এলাহাবাদ হাইকোর্ট, অযোধ্যার জমি-বিবাদ সংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে মুখবন্ধে বলেছিল “এখানে এমন একটা জমির অংশ রয়েছে, যেখানে দেবদূতরাও পদচারণা করতে ভয় পান। এই জমির তলায় অসংখ্য বিষ্ফোরক বোঝাই করা আছে। তাও আমরা ঝুঁকি নিচ্ছি।”
এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই অনুভূতিকে মাথায় রেখে,অযোধ্যা মামলায় দেশের সুপ্রীম কোর্টএর ‘সুপ্রীম’ রায় নিয়ে আলোচনা সভায় মত প্রকাশ করলেন বক্তারা। ২৫ নভেম্বর যাদবপুর কফি হাউসের সামনে, বোকাবুড়ো-পিইউসিএল কলকাতা নাগরিক সমন্বয়ের পক্ষ থেকে এই সভার আয়োজন করা হয়।
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জী বলেন, সুপ্রীম কোর্ট তার এক্তিয়ার-এর বাইরে গিয়ে এ ধরনের বিতর্কিত রায় দিয়েছে। আসলে বিচারকদের নিয়োগের পদ্ধতি নিয়েও আজ প্রশ্ন করার সময় এসেছে। সংবিধানের মূল নীতিগুলির বাইরে গিয়ে কোর্টের এই ধরনের রায় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাচীন ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে বহু জায়গা খুঁড়লেই অনেক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, আমাদের দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় কি এখন সেই কাজই করবে! মন্দির তৈরির জন্য সরকারী টাকা খরচের যে নির্দেশ কোর্ট দিয়েছে তা যেমন অসাংবিধানিক, তেমনই মসজিদ তৈরীর জন্য জমি দেওয়ার নির্দেশও অসাংবিধানিক। মোঘল সমাজ, ব্রিটিশ সমাজ ও আধুনিক সমাজকে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই রায়ের মাধ্যমে। তাই এই রায় সমালোচনার যোগ্য বলে আমাদের মনে হয়েছে। রামলালা-কে যেভাবে ‘জুরিসডিক এনটিটি’ বা মামলার আইনি অংশিদার করা হয়েছে, সেই বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ভবিষ্যতে এই আইনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা জরুরী। কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য। ১৯৯১ সালের পর থেকে পর থেকে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছে, তার বাইরে সুপ্রীম কোর্ট-ও নয়।”
মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী সুজাত ভদ্র বলেন, ‘‘এই রায় এর বিরুদ্ধে কোনও কথাই বলা যাবে না, এমন একটা প্রচার করা হচ্ছে। যদিও আইনের ক্ষেত্রে সব কিছু প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়। সুপ্রীম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত, কিন্তু অভ্রান্ত নয়। মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি কিভাবে এরকম অযৌক্তিক রায় দিতে পারে, তা ভাবলে অবাক হতে হবে সকলকে। এনআরসি নিয়ে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন, তা অসাংবিধানিক ও অন্যায্য। মহাত্মা গান্ধী রামকে “আন বর্ন বা আন ক্রিয়েটেড” বলেছিলেন। ৯০-এর দশক থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির ও রামরাজ্য বানানোর কথা প্রচার করতে থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্যে। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের দেশের সু্প্রিম কোর্টও এই বিষয়ের ভেতর ঢুকে পরলেন, এই রায়ের মাধ্যমে। ভবিষ্যতে যদি এরকম আরও কোনও বিপর্যয় হয়, তাহলে সুপ্রীম কোর্ট সমান ভাবে দায়ী থাকবে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানস ঘোষ, এই রায়ের মাধ্যমে দেশের সংখ্যালঘু মানুষকে ভয় দেখিয়ে আশঙ্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। ‘‘এনআরসি, কাশ্মীর সহ এই অযোধ্যা রায়ের মাধ্যমে সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। একটা ভুল ইতিহাস দিয়ে আমাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মুসলমানরা ওখানে প্রার্থনা করতেন কি না, সেটা কখনোই কোর্টের বিচার্য হতে পারে না। এক ধরনের ইসলাম বা এক ধরনের হিন্দু বলে কিছু হয় না। এই ধারণা সাভারকাররা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভারতবর্ষের বহুত্ববাদকেই আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থার রক্ষা করার কথা ছিল। এই রায় সম্পূর্ণ ভাবে এক ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনার ফসল। ইতিহাসগত ভাবে এই রায় আমাদের বহু বছর পিছিয়ে নিয়ে গেল।”
বক্তাদের বক্তব্যের পরে উপস্থিত দর্শকমন্ডলী বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। সুপ্রীম কোর্টের রায়ের বিভিন্ন অংশ নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দেন সব বক্তারাই। সভার কাজ পরিচালনা করেন অধ্যাপক তুষার চক্রবর্তী। এছাড়াও সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়। উপস্থিত ছিলেন, ডাক্তার বিনায়ক সেন, পিইউসিএল রাজ্য সম্পাদক অম্লান দত্ত, কলকাতা নাগরিক সমন্বয়ের অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, বোকাবুড়ো-র শুভদীপ দাস সহ অনেকে।
অযোধ্যা মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায় নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতুহল রয়েছে। আদৌ কতটা বিচার হল, সেই বিচার কতটা ন্যায়সঙ্গত ও সাংবিধানিক হল তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। যাদের মনে, এই রায় নিয়ে প্রশ্নল ছিল, তারা প্রশ্নের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ বক্তাদের কাছ থেকে বুঝতে চেয়েছেন ভালো করে। প্রশ্ন, মতামত ও বক্তব্যের মাধ্যমে বিরুদ্ধ মত প্রকাশের এক সন্ধ্যা কাটলো যাদবপুরে।