১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের ভেতর গোপনে “রাম লালার” মূর্তি স্থাপনের কাণ্ডটাই ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকের রাজনীতির ধারাকে ঠিক করে দিয়েছিল। এর পরই চলেছিল এক হিংসাত্মক অভিযান যা পরিণতি লাভ করেছিল বিজেপির সর্বোচ্চ নেতাদের পরিচালনায় এক ফ্যাসিস্ট জনতার হাতে বাবরি মসজিদের ধ্বংসে। এই অভিযান চলার সময় এবং মসজিদ ধ্বংসের পরপরই উত্তর ভারতের সর্বত্রই সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগে উন্মত্ত জনতার হাতে মুসলিমরা গণহত্যার শিকার হয়েছিল। অযোধ্যার “বিবাদটা” আপাতদৃষ্টিতে ছিল — বাবর বাবরি মসজিদ নির্মাণ করতে গিয়ে রামের জন্মস্থান বলে কথিত কোনো হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন কি করেননি তা নিয়ে। ঐ অভিযানের উদ্দেশ্য বস্তুত ছিল আরএসএস-এর এই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাসিবাদী ধারণার পক্ষে সমর্থন তৈরি করা: ভারত হিন্দুদের দেশ — আর মুসলিমরা ভারতে থাকতে চাইলে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা মেনে নিতে হবে। মন্দির নিয়ে সংঘ ও বিজেপির প্রচার শ্লোগানগুলোতে মুসলিমদের প্রতি প্রকাশ্যেই এই হুমকি দেওয়া হয়েছিল যে, ভারতে থাকতে গেলে তাদের রামকে নিজেদের ঈশ্বর বলে মেনে নিতে হবে। আরো হিংসাপ্রবণ শ্লোগানগুলো মুসলিমদের গণহত্যা করার আহ্বান জানিয়েছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনটাকে ফ্যাসিস্টরা ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে “বিজয়” দিবস রূপে উদযাপন করে — আর এর সঙ্গেই চলে ভারতে প্রতিটি প্রাচীন মসজিদ বা মুসলিম কাঠামোকে ধূলিস্যাতের অঙ্গীকার। ঘৃণার এই অভিযান বিজেপিকে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রথম বারের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খেলোয়াড়ের প্রতিষ্ঠা দেয়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সংঘটকদের বিরুদ্ধে এবং মসজিদ ধ্বংসের পর মুসলিমদের বিরুদ্ধে চালানো সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে রুজু হওয়া অপরাধের মামলাগুলোর বিচার প্রায় তিন দশক ধরে চলার পর এখনও সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু যে জমির উপর বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল তার মালিকানা সম্পর্কিত এক দেওয়ানি মামলায় সুপ্রীম কোর্ট ২০১৯-এর নভেম্বরে তাদের রায় দিয়েছে। এই রায়টা এমন সময় এল যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সংঘটকরা এবং ঐ ধ্বংসকাণ্ড থেকে সুবিধা পাওয়া লোকজন ভারতে প্রায় অপ্রতিহত ক্ষমতা ভোগ করছে, এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারতকে ফ্যাসিস্ট হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিমুখে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মোদী শাসিত ভারতের রাস্তাগুলোতে মাঝেমধ্যেই কোনো মুসলিম হিন্দু-সংখ্যাগুরুবাদী উন্মত্ত জনতার হাতে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে, যে জনতা “জয় শ্রীরাম” বলার জন্য ঐ মুসলিমের ওপর জুলুমবাজি চালাচ্ছে। মুসলিমদের নাগরিকত্বের মর্যাদাকে বিপন্ন করে তুলতে মোদী সরকার ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এবং নাগরিকদের সারা ভারত জাতীয় নাগরিকপঞ্জিকে রূপায়িত করার পরিকল্পনা করছে। যে লক্ষ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল তা পূরণ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, এবং ভারতীয় গণতন্ত্র তার জীবনের সবচেয়ে শোচনীয় সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। এই