আজকের দেশব্রতী : অনলাইন সংখ্যা (৬ আগস্ট ২০২০)
eee

আলাদাভাবে কোনো লেখা খোলার জন্য এখানে অথবা লেখার হেডিং-এ ক্লিক করুন

 

hhadd

নরেন্দ্র মোদি তার বক্তব্যে তাহলে আপাত বিচ্ছিন্ন বিন্দুগুলিকে এক রেখায় জুড়ে দিলেন। ৫ আগস্টকে এবার ১৫ আগষ্টের সাথে একই বন্ধনিতে রেখে দেওয়া হল! আমাদের প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক বুনিয়াদ ও কাঠামোর পক্ষে এর থেকে ভয়ানক ক্ষতিকর প্রস্তাবনা আর কী হতে পারে।

১৫ আগস্ট আমাদের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের দিশার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর ৫ আগস্ট ২০২০ তো এসেছে ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২-এর কু-কর্মের পথ বেয়ে যে ঘটনাকে ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট ‘জাতীয় লজ্জা’ বলে অভিহিত করেছিল।

এমনকি জমি মালিকানা মামলার শেষতম রায়েও সর্বোচ্চ আদালত ৬ ডিসেম্বরের ধ্বংসকাণ্ডকে অপরাধমূলক কার্য তথা আইন-কানুনের চরম উল্লঙ্ঘন বলেছে, এবং ১৯৪৯ সালে বাটপারি করে মূর্তি বসিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে একটি মসজিদের অপবিত্রকরণের ঘটনা হিসেবে ব্যক্ত করেছে।

সৌধ ধ্বংসের মামলাটি কিন্তু এখনও চালু আছে। ভূমিপূজনকে সরকারী কর্মসূচীতে পরিণত করে নরেন্দ্র মোদি যে কেবলমাত্র ধর্ম থেকে সরকারকে দূরে রাখার ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারা অবমাননা করলেন তা নয়, তিনি ১৯৪৯ থেকে শুরু করে ১৯৯২ পর্যন্ত একগুচ্ছ অপরাধমূলক কাজকে বৈধতাও দিলেন।

এই কাজ সংবিধান বর্ণিত আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতের ধারণাকে প্রকটভাবে নস্যাৎ করে। কিন্তু মোদি দেশের স্বাধীনতার সাথে তাকে একাকার করে দিতে আর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করতে চায়।

এতদসত্বেও আগস্ট মাসটা ৯ আগষ্টের ভারত ছাড়ো আন্দোলন আর ১৫ আগস্টের স্বাধীনতা দিবস হিসেবেই স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবে। আর, ৫ আগস্ট ২০২০ একাসন পাবে কেবলমাত্র ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর সাথে।

koled

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দাবি, বাকি বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় এদেশে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম, ভারত দেখিয়ে দিচ্ছে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়া কাকে বলে! পশ্চিমবাংলার টিএমসি সরকারও দাবি করছে, বাংলা বাকি ভারতকে দেখিয়ে দিচ্ছে কোভিডের মোকাবিলায় কিভাবে সফল হওয়া যায়! নিজের ঢাক নিজে পেটানোর বিরাম নেই। কিন্তু প্রকৃত কঠিন বাস্তবতা হল, তথ্য পরিসংখ্যানের ধারা বুঝিয়ে দিচ্ছে কী সারা ভারতে, কী বাংলায় কোভিড১৯-র মোকাবিলার হাল প্রায় শোচনীয় জায়গাতেই থাকছে। লকডাউন ক্রমাগত বাড়িয়ে চললেও তা সংক্রমণ প্রবণতাকে ছিন্ন করতে পারেনি। পরন্তু কোথাও কোথাও সরকারীভাবে স্বীকার করা হচ্ছে গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। সুস্থতার হার বাড়লেও, মৃত্যুহারও বাড়ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে, হাসপাতালে চিকিৎসা এবং সেল্ফ বা হোম কোয়ারান্টিন নিরাময় ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। ইতিমধ্যে সবচেয়ে তীব্র ও ব্যাপক মাত্রায় সংক্রমণ বাড়ছে মনে করে রোগ পরীক্ষার সর্বাধুনিক যন্ত্র বসানো হয়েছে মুম্বাই, নয়ডা ও কলকাতায়। ভারত এখন সংক্রমণের নিরীখে বিশ্বে শীর্ষস্থানে থাকা দেশগুলিকে আজ ছুঁয়ে ফেলছে তো কাল ছাপিয়ে যাচ্ছে। বাংলার হাল বিচার করলে ভারতের হাল কী দাঁড়িয়েছে তারও আন্দাজ মিলবে।

এরাজ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার এককথায় কোনও তালমিল থাকছে না। ফ্রন্টলাইনে থাকা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিশ্চয় যোদ্ধার মতো লড়ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও, মারাও যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যর্থতা-অপদার্থতার সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়েছে স্বাস্থ্য প্রশাসনের। একেবারে রাজ্যস্তর থেকে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল স্তর পর্যন্ত স্বাস্থ্য প্রশাসনের ভূমিকা আশা ভরসা তৈরির বদলে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে অনাস্থা-ক্ষোভ-অসন্তোষ। রাজ্যের গোটা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভঙ্গুর, অমানবিক, ও অসততার চেহারা প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে প্রকটভাবে। ওয়েবসাইটে প্রচারিত তথ্য সংবাদের সাথে বাস্তবে সঙ্গতি মিলছে না। সরকারী-বেসরকারী উভয় হাসপাতালের ক্ষেত্রেই বেঘোরে ঘুরে হয়রান হতে হচ্ছে। বিনা চিকিৎসায়ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। রাজ্য সরকারের গঠন করা টাস্ক ফোর্স ও গ্লোবাল অ্যাডভাইজারি ব্যবস্থার তেমন কার্যকারিতা ফলপ্রসূ হচ্ছে কোথায়? সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল বেড ব্যবস্থার ৮০ শতাংশই রয়েছে বেসরকারী ক্ষেত্রে, ভেন্টিলেশন সংস্থানের বিন্যাসও প্রায় সেরকম। অথচ করোনা যুদ্ধকালীন সময়ে কোভিড বেডের সংখ্যা সরকারী হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারী হাসপাতালে এক-পঞ্চমাংশ কম হয়ে থাকতে পারছে কেন? তার ওপর বেসরকারী ল্যাব থেকে হাসপাতাল সবেতেই চলছে পরীক্ষা গাফিলতি, প্রতারণা, ভুল রিপোর্ট, বিশাল আর্থিক প্যাকেজ চাপানো ও তা আদায় করতে হুমকি দেওয়া, স্বাস্থ্য বিমা ব্যবসায়ী সংস্থা ও হাসপাতাল ব্যবসায়ীর যোগসাজশে মেডিক্লেম গ্রাহ্য না করার ঘটনা ঘটছে।

dede

 

সরকারী স্বাস্থ্য প্রশাসন বলছে অভিযোগ থাকলে স্বাস্থ্য কমিশনে জানান। অন্যদিকে অভিযোগটা সরকারী হাসপাতাল জড়িয়ে হলে তাকে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘তদন্ত করে দেখা হবে’ প্রক্রিয়ায়। আর অভিযোগ বেসরকারী হাসপাতালের ঘটনা সূত্রে হলে কর্তৃপক্ষ হুমকি দিচ্ছে আাদালতে যাওয়ার। মুখ্যমন্ত্রীর দৈনন্দিন স্বাস্থ্য বুলেটিনে ‘কিছু সমস্যা থাকছে’ গোছের একই অন্তঃসারশূন্য কথা থাকে। করোনা মোকাবিলার মূল ব্যবস্থা চিকিৎসা ব্যবস্থাও যে ক্রমাগত ঘাতক ভাইরাসের রূপ ধারণ করছে, সেই স্তরের স্বীকারোক্তি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা যায় না। তিনি সরাসরি একবার মাত্র বৈঠক করেছিলেন বেসরকারী হাসপাতাল মালিকশ্রেণীর সাথে, আবেদন জানিয়েছিলেন সাড়া দিতে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, সব ছেড়ে রাখা হয়েছে ঐ রক্তচোষা হাসপাতাল মালিকদের ‘শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া আার দয়া দাক্ষিণ্য’র ওপর। সরকারী তত্ত্বাবধানের এহেন নিষ্ক্রিয়তা দেখে স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য চরমে ওঠার দুঃসাহস পাচ্ছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সব বিষয়েই কিছু নিয়ম বিধি তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা সেসব মানছেই না। তাহলে এর বিহিত হবে আর কিভাবে, এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন নতুন করে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রশ্ন। সেফ কোয়ারান্টিন, সেল্ফ কোয়ারান্টিন, হোম কোয়ারান্টিন ইত্যাদি ব্যবস্থাও সমস্যা জর্জরিত অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। ব্যাপক সমস্যা রয়েছে আইসোলেশানে থাকার মতো পর্যাপ্ত ঘর, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পুষ্টিকর খাদ্য ও পারিপার্শ্বিক মানবিক পরিমন্ডল পাওয়ার প্রশ্নে। এমতাবস্থায় হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। করোনা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তুমুল চাপ সৃষ্টি করতে হবে কেন্দ্র-রাজ্যের উভয় সরকারের ওপর। কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের যত অর্থ পাওনা আছে অবিলম্বে তা পাঠাতে হবে। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন অনেক দেরীতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ভাবনার কথা বলছে তা নিয়ে কালক্ষেপ না করে পদক্ষেপ করতে হবে এখনই। রাজ্য সরকারকে আনুষ্ঠানিক তর্জন-গর্জন ও গয়ংগচ্ছ মনোভাব নিয়ে চলার বদলে প্রকৃত যুদ্ধকালীন সক্রিয়তায় নামতে হবে নতুন করে। এরসাথে প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীশ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রচার ও হস্তক্ষেপ সবদিক থেকে যুদ্ধঘোষণা। আর সবকিছুর জন্য গণ আবেদন লাগাতার তুঙ্গে তুলে জনতার শক্তিকে সংগঠিত করাই সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা।

deedeebv

আগস্ট হল ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মাস। এবার ভারত ৭৩তম স্বাধীনতা বার্ষিকী উদযাপন করবে অনেক নীরবে নিভৃতে, আগে যা কখনও হয়নি। শুধু যে জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বা কোভিড-১৯ প্রতিহত করার অঙ্গ হিসাবে প্রত্যাশামাফিক দূরত্ব বিধি মেনে চলার কারণেই স্বাধীনতা দিবস এমন নিঃশব্দে নীরব হবে তা নয়। তার আরও বড় কারণ হল জীবনজুড়ে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঘনিয়ে ওঠা হতাশা ও অনিশ্চয়তার ঘনঘটা। একথা ঠিকই যে কোভিড-১৯ অতিমারী সারা বিশ্বেই হানা দিয়েছে। কিন্তু একদিকে কোভিড-১৯ আর অন্যদিকে বিচার-বিবেচনাহীনভাবে পরিকল্পিত, বিশৃঙ্খল ভাবে পরিচালিত এবং নির্মমভাবে বলবৎ করা লকডাউন — এই উভয়েরই ফলে যে বিপর্যয় তা একান্তই ভারতের।

কোভিড-১৯ অতিমারী শুরু হওয়ার আট মাস পর দেখা যাচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এর ছড়িয়ে পড়াকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে এবং ঝড়-ঝাপটার সবচেয়ে খারাপ পর্যায়টা পেরিয়ে এসেছে। এই অতিমারী ভারতে আসে তুলনামূলকভাবে কিছুটা দেরীতে, কিন্তু এরজন্য যে সময়টা পাওয়া যায় তাকে এর মোকাবিলার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কাজে একটুও সদ্ব্যবহার করা হয়নি। এক একটা সপ্তাহ গেছে আর ভাইরাসের সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বিশ্বজোড়া এই অতিমারীর ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলকে সঙ্গে নিয়ে ভারত এখন সবার প্রথমে। প্রসঙ্গত, এই তিনটে দেশেরই শাসন ক্ষমতায় রয়েছে কট্টর দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক সরকার, যারা সমস্ত বিচক্ষণ পরামর্শকেই অগ্রাহ্য করে এবং নিজেদের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধানের আবেগের তাড়না, খামখেয়াল এবং ঔদ্ধত্য দ্বারা চালিত হয়।

কোভিড-১৯ যে কঠিন চ্যালেঞ্জ সে সম্পর্কে মোদী সরকারের যখন জ্ঞানোদয় হল, প্রধানমন্ত্রী মোদী তখন মনে করলেন যে গোটাকয়েক নাটুকে ভাষণ ও চটকদার ক্রিয়াকলাপ দিয়ে তিনি এর মোকাবিলা করতে পারবেন, এটাকে তিনি মহাভারতের যুদ্ধ বলে অভিহিত করলেন যে যুদ্ধ ২১ দিনে জেতা হয়ে যাবে। এখন ২১ দিনের বদলে প্রায় ২১ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হতে চলল, আর সংখ্যাগুলো যত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল মোদীর মুখের কথাও হারিয়ে গেল। মোদী এখন আর কোভিড-১৯ নিয়ে প্রায় কোনো কথাই বলেন না; তিনি এখন এই সংকটকে একগুচ্ছ সুযোগ রূপে গণ্য করার নবলব্ধ সূত্রকেই আঁকড়ে ধরেছেন। এই ‘সুযোগগুলোকে’ তিনি পুরো মাত্রায় কাজে লাগাতে শুরু করেছেন, অর্থনীতি এবং রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই।

coal

 

কয়লা ব্লকগুলোকে নিলাম করা হচ্ছে, বেসরকারী উদ্যোগে ট্রেন চালানো শুরু হচ্ছে, শ্রম আইনগুলোকে মুলতুবি করা হচ্ছে, কৃষি বিপণন বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। গোটা দুনিয়াই যখন রাষ্ট্রের কার্যকরী হস্তক্ষেপের, বিশেষভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার সামাজিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে, মোদী সরকার তখন রাষ্ট্রের কর্তব্যকে পরিত্যাগ করে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বিচার বেসরকারীকরণকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই উঠেপড়ে লেগেছে। এবং, চূড়ান্ত ধৃষ্টতার সাথে ‘ভাবনা-চিন্তা’ ব্যাপারটাকেই খিল্লিতে পর্যবসিত করে মোদী সরকার রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের পরিত্যাগ ও কর্পোরেট অধিগ্ৰহণের যৌথ পদক্ষেপকে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযান বলে বেচতে চাইছে।

বেসরকারীকরণের এই আগ্ৰাসী তৎপরতার পাশাপাশিই বিরোধী কণ্ঠের ওপর এবং জন আন্দোলনের কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাতে লকডাউনকে অস্ত্র হিসাবে লাগাতার প্রয়োগ করতে দেখতে পাচ্ছি আমরা। অতিমারীর জন্য এনপিআর প্রকল্পকে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলেও সরকার সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বকারী কর্মীদের ওপর প্রণালীবদ্ধভাবে নিগ্ৰহ চালাচ্ছে ও তাদের গ্ৰেপ্তার করছে, এমনকি দুরভিসন্ধিমূলক ভাবে দিল্লী দাঙ্গাতেও তাদের জড়িত করছে। দিল্লী দাঙ্গার হত্যালীলায় মূল ধাক্কাটা নিরপরাধ মুসলিমদেরই সহ্য করতে হয়েছে। ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় দলিতদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে যেমন করা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে দিল্লী দাঙ্গাকেও বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করে তাকে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নিপীড়ন নামিয়ে আনার এক ন্যক্কারজনক অভিযানে পরিণত করা হচ্ছে।

মোদী সরকার গত বছর আগস্ট মাসে একতরফাভাবে ৩৭০ ধারাকে অকার্যকর করে তোলে এবং জম্মু ও কাশ্মীরের শুধু স্বায়ত্ততাই নয়, তার রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেয়। বাস্তবের জমিতে এই চকিত হামলাকে বলবৎ করা হল এক সুবিশাল ও সার্বিক দমন নামিয়ে — ইন্টারনেট ও মোবাইল টেলিফোন পরিষেবাকে বন্ধ করে দেওয়া হল, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরা সহ সমস্ত নেতৃবৃন্দকেই গৃহবন্দী করা হল এবং জনগণকে কার্যকরীভাবেই তালাবন্দী করে রাখা হল, কেননা, রাজ্যকে অভূতপূর্ব মাত্রায় সেনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটিতে জনসংখ্যার মৌলিক চরিত্র পালটে দিতে নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য চালিয়ে আরও আইনি ও নীতিগত পরিবর্তন সম্পাদিত হয়েছে।

গোড়ার দিকে জম্মু ও লাদাখে এই পদক্ষেপের পক্ষে সমর্থন ছিল, কিন্তু গত এক বছরে এই সমর্থন বলতে গেলে মিলিয়েই গেছে এবং গোটা জম্মু ও কাশ্মীরে মোহমুক্তি, ক্রোধ ও বিচ্ছিন্নতা বোধ প্রকট হয়ে মাথা চাড়া দিয়েছে। ভারতের কাশ্মীর সংকটকে তীব্র করে তুলছে লাদাখে চীনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ক্রমান্বয়ী পরিবর্তন, যা লাগাতার উত্তেজনা ও সংঘাতের এক অঞ্চল হিসাবে দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং চীনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা একই সাথে উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে ওঠাটা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে নয়া দিল্লীর কাছে এক দুঃস্বপ্ন হয়েই দেখা দেবে, আর মোদি সরকার এখন ঠিক এই পরিস্থিতির আবর্তেই ভারতকে এনে ফেলেছে। গালওয়ান উপত্যকায় চীনের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতকে ১৯৬৭ সালের পর সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে, এবং প্রাপ্ত সমস্ত সংবাদ থেকেই জানা যাচ্ছে যে পারস্পরিকভাবে সম্মত হয়ে সেনা অপসারণ ও পিছিয়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রন রেখা ভারতের দিকেই আরও কয়েক কিলোমিটার ঢুকে এসেছে। মোদী সরকার অনমনীয়ভাবে অস্বীকার করে চলছে, কিন্তু তা দিয়ে পরিস্থিতির পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন তো আর ঘটবে না।

বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ই ভারতের কাছে চীনা চ্যালেঞ্জকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। সরকার সর্বদাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমেরিকা ও ইজরায়েলেকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে, যদিও গোটা পৃথিবীতে আধিপত্য করা এবং অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করার মার্কিন নীতি ভারতের নিজের স্বার্থের পক্ষে ক্রমেই আরও বেশি প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা রূপে সামনে এসেছে প্রায় সমস্ত প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা ও তাদের সঙ্গে বৈরিতা। কেবলমাত্র পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বরাবরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার’ মধ্যেই আর ভারতের সমস্যা আটকে নেই; আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং বিশ্বের অপর একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ নেপালের সঙ্গেও ভারতের এখন সম্পর্কের জটিলতা। ভারতের বড় বড় বৈদ্যুতিন ও ছাপা সংবাদমাধ্যমগুলোতে নেপাল-বিরোধী কুৎসার প্রাবল্য এবং মোদীর নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্র বারাণসিতে নেপালি নাগরিকদের অবমাননার মর্মন্তুদ ও লজ্জাজনক ঘটনা নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে আরও বিষিয়েই তুলবে।

indus

 

অর্থনীতি এবং বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিক ব্যর্থতা এবং কোভিড-১৯ অতিমারী নিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে সরকার এখন আরও একবার বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলোতে সরকার ফেলার খেলায় মেতে উঠে এবং অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে হিন্দু ভাবাবেগকে উস্কিয়ে তুলে জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের মাঝে এবং লকডাউন চলাকালে সমস্ত ধর্মীয় সমাবেশ নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও মোদী ৫ আগস্ট প্রস্তাবিত রাম মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে যাবেন বলে সংবাদ। আর এটা হবে মোদী সরকার কর্তৃক কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার ও রাজ্য-মর্যাদা বিলুপ্ত করার ঠিক এক বছর পর। সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান যে ভারতের সংবিধান এবং সংবিধান প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের উপর বিজয় অর্জনের বিশেষ দিবস হিসাবে ৫ আগস্টকে চিহ্নিত করতে চায় তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।

ভারত নিয়ে দুটো ধারণার লড়াই এখন জনগণের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে। একটা ধারণার কেন্দ্রে রয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঊর্ধ্বে তুলে ধরা স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়বিচার; আর অন্য ধারণাটা ভিত্তি করে রয়েছে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের ওপর, ডঃ আম্বেদকরের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যা ভারতের কাছে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়েই দেখা দেবে। স্বাধীনতার স্পৃহাই ভারতকে জমিদারী প্রথা ও করদ রাজ্যগুলোর বিলোপ, গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও পরিষেবাগুলোর জাতীয়করণ এবং এক শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সৃষ্টির দিকে, এবং সাম্রাজ্যবাদী হুকুমদারী থেকে মুক্ত এক বিদেশ নীতি অনুসরণের দিকে চালিত করেছিল। মোদী-শাহ জমানায় এই সব বিষয়গুলোকেই আমরা বিপজ্জনকভাবে বিপরীতমুখী হতে দেখছি। এই সর্বনাশা বিপদের মুখোমুখি হয়ে ভারতের জনগণকে ভগৎ সিং ও আম্বেদকরের মতো ব্যক্তিত্বদের দেখানো পথেই ফিরে যেতে হবে এবং ভারতকে নিয়ে যেতে হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক সাম্যের বৈশিষ্ট্য সমন্বিত প্রাণোচ্ছল জনগণতন্ত্রের এক গন্তব্যে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ জুলাই ২০২০)  

ddeddew

অর্থনীতি এবং পরিবেশ সম্পর্কে কর্মনীতি ঘোষণার পর আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কর্মনীতি ঘোষণা করতে মোদী সরকার লকডাউনের সময়টাই বেছে নিল, নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০। মোদী শাসনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার পরপরই ২০১৯-এর মে মাসের ৩১ তারিখে ৪৮৪ পাতার একটা খসড়া পেশ করা হয়। সেই ৪৮৪ পাতার খসড়াকে সঙ্কুচিত করে এখন ৬০ পাতার এক কর্মনীতিতে পরিণত করা হয়েছে যাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ২০২০-র ২৯ জুলাই অনুমোদন দেয়। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মনীতির ক্ষেত্রেও সংসদকে এড়াতে, কোনো ধরনের মতামত দেওয়া থেকে তাকে প্রতিহত করতে সরকার আরও একবার লকডাউনকে মওকা করে তুলল। সরকারের দাবি, ব্যাপকতর স্তরে আলোচনার পরই তারা এই কর্মনীতিকে রূপায়িত করেছে। কিন্তু শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশ সংগঠন বলছে যে ওই আলোচনার পর তার ফলাফল নিয়ে যে তথ্য সরকার জোগান দিয়েছে বলে বলছে সে সম্পর্কে সরকারের কাছ থেকে তারা আদৌ কিছু শোনেনি। আরএসএস অনুমোদিত ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল অবশ্য এই কর্মনীতিকে স্বাগত জানিয়েছে, কেননা, তারা যে সমস্ত দাবি জানিয়েছিল তার ৬০-৭০ শতাংশই সরকার গ্ৰহণ করেছে।

নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ উপস্থাপিত হয়েছে একবিংশ শতকের প্রথম শিক্ষা নীতি হিসাবে যার ঘোষিত লক্ষ্য হল “ভারতীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে শিকড় চাড়ানো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ করে … ভারতকে বিশ্বে জ্ঞানের এক অতিবৃহৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা।” বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মান সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিক্ষা নীতির নথিতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আমেরিকার আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা, আমেরিকার সুপরিচিত আটটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যে নামটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আধুনিক যুগের আদর্শ জ্ঞান সমাজ বলতে যা বোঝা হচ্ছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওই নথি পাঁচটা দেশের উদাহরণ দিয়েছে : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইজরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ডের ভিত্তিতে তাঁরা জ্ঞান সমাজের ওই পাঁচটা দৃষ্টান্তকে আদর্শ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন সে সম্পর্কে ওই নথির রচয়িতারা অবশ্য আমাদের জানাননি। নতুন এই নথিতে আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব সংশয়াতীত রূপে স্পষ্ট, এবং এই নীতি আমেরিকার এবং অন্যান্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভারতে শাখা খোলার জন্য স্বাগত জানিয়েছে।

dre

 

শিক্ষাক্রম শেষ না করেই ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপক বিস্তৃত সমস্যা এবং ভালো গুণমানের শিক্ষার সার্বজনীন লভ্যতার অভাবের কথা নয়া শিক্ষানীতি স্বীকার করেছে। এই সমস্যার সমাধানে কর্মনীতির লক্ষ্যের কিছু উল্লেখ নথিতে করা হয়েছে এবং এই দাবিও করা হয়েছে যে দু-কোটি ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষা ব্যবস্থায় পুনরায় যোগদান করানো হবে। তবে এই লক্ষ্য কিভাবে অর্জিত হবে সে সম্পর্কে আমাদের অন্ধকারেই রাখা হয়েছে। স্কুলে ও তারপর  কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধরে রাখার কোন উপায় হাজির করার পরিবর্তে এই নীতি শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বহুবিধ রাস্তা খুলে রেখেছে। পড়া ছেড়ে দেওয়ার প্রত্যেকটা ধাপে একটা করে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এইভাবে শিক্ষা ত্যাগ করার পরিঘটনাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। দুর্বল শ্রেণী, জাত ও লিঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীরাই শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যায়। নয়া শিক্ষানীতি তাদের বেরিয়ে যাওয়াটা অব্যাহত রাখবে, তবে হাতে একটা সার্টিফিকেট পাবে তারা। বলা বাহুল্য যারা পাঠক্রমের গোটা পর্যায়টা অতিক্রম করে ডিগ্ৰি সম্পূর্ণ করবে একমাত্র তারাই সবচেয়ে ভালো কাজগুলো পাবে; মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়ে যারা সার্টিফিকেট পাবে, ভালো কাজ পেতে ওই সার্টিফিকেট কোনো সহায়ক হবে না।

eec

 

শিক্ষানীতিতে শিশুকালে শিশুদের যত্ন নেওয়া ও তাদের শিক্ষার স্তরের (ইসিসিই) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এই লক্ষ্যে অঙ্গনওয়ারি ব্যবস্থাপনাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ইসিসিই স্তরের (যার মধ্যে ৩ বছর পর্যন্ত বয়সীদের একটা উপ-কাঠামোও অন্তর্ভুক্ত) একটা “চমৎকার পাঠক্রম ও শিক্ষণপ্রণালী সংক্রান্ত কাঠামো”-র বিকাশ ঘটাবে এনসিইআরটি। আরও বলা হয়েছে, “যেখানে সম্ভব সেখানেই” শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা/ বাড়ির ভাষা/ স্থানীয় ভাষা, শুধু পঞ্চম ধাপ পর্যন্তই নয়, “ভালো হবে” যদি অষ্টম ধাপ এবং তার পরও এটাকে চালানো যায়। বর্তমানে ভারতে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরাজি বিশেষ অধিকার ও সুবিধার নির্দেশক রূপেই গণ্য হয়। নতুন ভাষা নীতি কি এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যেখানে মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা/ বাড়ির ভাষা/ স্থানীয় ভাষা নিকৃষ্ট রূপে বিবেচিত হবে, আর নিজেদের সন্তানদের ইংরাজির সুবিধা দিতে চাইলে দরিদ্র ও বঞ্চিত অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মাত্রাতিরিক্ত চড়া দামের বেসরকারী স্কুলগুলোতে পাঠাতে বাধ্য হবে?

rew

 

এবং সবশেষে এই নথি প্রসঙ্গক্রমে “১৮ বছর বয়স অবধি দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের যথাযথ ও ভালো গুণমানের” শিক্ষা দিতে উপযুক্ত সহায়ক ব্যবস্থার সংস্থান করার উল্লেখও করেছে। শিক্ষা সম্পর্কিত নীতির ক্ষেত্রে এ সবই শুনতে খুব ভালো, কেবল নথিতে স্পষ্টভাবে বলা নেই সরকার দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত (১৮ বছর বয়স অবধি) শিক্ষাকে কিভাবে সর্বজনীন করে তুলবে। সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে শিক্ষাকে বুনিয়াদি অধিকার করে তোলা যাবে কিভাবে? নতুন নথিতে বলা হয়েছে, সকলের সাধ্যের মধ্যে থাকা ভালো গুণমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু সকলের সাধ্যায়ত্ত বলতে সরকার কী বোঝাতে চাইছে তা আমরা বুঝতে পারছি না, এবং সেটা কিভাবে সুনিশ্চিত করবে তাও আমরা জানতে পারছি না। শিক্ষার সার্বজনীন লভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ রূপে সরকারী স্কুল ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত ও উন্নত করে তোলার প্রস্তাব নথিতে নেই। নথি শিক্ষার বাণিজ্যকরণকে খর্ব করার কথা বলেছে, তবে তা বেসরকারীকরণের ক্রমপ্রসারমান কাঠামোর মধ্যে। কায়দাটা খুবই সোজা; “জনহিতকর মানসিকতার” বেসরকারী স্কুল অথবা “মানবদরদী” বেসরকারী স্কুলের মতো শব্দগুলোকে বারবার ব্যবহার করে বেসরকারী শব্দটায় নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়েছে। কারা এই জনস্বার্থধারী মানবদরদী? তারা কি সেই একই মুনাফাবাজ কর্পোরেট সংস্থাগুলো যারা সন্তানের সাফল্যের জন্য মানুষের আকাঙ্খাকে মূলধন বানিয়ে চড়া দামে শিক্ষা বিক্রি করে? তারা কি সেরকম হবে না যারা শিক্ষায় টাকা না ঢেলেও শিক্ষার এজেণ্ডা ও অগ্ৰাধিকার নির্ধারণ করবে?

শিক্ষানীতি শিক্ষায় সরকারী ব্যয়কে বাড়ানোর কথা বলেছে, তবে তা ১৯৮৪ সাল থেকে অসংখ্যবার বলে আসা শিক্ষায় ব্যয়কে জিডিপির ৬ শতাংশ করারই পুনরাবৃত্তি, যে লক্ষ্যমাত্রা কখনই পূরণ হয় না। মুচকুন্দ দুবে কমিশন ২০০৭ সালে বিহারের জন্য যে অভিন্ন স্কুল ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল, যাতে সমস্ত পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সরকারী স্কুলে আসাটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, একমাত্র সেই ব্যবস্থাই সরকারী স্কুলের গুণমানকে উৎকৃষ্ট করতে এবং সামাজিক সাম্যের সার্বজনীন ভাবধারা ও বৈচিত্র্যের সমাদরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে (নীতীশ কুমার সরকার ভূমি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের মতোই দুবে কমিশনের রিপোর্টকেও আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে)। এই ধরনের আমূল সংস্কারকামী জোরালো ধাক্কা না দিলে, এবং তার রূপায়ণের সুনির্দিষ্ট পথ-মানচিত্র না থাকলে এই নীতিমালার অধিকাংশ লক্ষ্য দুরাকাঙ্খার বয়ান হয়েই থেকে যেতে বাধ্য।

dew

 

শিক্ষা নীতিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার পুনর্বিন্যাসের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে এবং তাকে কেন্দ্র করেই প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র পরিবর্তনগুলো আবর্তন করছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর যে জোর দেওয়া হয়েছে তার লক্ষ্য হল বৃহৎ পুঁজির প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করা। শিক্ষা নীতিতে মোট ছাত্রদের অর্ধেককেই ইন্টার্নশিপের সুযোগ সহ একেবারে ষষ্ঠ স্তর থেকে সরাসরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং ইনটার্নশিপকে এত আগে থেকেই প্রবর্তন করতে চাওয়া হচ্ছে কেন তা বুঝে ওঠাটা খুব একটা শক্ত ব্যাপার নয়। এই প্রক্রিয়ায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার পথে ঘোরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত গোষ্ঠীর ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রদেরই সাধারণ শিক্ষা থেকে বার করে এনে নিম্ন দক্ষতাসম্পন্ন স্বল্প আয়ের কাজে লাগানো হবে। অন্যভাবে বললে, দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে সার্বজনীন করার পরিবর্তে নয়া শিক্ষা নীতি কম বয়সী তরুণ/ কিশোরদের নিছক শ্রম শক্তিতে পরিণত হওয়াটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলতে পারে। আমরা স্মরণ করতে পারি, মোদী সরকার শিশু শ্রমিক নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন করেছিল যাতে ১৪ বছরের কম বয়সী কিশোররা “পরিবার ভিত্তিক উদ্যোগগুলিতে” কাজ করতে পারে, এবং এই নীতির সমর্থনে জাত-ভিত্তিক শ্রমের জাতপাতবাদী যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিল।

বৃত্তি শিক্ষার পথ ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে ভিন্ন ক্ষেত্রে চালিত করা ছাড়াও নয়া নীতি কলেজ শিক্ষার সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যাসের কথাও বলেছে। কয়েক বছর আগে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় চার বছরের স্নাতক পর্যায়ের পাঠক্রমকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিল, তবে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে চালু করার পরই ওই পাঠক্রমকে তুলে নিতে হয়। নয়া নীতি চার বছরের ডিগ্ৰি কোর্সের রূপে সফল না হওয়া ওই নীতিকে পুনরায় চালু করছে যাতে প্রতি বছরের শেষে শিক্ষা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খোলা রাখা হচ্ছে। মাস্টার ডিগ্ৰির সময়কালকে কমিয়ে এক বছরের কোর্সে পরিণত করা হয়েছে আর এম ফিলকে পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টা এবং তার সাথে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলা ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা চালু হওয়া — উভয়ই উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণা ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ঢোকার পথকে নিয়ন্ত্রিত করে তুলবে। স্কুল শিক্ষার মতো এখানেও বহিষ্করণের যে একাধিক বিকল্প খুলে রাখা হয়েছে তা সেই নির্দিষ্ট সমস্যাকেই চাপা দেবে ও গোপন করবে যে সমস্যাটা হল সামাজিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে বঞ্চিতদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঢুকতে পারার পরও ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার পরিঘটনা। শিক্ষা নীতি একটা জাতীয় বৃত্তি পোর্টালের কথা এবং বেসরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ২৫ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ অর্থ যোগানের সংস্থানের কথা বলেছে, তবে, নীতির রূপায়ণ কী দাঁড়ায় সেটাই এই পরিসংখ্যানগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রকৃত ধারণা দিতে পারবে।

যে কোনো শিক্ষা নীতির রূপায়ণের ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। নয়া নীতি শিক্ষার পেশায় সর্বোত্তম ও উজ্জ্বল মেধার ছাত্র-ছাত্রীদের টানার ও তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। কিন্তু কাজের নিরাপত্তাহীনতা উত্তরোত্তর বেড়ে চলা, চুক্তিতে শিক্ষা প্রদানের পরিঘটনা এবং সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত সম কাজে সম বেতন নীতির অতি মাত্রায় লঙ্ঘন নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে যে ক্ষোভ রয়েছে, নয়া নীতি সে সম্পর্কে নীরবই থেকেছে। নয়া নীতির আর একটা উদ্বেগজনক দিক হল চরম কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা। জাতীয় শিক্ষা কমিশন ও জাতীয় গবেষণা ফাউণ্ডেশনের গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে অভিন্ন মূল্যায়ন ও ভর্তির পরীক্ষা ব্যবস্থা — এই সবগুলির ক্ষেত্রেই নয়া নীতি ব্যাপক হারে ‘হালকা কিন্তু দৃঢ়’ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দিয়েছে এবং ‘শিক্ষা’ সংবিধানের যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত হলেও রাজ্য সরকারগুলোর হস্তক্ষেপের কোনো অবকাশই রাখেনি।

sade

 

আক্রমণাত্মক সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ক্ষমতার নেতৃত্বে থাকায় এই ধরনের অতি-কেন্দ্রীভবন শিক্ষা ক্ষেত্রের গোটা পরিসরটারই ক্রমবর্ধমান গৈরিকিকরণের পথ প্রশস্ত করবে। নয়া শিক্ষানীতি কয়েক জায়গায় সাংবিধানিক মূল্যবোধের উল্লেখ করেছে, তার সাথেই উল্লিখিত হয়েছে বিজ্ঞান মনস্কতা, বিশ্লেষণাত্মক অনুসন্ধান, বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদ এবং সার্বজনীনতার মতো শব্দবন্ধ। এ সত্ত্বেও পাঠক্রমে পরিবর্তন সম্পর্কে এবং গবেষণাকে আরএসএস-এর মতাদর্শগত দিশার ছাঁচে ঢালার প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমাদের প্রহরা জারি রাখতে হবে। জোরজবরদস্তি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আগে যে প্রতিবাদ হয়েছিল সে সম্পর্কে হুঁশিয়ার থেকে নয়া শিক্ষানীতি আপাতত ত্রিভাষা সূত্রকে অক্ষত রেখেছে এবং তাতে জোর থেকেছে সমস্ত স্তরে সংস্কৃতকে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর। অন্য যে বিষয়টা সম্পর্কে নয়া শিক্ষানীতি নীরব থেকেছে তা হল জাতপ্রথা ও জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণ, এই নীতির বাঁধা বুলি হয়ে উঠেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত গোষ্ঠীসমূহ, যদিও এই গোষ্ঠীগুলোর আরও সুযোগ লাভ সুনিশ্চিত হবে কিভাবে সে বিষয়টাকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারেই অস্বচ্ছ করে রাখা হয়েছে।

reqr

 

ভারতের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবশ্যই খোলনলচে বদলানো দরকার। দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাবিদরা সরকারী/ বেসরকারী, ধনী/ দরিদ্র ধারার বর্তমান সমান্তরাল ব্যবস্থাটাকে সরিয়ে তার স্থানে সন্নিহিত অঞ্চলে অভিন্ন স্কুল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়ে আসছেন, যে ব্যবস্থায় সবার জন্য বিনামূল্যে সম মানের শিক্ষা প্রদান করা হবে। শিক্ষায় ব্যয়ের ওপর অগ্ৰাধিকার দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে তাঁদের দীর্ঘকালের আর্জি, যাতে কোনো ভারতবাসীকেই অর্থের অভাবে অথবা আসন ঘাটতির কারণে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্কুল ও কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে না হয়। মোদী সরকারের নয়া শিক্ষানীতি কখনই সেই রূপান্তরণ নয় যা ভারতের শিক্ষানীতির প্রয়োজন। এর বিপরীতে এই শিক্ষানীতির নকশা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে ভারতের ব্যাপক সংখ্যাধিক দরিদ্র ও বঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ক্ষেত্রের বাইরে রাখা যায় ও শিক্ষার দরজা তাদের কাছে বন্ধ হয়ে যায়; সংরক্ষণ ও সামাজিক ন্যায়কে দুর্বল করা যায়; বেসরকারী, মুনাফাভিত্তিক শিক্ষার জোয়ার বয়ে যায়; এবং ডঃ আম্বেদকর যাকে চিহ্নিত করেছিলেন “স্তর বিন্যস্ত অসাম্য” তা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

baedaeeer

সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার জমি যেমন মন্দির ট্রাস্টের হাতে অর্পণ করেছিল তেমনই বাবরি ধ্বংসকে অপরাধ বলে ঘোষণা করেছিল। শিলান্যাস অনুষ্ঠানে হাজির থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কেন সেই অপরাধ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে?

ভারতের নাগরিক হিসেবে আমরা দাবি করছি – বাবরি ধ্বংসের অপরাধীদের রাজনৈতিক ফায়দা নয়, শাস্তি দাও।

আনলক গাইডলাইন বলছে – কোনও ধর্মীয় জমায়েত নয় এবং ৬৫ বছরের কাছাকাছি বয়সের সকলকে বাড়িতে পৃথকভাবে থাকতে হবে। ৬৯ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রীই যদি এই পালন-বিধিগুলি লঙ্ঘন করে অযোধ্যার ধর্মীয় জমায়েতে অংশ নেন তাহলে তিনি কি আসলে সব ভারতীয়কেই কোভিড-১৯ প্রতিরোধের নিয়মনীতি ভাঙতে উৎসাহিত করছেন না?

ধর্ম ও রাজনীতিকে মিলিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ভারতের সংবিধান দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। কেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী একটি মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন?

কোভিড-১৯ ও লকডাউন সংকটের সাথে গোটা দেশকে লড়তে হচ্ছে। তার সাথে প্রতি বছর বন্যা আরও কিছু মারণ রোগ নিয়ে আসে। এরকম পরিস্থিতিতে দেশের প্রধানমন্ত্রী জনতাকে এইসব ভয়াবহ সংকট থেকে সুরক্ষিত রাখার পদক্ষেপের বদলে মন্দির প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেন?

ddearie

পুর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ঋণ মুক্তির আন্দোলনে প্রতিনিয়তই যোগদান করে চলেছেন। গত ৩১ জুলাই আটপাড়া গ্রামে ঐ এলাকার আটটি গ্রামের দুই শতাধিক মানুষ জমায়েত হন। বৈঠকের আগে গ্রামে মিছিল সংগঠিত হয়। গ্রামের মানুষই মিছিলের নেতৃত্ব দেন ঋণ মুক্তি কমিটির ব্যানারে। বৈঠকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত জেলা কমিটির সদস্য কুনাল বক্সী ও সমীর বসাক উপস্থিত ছিলেন। মহাজনী সংস্থা বন্ধনের ঋণে বিপর্যস্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি ছিল। অন্যান্য মহাজনী সংস্থার ঋণগ্রস্তরাও ছিলেন। ছিলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। একই লোক বিভিন্ন সংস্থা থেকেই ঋণ নিয়েছিলেন এমন মানুষেরাও ছিলেন। বেশিরভাগই গরিব মেহনতিদের পরিবারের মহিলা। আবার কিছু মাঝারি স্তরের মানুষেরও উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন মানুষের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ঋণ ফাঁসে আবদ্ধ হয়ে দম বন্ধ অবস্থার মধ্যে আছেন। তার উপর লকডাউন ও করোনা আতঙ্ক ছড়ানোর ফলে উপার্জনহীন হয়ে আছেন। পরিবার প্রতিপালন কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তারপর ঋণভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

এই জামালপুর ব্লকেই করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে চলেছে। তার মধ্যেই মানুষ করোনার ভয়কে উপেক্ষা করেই জমায়েত হচ্ছেন। তাতেই বোঝা যায় গ্রামাঞ্চলে ঋণমুক্তির দাবি কতখানি জোরদার হয়ে উঠছে। আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয় আগামী ৭ আগস্ট ব্লক অফিসে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হবে। এবং ১৩ আগস্ট দেশজুড়ে ঋণ মুক্তি দিবস পালন করার কর্মসূচি এখানেও সংগঠিত করার প্রস্তুতি নিতে হবে। ইতিমধ্যেই কিছুদিন আগে একজন রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্য বলেছেন রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি নাকি কোনো উৎপাদনমুখী উদ্যোগ নিচ্ছেন না, এমনকি সরকারের  বিভিন্ন ধরনের মেলা ও প্রদর্শনীতে সরবরাহের ক্ষেত্রে যেসব স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নামে চালানো হয় তাও নাকি বাজার থেকে ক্রয় করে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নামে সরবরাহ করা হয়। কার্যত তিনি স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর স্বনির্ভর উদ্যোগের মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি করতে না পারার জন্য ও ঋণগ্রস্ত হওয়ার জন্য গ্রামীণ গরিব মেহনতিদের পরিবারের গোষ্ঠী সদস্য মহিলাদেরই দায়ী করেছেন।

ssa

 

গ্রামাঞ্চলে একচ্ছত্র ক্ষমতা দখলকারী পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, এমনকি গ্রামের সমবায়, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ক্লাস্টার কমিটির ক্ষমতা সবই তাঁদের দখলে তবুও কেন গোষ্ঠীগুলোর উন্নয়ন হচ্ছে না বা হাজারে হাজারে ঋণ ডিফল্টার হচ্ছে বা গোষ্ঠী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার জবাব তো শাসক দল তৃণমূলের নেতা কর্মীদেরই দিতে হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর ভর্তুকির জন্য নির্দিষ্ট কোটি কোটি টাকা কোথায় গেল? কেন গোষ্ঠীগুলোর উন্নয়নের ব্যবস্থা হল না? সরকারী মেলা ও প্রদর্শনীগুলোর গোষ্ঠীর নামের ভর্তুকির টাকা কাদের পকেটে গিয়েছিল, তার জবাব দিতে হবে। গোষ্ঠীর মাধ্যমে গ্রামের গরিব মেহনতিদের স্বনির্ভর করার ও কর্মসংস্থানের প্রচার কোথায় গেল! তাই প্রশ্ন হচ্ছে ঋণ মুক্তির, শুধুমাত্র ঋণ মকুবের নয়। অতীতের ডিআরডি ঋণ বা বিভিন্ন ধরনের ছাগল-গরু-হাঁস-মুরগী লোন অনাদায়ী হয়ে অনিবার্যভাবেই মকুব বা তামাদি হয়ে গিয়েছিল। সেই ধরনের কেবলমাত্র অনিবার্য ঋণ-মকুবে আটকে থাকলে কিন্তু গরিবদের দুরবস্থা বাড়বে। স্বনির্ভরগুলি গোষ্ঠিগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। আজকের ঋণমুক্তির দাবির লড়াই নতুন ভাবেই ভাবতে হবে।

১ আগস্ট বৈঠক হয় জারো গ্রামে ৫০ জনের মতো মহিলাদের, ২ আগস্ট মসাগ্রামে, ৩ আগস্ট সুরে কালনা গ্রামে, ৪ আগস্ট মসাগ্রামের বেরলী উত্তর পাড়া ও রেল গেটের পাশের জগন্নাথ পাড়ায়। এই সমস্ত বৈঠক পরিচালনা করেন লোকাল দায়িত্বশীলরা। এই দায়িত্বশীলদের মধ্যে আছেন নিতাই ক্ষেত্রপাল, রীতা পন্ডিত, রহিমা সেখ, অর্চনা মাল, দীপালী সহ অনেকে। এই সমস্ত মানুষের নেতৃত্বে তৈরি হবে আগামী দিনের ব্লক কমিটি।

