উপত্যকার অর্থনীতিতে বিধ্বংসী আঘাত প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি

জম্মু ও কাশ্মীরের বৃহত্তম শিল্প তালুকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ সফি দেউলিয়া হওয়া ঠেকাতে তার পৈতৃক ফল বাগিচার একটি অংশ বিক্রি করে দেওয়া মনস্থ করেছেন।

“ইতিমধ্যেই আমার কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। ৫ আগস্ট থেকে আমার দুটো কারখানাই বন্ধ রয়েছে। লাভ তো দূরের কথা, ঋণের সুদের টাকাই জমে যাচ্ছে, সেটা মেটানোর মতো পয়সাও আমার কাছে নেই” — ‘দি টেলিগ্রাফ’কে জানালেন সফি। উনি একটি রাইস মিল ও একটি পশুহাড়ের মিলের মালিক।

“আমার সব শ্রমিকই (বেশির ভাগই রাজ্যের বাইরের) চলে গেছে।আমাদের একটা ফলের বাগান আছে। যদি এই সমস্যা চলতেই থাকে তাহলে,ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে হয়তো তার একটা অংশ বেচে দিতে হবে।” সফি জানালেন।

গত ১২ সপ্তাহ ধরে তালুকের কয়েক ডজন কারখানা খুব দুর্দশায় আছে, ব্যাঙ্কগুলোও তাদের ঋণ শোধ করে দিতে বলেছে। এই চত্বরের প্রায় ৩৫০টি সংস্থা গত ৫ আগস্ট, যেদিন রাজ্যের বিশেষ মর্যাদাকে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করা হল, সেদিন থেকে বন্ধ আছে। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কয়েকটি হিমঘর চালু হয়েছে — সফি বললেন।

আকস্মিক কঠোর দমন অভিযান নেমে আসা আর তার সঙ্গে (গোটা উপত্যকায়) সমান্তরালভাবে অলিখিত বন্ধ, যা এই রবিবার ৮৪ দিনে পড়েছে, অর্থনীতিকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে। যার দরুণ ব্যবসায়ে বিরাট মাপের ক্ষতি আর হাজার হাজার লোকের কাজ হারানোর খবর আসছে। সকাল-সন্ধ্যায় কয়েক ঘন্টা বাদে বেশির ভাগ দোকান বন্ধই থাকছে। রাস্তায় সরকারি যানবাহন নেই। বেসরকারি যানবাহন অবশ্য উপত্যকার কিছু অংশে স্বাভাবিক আছে।

কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, প্রধান বাণিজ্যিক সংস্থাটি রবিবার পর্যন্ত প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকার ক্ষতির কথা জানিয়েছে। চেম্বারের প্রেসিডেন্ট শেখ আশিক বললেন, এই পরিমাণটা প্রাথমিক হিসেব মাত্র এবং সংস্থাকে আসল ক্ষতি আর অর্থনীতির স্থায়ী বিপর্যয় নিয়ে হয়তো একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।

“কয়েকটি ক্ষেত্র অন্যগুলির থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের কথাই ধরুন যেটা খুব বড় না হলেও বিকাশ লাভ করছিল। আইটি ফার্মগুলো আমেরিকান আর ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করছিল, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ওরা কাজ (পরিষেবা) দিতে পারছিল না। ফলে আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টরা অন্যত্র চলে গেছে। এদের বরাবরের জন্যই ক্ষতি হয়ে গেল।” তিনি বললেন।

“আমাদের ক্ষতির প্রাথমিক হিসেব আমাদের সংস্থাগুলির ফীড ব্যাক (ফলাফল সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া)-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি টাকা। আমাদের ১৫ থেকে ১৬টি বিশেষজ্ঞ কমিটি একসাথে বসে চূড়ান্ত হিসাবটা তৈরি করবে।

কার্পেট ব্যবসায়ী আশিক জানালেন, হস্তশিল্প ক্ষেত্রটি বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে তার মোট পরিমাণ এখনও জানা যায়নি ।

“৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ তাঁতি কাজ হারিয়েছেন। তার কারণটা হল আমরা জুলাই-আগস্ট অনলাইনে অর্ডারগুলো পাই, আর সেগুলো খ্রিস্টমাস বা নববর্ষের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। আমরা তো অর্ডারই পেলাম না, তাই তাঁতিরা বেকার বসে আছেন” তিনি জানালেন। “পর্যটন সহ কয়েকটি শিল্প অত্যন্ত বাজেভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। দেখবেন শয়ে শয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হাউসবোট খালি পড়ে আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছে।”

অতীতেও উপত্যকায় দীর্ঘ দীর্ঘ দিন এই ঝাঁপ বন্ধের পর্যায় চলেছে, কিন্তু এবারই প্রথম ১০,০০০ কোটি টাকার ফল ব্যবসাও বিপর্যস্ত হল। যখন আপেল উৎপাদকরা আকস্মিক আঘাতের প্রাথমিক বিমূঢ়তার পর সবে দেশের অন্য রাজ্যগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ে অনীহা কাটিয়ে উঠছেন তখনই জঙ্গি-হুমকির মুখে পড়লেন।

আপেল উৎপাদকরা এ বছর তাদের মোট প্রায় ২০লক্ষ টন উৎপাদনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ রপ্তানি করতেন পেরেছেন— বহিরাগত, যাদের বেশির ভাগই আপেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তাদের ওপর জঙ্গি আক্রমণের জন্য রপ্তানি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত — হামলার ফলে পাঁচ জন মারাও গেছেন। ব্যবসায়ী সমাজও এই সরকারী দমন অভিযানের নিশানায় ছিল যাতে ৫ আগস্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে দুর্বল করে দেওয়া যায়

 তিনজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী — মুবিন শাহ, ইয়াসিন খান এবং শাকিল কোয়ালেন্দার — এদের সকলকেই গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দানবীয় জন নিরাপত্তা আইনের আওতায় রাখা হয়েছে, যে আইনে দীর্ঘদিন বিনা বিচারে আটক রাখা যায়।

ইয়াসিন খানের মা গত শুক্রবার প্রয়াত হয়েছেন। আশিক জানালেন, মানবিকতার ভিত্তিতে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ী সমাজ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাতে কোনো সাড়া মেলেনি।

বিদায়ী রাজ্যপাল সত্য পাল মালিকের উপদেষ্টা ফারুক খান, চেম্বার কীভাবে ক্ষতির পরিমাপ করেছে এবং তা যথাসাধ্য কম করে দেখানো হয়েছে কিনা — এই প্রশ্নের উত্তরে জানান, ‘‘আমি অনুমানের ভিত্তিতে কোনো মন্তব্য করবো না। আমি আপনার বিশেষ কোনো সাহায্যে আসবো না”। সরকার কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে কিনা এ ব্যাপারেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।

‘ক্রাশিং ব্লো টু ভ্যালি ইকোনমি’
মুজাফ্ফর রায়না, পুলওয়ামা

‘দি টেলিগ্রাফ’ ২৮অক্টোবর ২০১৯
ভাষান্তর - জয়ন্তী দাশগুপ

kashmir

 

খণ্ড-26
সংখ্যা-36