প্রতিবেদন
কৃষকের এ মৃত্যু-মিছিলের কারণ শাসকশ্রেণীর নির্দয় নীতি

মোদী সরকারের কত কথার ফুলঝুরি! কৃষকের দুরবস্থা নাকি দূর হচ্ছে! আরও পাল্টাবে। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে। আর মোদী আমলের আগাগোড়া প্রকৃত নিষ্ঠুর বাস্তবতা হল পাথুরে কঠিন, কৃষক ঋণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারছে না, ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ প্রতিশ্রুত দাম পাচ্ছে না, বীজ থেকে সার, কীটনাশক ইত্যাদি নানা প্রতারণায় জর্জরিত, আর কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা-প্রবণতাও বন্ধ হচ্ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সর্বশেষ ২০১৬ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট। ঐ রিপোর্টেও উল্লেখ রয়েছে, ঘটেই চলেছে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা। এনসিআরবি রিপোর্ট প্রকাশ হওয়া উচিত অন্তত অনধিক এক বছরের ব্যবধানে। কিন্তু এই রিপোর্ট তৈরি ও প্রকাশে দেরী করা হয় অস্বাভাবিক রকমের। মোদী আমল লাগু হওয়ার পর থেকে বছরকার রিপোর্ট তৈরিতে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে দু’তিন বছর। ২০১৬-র রিপোর্ট প্রকাশ হল ২০১৯-এর অক্টোবর-নভেম্বরে। এত দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে মূল কারণ কি? তা কি এজন্যই নয় যে সংগঠিত অপরাধের শিকার হওয়া বৃহত্তম অংশ হল কৃষক ও ক্ষেতমজুর-গ্রামীণ অন্যান্য গরিব শ্রেণীর, শ্রমজীবী শ্রেণীর, মুসলিম-দলিত-নারী সম্প্রদায়ের ও নিপীড়িত জাতিসত্ত্বার মানুষেরা? এই বর্গের লোকেদের হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা? যা সংগঠিত হওয়ার পেছনে প্রকাশ্য ও গোপন হাত থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি, আচরণ ও ক্ষমতাধরদের? প্রত্যুত্তরটি রয়েছে প্রশ্নের মধ্যেই।

এনসিআরবি-র সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্টটি ২০১৬ সালের। রিপোর্টে উল্লেখ হয়েছে, ২০১৫-তে কৃষিজীবী মানুষের আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল কৃষক ৮,০০৭, ক্ষেতমজুর ৪,৫৯৫; ২০১৬-তে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল কৃষক ৬,২৭০ ও ক্ষেতমজুর ৫,১০৯। ২০১৪-তে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে কৃষি ও কৃষকের জন্য বহু কথা শুনিয়েছিল মোদী সরকার। কিন্তু ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের আত্মহত্যা কমেনি, বেড়েছে। ২০১৬-তে কৃষক আত্মহত্যার রাজ্য তালিকায় প্রথম তিন স্থানে ছিল মহারাষ্ট্র (৩,৬৬১), কর্ণাটক (২,০৭৯), মধ্যপ্রদেশ (১,৩২১)। সর্বোচ্চ মাত্রায় কলংকিত মহারাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় ছিল বিজেপি-শিবসেনা জোট। পক্ষান্তরে, ২০১৬-র মাঝামাঝি সময় থেকেই উত্তাল হয়েছিল প্রতিবাদী কৃষক আন্দোলন। হত্যারই নামান্তর আত্মহত্যার শিকার কৃষক সম্প্রদায়কে প্রতিরোধের নতুন ভাষা যোগাতে। কৃষক জনতা হাজারে হাজারে অভিযান চালিয়েছে রাজ্যে রাজ্যে। মহারাষ্ট্রে সংগঠিত নাসিক থেকে মুম্বই সপ্তাহব্যাপী লং মার্চ, রাজধানী দিল্লীতে ঐতিহাসিক জমায়েত, সংসদের বাইরে পাল্টা কিষাণ সংসদ থেকে কিষাণ সনদ তৈরি এবং তা কার্যকরী করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা — এই সবকিছুই হয়ে আছে অসাধারণ লড়াইয়ের একেকটি মাইলফলক।

প্রসঙ্গত বাজেট পেশকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বড়গলায় বলেছিলেন, সরকারের মন জুড়ে আছে ‘গ্রাম, গরিব এবং কৃষকরা। তাঁর মন্তব্য ছিল বাজেট ছাড়াই কিভাবে চাষাবাদ করা যায় কেন্দ্র রয়েছে সেই চেষ্টায়! তালাশে থাকছে চাষে প্রাকৃতিক প্রকরণের ওপর নির্ভর করাতে! ইতিমধ্যে কর্ণাটক, হিমাচল প্রদেশ, কেরালা, উত্তরাখন্ড, ছত্তিশগড় ও অন্ধ্রপ্রদেশ — এই ছয়টি রাজ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে কম সেচের জলে, কম খরচে অনেক বেশি ফলনের প্রাকৃতিক প্রযুক্তি নির্ভর চাষের। কেন্দ্র ভাবাচ্ছে এভাবে নিরন্তর প্রয়াসের মধ্য দিয়ে প্রায় নিখরচায় ২০২২-এর মধ্যে কৃষক পৌঁছে যাবে দ্বিগুণ আয়ের শিখরে। কেন্দ্র জানিয়েছে এই প্রাকৃতিক উপাদান নির্ভর উদ্ভাবনী ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভের এক বৃদ্ধ চাষি। ‘নীতি আয়োগ’ সেই খবর পাওয়া মাত্রই ঐ চাষিকে দিল্লীর দরবারে তুলে এনে লুফে নিয়েছে তাঁর পরামর্শ। সেই বিদর্ভ, যে ভূখন্ড প্রায় বরাবর কৃষকের আত্মহত্যাপ্রবণ শীর্ষাঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের কৃষক ভাবনা যদি এতই আন্তরিক হবে তবে সবার আগে বিদর্ভকে, মহারাষ্ট্রকে কলঙ্কের শীর্ষস্থান থেকে মুক্ত করার চেষ্টা নেই কেন? প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রথমোক্ত রাজ্যের তালিকায় মহারাষ্ট্র নেই কেন?

