২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ‘বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’ (বিসিএমএফ)-এর সপ্তম রাজ্য সম্মেলন চাঁপদানিতে অনুষ্ঠিত হল। পলতা ঘাটে ছিল জমায়েত, ওখান থেকে জাতীয় পতাকা সহ লাল পতাকা নিয়ে মিছিল সম্মেলনের সভাস্থলে পৌঁছাল। শহীদবেদীতে জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা তোলেন কমরেড ধ্রুবদাস শূর, লাল পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড শ্যামল বাগ এবং শহীদ ও প্রয়াত কমরেডদের স্মৃতিতে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর প্রতিনিধিরা মিলিতভাবে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করে প্রয়াত কমরেড ব্যোমকেশ ব্যানার্জী সভাগৃহ ও কমরেড রামবাবু পাশোয়ান মঞ্চে প্রবেশ করে। কমরেড মেঘনা মজুমদার ও বাবুনি মজুমদার ‘কাগজ নেহি দেখায়েঙ্গে’ সঙ্গীত পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়।
মিছিলের জমায়েত গান্ধীজীর মূর্তির পাদদেশে চারিদিকে ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয় গান্ধীজীর বেদী। ২৬ জানুয়ারি, ১৫ আগস্ট আমরা যা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম তা হল তারস্বরে মাইক বাজিয়ে দেশভক্তির প্রচার কিন্তু এবার তা শোনা গেল না। জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন দল বা দল বিহীন প্রচার নো এনপিআর, নো এনআরসি, নো সিএএ ব্যানার ঝোলানো। এই পরিস্থিতির ছাপ সম্মেলনেও দেখা যায়।
বিসিএমএফ সাধারণ সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রস্তাবনায় যে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে—মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিকদের উপর আক্রমণ তীব্র করেছে। ৪৪টি শ্রম আইনকে বাতিল করে ৪টে লেবার কোডের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে মজুরি কোডকে আইনে পরিবর্তন করেছে। অন্য দুটি কোড সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আছে, সংসদে পেশ করার অপেক্ষায়। ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড বিল ২০১৯’ এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অবাধ ছাঁটাইয়ের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য লোকসভায় পেশ করা হয়েছে। চলতি যে আইনগুলি ছিল- ‘ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট ১৯২৬’ ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার) অ্যাক্ট ১৯৪৬’ এবং ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউ অ্যাক্ট ১৯৪৭’—সেগুলিকে বাতিল করা হল।
এই অসহনীয় পরিস্থিতিতে চটকলে কর্মরত ২১টি ইউনিয়ন রাজ্য সরকারের কাছে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ২২ দফা দাবি সনদ পেশ করে। রাজ্য সরকার ত্রিপাক্ষিক মিটিং করা নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। তখন ইউনিয়নগুলো ১৩ মার্চ থেকে লাগাতার ধর্মঘটের নোটিশ জারি করে। এই সময় শ্রমমন্ত্রী তড়িঘড়ি করে ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডেকে কয়েকটি ইউনিয়নকে দিয়ে এক অসম মজুরি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। বিসিএমএফ সহ ৮টি বামপন্থী ইউনিয়ন এর প্রতিবাদে অসম মজুরি চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে ত্রিপাক্ষিক মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এই চুক্তিতে নিউ এন্ট্রান্টদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি যেখানে ১১২ টাকা সেখানে ৮০ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে দৈনিক মাত্র ২ টাকা এবং হাজিরা ভাতা মাত্র ৫০ পয়সা। চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার জন্য শ্রমিকরা ইউনিয়নের উপর আস্থা জ্ঞাপন করেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউনিয়নগুলির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটছে। এই সময় চটকল ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের সাথে তার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস হয়ে চলছে। পুরানো মজুরি কাঠামোর সাথে যুক্ত শ্রমিক যারা মজুরির উপর ৪১.