দিল্লী জয়ের জন্য বিজেপির বিদ্বেষ ভরা প্রচারের পর ২০২০-র দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের রায় এখন আমরা জানি, আর সেটাকে ২০১৫-র রায়ের প্রায় পুনরাবৃত্তিই বলা চলে। আপ ২০১৫-র নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি যে ভোট পেয়েছিল এবারও সেটাই মোটামুটি বজায় রেখেছে, যদিও তার আসন সংখ্যা সামান্য কমে ৬৭ থেকে দাঁড়িয়েছে ৬২-তে। আপ যে সমস্ত আসন হারিয়েছে তার সবগুলোই বিজেপি পেয়েছে যার ফলে তাদের আসন সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮। কংগ্রেস এবারও কোনো আসন পায়নি আর আপ যদি ২০১৫-র প্রাপ্ত ভোটের অংশকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়ে থাকে তবে তা কংগ্রেসেরই ভোট ক্ষয়ের মূল্যে। যে দলিত এবং মুসলিমরা বরাবর কংগ্রেসকে ভোট দিত, তাদের ভোটের প্রায় সমস্তটাই একজোটে আপ-এর দিকে চলে গেছে আর প্রায় একই সংখ্যক ভোটার যারা আগে আপকে ভোট দিয়েছিল তারা তাদের আনুগত্য পাল্টে নিয়েছে বিজেপির দিকে।
এটা এমনই একটা নির্বাচন হল যেটাতে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারি যে বিজেপির বিদ্বেষমূলক প্রচার হিতে বিপরীত হয়েছে। বিজেপি শুরু করেছিল এই শ্লোগানটা দিয়ে : ‘দেশ বদলা, দিল্লী বদলো’ (ভারত বদলে গেছে, এখন দিল্লীকে বদলান)। কিন্তু সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তীব্র হয়ে উঠলে আতঙ্কিত হয়ে পড়া শাসকরা মনে করল যে, তারা শাহিন বাগকে পাকিস্তান বা মোগল সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরে দিল্লীর ভোটারদেরও ভয় পাইয়ে দিতে পারবে, এবং ‘গোলি মারো শালো কো’ তাদের প্রচারের মূল বিষয় হয়ে উঠল। এই আওয়াজ যত জোরালো হয়ে উঠল তখন তা আর কথার কথায় আটকে না থেকে কাজে পরিণত করার আহ্বান হয়ে উঠল আর সশস্ত্র গুণ্ডারা জামিয়া ও জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রীদের এবং শাহিন বাগের মহিলা প্রতিবাদকারীদের ওপর হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে আনল।
সস্তায় জল ও বিদ্যুৎ দেওয়া এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থাকে উন্নত করার আপ-এর সমস্ত দাবি ও প্রতিশ্রুতিকে ‘বিনা পয়সার উপঢৌকন’ বলে উড়িয়ে দিল এবং জেএনইউ-র পড়ুয়াদের ওপর বড় আকারের ফী বৃদ্ধিকে চাপিয়ে দিতে তাদের ওপর নির্মম দমন নামিয়ে আনল।উত্তরপ্রদেশের যে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের রাজ্যে সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারীদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পুলিশকে প্ররোচিত করলেন এবং মুসলিম সম্প্রদায় ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কার্যত এক যুদ্ধ শুরু করলেন, তিনি কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনলেন যে তিনি শাহিন বাগের প্রতিবাদকারীদের বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছেন আর বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য ভোটারদের কাছে আহ্বান জানালেন যাতে বিজেপি প্রতিবাদকারীদের বুলেট খাওয়াতে পারে। অন্য কিছু প্রচারক আবার কেজরিওয়ালকে সন্ত্রাসবাদী বলে অভিহিত করলেন। বিজেপির প্রচার যখন প্রত্যাশিত সাড়া পেল না এবং বুথ ফেরত সমীক্ষাগুলো আপ-এর পুনরায় দিল্লী বিজয়ের পূর্বাভাস দিল, মোদীপন্থী মিডিয়ার কিছু অংশ তখন দিল্লীর ভোটারদের এই বলে অভিহিত করল যে তারা জাতীয় স্বার্থের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতক না হলেও ঐ স্বার্থের প্রতি উদাসীন যে স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে বিজেপি এবং তারা আপ সরকার প্রতিশ্রুত ‘বিনা পয়সার উপঢৌকনের’ প্রতি আসক্ত। আর এই সুতীব্র ঘৃণাকে নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগ্ৰামের প্রচারে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিলেন বিজেপির তথাকথিত চাণক্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি দিল্লীর ভোটারদের এত জোরে পদ্ম বোতামে চাপ দিতে বললেন যাতে শাহিন বাগের প্রতিবাদকারীদের গায়ে কারেন্ট লাগে।
