আমাদের সংবিধানের প্রথমেই বলা আছে এই সংবিধানটা তৈরি করেছেন ভারতের জনগণ। কিন্তু আজকের ভারতে সংবিধানটা জনগণের দিক থেকে চলে যাচ্ছে শাসকের দিকে। আমাদের সংবিধান সমস্ত ধরনের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ। সংবিধানের চরিত্র পুরোপুরি বদলে দেওয়া হচ্ছে। আজকে ধর্মকে কেন্দ্র করে একটা বড় ভেদাভেদ এনে সংবিধানকে উলোটপালট করে দেওয়া হচ্ছে।
এই আক্রমণের উল্টোদিকে আশার ব্যাপার এটাই যে মানুষ পথে নেমেছেন। সংবিধান রক্ষার জন্য আজকে এত বড় বড় আন্দোলন হচ্ছে নানা জায়গায়। গোটা দেশের মনযোগ এই মুহূর্তে মূলত সিএএ, এনআরসি, এনপিআর এবং ডিটেনশন ক্যাম্পের মতো বিষয়গুলিতে নিবদ্ধ।
বাজপেয়ী সরকারের সময় সুপ্রিম কোর্ট বাইরে থেকে মানুষের এদেশে অনুপ্রবেশকে সরাসরি আগ্রাসন বলে মন্তব্য করেছিল। তখন সেটা সবার তেমন নজরে আসেনি। এনআরসি করে আসামে বহু লক্ষ মানুষকে বাদ দেওয়ার পর এখন এই নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে আলোড়ন পড়ে গেছে। বিজেপি তার নির্বাচনে প্রচারে বারবার বলেছিল অনুপ্রবেশকারীদের সে দেশ থেকে বের করে দেবে। এখন এই নিয়ে তুমুল আন্দোলনের চাপে পড়ে সে মিথ্যা বলতে বাধ্য হচ্ছে। সে বলছে এনআরসি-র কোনও কথাই নাকি সে বলেনি। ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়েও লাগাতার মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। অসমে আলাদা করে যেমন ডিটেনশন ক্যাম্প আছে, তেমনি প্রতিটি জেলায় জেলগুলি এই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিটেনশন ক্যাম্পগুলির অবস্থা অবর্ণনীয়। সেগুলি আমাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে ইহুদী নিধন যজ্ঞের জন্য হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়। আসামের ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি থেকে মাঝেমাঝেই মৃত্যুর খবর আসছে।
অসমে এনআরসি-র ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছিল ১৯৭১ সাল। বিজেপি লোকসভা নির্বাচনের সময় ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে এনআরসি তৈরির কথা বলেছে। এই ভিত্তিবর্ষকে ১৯৫১-তে পিছিয়ে দেবার মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের হাতে ১৯৫৬ সালের জমিদারী প্রথা বিলোপ ও সীমিত ভূমিসংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেটুকু কাগজপত্রের অধিকার এসেছিল, তাকেও অস্বীকার করা হচ্ছে।
এনআরসি-কে আন্দোলনের চাপে আপাতত বন্ধ রাখার কথা বলে ঘুরিয়ে এনপিআর-এর মধ্যে দিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। আধিকারিকদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে কাউকে ডাউটফুল ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করার।
নতুন সিএএ আইনের মাধ্যমে আরো তেত্রিশ হাজার লোককে নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে, এরকম একটা হিসাব দেওয়া হয়েছিল পার্লামেন্টারি কমিটিতে এই সংক্রান্ত আলোচনার সময়ে। অন্যদিকে আমরা দেখছি কেবল অসমেই বাদ গেছেন উনিশ লক্ষ মানুষ। বাদ যাওয়া বিহার বা আসামের মানুষকে সিএএ দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। তারা বলতে পারবেন না, তারা পাকিস্তান, আফগানিস্থান বা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।
আজকের মুসলিম সমাজ ব্যাপক সংখ্যায় নেমেছেন আন্দোলনে। তার পাশে হিন্দু সমাজের মানুষদের একাংশ জড়ো হচ্ছেন। কমিউনিস্ট পার্টিকে উদ্যোগ নিয়ে যে হিন্দুদের বিজেপি ভুল বোঝাতে পেরেছে, তাদের আন্দোলনের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের নানা ধরনের অধিকারের ওপরেই আজকে আঘাত আসছে। শিক্ষার অধিকার থেকে শুরু করে অন্য সমস্ত কিছুকে সাধারণ মানুষের থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সমস্ত অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক অধিকার হল নাগরিকত্বের অধিকার। সেখানে নেমে আসা হামলা তাই সবচেয়ে দুশ্চিন্তার।
বিজেপির মূল টার্গেট এখন বাংলা। যে রাজ্যপালকে পাঠানো হচ্ছে তিনি নিজেকে বঙ্গ বিভাজনকারী কার্জনের উত্তরাধিকারী বলছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারী। বিভাজনের চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যের আদর্শ ও ইতিহাসকে তুলে ধরতে হবে আমাদের। রাখিবন্ধন থেকে দাঙ্গার সময়ে ট্রাম শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ঐতিহ্য, তেভাগা থেকে নকশালবাড়ির ঐতিহ্যকে সামনে আনা দরকার এই লড়াইয়ের সময়।
আম্বেদকর বলেছিলেন ভারত যদি হিন্দুরাজ হয় সেটা হবে বড় বিপর্যয়। এই হিন্দুত্বকে যদি দাঙ্গায় কাজে লাগিয়ে নেওয়ার জায়গাটুকুর বাইরে দেখা হয়, তাহলে তার মধ্যে জাতপাত, পিতৃতন্ত্র ইত্যাদিই কেবল পড়ে থাকবে, আর তা সমাজ ও দেশকে ধ্বংস করে দেবে।