মোদী-২ সরকার কৃষিতে বাজেট বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেছিল, ২০১৯-২০-র জন্য বরাদ্দ করা হল ১,৪২,২৯৯ কোটি টাকা; বৃদ্ধির অংশ ২০১৮- ১৯-এর তুলনায় একলাফে ৮০ শতাংশ! এর মধ্যে ধার্য ছিল কৃষকের আয়ে সহায়তা প্রকল্প বাবদ ৫৫,০০০ কোটি এবং প্রধানমন্ত্রী কিষাণ পেনশন যোজনা বাবদ ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কতটা কার্যকারিতার আর কতটা গল্প সেই তফাত বুঝতে সদ্য মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ধাক্কা খাওয়ার নিদর্শনে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ মিলেছে বৈকি। কৃষি ও কৃষক সংক্রান্ত মর্মান্তিক কঙ্কালসার পরিসংখ্যান প্রকাশ হয়ে গেছে। ২০১৮ ও ২০১৯ পরপর দুবছরের গোড়া থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তুলনামূলক পরিসংখ্যান লক্ষ করুন। ২০১৮-র প্রথম ছয়মাসে কৃষকের আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল মোট ১৭১৫, তার মধ্যে বিদর্ভে সংঘটিত সংখ্যাটি ছিল ৮০৮। ২০১৯-এ সমসময়ে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৭৯৯ ও ৮২২। এজন্য দায়ী ঋণফাঁদ থেকে নিস্ফলা বীজ, সেচ দুর্নীতি, চাষ খরা, ফলনে মার, ফসলের মূল্যে মার, ঋণমুক্তি না পাওয়া এবং বিমুদ্রাকরণের জেরও জেরবার করেছে। সরকার ঋণমুক্তি ও সহায়ক মূল্যের তহবিল গঠনের গলাবাজি শুনিয়েছে, চাষির কাছে ওসব অধরাই থেকে গেছে। তাই চাষিরা দীর্ঘ সময় ধরে থেকেছে গুমরে গুমরে। ঘরে ঘরে ঘটেছে নিজেদের শেষ করে দেওয়ার ঘটনা। এহেন পরিণতির প্রতিক্রিয়া যাতে ফেটে না পড়ে সেটা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ম্যানেজ করতে বিজেপি ‘পুলওয়ামা’ আর ‘বালাকোট’ কান্ডকে ব্যবহার করে উৎরে যেতে পেরেছিল। কিন্তু সেই প্রতারণাপূর্ণ তৈরি করা ‘অতি জাতীয়তাবাদী’ হাওয়া তার চার মাস বাদে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে তেমন কাজ দিল না। বারেবারে তো ঘুঘু ধান খায় না। তাই বিজেপিকে মহারাষ্ট্রের বিশেষত গ্রামীণ ক্ষেত্রে নতুন করে প্রত্যাখ্যাত হতে হল। এভাবে মহারাষ্ট্রের যে নজীর স্থাপন করল, তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে সারা দেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে।

কৃষিজীবী মানুষের চাষাবাদের জীবনযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার যে প্রবণতা রাজ্যে রাজ্যে লক্ষণীয়, তা থেকে বাদ নেই পশ্চিমবঙ্গ। যদিও তা এরাজ্যের তৃণমূল সরকার যথারীতি স্বীকার করে না। অস্বীকার করে প্রথমত এরকম ঘটনা ঘটছে না দাবি করে, তবে তা চেপে দিতে ব্যর্থ হলে, চাষি আত্মহত্যার ঘটনা মানতে বাধ্য হলেও, আড়াল দেয় এই ‘তত্ত্ব’ সাজিয়ে যে মারা যাওয়ার পেছনে কৃষিজনিত কোনো কারণ ছিল না, নেই, থাকতে পারে না। কারণ এখানে রয়েছে ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় কৃষক বন্ধু প্রকল্প’। মন্তব্য নিস্প্রয়োজন।

কৃষকের ঋণমুক্তি আর ফসলের ন্যায্যমূল্যের হক আদায়ের লড়াই এখন সময়ের ভীষণ এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। আর এটা চাষিদের অনর্থক আত্মবিনাশী পন্থা থেকে সরে এসে মন্ত্রে জাগরণ ঘটাতে পারে “বাঁচতে গেলে লড়তে হবে, লড়াই করে বাঁচতে হবে”।

খণ্ড-26
সংখ্যা-36