বিশিষ্ট সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। একাশি বছর বয়সে যখন তাঁর জীবনাবসান হল, তখনো তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন সৃজনকর্মে। ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পরে পরিচিতজনেরা যখন আক্ষেপ করছেন মৃত্যুর করাল ছায়া প্রত্যক্ষ করে, তখন অসুস্থ অবস্থাতেই এই সেদিন, ৯ অক্টোবরের এক লেখায় তিনি রোগাক্রান্ত হওয়া ও চলে যাওয়ার জল্পনা নিয়েই লিখে গেলেন এক সরস রচনা। সমস্ত জটিলতা আর সঙ্কটকে পরিহাস মিশিয়ে পরিবেশন করতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নবনীতার পাঠকেরা জানেন নানা রম্য রচনায় সেলফ স্যাটায়ারকে তিনি কীভাবে তাঁর অভিজ্ঞান করে তুলেছিলেন। ‘নটী নবনীতা’ বা ‘ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান’-এর মতো নানা রচনায় তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে। দেশ বিদেশের নানা জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেইসব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ভ্রমণকাহিনীগুলিতেও নিজেকে নিয়ে অনবরত মজা করে যাওয়ার এক দুর্লভ সরসতা খুঁজে পান নবনীতার পাঠক।
সাহিত্য আকাদেমী, পদ্মশ্রী সহ নানা পুরস্কারে সম্মানিত জনপ্রিয় সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন ছিলেন সাহিত্যের বিদুষী ছাত্রী, প্রাজ্ঞ অধ্যাপিকা ও মননশীল প্রাবন্ধিক আর এক নবনীতা। রাধারাণী দেবী ও নরেন্দ্র দেবের মতো খ্যাতনামা পণ্ডিতের সন্তান নবনীতা বরাবরই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্ণিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী নবনীতা দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন হাভার্ড, কর্ণেল, রটগার্টস, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বসেরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বাংলা, হিন্দী, ওড়িয়া, অসমীয়া, সংস্কৃত, ইংরাজি ছাড়াও ফরাসি, জার্মান ও হিব্রু ভাষা জানতেন তিনি। এদেশের অগ্রগণ্য রামকথার গবেষকদের মধ্যে একজন ছিলেন নবনীতা।
নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে মহাকাব্যকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে নবনীতা দেবসেনের। নারীচেতনা সংক্রান্ত তাত্ত্বিক কাজকর্মের পাশাপাশি বাংলার মহিলা সাহিত্যিকদের নিজস্ব সংগঠন ‘সই’ তৈরি করা ও তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সক্রিয় ছিলেন। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি তাঁকে পেয়েছিল উপদেষ্টা মন্ডলীর মধ্যে, পেয়েছিল তাঁর আন্তরিক সক্রিয় সাহায্য, পরামর্শ।
বিশিষ্ট কবি, জনপ্রিয় আখ্যানকার, বিদুষী অধ্যাপিকা, মননশীল গবেষক, মনমাতানো রম্যরচনাকার নবনীতা দেবসেনের প্রয়াণে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। আগামী দিনে তাঁর পাঠকদের ভালোবাসার মধ্যেই বেঁচে থাকবেন নবনীতা।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন