গত কয়েকদিন ধরে একের পর এক ধর্ষনের ঘটনা খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। হায়দ্রাবাদের ২৬ বছর বয়সী এক মহিলা চিকিৎসক প্রিয়াংকা রেড্ডিকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা সামনে আসার পর থেকেই দেশজু উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে শিরোনাম হয়েছে আরও কয়েকটি ধর্ষনের ঘটনা যেমন তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে এক ১৯ বছরের দলিত মহিলাকে ধর্ষণ করে হত্যা, রাঁচিতে ২০ বছরের এক আইনের ছাত্রীকে বন্দুক দেখিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ১২জন মিলে গণধর্ষণ করেছে, গুজরাটের বরোদায় এক নাবালিকাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, এবং আমাদের এই কলকাতায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর অঞ্চল কালিঘাটে দুই জন নাবালিকা যারা ভিক্ষা করে সংসার চালাতো তাদেরকে পয়সা দেওয়ার নাম করে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। এতগুলি ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসাতে জনগণের মধ্য থেকে নানা প্রতিক্রিয়া উঠে আসছে। অনেকেই ভাবছেন হয়তো দেশের একি হল? কিন্তু আপনারা কি জানেন ভারতবর্ষে ধর্ষণ রোজ ঘটে? জাতীয় অপরাধ তথ্যপঞ্জি বলছে ভারতে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ হয়। তারপর থেকে যায় অনেক ঘটনা যেগুলি নথিভুক্ত হয় না।
প্রিয়াংকা রেড্ডির পোড়া শরীরের ছবি যখন সোস্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন তা দেখে (ধরে নিলাম রাগেই) এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি চরম আক্রোশে ফেটে না পড়ে, যে সমাজ লিঙ্গগত বৈষম্যকে টিকিয়ে রেখেছে তাকে প্রশ্ন না করে উঠে আসছে নানান উপদেশ যার বেশিরভাগটাই হল ধর্ষণ আটকাতে গেলে মেয়েদের ঠিক কি কি করতে হবে? মেয়েদেরকেই জানতে হবে কিভাবে সমাজে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যায়! যেমন আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে, লঙ্কাগুঁড়ো, চাকু ব্যবহার করতে শিখতে হবে, কী জামাকাপড় পরতে হবে, কতক্ষণ বাইরে থাকতে হবে—সব কিছুর উপর নির্দেশ জারি করা হচ্ছে। প্রিয়াংকা রেড্ডির ঘটনার পর পুলিশ বলেছে মেয়েটি কেন রাতে পুলিশকে না ফোন করে নিজের দিদিকে ফৌন করেছিল!
কেন বলুন তো মেয়েদেরকেই সব জানতে হবে? ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ কী? ধর্ষণ কী? সব মেয়েদেরকেই কেন শিক্ষা নিতে হবে। কেন বাড়ির ছেলেদের আমরা শেখাই না লিঙ্গসাম্যের কথা? আপনারা কি ভাবছেন মেয়েটি স্বেচ্ছায় ধর্ষকের হাতে স্যারেন্ডার করে দেয়? এইভাবে মেয়েদেরকে অপরাধী করে দেবার চিন্তা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করুন। এইসব দোষারোপ না করে সমাজের মধ্যে থাকা ধর্ষণ সংস্কৃতিকে—যেখানে শুধুমাত্র মেয়েদের শরীর, মেয়েদের অবাধ চলাফেরা, পোশাক, মেলামেশাকে দোষ দেওয়া হয়—প্রশ্ন করুন। মেয়েরা ‘অবলা’, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’, তাদেরকে উদ্ধার করতে হবে, রক্ষা করতে হবে—এই চিন্তাই আপনাকে (পুরুষকে) ক্ষমতাবান তৈরি করেছে।
বিভিন্ন নারী আন্দোলনের কর্মীরা বহুবার বলেছেন এমনকি জ্যোতি সিং নির্মম ধর্ষণের পর দেশে জুড়ে আন্দোলনের ফলে ২০১৩ সালের ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট তৈরি হয়েছে তাতেও বলা হয়েছে ধর্ষণ কখনোই যৌন আকাঙ্ক্ষা থেকে সংগঠিত হয় না, ধর্ষণ হল ক্ষমতার প্রকাশ। সম্মতি ব্যাতিরেকে জোর করে সম্পর্ক স্থাপন করলেই তাকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ মানে বলাৎকার। ধর্ষণ আটকানোর কাজ মেয়েদের নয়, এটা সমাজের কাজ। তাই সমাজের উচিৎ পরিস্থিতিকে পাল্টানোর। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ‘ধর্ষণ’-কে তার দমনমূলক আধিপত্য প্রকাশের এক অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে যুগে যুগে টিকিয়ে রেখে এসেছে। কাশ্মীর থেকে ছত্তিসগড়ে। আদিবাসী মহিলাদের উপর অত্যাচার এই দমনমুলক রাজনৈতিক আধিপত্যকে বজায় রাখার গল্প। এরা ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-এর ঝাঁ চকচকে বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি টাকা খরচা করবে অন্যদিকে মহিলাদের নানা আন্দোলনের ফলে গড়ে ওঠা মহিলাদের জন্য আইনকেই বাইপাশ করে নিজেদের ক্ষমতা দেখায়। আইনে নির্যাতিতার বয়ানকেই প্রথম গুরুত্ব দেবার কথা বলা থাকলেও থানায় গেলে নির্যাতিতার মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব না দিয়ে নানারকম প্রশ্ন করা হয়। যৌন হিংসার কেসের দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করার জন্য ফাস্ট ট্রাক কোর্ট গঠন হলেও এই কোর্টেই ২০১৬ পর্যন্ত পেন্ডিং কেস ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