-- সজল পাল  

geeddew

ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল নেত্রী অনেকবারই বলেছিলেন বাংলার যুবকদের কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্যে বা বাইরে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে, তিনি ক্ষমতাসীন হলে কাউকেই আর বাইরে যেতে হবে না, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাজের ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই হবে। ক্ষমতায় আসার পর ৯ বছর হতে চলল। গত বছর তাঁদের একজন মন্ত্রী বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা এত বেশি উন্নয়ন করেছেন যে গ্রামের মানুষের আর কাজের দরকার নেই, মানুষ কাজ চাইছেন না, তাই পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজ কম হচ্ছে। তার মানে তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা মনে করতেন বা দেখাতে চাইতেন যে পশ্চিমবঙ্গের গরিব মেহনতিদের পরিবারের যুবকদের আর বাইরে কাজের সন্ধানে যেতে হয় না। সে কারণেই হয়তো লকডাউন ঘোষণার সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা মাথাতেই আসেনি।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানের মনতুষ্টি করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দিল্লী থেকে গুজরাট পর্যন্ত ‘গরিব-হীন ভারতবর্ষ’ দেখানোর কাজে বিভোর ছিলেন, এবং তার ঘোর কাটার পর যখন দেখা গেল করোনায় দেশকে ঘিরে নিয়েছে তখন তড়িঘড়ি জনতা-কার্ফু নাম দিয়ে রেল বিমান যানবাহন অফিস বাজার সব বন্ধ করে দিলেন। পরের দিন রাত, ২৩ মার্চ আটটার সময় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আবেগকম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন রাত ১২টার পর থেকেই সারা দেশে সম্পূর্ণ  লকডাউন। মাত্র ২১ দিন দেশবাসীর কাছে সময় চাইলেন। বললেন সবাই ঘরে থাকুন তাহলেই দেশ জয়ী হবে। কিন্ত যাদের ঘর নেই তারা কোথায় থাকবেন সে কথা বললেন না। বললেন না দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দিনমজুর ও মেহনতিদের কিভাবে জীবন-জীবিকার সমাধান হবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা ভাবতেই পারলেন না। লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ মেহনতিরা অর্ধাহার অনাহার ও থাকার জায়গার অভাবে বাধ্য হয়ে লকডাউন ও পুলিশের অত্যাচার অগ্রাহ্য করেই হাজার হাজার মাইল হাঁটার ঝুঁকিপূর্ণ পথে নিজেদের ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রাস্তায় না খেতে পেয়ে, দুর্ঘটনায়, ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে এবং অসুস্থ হয়ে শয়ে শয়ে আহত ও নিহত হতে লাগলেন। রক্তে রঞ্জিত হল রাজপথ রেলপথ। বিশ্বের সোস্যাল মিডিয়া, সংবাদ জগতে, মানবাধিকারের প্রশ্ন উঠল, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিষয় হয়ে উঠল। তখনই কেবল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বোধ উদয় হল। স্বীকার করলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের অস্তিত্ব। এবং অতঃপর শুরু হল ঘরে ফেরানো নিয়ে টালবাহানা। যারা বছরের পর বছর ধরে ‘চালু ডিব্বা’র যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে যান কাজের সন্ধানে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মজুর হওয়ার জন্য; অত্যাচার, বঞ্চনার, প্রতারণার স্বীকার হচ্ছেন যারা প্রতিনিয়তই। কিন্তু কেন শ্রমিক পরিযায়ী! কেন কেরল-কর্ণাটক-তামিলনাডু-গুজরাট-মহারাষ্ট্র সহ কিছু রাজ্যের মজুরি পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-ওড়িষ্যা-ঝাড়খন্ড সহ কিছু রাজ্যের থেকে ২\৩ গুন বেশি? শাসক শ্রেণীগুলির বৈষম্যমূলক নীতির ফলই হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক তৈরির উৎস। গ্রামীণ ভারতের প্রতি বৈষম্য, শ্রেণীগত বৈষম্য, জাতিগত বর্ণগত, সম্প্রদায়গত, ধর্মগত ও এলাকাগত বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক।

লকডাউনের সময় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কর্মীরা বিভিন্ন রাজ্যে যোগাযোগ রেখেছেন, সহযোগিতা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তার প্রভাব বিভিন্ন রাজ্যে যেমন আছে তেমনই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে। অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যেই এই স্তরের উত্থান। এদের সংগঠিত করা আজকে সময়ের দাবি। কেন্দ্রীয় সরকার অনেক বড় বড় প্যাকেজের কথা বললেও তিনমাস ৫ কেজি চাল ও ১ কেজি ডাল ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। গরিব কল্যাণ যোজনার ১২৫ দিন কাজ দেওয়ার কথা বললেও সব রাজ্য বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কোনো জেলাকেই যুক্ত না করে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ঘরে ফেরার পর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের গরিব মেহনতিদের মতো পরিযায়ী শ্রমিকদেরও চরম সংকট চলছে। কাজ নেই, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভ বেড়ে চলেছে। বর্ধমান সদর-১, পুর্বস্থলী-২ ও মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা-২ ব্লকে গত সপ্তাহে উৎসাহব্যাঞ্জক বৈঠক হয়েছে। মুকশিমপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাররপাড়া গ্রামে জবকার্ডের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন। বিডিও সাহেব ১৫ দিনের সময় নিলেও তৃণমূলের নেতারা নিজেদের গোষ্ঠীকোন্দল নিয়েই ব্যস্ত আছেন। কাজ দিচ্ছেন না, আবেদন নিচ্ছেন না। ডেপুটেশন নিতেও রাজি হচ্ছেন না। নাদনঘাট পঞ্চায়েতের ইসলামপুর গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকেরা অনেক লড়াইয়ের পর কাজ পেলেন। মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকরাও আন্দোলন চালিয়ে কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

-- সজল পাল  

aaadde

গত ৪ আগস্ট সকালে পাণ্ডুয়ার তিন্না সংলগ্ন দেশবন্ধু মোড়ে দেখা গেল, রাস্তার পাশে কংক্রিটের তৈরি লোকনায়ক সিধু ও কানহুর মূর্তির হাতে ধরা কুঁড়ুল ও হাতের আঙুল ভাঙ্গা, পায়েও ফাটল। এই ঘটনায় স্তম্ভিত আদিবাসী জনগণ সকালেই পথে নামেন প্রতিবাদে। পুলিশ আসে। ঘণ্টা দেড়েক অবরোধের পর, পাণ্ডুয়া থানা ঘটনার তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিলে, অবরোধ ওঠে। এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন ‘আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’র জেলা সহসভানেত্রী ময়না কিস্কু এলাকা সংলগ্ন মালা পুকুরের আদিবাসী জনগণের সাথে দেখা করেন। ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। বৃহত্তর প্রতিবাদের প্রতিশ্রুতি দেন।

সম্প্রতি গুড়াপের শংকরপুরে এক আদিবাসী ছাত্রীর উপর নির্যাতন ঘটে। এই ঘটনার পর আদিবাসী সমাজ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানান। ‘আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’র পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধিদল মঞ্চের অন্যতম সহ-সম্পাদক মহাদেব মুর্মুর নেতৃত্বে নির্যাতিতা ছাত্রীটির বাড়ি গিয়ে আদিবাসী পরিবারটির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। ৩ আগস্ট ধনেখালিতে আদিবাসী মঞ্চের ব্লক কর্মিসভায় উপস্থিত মঞ্চ-নেতৃত্ব এই ঘটনার প্রতিবাদ আরো তীব্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আগামী ৯ আগস্ট, বিশ্ব আদিবাসী দিবস। ওইদিন এই ঘটনাগুলিকে সামনে রেখে আদিবাসী স্বার্থ রক্ষার শপথ নিতে বেলা ১২টায় বরুনানপাড়ায় আদিবাসী সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। এরই প্রস্তুতিতে গত ২৭ জুলাই মঞ্চের নেতৃত্ব পাগান মুর্মু, বিশ্বনাথ সরেন, সিদ্ধেশ্বর মাণ্ডিদের উদ্যোগে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

pro

 

গত ১৭ জুলাই উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হয়। এবছরই প্রথম সাঁওতালি মাধ্যমে ১৩৮ জন আদিবাসী ছাত্র/ছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন। অথচ রাজ্য সরকার এখনো পর্যন্ত ঘোষণা করেনি যে কোন কোন কলেজে সাঁওতালি ভাষায় স্নাতক (বিএ) পড়ানো হবে! সাঁওতালি ভাষা এরাজ্যে দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সাঁওতাল ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতি রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত অবহেলা এই ঘটনায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ধরা যায়। এর প্রতিবাদে মঞ্চের রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসে এই ঘটনারও প্রতিবাদ জানানো হবে। এছাড়া লোকপ্রসার প্রকল্প ও আদিবাসী মোড়লদের সামাজিক ভূমিকার সরকারী স্বীকৃতির দাবিও তুলে ধরা হবে। কৃষক সংগঠনগুলির সর্বভারতীয় সমন্বয় কমিটির ডাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষকবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধেও দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচী রয়েছে ৯ আগস্ট। সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এই সর্বভারতীয় মঞ্চের শরিক। ৯ আগস্ট আদিবাসী মঞ্চ আদিবাসী স্বার্থ তুলে ধরার পাশাপাশি কৃষক স্বার্থকেও তুলে ধরবে।

gaaassa

৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের এক বছর, জম্মু কাশ্মীরকে রাজ্য হিসেবে লুপ্ত করা ও কাশ্মীরের সমগ্র জনসাধারণকে বন্দী করার এক বছর।

গতবছর মোদি সরকার অনেক লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তাদের এই পদক্ষেপে নাকি দেশের এবং কাশ্মীরের মানুষের অনেক উপকার হবে। সেই সময় অনেকেই সতর্ক করেছিল যে কাশ্মীরে মোদি সরকার যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা অচিরেই সারা দেশে অত্যাচার চালানোর নীল নক্সা হয়ে দাঁরাবে। এক বছরের মধ্যেই মোদি সরকারের সেইসব বড়ো বড়ো কথা বাস্তবে প্রতারণা হয়ে দেখা দিয়েছে, আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জম্মু কাশ্মীরে মোদি সরকারের চালানো অত্যাচারের মডেল সারা দেশেই গণতান্ত্রিক কন্ঠস্বরকে দমন করার, থামিয়ে দেওয়ার, বন্দী করার পরিঘটনা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীরের বন্দী জনতার সংহতিতে ৩ আগস্ট বহু মানুষ প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন। দেশ জুড়ে সিপিআই(এমএল) কর্মীরা বহু জায়গায় ছোট ছোট প্রতিবাদী সমাবেশ সংগঠিত করে কোভিড-১৯ সতর্কতা বজায় রেখে। বহু কর্মী সোশাল মিডিয়ায় পোস্টার প্রদর্শনের মাধ্যমে সেই সংহতি ও প্রতিবাদকে ছড়িয়ে দেন।

aaaaedewaa

১-৯ আগস্ট প্রচার অভিযানের দাবিসমূহ

    • গ্রামীণ, ঘরে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের আগামী ৬ মাসের জন্য মাসিক ১০,০০০ টাকা ও লকডাউনের মজুরি দিতে হবে।
    • ছাঁটাই, মজুরি সংকোচন, ডিএ সংকোচন, সমস্ত ধরনের সামাজিক সুরক্ষার উপর হামলা বন্ধ করতে হবে।
    • জাতীয় সম্পত্তি বেচে দেওয়া চলবে না। বিলগ্নিকরণ, কর্পোরেটকরণ, বেসরকারীকরণ চলবে না।
    • কৃষিক্ষেত্রে কৃষক বিরোধী, কর্পোরেট মুখী, বাজারমুখী তিনটে অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করো।
    • বিজেপি শাসিত রাজ্য সহ অন্য রাজ্যে শ্রম আইন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত বাতিল করো।
    • শ্রমিকশ্রেণীকে দাসে পরিণত করার লক্ষ্যে তৈরি শ্রম কোডগুলো বাতিল করো।
    • ১২ ঘণ্টার শ্রমদিবস মানছি না। শ্রমিকদের অধিকার হরণ করা চলবে না।
    • সরকারের বিরোধীতা করার জন্য যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দাও।
    • বেকারত্বে লাগাম টানো।
    • নারেগা প্রকল্পকে মজবুত করো। প্রত্যেককে বছরে ২০০ দিন কাজ দিতে হবে, দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি দিয়ে।
    • শহুরে গরিবদের জন্য শহরে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প চালু করতে হবে।
    • মূল্যবৃদ্ধি ও মজুতদারি ঠেকাও।
    • অত্যাবশক পণ্য আইন খারিজ করার অপচেষ্টা থেকে হাত গোটাও।
    • খাদ্য নিশ্চয়তা প্রকল্প সুনিশ্চিত করো।