পৃষ্ঠভূমিতে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচারের সাংবিধানিক নীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার সুযোগ সুপ্রীম কোর্টের ছিল। বিচার ব্যবস্থা যে ক্ষমতাধরদের সেবক হওয়ার পরিবর্তে সংবিধানের অভিভাবক, তা প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ তার কাছে ছিল। সেই সুযোগ সুপ্রীম কোর্ট হারিয়েছে। বিপরীতে সে এমন একটা অসংলগ্ন রায় দিয়েছে যা প্রত্যয় জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সাধারণ রীতির বিপরীতে, পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চের রায়ে বিস্ময়করভাবে কোনো বিচারপতির স্বাক্ষর নেই। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাঁচ বিচারপতির কেউই ঐ রায়টি লেখার দায় নিতে চাননি: এখানে অতএব এই প্রশ্নটা উঠছে যে, রায়টা কি বিচারপতিদের কাছে আদৌ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করেছে যে, বাবরি মসজিদের তালা ভেঙ্গে মসজিদের ভেতর রামলালার মূর্তিস্থাপন একটা অপরাধজনক কাজ ছিল। সে আরো স্বীকার করেছে, বাবরি মসজিদের ধ্বংস একটা “গুরুতর অপরাধ” ছিল। সুপ্রিম কোর্ট এটাও মেনে নিয়েছে যে, বাবরি মসজিদ নির্মাণের পথ প্রশস্ত করতে কোনো রাম মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। সে জোর দিয়ে বলেছে, মালিকানা বিষয়ের রায় বিশ্বাসের পরিবর্তে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই হতে হবে। গোটা জমিটা রাম মন্দির নির্মাণের জন্য কেন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়া এবং ধ্বংস হওয়া মসজিদের বদলে নতুন মসজিদ নির্মাণের জন্য কাছেপিঠে পাঁচ একর জমি বণ্টনের সিদ্ধান্ত তার নিজেরই পেশ করা সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যে যুক্তির উপর ভিত্তি করে সুপ্রীম কোর্টতাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তা হল — ১৫২৮ সালে মসজিদটির নির্মাণ এবং ১৮৫৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের আবির্ভাব, এই দুয়ের মধ্যবর্তী সময়কালে হিন্দুরা যেমন বাইরের চত্বরে পূজো করত, তেমনি ভেতরের চত্বরেও তাদের প্রবেশাধিকার ছিল। সুপ্রিম কোর্ট এটাকে হিন্দু ও মুসলমানদের কোনো ধরনের সংঘাত ছাড়াই পরস্পরের পাশাপাশি উপাসনা করার সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ধরে নিতে চায়নি। বিপরীতে সে এই সিদ্ধান্ত টেনেছে যে, ঐ স্থানের উপর তাদের একচেটিয়া মালিকানা এবং প্রবেশাধিকার যে ছিল সে কথা মসজিদ পক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি! তাহলে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মসজিদে হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্যই কার্যত মুসলিমদের শাস্তি দেওয়া হল। কিন্তু মন্দির পক্ষও তো ঐ স্থানের উপর তাদের একচেটিয়া মালিকানা এবং প্রবেশাধিকারের কথা প্রমাণ করতে পারেনি। এছাড়াও, মন্দির পক্ষ তাদের বিতর্কিত দাবি বা প্রস্তাবিত বিষয়েও কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তারা এই সমস্ত বিষয়েও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি যে — সেখানে একটা মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল, সেটা ছিল একটা রাম মন্দির, সেই স্থানটা রামের জন্মস্থান বলে স্বীকৃত ছিল, বা বাবর সেই মন্দিরকে ধ্বংস করেন। সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করেছে যে, মন্দিরের অস্তিত্ব অথবা তার ধ্বংসের সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপিত করা হয়নি এবং মসজিদে রামলালার মূর্তি স্থাপন ছিল একটা অপরাধজনক কাজ। গোটা স্থানটাই মন্দির নির্মাণের জন্য প্রদান সুপ্রীম কোর্টের নিজেরই পর্যবেক্ষণ করা ঘটনাবলীর সঙ্গে খাপ খায় না।
সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ ধ্বংসের “গুরুতর অপরাধের” সংঘটকদের এই অপরাধ থেকে সুবিধা লাভে সক্ষম করেছে। সেটা করতে গিয়ে সে এই ধরনের অপরাধগুলোর সংঘটনে একটা বিপজ্জনক প্ররোচনাও যুগিয়েছে। এ ব্যাপারে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই যে, বাবরি মসজিদ অটুট থাকলে সুপ্রিম কোর্ট কখনই মন্দির নির্মাণের পথ করে দিতে মসজিদটি ধ্বংসের নির্দেশ দিত না। ধ্বংসকাণ্ড সম্পন্ন হয়েছে বলেই (সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন করে) মন্দির জমিটা পেয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং সংঘের অতি- দক্ষিণপন্থী অন্যান্য সংগঠন ইতিমধ্যেই সেই সমস্ত মসজিদ বা স্মৃতিসৌধের (কাশী, মথুরা এবং এমনকি তাজমহলও) তালিকা তৈরি করতে শুরু করেছে যেগুলোকে মন্দির বলে দাবি করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। রায় তাদের এই বিশ্বাসে স্পর্ধিত করেছে যে, মসজিদ/স্মৃতিসৌধগুলোকে যদি তারা ধ্বংস করতে পারে তবে ঐ সমস্ত স্থানের ওপর তাদের আইনি দাবি শক্তিশালী হবে।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফ্যাসিবাদী কাণ্ড এবং তার পথ ধরে মুসলিমদের গণহত্যার পর ২৭ বছর পার হয়ে গেলেও আদালতগুলো এখনও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অপরাধের সংঘটকদের শাস্তি দিতে পারেনি। বিপরীতে, জমির মালিকানা সম্পর্কিত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দৌলতে অপরাধের সংঘটকরা আজ বিজয় এবং নিজেদের কীর্তিকলাপের সঠিকতা দাবি করছেন। বহু আলোচিত এক বিবাদের “নিষ্পত্তির” নামে অধিকাংশ বিরোধী দল যে এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছে তাকে একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। সত্য এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা ছাড়া নিষ্পত্তি আসতে পারেনা।
ঝাড়খণ্ডে আদর্শ নির্বাচন বিধি চালু হয়ে গেছে এবং সেখানে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া চলছে। সুপ্রিম কোর্ট এবং নির্বাচন কমিশনকে এটা সুনিশ্চিত করতে হবে যে, ঝাড়খণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যেন রাজনৈতিক রসদ হিসাবে ব্যবহার করা না হয়।
আমরা ভারতের শান্তি ও ন্যায়কামী জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখুন এবং অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের নামে ১৯৯০-এর দশকে যে সাম্প্রদায়িক রক্তগঙ্গা বয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তা সুনিশ্চিত করুন। গণতন্ত্র এবং ন্যায়ের শক্তিগুলোকেও এটা সুনিশ্চিত করতে হবেযে, মন্দিরের নামে সংঘ বাহিনী যেন বিজয়োল্লাসের উন্মাদনায় মেতে উঠতে না পারে, যার লক্ষ্য হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আরো সন্ত্রস্ত করে তোলা ও তাদের ভোটাধিকার হরণ করা, এবং জীবিকা, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য বুনিয়াদি অধিকারের মত জনগণের জরুরী ইস্যুগুলো থেকে দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায় হল আমাদের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের চারটে সাংবিধানিক স্তম্ভ এবং সংঘ-বিজেপি বাহিনী এই রায়কে ধরে স্পর্ধিত হয়ে উঠে আমাদের প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক বনিয়াদকে ধ্বংস করার তার পরিকল্পিত নকশাকে চালিয়ে যাবে, আমরা তা হতে দেব না।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২ নভেম্বর ২০১৯)