অনেকেই চাইছেন ধর্ষণ বন্ধ করার সমাধান হল ফাঁসি। আচ্ছা আপনি কি সত্যি মনে করেন ফাঁসি হলেই ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে? জ্যোতিসিং-এর ধর্ষকদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে তাতে কি সমাজে ধর্ষণ বন্ধ হয়েছে? বরং এখন ধর্ষণের পর প্রমাণ লোপের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যাও করে দেওয়া হচ্ছে।
মহিলাদের অবাধে চলাফেরার করার জন্য রাস্তাঘাট নিরাপদ বানানো, অফিস, স্কুল, কলেজ সর্বত্র মেয়েদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা, পুলিশি ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তোলা, মহিলাদের সম্মতিকে গুরুত্ব দেওয়া, নির্যাতিতাকে ভয় না দেখিয়ে তার সাথে সহমর্মিতা দেখানো, যৌন হিংসার কেসের দ্রুত বিচার কার্য সম্পন্ন করা এইসবই পারে মেয়েদেরকে সুরক্ষিত করতে। এইসব পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, ধর্ষককে শূলে চড়িয়ে দেবার আইন চালু হলে আর যাই হোক ধর্ষণ বন্ধ হবে না।
এই রাষ্ট্র চাইবেই ফাঁসি হোক তাতে তাদের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্ব কমে যায়। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে। যে দেশের শাসকের দল আসিফার ধর্ষকের সমর্থনে মিছিল বার করে, সেনাবাহিনী কর্তৃক কাশ্মীরের মহিলাদের ধর্ষণের খবরে উল্লসিত হয়, উন্নাওয়ের নির্যাতিতার গোটা পরিবারকে শেষ করে দিতে চায়, এবং সেই ব্যাক্তিকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী করে যিনি মনে করেন মুসলিম মহিলাদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করা উচিৎ, যারা ধর্ষণ ঘটলেই তাতে ধর্ষকের জাত এবং ধর্মখোঁজে তারা আর যাই হোক নারীদের মুক্তির কথা ভাবে না। তাই সেই শাসক দল অর্থাৎ মোদি-অমিত-যোগীর বাহিনী এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে এইটাই স্বাভাবিক।
কালীঘাটের ১৩ থেকে ১৪ বছরের যে নাবালিকা দুটির ধর্ষণ হয়েছে তাদেরে যারা ধর্ষণ করেছে তারাও নাবালক। ভাবুন তো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোন সমাজ তৈরি করে যাচ্ছি যেখানে ছোট থেকেই এই ধর্ষণের মানসিকতা গড়ে উঠছে। মেয়েদেরকে ঘরের মধ্যে বন্দী রাখতে চাইছেন অথচ ৯৮% নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার পিতা, নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী বা পরিচিতদের মাধ্যমে। এর দায় কার?
আমরা যখন থেকে গত রবিবার আইপোয়া এবং আইসার পক্ষ থেকে কালিঘাট থানায় বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিলাম সেখানের ইনচার্জ বললেন নির্যাতিতা মেয়েটির মায়েরা নাকি কেস তুলে নিতে চায় কারণ তারা ভয় পাচ্ছে এর পরে তার মেয়েরা এই অঞ্চলে ভিক্ষা করতে পারবে না, আর ভিক্ষা না করলে সংসার চলবে না। কি অদ্ভুত! থানার সীমানার মধ্যে ধর্ষণ হচ্ছে, আর নির্যাতিতার পরিবারই ভয় পাচ্ছে অথচ দেখুন এই রাজ্যে মেয়েদের জন্য রাজ্যের কন্যাশ্রী, রুপশ্রী নানা বাহারি প্রকল্প দেশ বিদেশে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। কেন্দ্রে ‘বেটি পড়াও’ রাজ্যে কন্যাশ্রী তবুও আমার দেশের কন্যা শিশুকে জন্মের আগেই মেরে ফেলা হয়, জন্মালে পাচার হয়, প্রকাশ্য দিবালোকে ধর্ষণ হয়ে যায়।
তাই মেয়েদেরকে নিজেদের কিভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবেসেই পাঠ না শিখিয়ে সমাজের বুকে বেড়ে ওঠা ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে আঘাত করুন। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শিকড় শুদ্ধু উৎপাটিত না করতে পারলে নারী সমাজের মুক্তি নেই। তাই আপনার আক্রোশকে ক্রোধে পরিণত করে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করুন। নারীর নির্ভয় স্বাধীনতার দাবিতে ঘর থেকে বাহির সর্বত্র সোচ্চার হোন।
- মিতালি বিশ্বাস