দিল্লীতে বিজেপির প্রবল পরাজয় মোদী-শাহ-যোগী এই ত্রয়ী ও তাঁদের প্রিয়পাত্রদের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে চালিত বিদ্বেষপূর্ণ ও তীব্র ঘৃণাভরা প্রচারের পরাজয়কেই দেখিয়ে দিচ্ছে। আর বিজেপির এই কুকথাময় ঔদ্ধত্যের মুখের মতো জবাব দিয়ে শাহিন বাগ এলাকার কেন্দ্রে আপ প্রার্থী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। উন্নয়নের দিক থেকে তাঁর সরকার দিল্লীকে ছাপিয়ে যাচ্ছে বলে নীতীশ কুমার যে প্রচার করেন তা চূড়ান্ত রূপে ব্যর্থ হয় এবং তাঁর জেডিইউ-কে সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে পরাজয়ের বেইজ্জতির মুখে পড়তে হয়। একথা ঠিকই যে, মধ্য-দক্ষিণপন্থী দল হিসাবে অর্থনৈতিক নীতির দিক থেকে বিজেপির সঙ্গে আপ-এর অনেক ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আপ-এর যে ধারণা তার সাথে বিজেপির উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদের মডেলের মিলও কম নয়, মোদী-শাহর কাশ্মীর নীতি এবং এই ধরনের আরো কিছু প্রশ্নে আপ-এর পুরোপুরি অনুমোদনের মধ্যে যা প্রতিফলিত হয়েছ। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রতি বিরোধিতা এবং শ্রমিক, নারী, দলিত, সংখ্যালঘু এবং প্রান্তে অবস্থানকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করার মতো গণতন্ত্রের প্রশ্নগুলিতে আপ-এর প্রতিক্রিয়া মোটামুটিভাবে অব্যক্ত এবং সংশয়াত্মক বলেই দেখা যায়। এটাও সত্যি যে, দিল্লীতে আপ-এর বিজয়ে সুনির্দিষ্ট স্থানীয় প্রেক্ষাপট রয়েছে এবং লোকসভা নির্বাচন ও সর্বভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার সম্ভবত পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই সমস্ত সুনির্দিষ্টতা এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতির আজকের সন্ধিক্ষণে, যখন একাদিক্রমে দ্বিতীয় বার মোদীর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পরিণামে লাগামছাড়া ফ্যাসিবাদী হামলা চলছে, দিল্লীর রায়ের বিপুল তাৎপর্যকে একটুও খাটো করে দেখা যাবে না।
দিল্লী এবং তার বাইরের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কর্তব্য হল দিল্লী রায়ের বিপুল সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে যে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ এবং জলের মতো বুনিয়াদি ইস্যুগুলোর কেন্দ্রীয়তার মধ্যেই রয়েছে সাধারণ জনগণের প্রধান স্বার্থ, যে ইস্যুগুলোর ওপর আপ সরকার জোর দিয়েছে। এই এজেন্ডাকে সম্প্রসারিত করে সেগুলি অর্জনের জন্য সক্রিয় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যাতে জনগণের মৌলিক অধিকার এবং বুনিয়াদি প্রয়োজন ও আকাঙ্খা পূরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রকৃত লাভকে সুনিশ্চিত করা যায়। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ঝাড়খণ্ডে বিজেপির নির্ধারক পরাজয়ের পরই এই রায় এল যা যেমন জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্রোধকে দেখিয়ে দিয়েছে, তেমনি মোদী-শাহ শাসনতন্ত্রের নির্বাচনী অপরাজেয়তার সমস্ত কথাবার্তা উপেক্ষা করে ঐ শাসকদের দুর্বলতাকে এবং সংঘ-বিজেপির বিভেদমূলক এজেন্ডার বিপর্যয়কর প্রভাব ও তাৎপর্যকেও প্রতীয়মান করেছে। বিজেপি ঝাড়খণ্ড এবং দিল্লীতে কাশ্মীর, অযোধ্যা, সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর প্রহেলিকা সহ সমস্ত তাসই খেলে, এ সত্ত্বেও তার ব্যাপক পরাজয় ঘটে। এটা ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধের কাছে শুভ ইঙ্গিতই বহন করছে। দিল্লী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার যে সময়টা দিল সেটাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সিএএ-এনআরসি-এনপিআর নকশার বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদকে তীব্রতর করে তুলতে হবে এবং এ বছরের শেষের দিকে ও সামনের বছর গোড়ার দিকে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাতে তাতে বিজেপি এবং তার মিত্রদের একই ধরনের নির্ধারক পরাজয় ঘটাতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০)