গত ১৫ নভেম্বর এন্টালির ভূপেশ ভবনের পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অল ইন্ডিয়া পিপলস ফোরাম এর উদ্যোগে আয়োজিত হল এক আলোচনা সভা। এনআরসি : বিপর্যয় ও প্রতিরোধ শীর্ষক এই আলোচনাসভায় মুখ্য বক্তা ছিলেন কান্নন গোপিনাথন, যিনি কাশ্মীরের মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় দমনের প্রতিবাদে আইএএসএ-র চাকরি ছেড়ে সাম্প্রতিক সময়ে এক আলোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন।
কান্নন গোপিনাথন তাঁর বক্তব্যে বলেন — কালো টাকা বিলোপ করার নামে নোটবন্দি করা হয়েছিল। কালো টাকা বিলুপ্ত হয়নি, মানুষ তিন মাস ধরে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছে। প্রশ্ন এটা নয় যে কালো টাকা বিলোপ জরুরী কি জরুরী নয়। প্রশ্ন এটা কালো টাকা কী আর কীভাবে সেটা বিলোপ করা যায়। কে অনুপ্রবেশকারী সেই প্রশ্ন কীভাবে নির্ণিত হবে, সেটা প্রথম প্রশ্ন। সরকার ডকুমেন্টের ভিত্তিতে এটা স্থির করে। যার কাছে নির্দিষ্ট ডকুমেন্ট নেই তাদের দেশের বাইরে বের করে দেওয়া উচিত কিনা, এই জরুরী প্রশ্নটা প্রথম তুলতে হবে। ঠিক ঠিক ডকুমেন্ট বহু মানুষের কাছেই থাকবে না। তারা অনুপ্রবেশকারী না হলেও থাকবে না। যারা প্রান্তিক মানুষ, যারা পরিযায়ী শ্রমিক, যারা নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন - তাদের কাছে ডকুমেন্ট থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। অনেক বিতর্কের পর আমাদের সংবিধান বলেছিল যে এই দেশে যারা জন্মেছে তারা সবাই ভারতের নাগরিক। এটা বদলে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। নাগরিকত্ব অনেকগুলো অধিকারের সমষ্টি। সেগুলো থেকে অসংখ্য মানুষকে বঞ্চিত করার চেষ্টা চলছে। কৃষকদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে জমি অধিগ্রহণ আইনকে লঘু করার চেষ্টাকে রোখা গেছিল। নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিষয়কেও সেরকম জোরালো আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই রোখা দরকার। অনেক ডকুমেন্ট জোগাড় করেও নানা ক্ল্যারিক্যাল ও অন্যান্য ভুলভ্রান্তির কারণেও লোকে বিপদে পড়বে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন গরিবরা। এনআরসি প্রধানত গরিব বিরোধী একটি প্রকল্প। যদি ডকুমেন্ট না থাকে ও কেউ মুসলিম না হন, তাহলে প্রথমে উদ্বাস্তু হিসেবেই তাদের দেখা হবে।
আমি কাশ্মীর প্রশ্নে পদত্যাগ করেছিলাম। ৩৭০ করেই তারা থামেনি। ইন্টারনেট সহ সমস্ত কমিউনিকেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সমস্ত বিরোধী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গণতন্ত্রের মূল শর্ত মতামত প্রকাশ, কথা বলার অধিকারকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। আমি সরকারের প্রতি রাগে পদত্যাগ করিনি। বাকি ভারতের নীরবতার কারণে পদত্যাগ করি। মনে হয়েছিল মানুষ আত্মসমর্পণ করছেন। আমার আশা ছিল ভারত এটা মানবে না। সেটা ধ্বস্ত হয়েছিল। বুরোক্র্যাটদের কেউ প্রশ্ন তোলেনি কেন বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। সাধারণ মানুষ সেটা হতে দেন না প্রতিবাদের মাধ্যমে। কাশ্মীর নিয়ে প্রশ্ন তোলার লোক পাওয়া যাচ্ছিল না সেভাবে। মিডিয়া মিষ্টি বিতরণের ছবি দেখাচ্ছিল। এসব মেনে নিতে সমস্যা হচ্ছিল। আমার পদত্যাগের ব্যাপারটায় যে মিডিয়ার দৃষ্টি পড়বে, তা আমি ভাবিইনি। আমরা অনেক অধিকারের কথা বলি। কিন্তু নাগরিকত্বের মৌলিক অধিকার চলে যাওয়ার আশঙ্কায় সবাই ভুগছেন। মুম্বাইতে মুসলিম বৃদ্ধদের অনেককে আমি দেখেছি কি আশঙ্কা নিয়ে নানা ডকুমেন্ট তারা খুঁজে চলেছেন। এটাই হল এনআরসি আতঙ্ক। এনআরসি একইসঙ্গে মুসলিম বিরোধী এবং গরিব বিরোধী। আসামের এনআরসি ছয় বছর নিয়েছিল এবং তা এখনো মেটেনি। গোটা দেশে এটা করতে কুড়ি-পঁচিশ বছর কম করে লেগে যাবে। ততদিন মানুষকে হন্যে হয়ে আতঙ্ক নিয়ে ডকুমেন্ট জোগাড় সংশোধন পেশ নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে।