৯৭ শতাংশ ফ্রীঞ্জ বেনিফিট পান তাদের সংখ্যা কমতে কমতে ২০ শতাংশের নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। আগামীতে তা শূন্য শতাংশে দাঁড়াবে। নতুন (নিউ এন্ট্রান্ট) যারা কাজে ঢুকেছেন তাদের একটা অংশের নাম মাস্টার রোলে থাকা সত্ত্বেও ফ্রীঞ্জ বেনিফিটের আংশিক সুবিধা পান। ফল স্বরূপ এই শ্রমিকরা নিজেদের মিল ছেড়ে অন্য মিলে বেশি টাকা মজুরির জন্য কাজ করতে চলে যায়। এই ক্ষেত্রে শ্রমিকরা প্রতিদিন এক মিল থেকে আরেক মিলে নগদ মজুরির দরকষাকষি করে কাজে ঢোকেন। দিনের শেষে নগদ মজুরি হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরেন, মিল কর্তৃপক্ষ এই শ্রমিকদের কোনো সামাজিক সুরক্ষা দেয় না। এই ধরনের ফ্লেক্সিবেল শ্রমিক সব মিলে ছেয়ে গেছে। রেগুলার শ্রমিক থেকে তুলনামূলকভাবে এরা মজুরি বেশি পান। কিন্তু এদের কোন সামাজিক সুরক্ষা নেই, ‘হায়ার এণ্ড ফায়ার’ নীতিতে নিযুক্ত হন। এরা মিলে ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রাখে না। দ্বিতীয়ত যারা পুরানো শ্রমিক বেশিরভাগেরই অবসরের বয়স হয়ে গেছে তারা ইউনিয়নের কাজের ঝুকি নিতে চান না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিল কর্তৃপক্ষ সব মিলেই অলিখিতভাবে ঠিকাদারি প্রথা চালু করে দিয়েছে। নতুন প্রবণতা—এস ৪ লুম আসার পর মিলগুলিতে মহিলা শ্রমিক নিয়োগ বাড়ছে। এখানে মহিলাদের যৌন নিরাপত্তার অভাব থাকছে। ইউনিয়নকে নতুন ভর্তি শ্রমিক, ফ্লেক্সিবেল ও মহিলা শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও রক্ষার জন্য ইউনিয়নভুক্ত করতে না পারলে চটকল শ্রমিকরা নিজেরাই সব ধরনের সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন এবং ইউনিয়নও কাগুজে সংগঠন হয়ে পড়বে। বিসিএমএফ ৭ম রাজ্য সম্মেলন পশ্চিমবঙ্গের চটকল শ্রমিকদের কাছে এই বার্তা দিচ্ছে ইউনিয়ন পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হোন, আর্থিক, সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট তোষণ ও শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউ সহ ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ১২ দফা দাবিতে ৮ জানুয়ারি ২০২০ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল। চটকলে বিসিএমএফ সহ ২২টি ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের ১২ দফা দাবির সাথে চটকল শ্রমিকদের ৮ দফা দাবি যুক্ত করে সাধারণ ধর্মঘটে অংশ নিয়েছে। বিসিএমএফ-এর সাথে যুক্ত শ্রমিকরা সব হামলাকে উপেক্ষা করে ধর্মঘটে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ধর্মঘট সফল করার জন্য রাজ্য সম্মেলন শ্রমিকদের অভিনন্দন জানাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫(ক) ধারা বাতিল, এনপিআর, এনআরসি সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হচ্ছে। এক ভয়ঙ্কর বিভাজনের রাজনীতির মুখোমুখি চটকল শ্রমিক সহ দেশবাসী। বিভাজন করানো হচ্ছে ধর্ম, ভাষা ও বর্ণের ভিত্তিতে।
বিসিএমএফ-এর রাজ্য সম্মেলন চটকল শ্রমিকদের কাছে আবেদন করছে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুন, নিজেদের দাবিগুলিকে আদায় করার জন্য ব্যাপক শ্রমিক ঐক্য গড়ে তুলুন।
(১) ন্যূনতম ২১০০০ টাকা মজুরি ও ১০০০০ টাকা পেনশন দিতে হবে। (২) সম কাজে সম বেতন চাই। (৩) এস ৪ (চিনে তৈরি লুম)-এর ম্যান মেশিন রেশিও এবং মজুরি ঠিক করতে হবে। (৪) চটকল চুক্তি ২০১৯ রিভিউ করতে হবে। (৫) হাজিরা ইনসেনটিভ সমহারে সবাইকে দিতে হবে। (৬) অবিলম্বে অবসর প্রাপ্ত শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি দিতে হবে (৭) মহিলা শ্রমিকদের উপর যৌন হেনস্থা বন্ধ করার জন্য আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আই সি সি) গঠন করতে হবে। (৮) সব ধরনের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। (৯) মিলের কোয়ার্টার বাসযোগ্য করতে হবে। (১০) শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য কর্মস্থলে পরিবেশ ও বায়ুদূষণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। (১১) সিএএ, এনআরসি, এনপিআর মানছি না। (১২) এনডিএ সরকার দমন পীড়ন বন্ধ কর। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দিতে হবে। (১৩) গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হোন।
সম্মেলন পরিচালনা করার জন্য ৮ জনের সভাপতিমণ্ডলিতে ছিলেন কৃষ্ণা বেহারা, বটকৃষ্ণ দাস, মাজাহার খান, মহ. জহিম, সত্যনারায়ণ মাঝি, সমীর মজুমদার, তপন ঘোষ এবং মহ. ইসরাফিল। সম্মেলনে ১৪টি মিলের সম্পাদক সহ বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ১৩১ জন প্রতিনিধি এবং অতিথি ও পর্যবেক্ষক ৩৫ জন মোট ১৬৬ জন। এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক কমরেড বাসুদেব বসু স্বাগত ভাষণ দেন। সব শেষে সর্বসন্মতিতে নবেন্দু দাশগুপ্ত সভাপতি, অতনু চক্রবর্তী সাধারণ সম্পাদক এবং দেবব্রত ভক্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সহ ৪৬ জনের রাজ্য পরিষদ নির্বাচিত করেন। আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।