অশনি সংকেত : ভারতীয় রেলকে কোন পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

হঠাৎ একদিন বলা শুরু হয়ে যাবে — “রিলায়েন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনে আপনাকে স্বাগত। যাত্রীদের জানানো হচ্ছে জিও ফাইয়ের সুবিধা নিতে বড় ঘড়ির সামনের ওয়েটিং লাউঞ্জের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এ এইচ হুইলার অ্যান্ড কোম্পানির বুকস্টলের নিকটে নীতা রেল আহারের পাশেই আমাদের নবনির্মিত মুকেশ ক্যাফেটারিয়াতে আসুন। এখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ওয়াইফাইয়ের পাশাপাশি একশো মিলিলিটার কাগজের কাপে মাত্র একশ সত্তর টাকায় নেসকাফে শেক, আশি টাকায় আসাম চা, একশো তিরিশ টাকায় দার্জিলিং চা এবং দুশো কুড়ি টাকায় হট চকোলেট পাওয়া যাচ্ছে। নিরাপত্তার কারণে স্টেশনের সর্বত্রই বিশেষ জ্যামার বসানো থাকায় অন্যত্র মোবাইল কলিং এবং ইন্টারনেটের সুবিধা পাওয়া যাবে না।”

পাঠক, আপনি প্রবেশ করেছেন কর্পোরেট ভারতীয় রেলের আঙিনাতে। আপনার ছোটবেলার কু-ঝিক ঝিক রোমান্স এবার পুঁজিপতির মুনাফার দৌড়ে সামিল হতে চলেছে দেড়শতাধিক বছর ধরে লক্ষ কোটি রেলশ্রমিকের ফিমার এ গড়া রেল আর রিব কেজ-এ তৈরি স্লিপারে গাঁথা রেলপথের ওপর দিয়ে।

অবাক হচ্ছেন? অচিরেই শুনতে পাবেন এমন ঘোষণাও

“যাত্রীগণ কৃপয়া ধ্যান দে নঈ দিল্লী সে লখনউ জানেওয়ালি ১২৫৮৬ ডাউন আম্বানী- তেজস এক্সপ্রেস থোড়ি হি দের মে কানপুর সেন্ট্রাল পঁউছনেওয়ালি হ্যায়।”

এবং নিশ্চিত থাকুন। কানপুর সেন্ট্রাল থেকে বিলাসবহুল প্রথম বাতানুকুল শ্রেণীর কামরায় যিনি উঠে আসবেন তিনি তং মত করো, কাফি হো গয়া হ্যায়” বলা বাংলা-হিন্দি ডিকশনারি হাতে আরাবল্লীর ডাকাতদের পেছনে ধাওয়া করা বছর পঞ্চাশের কোনো ডার্ক, শর্ট, বল্ড, মুসটাশের মধ্যবিত্ত গড়পারিয়া বাঙালি নন। দেখবেন, বদলে যাওয়া পুঁজিবাদী ভারতের মুনাফাবাজ নাগরিক লছমণভাই গণপত ভাই প্যাটেল নামের ঐ চতুর বানিয়া যাত্রীটি হয়তো সে গাড়িতে সওয়ার হয়ে নিজেই দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস ডাকাতি করতে চলেছেন লখনউতে। “এ ঘনশ্যিয়াম, রেসিডেন্সি আউর বড়া ইমামবাড়া কা পুরানা ইঁটা কা অকশন কাল হি বুলা দো” — জিও ফোনের ভিডিও কলিং-এ হয়তো এমনই বার্তা পাঠাতেও শুনবেন ভদ্রলোককে!

নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার রথে সওয়ার হয়ে আসা এক চতুর বানিয়ার স্বপ্নের ভারতবর্ষ দেশের আমজনতার কাছে এক ঘোরতর দুঃস্বপ্নের অন্ধকার নিয়ে আসতে চলেছে। সে অন্ধকারে ঢাকা পড়তে চলেছে রেলওয়ে বোর্ডের ওয়েবসাইটে গালভরা বুলিতে লেখা “রাষ্ট্র কী জীবনরেখা বা লাইফলাইন টু দ্য নেশন” নামে অভিহিত গর্বের ভারতীয় রেলও।

দেখে নেওয়া যাক দেশের এই জীবনরেখা স্তব্ধ করে দিতে তাদের তৎপরতার হিসেব-নিকেশ। নতুন সরকার ক্ষমতায় বসার পরেই ইতিপূর্বে সারা দেশে একদা রেলের ঊনিশটি ছাপাখানার মধ্যে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট পাঁচটির মৃত্যুপরোয়ানায় সিলমোহর দেওয়ার পর পরবর্তী লক্ষ্য সাতটি লাভজনক উৎপাদন সংস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে রেলের প্রায় আশি হাজার কর্মীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলা। এই সাতটি উৎপাদন সংস্থা হল : চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস, চেন্নাইয়ের ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি, বারাণসীর ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কস, পাতিয়ালার ডিজেল মডার্নাইজেশন ওয়ার্কস, ব্যাঙ্গালোরের হুইল অ্যান্ড অ্যাক্সেল প্ল্যান্ট, কাপুরথালার রেল কোচ ফ্যাক্টরি এবং রায়বেরিলীর মডার্নকোচ ফ্যাক্টরি। এবং এর পরবর্তীকালে, কয়েক লক্ষ রেলকর্মীর ভবিষ্যত অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ধাপে ধাপে কর্পোরেটাইজেশনের খড়্গ নেমে আসতে চলেছে দেশের সবকটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপেও। এবং এখানেই শেষ নয়। এখনই দুটি দুরপাল্লার যাত্রীবাহী ট্রেন চালানোর দায়িত্ব কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেবার পাশাপাশি শতাধিক রেল স্টেশন চলে যাচ্ছে বেসরকারি হাতে। এমনকি রেলওয়ে সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্সের অবলুপ্তি ঘটিয়ে প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ডনিয়োগ করার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত এবং কোথাও কোথাও তা কার্যকর করে ফেলারও খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বসে নেই রেলকর্মীরা। দেশের প্রতিটি জোনের অন্তর্গত প্রতিটি ডিভিশনে, প্রতিটি উৎপাদন সংস্থা, প্রতিটি ওয়ার্কশপে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলির নেতৃত্বে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন তাঁরা। কোথাও কোথাও পথে নামতে হয়েছে বিপন্ন রেলকর্মীদের পরিবারের লোকজনদেরও — যা নিয়ে পুঁজিবাদের দালাল ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে উচ্চারিত হচ্ছে না একটি শব্দও, ছাপা হচ্ছে না একটি লাইনও। পরিস্থতি যদিও সেই ঊনিশশো চুয়াত্তরের ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের পুনরাবৃত্তির দিকেই ইঙ্গিত করছে।

অনেকে ভাবছেন, সময়ানুবর্তিতার অভাবে ভোগা, নিম্নমানের পরিষেবার ভারতীয় রেল তাঁর কর্মীদের দায়িত্ব-জ্ঞান হীনতার কারণেই এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তাই কর্পোরেটাইজেশনে জব্দ হবে বেয়াড়া শ্রমিক আর ঘুরে দাঁড়াবে ভারতীয় রেল। প্রায় বাইশ বছর গর্বের এই সংস্থার সাথে জড়িয়ে থাকার সূত্রে জানি এই শিল্পে প্রায় সর্বত্রই একজন রেলশ্রমিককে তাঁর উৎপাদনের লক্ষ্যে পৌঁছতে কি ভয়ানক ওয়ার্কিং এনভায়রনমেন্ট অর্থাৎ কাজের পরিবেশ সহ্য করতে বাধ্য হতে হয় এবং নিরন্তর কর্মী সংকোচনজনিত অপ্রতুল কর্মীসংখ্যার কারণে গড়ে প্রায় তিন জনের নির্দিষ্ট করা কাজ এক জনকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে পরিষেবা টিকিয়ে রাখা হয় প্রায় প্রতিটি উৎপাদন সংস্থা, প্রতিটি ওয়ার্কশপ এবং প্রতিটি দপ্তরে। যারা করেন এবং যারা করান — সিস্টেমের শিকার উভয়েই। পরিষেবার গুণমান এবং সময়ানুবর্তিতায় যার সুদুরপ্রসারী প্রভাব পড়তে বাধ্য।

নগর পুড়লে রক্ষা পায় না দেবালয়ও। ভারত সরকার শুধু ভারতীয় রেলে সর্বনাশ ডেকে আনছেন না, শুধুই বিপন্নতার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেন না অগণিত রেলকর্মীর ভবিষ্যত, সেই সঙ্গে ভারতীয় রেলে নিয়োগ পাবার ন্যূনতম প্রত্যাশাও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আগামী প্রজন্মের কাছে। বিমানের দেড়গুণ বা দ্বিগুণ ভাড়ার নিরুপায় সফরকালে রিলায়েন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনের মুকেশ ক্যাফেটারিয়াতে একশো তিরিশ টাকায় একশো মিলিলিটার দার্জিলিং চা খেয়ে জিওফাইতে ডেটা কানেকশন করতে বাধ্য হবার পরিস্থিতিতে না পড়লে এই প্রবাদের মর্মার্থ উপলব্ধি করা সমকালের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না।

খণ্ড-26
সংখ্যা-34