ত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে শ্রেণী শোষনের বিরুদ্ধে লড়াইকে ব্যাপক গ্রামীণ ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে লেবাদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও নিপীড়িত জনগনকে ভালোবাসার অদম্য অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পার্টির অপরিহার্য নেতা হয়ে ওঠেন এবং গোপীবল্লভপুর-১ নং ব্লকের পার্টি সম্পাদক হন।

১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে গোপীবল্লভপুরের বেতকলা, শ্যামসুন্দরপুর, আশুই, বর্গীডাঙ্গা ইত্যাদি মৌজায় ভূমিহীন ও ভাগচাষীদের সংগঠিত করে জোতদার-জমিদার-মহাজনদের জমির ধান কেটে সবার মধ্যে গণবন্টনের লড়াই ক্রমশঃ জঙ্গলমহলে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছয় এবং এই লড়াই শুরু হওয়ার তিন-চার দিনের মধ্যে হাজার হাজার গ্রামীন শোষিত জনতার যোগদানে তা অভ্যূত্থানের রূপ নেয়। এই আন্দোলনে সামনের সারিতে সন্তোষদার সঙ্গে সক্রিয়তায় থাকেন লেবাচাঁদ টুডু। এরপরে অত্যাচারী মহাজনদের গরীব কৃষকদের কাছ থেকে বলপ্রয়োগ করে ঋণের সুদ আদায়ের বিরুদ্ধে গ্রামীণ মহিলাদের নেতৃত্বে পরিচালিত বন্ধকী জমি ও অন্যান্য জিনিস উদ্ধার করার আন্দোলনকে রাজনৈতিক দিশায় পরিচালনায় কার্যকরী ভূমিকা নেন তিনি।

পরবর্তীতে পার্টির গোপন অবস্থায় সশস্ত্র গেরিলা স্কোয়াডের কমান্ডার হিসাবে রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলার মধ্য দিয়ে তিনি জনতার চোখে অতিকথার নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। বিপ্লবীদের গণআন্দোলন ও সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের সম্মিলিত আঘাতে ভয় পেয়ে অনেক জোতদার, জমিদারেরা তাদের বন্দুক বিপ্লবী নেতৃত্বের কাছে জমা দিয়েছিল। আবার আক্রমণাত্মক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জমিদার, জোতদারদের বন্দুক লুঠ করে নিয়েছিল বিপ্লব শানিত কৃষক বাহিনী। একই সময়ে সংগ্রামী আদিবাসী নেত্রী কুনি টুডু আদিবাসী মহিলাদের নিয়ে সশস্ত্র স্কোয়াড গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে লেবাচাঁদ টুডুর জীবনসঙ্গিনী কুনি টুডু সমমর্যাদায় সিনা টান রেখে বিপ্লবী নেত্রীর ভূমিকায় অটল থেকেছেন। লেবাদার জীবনজোড়া সংগ্রামী জীবনের পাঠে তাঁর সহযোদ্ধা কুনি টুডুর অসামান্য ভূমিকাকে উল্লেখ না করলে সেই উত্তাল সময়ের সামাজিক অভিঘাত পরিমাপ করা যাবে না। ১৯৭০ সালে একদিন খড়গপুরে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন লেবাচাঁদ টুডু ও কুনি টুডু। ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি আন্দোলনের সুবাদে তাঁরা জেল থেকে মুক্ত হন। সদ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে নদীর চরের জমি দখল করা নিয়ে গরীব কৃষকদের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে দু’পক্ষের গ্রহনযোগ্য জমি বন্টনের সুষ্ঠু সমাধান করতে সফল হয়েছিলেন লেবাচাঁদ। ১৯৭৮ সালে গোপীবল্লভপুরে খাস জমি ও বর্গা জমি থেকে গরিব কৃষক ও প্রকৃত বর্গাদারদের উচ্ছেদ করতে উদ্যত হয় স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব। এর বিরুদ্ধে তুখোর তীরন্দাজ লেবাচাঁদ বর্গাদারদের পাট্টা দেওয়ার দাবির আন্দোলনকে সফল করতে তীরধনুক হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে জেল থেকে লেবাদা নয়াগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ৮০০০ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে থাকেন। এরপরে ১৯৮০ সালে ঝাড়গ্রাম এবং ১৯৮২ সালে ময়ুরভঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে সিপিআই(এমএল) দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৯৬ সালে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক নাগরিক মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে নকশালপন্থী সংগঠনগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চলে। লেবাচাঁদ ছিলেন এই মঞ্চের সহ সভাপতি। তাঁর হাত ধরে ১৯৭৯ সালে আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র ‘সারনা রিক্রিয়েশন ক্লাব’ গড়ে ওঠে। এই সময়ে কৃষকের জমিতে সেচের দাবিতে বম্বে রোড অবরোধ ও লাগাতার অনশন ধর্মঘটের সফল আন্দোলনে সন্তোষদার সঙ্গে থেকে নেতৃত্ব দেন লেবাচাঁদ টুডু। এবাদে সাঁওতালি ভাষার প্রচার ও প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। সুবর্ণরেখা কলেজে ‘ছাত্র ঐক্য’ নামে সংগঠন গড়ে তোলা ও এসএফআই, পুলিশের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করে পরবর্তীতে ৫ বছর ওই কলেজের ছাত্র সংসদ দখল করে নেওয়ার পেছনেও মূল প্রণোদনা ছিল লেবাদার। ঝাড়খন্ডে আলাদা রাজ্যের দাবিতে মুখর আন্দোলনেও লেবাদা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