লড়াইয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হও।
বিজয়ের জন্য লড়াই করো।
এআইসিসিটিইউ

boo

 

dew

সদ্য প্রকাশিত হয়েছে “জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০”। এখানে বিদ্যালয় শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে আগামী পথচলার নীতিমালা রয়েছে। এই লেখাটিতে আমরা কেবল বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষাকাঠামো ও নীতি নিয়ে কী বলা হয়েছে তা কিছু দিক উল্লেখ করব এবং প্রাথমিক কিছু পর্যবেক্ষণই কেবল সূত্রাকারে রাখব।

    • গোড়াপত্তন - প্রাক বিদ্যালয় বা প্লে স্কুলের ৩ বছর, প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণির ২ বছর মিলে মোট ৫ বছর এই স্তরের জন্য রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে তিন থেকে আট বছর বয়সের বাচ্চারা এই পর্বে খেলাধূলা ও বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে কিছু কিছু জিনিস শিখবে। মাতৃভাষা শেখা এই পর্বের মূল লক্ষ্য।

    • প্রস্তুতি পর্ব - তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণি নিয়ে তিন বছরের এই স্তর। বলা হয়েছে আট থেকে এগারো বছর বয়েসের ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা, ক্রিয়াকলাপ, পারস্পরিক আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে এই পর্বে শিখবে। ভাষাজ্ঞান এবং গণনা – মানে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ শেখা এই পর্বের মূল লক্ষ্য। আগের পর্ব আর এই পর্বে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কেবল মাতৃভাষা ও স্থানীয় ভাষাকে অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে। রয়েছে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে মূল্যায়নের কথাও। বোর্ড পরীক্ষার আগে আর একটি মূল্যায়নের কথা রয়েছে অষ্টম শ্রেণিতে।

cass

 

প্রশ্ন হল মাতৃভাষার সাথে আর একটি ভাষা হিসেবে ইংরাজি – দু্টি ভাষাই কি এই স্তরে যথেষ্ট ছিল না? তৃতীয় ভাষার সূত্রে কি হিন্দিকে ঘুরিয়ে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে? আর হিন্দিভাষী এলাকায় সংস্কৃত? মনে রাখতে হবে বর্তমানে ক্লাস সেভেন-এইটে তিন ভাষা পড়ানোর চল আছে। সেটাকে ক্লাস থ্রি, ফোর, ফাইভে নিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? তা চাপ কতটা বাড়াবে শিশুদের? প্রথম আর দ্বিতীয় ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে কি? এই স্তরে ত্রিভাষা নীতি প্রণয়নের প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক ওঠা দরকার ও এর পুনর্বিবেচনা জরুরি।

    • মধ্যবর্তী স্তর – ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণি নিয়ে তিন বছরের এই স্তর। এই স্তরটিকে একসময়ে সিনিয়ার বেসিক, আপার প্রাইমারি, জুনিয়ার হাই ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হত। বলা হয়েছে এগারো থেকে চোদ্দ বছরের ছেলেমেয়েরা এই পর্বে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, গণিত, কলা ইত্যাদি শিখবে। মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে বোধের বিকাশের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে।

এই স্তরের শুরু থেকে কম্পিউটার কোড শেখার কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি খেলাধূলা, সঙ্গীত ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কলাচর্চাকেও বিষয় হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছে।

এই স্তর থেকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষাকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয় নি। যা আগের দুই স্তরে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ক্লাস সিক্স থেকে বেসরকারী ইংরাজী মাধ্যম স্কুলের রমরমার পথ খুলে রাখা হল। আগের দুই স্তরে মাতৃভাষা ও স্থানীয় ভাষায় শিক্ষাদানের যে নির্দেশিকা ছিল, সেখান থেকে এই পশ্চাদপসরণ দুর্ভাগ্যজনক। সরাসরি না বলা হলেও আশঙ্কা হয় এর আগে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বুনিয়াদী শিক্ষার যে কথা বলা হয়েছিল, তা পঞ্চম শ্রেণিতে এসেই শেষ করে দেওয়ার নকশা তৈরি করা হচ্ছে।

dde

 

    • মাধ্যমিক স্তর – নবম দশম শ্রেণির বর্তমান মাধ্যমিক স্তর এবং একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক স্তরকে মিশিয়ে চার বছরের এই নতুন মাধ্যমিক স্তর চালু করার কথা বলা হয়েছে। একাদশ শ্রেণিতে বিষয় বেছে নেবার বর্তমান ব্যবস্থাটি চালু করে দেওয়া হচ্ছে নবম শ্রেণিতেই। বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগের বিভাজন তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের বিষয় মিলিয়ে মিশিয়ে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তিগত বিষয় বেছে নেবার সুযোগও এর মধ্যে থাকছে। এই স্তরের শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে বিশ্লেষণী চিন্তার বিকাশের কথা বলা হয়েছে।

বোর্ড স্তরের পরীক্ষাকে সহজ করার কথা বলা হয়েছে। সাধারণ দক্ষতাকে কেবল যাচাই করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বোর্ডগুলির আমূল পুনর্বিন্যাসের কথাও এসেছে। তবে তার সঠিক রূপরেখা এখনো অস্পষ্ট।

সদ্য প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে সামান্য কিছু প্রাথমিক পর্যবেক্ষণই কেবল এখানে রইলো। আগামী দিনে এই নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনায় প্রবেশ করা যাবে।

- সৌভিক ঘোষাল  

ddeddd

লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়ে জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। সামাজিক ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ছাত্রসমাজের কাছে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই এক বড়ো প্রশ্ন চিহ্ন আকারে সামনে এসেছে। একাদশ শ্রেণীতে নতুন করে ভর্তি হতে গিয়ে খরচ করতে হতো কোথাও ১,৫০০ টাকা তো কোথাও ২,০০০ টাকা। ‘যেমন বিষয় পড়তে চাও তেমন অর্থ ঢালো’ মডেল। বিজ্ঞান অথবা কলা বিভাগের ল্যাবরেটরি নির্ভর বিষয়গুলি নিতে গেলে গুণতে হবে আরো বেশি টাকা। বিষ্ণুপুরের স্কুলগুলিতে একেক বিষয়ে যা প্রায় ১৫০ টাকা। তাই মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ছোট ব্যবসায়ী এবং গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ-এর কথা ভেবে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি করতে হবে বিনা পয়সায় – এমন দাবি তোলে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন।

সংগঠনের বিষ্ণুপুর ইউনিট বিগত ৩০ জুলাই থেকে পোস্টার অভিযান চালানোর পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াতেও ব্যাপক জনমত গঠন করতে থাকে। কয়েকটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা/শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক মহাশয়কে ফোন করেও অনুরোধ করা হয় সংগঠনের তরফ থেকে। ৩ আগস্ট বিষ্ণুপুর পৌরসভার মধ্যে অবস্থিত ৫টি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলেই ডেপুটেশন জমা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ইতিমধ্যে ১ আগষ্টের আগেই বিষ্ণুপুর হাইস্কুল ও তারপর কুসুমবনি যমুনাদাস উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ভর্তি-ফি মুকুব করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ফলত কৃত্তিবাস মুখার্জী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, শিবদাস সেন্ট্রাল গার্লস হাইস্কুল ও পরীমল দেবী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি স্কুলই জানিয়েছে তারা একাদশ শ্রেণীর ভর্তি ফি নেবে না। এবং কোনো ছাত্রছাত্রী যদি কোথাও ভর্তি না হয়ে থাকে কোনো বিশেষ কারণের জন্য তবে তারা সেই ছাত্র/ছাত্রীটিকে আগামিতেও ভর্তি নেবেন।

cass

 

ব্যতিক্রম কেবল শিবদাস সেন্ট্রাল গার্লস হাইস্কুলে, সেখানে ল্যাব সাবজেক্ট পিছু ১৫০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। তাদের চাপ দেওয়া হলে তাঁরা আশ্বাস দেন যে যেসকল ছাত্রী টাকা ফেরত দেওয়ার লিখিত আবেদন করবে তাদের প্রত্যেকের এই ভর্তির সাথেই যুক্ত ল্যাব ফি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এজন্য অভিভাবকদের সাথে কথা বলে তাদের লিখিত আবেদন জমা দেওয়ার কথা জানানো হয় সংগঠনের তরফে।

সার্বিকভাবে সমস্ত স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের এই নতুন শ্রেণীতে ভর্তি সংক্রান্ত সমস্যটি নিয়ে একটি ভালো পদক্ষেপ নেওয়ায় আইসা-র পক্ষ থেকে তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সংগ্রামী অভিনন্দন জানান হয়েছে এবং স্কুলগুলির পরিকাঠামো ও শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়তার জন্য বিষ্ণুপুর মহকুমার স্কুল ইন্সপেক্টরের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।

-- ফারহান হোসেইন খান 

dwass

হাওড়া জেলা সংগ্রামী আশা ইউনিয়ন ও হাওড়া জেলা এআইসিসিটিইউ-এর পক্ষ থেকে আশা কর্মী সোমা দাসকে সংবর্ধনা জানানো হয়। করোনা আক্রান্তদের যেভাবে সামাজিক অস্পৃশ্যতার শিকার হতে হচ্ছে চারিদিকে, আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করে রাষ্ট্র যখন সামাজিক সংহতিকেই ভাঙতে উদ্যত সেই সময়ে হাওড়ার এক আশাকর্মী সোমা দাস করোনাকে হারিয়ে আবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেন। ভারতের তথা বাংলার স্বাস্থ্য কাঠামোর অন্যতম ভিত এই আশা কর্মীরা। সামাজিক সংহতি দৃঢ় করার আহ্বান নিয়ে ও করোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সামাজিক অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে হাওড়ার পাঁচলা ব্লকের গাববেড়িয়া এলাকায় এই সংবর্ধনা কর্মসূচীতে আশা ইউনিয়নের পক্ষে শিখা গায়েন, রুপালী বাগ, কল্যাণী গোস্বামী, অঞ্জনা মন্ডল ছাড়াও এআইসিসিটিইউ-এর জেলা নেতা দেবব্রত ভক্ত ও রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনা সভা থেকে সিদ্ধান্ত হয় আগামী ৭ আগস্ট প্রকল্প শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে আশা কর্মীরা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ কর্মসুচী পালন করবেন।

rrrcce

যদি আপনি ধনী হন ও গাড়ি কিনতে চান, স্টেট ব্যাঙ্ক আপনাকে ঋণ দেওয়ার জন্য উন্মুখ, অন্য ব্যাঙ্ক বা অব্যাঙ্ক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিও। সুদের হার বার্ষিক ৭.৫% থেকে ৯%-এর মধ্যে থাকবে। যদি আপনি ধনী চাষি হন, আপনার বন্ধকযোগ্য জমি জমা থাকে তাহলেও আপনি অনায়াসে কৃষিকাজের জন্য ঋণ পাবেন, কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বার্ষিক ১০.২৫% হারে। যদি আপনার সোনা থাকে তাহলে সেটি বন্ধক দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে স্টেট ব্যাঙ্ক ঋণ দিচ্ছে ৭.২৫% হারে। সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ঋণ নিতে চাইলে কৃষকেরা ঋণ পাবেন ৯% হারে। যদি কেউ বাড়ি করতে ঋণ চান, শহরাঞ্চলে, স্টেট ব্যাঙ্ক ৭.৫% হারেও ঋণ দিতে ইচ্ছুক। ব্যবসায় ঋণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম হার বার্ষিক ১১%। ফলে যাদের নিয়মিত আয় আছে বা সম্পত্তি আছে তাদের জন্য ঋণের যোগান আছে সহজ ও স্বল্প সুদে।

কিন্তু যাদের বন্ধক দেওয়ার মতো জমি নেই, নিয়মিত আয় নেই, বাপকেলে পুঁজি ও ব্যবসায় নেই। নেই রাজ্যের বাসিন্দে যারা, তাদের কী হবে? কী হবে ভাগচাষিদের? অর্থাৎ যাদের অর্থের বেশি প্রয়োজন তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের বন্দোবস্ত কোথায়? তেমনটা মুখে বলা হলেও কাজে কিছুই করা হয়নি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পথনির্দেশিকাতেও প্রান্তিক চাষি অবধি ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ভূমিহীন কৃষক বা তাদের পরিবারদের ঋণ যে প্রয়োজন তেমনটা মনে করা হয়নি। কিন্তু হুজুর সরকার মা বাপ! তেনারা কি প্রজাদের ভুলে যেতে পারেন? তাই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থানের বন্দোবস্ত করার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ও গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য জাতীয় কৃষি ব্যাঙ্ক (নাবার্ড)কে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। ইত্যবসরে অধ্যাপক মহম্মদ ইউনুস নোবেল পেয়েছেন বাংলাদেশে গ্রামীণ-এর মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্র কৃষকদের ঋণের বন্দোবস্ত করে। তবে তিনি দারিদ্র দূরীকরণের জন্য অতিক্ষুদ্র ঋণের একটি অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করলেও নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর অতিক্ষুদ্র ঋণের মডেল প্রয়োগের ৪ দশক পরেও বাংলাদেশে গণদারিদ্র রয়েছে। দারিদ্রসীমার নিচে রয়ে গেছে প্রায় ৪ কোটি (২০.৫%) মানুষ যার মধ্যে ২ কোটি (১০.৫%) হতদরিদ্র।  

অতিক্ষুদ্র ঋণের মডেলটি পরবর্তীতে অনেক উন্নয়নশীল দেশ গ্রহণ করেছে। মূলত ব্যাঙ্কের নিয়মমাফিক ঋণ পাওয়ার অযোগ্য গ্রামীণ (শহুরেও) দরিদ্র মানুষকে সুদখোর মহাজনের মাত্রাতিরিক্ত সুদের ঋণ থেকে বাঁচাতে স্বল্প পরিমাণের ঋন কম সুদের হারে প্রদান করাই মহ: ইউনুসের অতিক্ষুদ্র ঋণের মডেলের অন্তর্বস্তু ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা ঋণ দিয়ে মুনাফা করার জন্য অর্থলগ্নিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বহু দেশেই সরকার দারিদ্র দূরীকরণে নিজের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিতে অতিক্ষুদ্র ঋণের মডেলটির রূপায়ণের বন্দোবস্ত করেছে। ভারতেও নাবার্ডের মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টা সরকার গ্রহণ করেছে, ও ঋণের পরিমাণকে সাফল্যের নজির হিসেবে উপস্থাপন করছে।

অতিক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মূলত দুটি মডেল রয়েছে। একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ঋণ প্রদান। যেক্ষেত্রে সেই গোষ্ঠীর সঞ্চয় ব্যাঙ্কে থাকে এবং তার বিপরীতে সঞ্চয়ের কয়েক গুণ ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। নাবার্ডের ২০১৮-১৯ সালের অতিক্ষুদ্র ঋণের উপরে প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতে ১ কোটির উপরে স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে যার সঙ্গে ১২ কোটি পরিবার যুক্ত হয়ে রয়েছে। ওই স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা, সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ ৮৭ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং ওই গোষ্ঠীগুলি বছরে ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেছে। ঋণী স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির গড় ঋণের পরিমাণ ১৭২ হাজার টাকা ও ২০১৮-১৯ সালে ঋণ গ্রহণকারী স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে প্রদত্ত গড় ঋণের পরিমাণ ২১৬ হাজার টাকা। অপরদিকে যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠীর সংখ্যা ৫১ লক্ষ ও মোট ঋণের পরিমাণ ৭২ হাজার কোটি টাকা। ফলে যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠীগুলির প্রতিটির গড় দায়ের পরিমাণ ১৪১ হাজার টাকা। ২০১৮-১৯ সালে ১৬ লক্ষ নুতন যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠী তৈরি করা হযেছে। যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠি কেবল ঋণ গ্রহণ করে, এবং তা ব্যক্তিগত চুক্তির ভিত্তিতে ব্যক্তিকে প্রদান করা হলেও গোষ্ঠীর সমস্ত সদস্য ওই ঋণ আদায়ের জন্য দায়বদ্ধ থাকে।

অতিক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী শিল্পের তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ মোট ঋণের পরিমাণ ১৮৭ হাজার কোটি টাকা, যা ৩১ মার্চ ২০১৮-র তুলনায় ৩৮% বেশি। ওই মোট ঋণের মধ্যে ব্যাঙ্ক প্রদত্ত ঋণ ৬১ হাজার কোটি টাকা (৩৩%), অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি অতিক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা প্রদত্ত ঋণ ৬৯ হজার কোটি টাকা (৩৭%), ক্ষুদ্র ঋণ ব্যাঙ্ক দিয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা (১৮%), অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা (১১%), অন্যান্যরা ২ হাজার কোটি টাকা (১%)। গত বছরের তুলনায় অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি অতিক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা, ব্যাঙ্ক, ক্ষুদ্র ঋণ ব্যাঙ্ক, অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্যদের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে যথাক্রমে ৪২%, ৩৬%, ২৫%, ৫৯% ও ৩০%। অন্যদিকে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বা সামগ্রিক ব্যাঙ্ক ঋণের বৃদ্ধি ভারতীয় অর্থনীতির দুর্দশাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। ২০১৮-১৯ সালে সামগ্রিক ব্যাঙ্ক ঋণের বৃদ্ধি ঘটেছিল ১১%। ২০১৯-২০ সালে তার বৃদ্ধি ৩%-এর মতো। ফলে ব্যাঙ্কগুলি তাদের ব্যবসায় বৃদ্ধির জন্যই অতিক্ষুদ্র ঋণের খাতক বাড়াচ্ছে, অনেক সময়ই ঋণ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন প্রকারের অনৈতিক উৎসাহও দিচ্ছে।

স্বনির্ভর গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আমানতের ১২%-এর বেশি পশ্চিমবঙ্গের খাতে রয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে মোট প্রদত্ত ঋণের ১২% এই রাজ্যেই বন্টিত হয়েছে। তবে মোট ঋণের ১০%-এর কম এই রাজ্যে স্বিনর্ভর গোষ্ঠীগুলির কাছে পাওনা। ফলে ধরাই যেতে পারে এরাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির নিয়মিত ঋণ পরিশোধের ইতিহাস রয়েছে, এবং তা এনপিএ বা অকার্যকরী সম্পদের অনুপাতের মধ্য দিয়েও প্রকট। সারা ভারতে সেই হার ৫.১৯% হলেও এরাজ্যে তা ২.৭৮%। ৩১ মার্চ ২০১৯-এ পশ্চিমবঙ্গে যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৫৬৮ হাজার যার মধ্যে ২০২ হাজার তৈরি হয়েছিল ২০১৮-১৯ সালে। সারা ভারতের তুলনায় ওই দুটি সংখ্যা যথাক্রমে ১১% ও ১৪%। ২০১৮-১৯ সালে যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১৯০৯ কোটি টাকা (সারা ভারতের ৬%) ও ৩১ মার্চ ২০১৯এ তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪,২৫২ কোটি টাকা (সারা ভারতের ৬%)। ফলে যৌথ দায়বদ্ধ গোষ্ঠীগুলিকে প্রদত্ত ঋণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সামনের সারিতে নেই।

nir

 

উপরের পরিসংখ্যানগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে যে সারা ভারতেই অতিক্ষুদ্র ঋণের চাহিদা রয়েছে। যে ঋণ মূলত গ্রামীণ মহাজনেরা চড়া সুদে দিয়ে থাকত। এও জানা যায় যে, এখনো মহাজন কর্তৃক প্রদেয় অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ৬৫% বাজারে অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলি পৌঁছতে পারেনি। ফলে তাদের জন্য অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে। মহাজনী সুদ না নিলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলির সুদের হার উপরের প্রথম অনুচ্ছেদে বিবৃত সুদের হারের তুলনায় অনেক বেশি। ঋণগুলি সাধরাণত কোনো বন্ধক ছাড়াই দেওয়া হয়। তবে গোষ্ঠীর কেউ ঋণ শোধ না করতে পারলে তার উপরে গোষ্ঠীর অন্য সদস্যরা চাপ তৈরি করে। ফলে খাতক তাঁর প্রতিবেশে প্রায় প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে। যেহেতু অতিক্ষুদ্র ঋণের খাতকের প্রতারণার কোনো উদ্দেশ্য থাকে না তাই প্রতারক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হলে বহুক্ষেত্রেই মানসিক অবসাদের স্বীকার হয়ে আত্মহত্যাও করে থাকে। ২০১০ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে অনুরূপ ঋণ সমস্যা তৈরি হয়েছিল। মুনাফার লোভে ঋণ দাতারা খাতকদের চড়া সুদে উপর্যুপরি ঋণ দিয়ে একধরনের ঋণ ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে। ওই সময়ে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার সুদের হার বেঁধে দিয়ে আইন করেছিল। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় স্তরে একবার ২০১১-১২ সালে ও পরে ২০১৬ সালে অতিক্ষুদ্র ঋণপ্রদান (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) সংক্রান্ত বিল আনা হলেও আজ অবধি সেগুলি আইনে পরিণত হয়নি।

অতিক্ষুদ্র ঋণের বাজারটি ব্যাঙ্ক, অব্যাঙ্ক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান, অতিক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠান বা ক্ষুদ্র অর্থলগ্নি ব্যাঙ্ক সকলের কাছেই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ঋণের উপর সুদ গ্রহণের হারের ক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। ফলে যে যেমন পারে সুদ নিয়ে থাকে। সেই সুদের হার বার্ষিক ২০% থেকে ৪৫% পর্যন্ত হয়, তারও বেশি হতে পারে। যে অঞ্চলে যেমন ভাবে পারা যায় তেমনি সুদ নেওয়া হয়। ঋণ পরিশোধে গাফিলতি হলে পাড়া প্রতিবেশি গোষ্ঠী সদস্যের চাপ যেমন থাকে, আদায় করার জন্য গুণ্ডা বা বাউন্সারও পাঠানো হয়। সব মিলিয়ে এক ভীতিপ্রদ পরিবেশ তৈরি করে ঋণের কিস্তি আদায় করার বন্দোবস্ত চালু আছে। আগেই বলেছি, খাতকের সাধারণতঃ প্রতারণার কোন ইচ্ছেই থাকে না, তাই সাধারণ অবস্থায় কোনো বিপাকে না পড়লে নিয়মিত কিস্তি শোধ করে থাকে। কিন্তু বিপদে পড়লেও ঋণদাতারা ছাড় দেয় না।