আলোচনাসভাটি শুরু হয় এনআরসি : বিপর্যয় ও প্রতিরোধ নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। পুস্তিকা প্রকাশের পর শুরু হয় আলোচনা সভা, যেখানে প্রথম বক্তা ছিলেন আসামের মানুষ পার্থপ্রতিম মৈত্র। পার্থপ্রতিম খুব কাছ থেকে আসামের এনআরসি-র সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে দেখেছেন এবং গোটা দেশে তার ছড়িয়ে দেওয়ার রাজনীতিকে নিয়মিত অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করে চলেছেন। পার্থপ্রতিম তাঁর বক্তব্যে বলেন—এটা ছিল আসামের নাগরিক পঞ্জী যা ১৯৫১-তে তৈরি হয়েছিল, তার নবায়ন। ১৯৫১-র নাগরিকপঞ্জী কোথায় এবং কি কাজে লেগেছে তা সঠিক জানা যায় না। বলা হয় তা অবিকৃত অবস্থায় নেই, অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৬৬-র ভোটার লিস্টকে নবায়নের একটা ভিত্তি করা হয়। লিগাসি কোড এর সাহায্যে তখনকার লোকেদের সাথে পরের লোকেদের সংযোগ দেখাতে বলা হয়। লিগাসি কোড-এর জন্য ১২টি ভ্যালিড ডকুমেন্ট-এর একটি জমা দিতে বলা হয়। ল্যান্ড ডকুমেন্ট, এলআইসি-র কাগজ ইত্যাদি তার মধ্যে ছিল। যা কিছু ভ্যালিড ডকুমেন্ট সবেতেই সাধারণত বাবার নাম থাকত, মায়ের নাম নয়। মায়ের নামে বাড়ি কাগজ ইত্যাদি থাকলে সমস্যা। প্রান্তিক মানুষদের অনেকেরই কাগজপত্র নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দাঙ্গা ইত্যাদিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এদের কাগজ বানিয়ে দেওয়ার জন্য পঁচিশ হাজার এর মতো টাকা চাইতে থাকে দালালরা। এর মধ্যে নানা ভুলভ্রান্তি থেকে যায়। একই নামের অনেকে থাকায় ফ্যামিলি ট্রি-তে গরমিল ধরা পড়ে। শেষমেষ উনিশ লক্ষ লোক বাদ গেল। তাদের এখন দৌড়তে হচ্ছে ট্রাইবুনালে। তিন কোটি এগারো লক্ষ লোকের নাম আছে তালিকায়। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন তাদেরও ডেকে পাঠানো হতে পারে। কারণ এই এনআরসি নিয়ে স্থানীয় বিজেপি খুশি নয়। বলা হচ্ছে বারো লক্ষ বাঙালি হিন্দুর নাম বাদ গেছে। কিন্তু এই সংখ্যাটা বোঝা গেল কিভাবে? এনআরসি-তে ধর্ম বা ভাষার কোনও কলাম ছিল না। ফলে প্রথম থেকে কীভাবে এই সংখ্যাটা উচ্চারিত হতে থাকল তা এক বিষ্ময়। লাখ চারেক লোক আবেদন করেনি। অসমীয়ারা বলছে তাদের লাখ দেড়েক লোক নেই। গোর্খাদের লাখ খানেক লোক বাদ গেছে বলে তাদের দাবি। ফলে মুসলিমদের নাম বাদ যাওয়া তালিকায় বেশ কমই আছে দেখা যাচ্ছে, যা বিজেপির এনআরসি নিয়ে উৎসাহের মূল কারণ। এজন্যই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, যা মুসলিমদের আলাদা করবে, তা নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। এনআরসি-কে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার আগে বিজেপি সিএবি পাশ করাতে চায়। উনিশ লাখ লোক যাদের নাম ওঠেনি, তার সঙ্গে ডি-ভোটার ও অন্যান্য মিলে সংখ্যাটা প্রায় পঁচিশ লাখ। অনেকে বলছেন এদের নাগরিকত্ব না দিয়ে লেবার ফোর্স হিসেবে দেখা হোক। এদের নাগরিক অধিকার থাকবে না, তারা সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে।
আলোচনাসভার শেষ বক্তা ছিলেন তরুণ আদিবাসী নেতা মিলন মান্ডি। তাঁর উচ্চগ্রামের বক্তব্যে এন আর সি বিরোধিতায় পথে নামার, প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলনকে জঙ্গী চেহারা দেবার আহ্বানই আগাগোড়া ধ্বনিত হয়। এই আলোচনাসভার উদ্যোক্তাদের মধ্যে এআইপিএফ ছাড়াও ছিলেন বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ, গণ সংস্কৃতি পরিষদ, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ, সহমন, ভারতীয় আদিবাসী একতা মঞ্চ, জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক, আইসা, নাগরিক উদ্যোগ, চেতনা মঞ্চ, মিরর প্রভৃতি সংগঠন।