রাজনৈতিক বন্দীদের মাসিক ভাতা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন জোরের সাথে। লেবাচাঁদ ও কুনি টুডু শেষ জীবনে আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখার স্বার্থেনিজেদের শেষ সম্বল এক বিঘা জমি ‘কস্তুরীবাঈ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে স্কুল তৈরির জন্য দান করেছেন। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর কুনি টুডু জরায়ুর ক্যান্সারে ভুগে প্রয়াত হন। মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে পুঁজি ও সরকার বিরোধী গণআন্দোলনকে প্রসারিত করার অদম্য উৎসাহে কম. সোমনাথ চ্যাটার্জী পরিচালিত ‘এসওসি সিপিআইএমএল’ দলকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের সঙ্গে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর সংযুক্তিকরণ ঘটিয়ে লেবাদা তাঁর দীর্ঘসময়ের সহযোদ্ধাদের নিয়ে আবার লড়াই-আন্দোলনের রণাঙ্গনে ফিরে আসেন। পার্টির অন্যতম রাজ্য নেতা হিসাবে তিনি সক্রিয় থাকেন। ২০২২ সালে মে মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত লিবারেশনের ১২তম রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চে তাঁর উদাত্ত আহ্বান সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের বহুদিন স্মরণে থাকবে। তিনি তাঁর শেষদিন পর্যন্ত সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য, এবং রাজ্য স্তরে ‘আদিবাসী বিকাশ ও অধিকার মঞ্চে’র সভাপতি ও সর্বভারতীয় সংগঠন ‘আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা’র সহ সভাপতির পদে ছিলেন।

রাজ্য সম্মেলন শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরে লেবাচাঁদ টুডু গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে ঝাড়গ্রাম হাসপাতাল, পরে মেদিনীপুর জেলা হাসপাতাল এবং সবশেষে কলকাতার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা হওয়ার সময় তাঁর যকৃতে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা নিদান দেন। আদি ও অকৃত্রিম সহযোদ্ধা কমরেড পিন্টু দের তত্ত্বাবধানে লেবাদাকে তাঁর নিজের গ্রামে ফিরিয়ে আনা হয়। আদিবাসী সমাজে কিংবদন্তী বিপ্লবী নেতা লেবাচাঁদ টুডু ২ জুলাই পাটবাধা গ্রামে তাঁর একচিলতে বসতবাড়িতে প্রয়াত হন।

কেন্দ্রে আসীন ফ্যাসিবাদি মোদী সরকার কর্পোরেট লুটকে মান্যতা দিয়ে ২০০৬ সালের বনাধিকার আইনকে অকেজো করতে চলেছে। বনবস্তী নিবাসী আদিবাসী সমাজের জমি ও জীবিকা কেড়ে নিতে তারা চরম আক্রমণ ও উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে। রাজ্যের তৃণমূল সরকারও বীরভূমের দেওচা-পাচামীতে আদিবাসী- মূলবাসীদের বসত উচ্ছেদ করে আদানীর মতো কুখ্যাত কর্পোরেটের হাতে কয়লা উত্তোলনের জন্য সঁপে দিতে উদ্যত - সেই সময়ে বিরল রাজনৈতিক ধীশক্তির অধিকারী কমরেড লেবাচাঁদ টুডুর অতীব প্রয়োজনীয় পরামর্শগুলি থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। জঙ্গল মহলকে নতুন উদ্যমে বামপন্থী গণআন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে আবারও গড়ে তোলার মূল কান্ডারী হয়ে উঠতে পারতেন কমরেড লেবাদা। তাঁর মৃত্যু সমগ্র বিপ্লবী বামপন্থী শিবিরে বিষন্নতা ছড়িয়েছে, তৈরি করেছে এক গভীর শূন্যতার বোধ। লেবাদার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের শেষদিন অবধি সমাজ বদলের স্বপ্নকে লালন করা ও জনগনকে সংগঠিত করতে লেগে থাকার চমৎকার অভিজ্ঞতা প্রজন্মের পর প্রজন্মে বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে।

পরিচিতি সত্তার পক্ষের স্বতঃস্ফুর্ত আবেগকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণি পার করতে চায় বিজেপি-আরএসএস শিবির। আদিবাসী মহিলা নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে জিতিয়ে নিয়ে বশংবদ রাষ্ট্রপতিকে সামনে রেখে কর্পোরেটদের স্বার্থে বুট, বুলেট, বুলডোজার রাজ চালিয়ে চলবে মোদী সরকার। এই বিভীষিকার রাজত্বের বিপরীতে জনগণের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও শোষনমুক্তির নায়ক লেবাচাঁদ টুডুর জীবনাদর্শ ও সংগ্রামের মূল্যবান ইতিহাসকে আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। সেটাই হবে প্রয়াত প্রিয় কমরেডের প্রতি সত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন।

আমরা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি রাজ্য সদস্য কমরেড লেবাচাঁদ টুডুর প্রয়াণে গভীরভাবে শোকগ্রস্ত। লেবাদার বিস্তৃত পরিবার-পরিজন এবং তাঁর দীর্ঘ সময়ের সহযোদ্ধাদের আমরা আন্তরিক সমবেদনা জানাই। সমাজ বদলের লক্ষ্যে লেবাদার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন ও বিপ্লবী চেতনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আসুন আমরা তাঁর অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হই।