এমনকি এই কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও ঋণগ্রহিতাদের উপরে প্রবল চাপ দিচ্ছে ঋণদাতারা। মূলত গ্রামীণ মহাজনের চরিত্রই ওই সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের আচরণে ফুটে বেরুচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কেন চুপ করে রয়েছে? কেন এত চড়া হারের সুদে ঋণ দিয়ে ওই সমস্ত ব্যাঙ্ক ও অন্যন্য সংস্থা অস্বাভাবিক মুমনাফা করছে? লক্ষ্যণীয় সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি বাণিজ্যিক কর্পোরেটগুলিকে কম সুদে ঋণ দেয়। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি যথেষ্টই বেশি ও বহু ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের ব্যয় অনেক বেশি হয়, আইনি ব্যয়ের জন্য, তা সত্বেও সুদের হার কম। অন্যদিকে সাধারভাবেই অতিক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতারা প্রতারণা করে না, তবুও তাদের ঋণের উপর সুদের হার অন্যত্র সুদের হারের ২ থেকে ৬ গুণ পর্যন্ত হয়। এই সুদের হারকে কমানোর জন্য কোনো প্রকল্প সরকার বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে নেই। যেহেতু, অতিক্ষুদ্র ঋণে মুনাফা বেশি তাই সমস্ত ব্যাঙ্ক এই ঋণের দিকে ঝুঁকছে। তাছাড়া, কৃষি ঋণ বা গৃহ ঋণের মতো এই ঋণগুলিকেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অগ্রাধিকার প্রদানকারী ক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই অতিক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করলে ব্যাঙ্কগুলি ৪০% অগ্রাধিকারী ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের বিধিটিও পরিপূর্ণ করতে পারে। সব মিলিয়ে সমাজের সব থেকে পিছিয়ে পড়া দরিদ্রজনেরা প্রাতিষ্ঠানিক সুদের ব্যবসার খাতক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। যারা সব থেকে গরিব তারা সব থেকে বেশি সুদ দিতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার, নাবার্ড, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক, অতিক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান সকলেই এমন ভান করছে যে তারা না থাকলে তো গ্রামীণ মহাজনের খপ্পরে পড়বে গ্রামীণ গরিব তাই খাতকের সুবিধের জন্যই এই কাঠামো। কিন্তু আদতে অতিক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলি নব্য কলেবরে মহাজনী ব্যবসায় শুরু করেছে। যার ফলে ঋণগ্রহিতাদের একদিকে ঋণের ফাঁদে ঢুকতে প্রলুব্ধ ও বাধ্য করা হচ্ছে। অপরদিকে ঋণ পরিশোধে অপারগ হলে তাদের জীবন দুঃসহ করে তুলছে প্রতিষ্ঠানগুলি।

ফলে সমাজের সর্বস্তর থেকে দাবি করতে হবে যে, সরকারকে অতিক্ষুদ্র ঋণের উপরে সুদের হার কমাতে হবে। যেহেতু এই ঋণগুলিকে অগ্রাধিকারী ক্ষেত্রের ঋণ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে তাই এই সমস্ত ঋণের উপর সুদের হার কৃষি সমেত অন্যান্য অগ্রাধিকারী ক্ষেত্রের ঋণের হারের থেকে বেশি করা চলবে না। দ্বিতীয়ত, ঋণ আদায়ের জন্য গুণ্ডা প্রেরণের সংস্কৃতিকে বন্ধ করতে হবে, তৃতীয়ত, কোভিড-১৯ ও তজ্জনিত লকডাউনের ফলে গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে যে বিপুল অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে সেই জন্য যতদিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত সমস্ত ঋণকে মকুব করতে হবে।

- অমিত দাশগুপ্ত  

madddewar

চলে গেলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তুলনামূলক সাহিত্যের অসামান্য অধ্যাপক, ছক ভাঙা অনন্য অনুবাদক। সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি পাঠকেরা সকলেই তাঁকে চেনেন বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট অনুবাদক হিসেবে। ইউরো আমেরিকান সাহিত্যের বাইরে তাকানোর চোখ তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস প্রয়াসের কথাও বুধজনেরা জানেন। লাতিন আমেরিকান সাহিত্য, আফ্রিকান সাহিত্য প্রভৃতির অনুবাদ টীকা ইত্যাদি সহযোগে তৃতীয় দুনিয়ার সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। এই সব অনুবাদকর্ম ছিল তাঁর নিজস্ব প্রগতিশীল রাজনীতি ভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ইউরো আমেরিকান সাহিত্যের মধ্যে দিয়েই কেবল বাইরের জগৎকে চেনা যে মূলত আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, আর মননের শৃঙ্খল ভাঙার জন্য যে সচেতনভাবে এই গণ্ডিকে পেরনো দরকার, সে কথা তিনি বারবার বলতেন।

গার্সিয়া মার্কেজ, বরিস পাস্তেরনাক, জুলে ভার্ন, এডগার অ্যালান পো প্রমুখ সুপরিচিত সাহিত্যিকদের লেখা অনুবাদের পাশাপাশি তাঁর অনুবাদের মাধ্যমেই অধিকংশ বাঙালি পাঠক জেনেছে আলেহো কার্পেন্তিয়ের, হুয়ান রুলফো, সেসার ভায়েহো, ভাসকো পোপা, নিকানোর পাররার, চেসোয়াভ মিউজ, ডেরেক ওয়ালকট সহ আরো অনেক অনেক সাহিত্যিককে। শুধুই অনুবাদ নয়, তার সঙ্গে মূল্যবান ভূমিকা, টীকা ভাষ্য সহযোগে পরিবেশিত এইসব অনুবাদগুলি বাঙালি পাঠকের সাহিত্য পাঠের দিগন্তকে প্রসারিত করে দিয়েছিল।

যশস্বী অধ্যাপক বা অনুবাদক পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট কবিও। ক্রীড়া সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল। রবীন্দ্রনাথের কিশোর সাহিত্যকে নানাদিক থেকে বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখা বইটি অনেক নতুন চিন্তার সন্ধান দেয় আমাদের। দেশ দুনিয়ার কিশোর সাহিত্যের অনুবাদ ও সংকলন প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বাঙালি শিশু কিশোরদের মনকে প্রথম থেকেই সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তর দিকে মেলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস প্রয়াসের জন্যও তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর চলে যাওয়ায় বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগৎ অনেকখানি রিক্ত হল।
তাঁর প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি 
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন  

rarae

নারীবাদী মার্ক্সবাদী মানবতাবাদী – এই শব্দগুলি তাঁর পরিচয় হয়ে উঠেছিল। ২ আগস্ট তাঁর মৃত্যুর খবর আচানক শোকস্তব্ধ হতচকিত করে দেয় কলকাতা তথা রাজ্যের গণ আন্দোলনের জগতকে। কলকাতার মিটিং-মিছিল-লড়াইয়ের ময়দানে সর্বপ্রিয় হয়ে ওঠা প্রাণবন্ত কমরেড রায়া দেবনাথ, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিরলস প্রগতিশীল প্রচারের প্রিয় মুখ রায়া দেবনাথ। তাঁর মৃত্যু গণআন্দোলনের বড় ক্ষতি। তাঁর উজ্জ্বল হাসি মুখের স্মৃতি ভবিষ্যতেও লড়াইয়ের ময়দানে বহু কমরেডকে শক্তি সাহস ও ভরসা জোগাবে।

লাল সেলাম কমরেড রায়া দেবনাথ।

sresh

শ্রমিক আন্দোলন হারাল এক প্রবীণ অভিজ্ঞ যোদ্ধাকে

সিপিআই(এম) পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিআইটিইউ-র অন্যতম শীর্ষ নেতা কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর প্রয়াণে শোকাহত। শ্রমিক আন্দোলন তথা বামপন্থী আন্দোলনের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। যৌথ শ্রমিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। যার শেষ নিদর্শন বিপিএমও’-র নেতৃত্ব প্রদান। যৌথ আন্দোলনের সূত্রে শ্যামলদাকে আমরা সর্বদা পেয়েছি। আজ কমরেড শ্যামলদার না থাকার অভাব আমরা অনুভব করছি।

কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী লাল সেলাম।
 

বাসুদেব বসু
সাধারণ সম্পাদক
এআইসিসিটিইউ
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

ggg

গত ৪ আগস্ট  শিলিগুড়ির শান্তিনগরে নিজস্ব বাসভবনে ৭৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কমরেড প্রদীপ ব্যানার্জী, যিনি রানা নামে পরিচিত। সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য ছিলেন। ৭০ দশকের প্রথম থেকেই পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। কমরেড অনল, কঙ্কর, বক্সিদা, রানা সব একই কারখানায় কাজ করতেন। দূর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে ব্ল্যাস্ট ফার্নেস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। নকশালবাড়ি আন্দোলন ধাক্কা খাওয়ার পর হতাশা, দ্বিধা, সংশয়ের পরিবেশ অতিক্রম করে পার্টি পুনর্গঠনের পর্বে চাকরি ছেড়ে পেশাদার বিপ্লবী ক্যাডার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমে গ্রামের কৃষক জনগণের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে হাত দেওয়া, ক্রমে ক্রমে পার্টির বিভিন্ন দায়িত্ব ও ভূমিকা নিতে শুরু করেন কমরেড রানা। কলকাতা জেলা পার্টির কাজে এবং ছাত্রদের মধ্যে বেশ কিছু দিন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে উত্তরবাংলায় জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলার কাজ করেছেন। কমরেড রানার আত্মত্যাগ এবং বিগত দিনের কাজের অবদান রাজ্য পার্টি বরাবর মনে রাখবে। তাঁর মৃত্যুতে আমরা শোক প্রকাশ করছি এবং তার পরিবার পরিজনদের শোকের সাথে সমবেদনা জানাচ্ছি। কমরেড প্রদীপ ব্যানার্জি লাল সেলাম।

-কার্তিক পাল 

aaa

১৯৭৭ সালে অবিভক্ত বিহারে ধানবাদ জেলার নিরসা কয়লাঞ্চলে কমরেড গুরুদাস চ্যাটার্জীর দু-কামরার ছোট্ট কোয়ার্টারে বিপ্লবীদের প্রথম থেকেই আপন করে নিয়েছিলেন কমরেড অঞ্জলি চ্যাটার্জী। দীর্ঘ পর্ব জুড়ে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন ও দেখভাল করেছেন। পুরুলিয়ার গ্রামে ৮/৯ বছর বয়সী কনিষ্ঠ পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর সংকটের মধ্যেও আমাদের দূরে সরিয়ে দেননি। বিনোদ মিশ্র সহ অনেক নেতৃস্হানীয় কমরেডের নিয়মিত ও বিশ্বস্ত শেল্টার ছিল সেই কোয়ার্টার। ২০০০ সালে কমরেড গুরুদাস চ্যাটার্জীকে হত্যা করে রাজনৈতিক দুষ্কৃতিরা। সেই সময়ও কমরেড অঞ্জলি চ্যাটার্জি নিজেকে শান্ত রেখে সবদিক সামলেছেন। প্রচারের আলোয় আসা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে এরকম অনেক মহিলা কমরেডদের হাততালি-বিহীন ইতিহাস পার্টিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে ও করে। কমরেড অঞ্জলি তাঁদেরই একজন। শত্তরোর্ধ কমরেড অঞ্জলি চ্যাটার্জী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কলকাতা এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে, টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে গত ৩০ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লাল সেলাম কমরেড অঞ্জলি।

- তরুণ সরকার 

খণ্ড-27
সংখ্যা-27