কমরেড লেবাচাঁদ টুডু লাল সেলাম।
 

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার,
২৫ জুলাই ২০২২

Commemorating

২৫ জুলাই ২০২২ মৌলালি যুবকেন্দ্রে স্মরণসভায় কমরেড লেবাচাঁদ টুডুর গ্রাম থেকে বহু মানুষ এসেছিলেন তাঁদের প্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে। ছিলেন তাঁর লড়াইয়ের দীর্ঘদিনের সাথি পিন্টু দে, দাদা ধরমা টুডু, ভাইপো সালকু টুডু এবং জগদীশ প্রামাণিক, অশ্বিনী সেনাপতি, পরেশ সিং সহ আরও অনেকে। এসেছিলেন ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার গ্রামগঞ্জ থেকে অনেক মানুষ। সংগ্রামী নেতার ছবিতে মালা ও ফুল দিয়ে সভা শুরু হয়। সভার প্রথমেই শ্রদ্ধাঞ্জলী পাঠ করেন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। সিপিআই(এমএল) রেড স্টারের পক্ষ থেকে প্রদীপ সিং ঠাকুর, সিপিআই(এমএল) নিউ ডেমোক্রেসির পক্ষ থেকে সুশান্ত ঝা, এপিডিআরএর পক্ষ থেকে তাপস চক্রবর্তী, লেবাচাঁদ টুডুর সংগ্রামী জীবনকে কাছে থেকে দেখা সাংস্কৃতিক কর্মী মেঘনাদ দাসগুপ্ত, বন্দী মুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে ছোটন দাস তাঁদের বক্তব্যর মাধ্যমে লেবাচাঁদ টুডুকে স্মরণ করেন। পার্টির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল। সকলের বক্তব্যেই কমরেড লেবাচাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা, এবং গণআন্দোলন ও ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টার কথা উঠে আসে। কুনি টুডু ও লেবাচাঁদ টুডুর একজনকে আরেকজন থেকে আলাদা ভাবে দেখা যায় না বলে জানান এই বিপ্লবী জুটির ঘনিষ্ঠ সাথিরা। মেঘনাদ দাশগুপ্ত বিশেষভাবে তুলে ধরেন মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকা তথা বিপ্লবী সংগ্রামের নেতৃত্বে মহিলাদের প্রতিষ্ঠিত করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তার কথা। একইসাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠির অপরিহার্য ভূমিকার দিককে তুলে ধরেন তিনি। লেবাচাঁদ টুডুর লেখা এবং লেবা ও কুনির কাছ থেকে শেখা সান্তাড়ি ভাষায় লড়াইয়ের গান গেয়ে শোনান কুনি-লেবার লড়াইয়ের সাথি তিয়াসা দাসগুপ্ত। এছাড়াও মেঘনাথ দাসগুপ্ত, বাবুনি মজুমদার লেবাদা’র স্মরণে গান শোনান। পার্টির পক্ষ থেকে “জননেতা লেবাচাঁদ টুডু স্মরণিকা” প্রকাশ ও বিতরণ করা হয়। এই পুস্তিকায় পিন্টু দে, কুমার রানা, তপন মুখার্জি, প্রদীপ সিং ঠাকুর, লক্ষণ টুডু সহ বিভিন্ন সাথিবন্ধুরা তাঁদের লেখায় স্মৃতিচারণ করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল সংগীতের মাধ্যমে কমরেড লেবাচাঁদ টুডু’কে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ সভা শেষ হয়।

Comrade Mozammel Haque passed away

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের শিলিগুড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক ও এআইসিসিটিইউ-র দার্জিলিং জেলা সম্পাদক কমরেড মোজাম্মেল হক ২৪ জুলাই পেড়িয়ে ২৫ জুলাই রাত ১টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিক ভাবে প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন তাঁর স্ত্রী, কন্যা, তিন পুত্র, নাতি-নাতনি, সেইসঙ্গে শিলিগুড়ি সহ সমগ্র গ্রাম-শহরের অসংখ্য গুনমুগ্ধ সমাজকর্মীদের। এই অপ্রত্যাশিত আঘাতে সারা শহর ও জেলার গ্রামগুলিতে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। পার্টির দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহর নেতৃত্বে সকালের মধ্যেই পার্টির জেলা নেতৃত্ব সহ সর্বস্তরের কর্মীদের বড় অংশ প্রয়াত কমরেডের ৬নং ওয়ার্ডস্থিত বাসভবনে একত্রিত হন শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। দিল্লী থেকে ফোনে গভীর শোক ব্যক্ত করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। দুঃসংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর জননেতার প্রতি শেষ সম্মান জানাতে একে একে উপস্থিত হন সিপিআই(এম) রাজ্য সদস্য অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকার, সিটুর জেলা সম্পাদক বিমল পাল, পিসিসি সিপিআই (এম এল)-এর অমূল্য দাস, সিপিআই(এমএল) এন ডি-র পলান, এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দল পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা জয় লোধ, এপিডিআর সংগঠক অভিরঞ্জন ভাদুড়ী, বিবেক সরকার। শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সভাপতি রূপক দে সরকার, দীপঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখ। ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক অধ্যাপক অজিত রায়, শঙ্কর দাস প্রমুখ আন্তরিক তাগিদ নিয়ে ছুটে আসেন। এছাড়াও বিভিন্ন ছোট ব্যবসায়ী থেকে টোটো চালক সকলেই এসেছিলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

প্রয়াত কমরেড মোজাম্মেল হক প্রথম জীবনে ছোট ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৯৮ সালে শিলিগুড়ি পুরনিগমের ৬নং ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন মনোনীত প্রার্থী ছিলেন অভিজিৎ মজুমদার। নির্বাচনী প্রচারের সূত্রে কমরেড মোজাম্মেল পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অনতিবিলম্বে পার্টি সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল অবধি চাঁদমণি চা বাগান উচ্ছেদ বিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চের অন্যতম কার্যনির্বাহী হয়ে লাগাতার উদ্যোগ চালিয়ে জননেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান। এবং এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি সুবক্তা ও তুখোর সংগঠক হয়ে ওঠেন। এরপরে রেল কর্তৃপক্ষ রেল লাইন সংলগ্ন হতদরিদ্র সংখ্যালঘু বাসিন্দাদের উচ্ছেদের নোটিশ দিলে কমরেড মোজাম্মেলের নেতৃত্বে দীর্ঘ প্রতিরোধ আন্দোলন পরিচালিত হয়।

অচিরেই তিনি জেলা নেতৃত্বে উত্তীর্ণ হন। দৈনন্দিন পার্টি কাজকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সম্পাদন করতে তিনি সদা আগ্রহী ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সাধারণ মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে পার্টির মুখপত্র “আজকের দেশব্রতী” পৌঁছে দিতে নিবিড়ভাবে সক্রিয় ছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে সমগ্র বামপন্থী শিবিরের নজর কেড়ে তিনি শ্রমজীবি মানুষের প্রিয়জন হয়ে ওঠেন। এরপরে শিলিগুড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক হিসাবে কার্যভার নেওয়ার সাথে সাথে তিনি শ্রমিক সংগঠনের জেলা সম্পাদক হিসাবে চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে চলমান আন্দোলনের শরিকদের মধ্যে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

স্বকীয় উদ্যোগ, কঠিন পরিশ্রম,নতুন কিছু পরিঘটনার বাস্তব বিশ্লেষন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সর্বোপরি গরিব শ্রমজীবী জনতার সঙ্গে আন্তরিক ব্যাবহারের সুবাদে কমরেড মোজাম্মেল হক এক বিস্তীর্ণ রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে অপরিহার্য সেনাপতি হয়ে উঠেছিলেন।

তাঁর এই অপ্রত্যাশিত প্রয়াণে পার্টির দার্জিলিং জেলা কমিটি ও এই সঙ্কটকালে সামগ্রিক বাম আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হল।

অনন্য জননেতা কমরেড মোজাম্মেল হক লাল সেলাম।

Veteran farmer leader Golam Mohiuddin dies

এআইকেএম-র হুগলী জেলা সভাপতি, প্রবীণ কৃষক নেতা গোলাম মহিউদ্দিন গত ১৬ জুলাই রাত্রে আকষ্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বাড়ি পান্ডুয়া ব্লকের ইলছোবা গ্রামে। কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা এই কমরেড দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন এবং প্রবীণ বয়সে এসে বাম আন্দোলনে সামিল হন। পরবর্তীতে পান্ডুয়া ব্লকে এআইকেএম গঠনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অত্যন্ত বিনয়ী ও অমায়িক স্বভাবের জন্য তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। এআইকেএম-র জেলা সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং তাঁর পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। কমরেড গোলাম মহিউদ্দিন লালসেলাম।

== == ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-29