অপুষ্টিতে ভোগা লক্ষ লক্ষ রন্ধনকর্মী কাজ হারানোর আশঙ্কায় ক্ষোভে ফুঁসছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’ এক নির্দেশিকা জারি করে জানাচ্ছে ২০১৭ সালের মে মাসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিড-ডে-মিল প্রকল্পে অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কেন্দ্রীয় রন্ধনশালা’র মাধ্যমে রান্না করা খাবার বিদ্যালয়গুলিতে সরবারহ করতে পারবে। অর্থাৎ কোনো একটা জায়গায় রান্না করে অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি বিভিন্ন স্কুলে রান্না করা খাবার সরবারহ করবে। বাস্তবে কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করে তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। এর ফলে খাদ্যের গুণমানের অবনতি ঘটার সম্ভাবনা আছে। তেমনি রন্ধন কাজে যুক্ত ২৫ লক্ষাধিক কর্মীর বেশিরভাগই কাজ হারাবেন। ইতিমধ্যেই এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড-ডে-মিল) ইউনিয়ন দাবি করেছে – কোনো অবস্থাতেই মিড-ডে-মিল প্রকল্পকে বেসরকারিকরণ করা চলবে না। রন্ধনকর্মীদের ৪৫ ও ৪৬তম শ্রম সম্মেলনের সুপারিশ অনুযায়ী শ্রমিকের মর্যাদা ও মজুরি বৃদ্ধির, সামাজিক সুরক্ষার সুপারিশ কার্যকর এবং কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বাতিল হওয়া ৪৭তম শ্রম সম্মেলনকে পুনরায় চালু করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার বেগতিক দেখে সমগ্র বিষয়টিকে রাজ্য সরকারের ঘাড়ে ফেলে দিয়েছে। ইউনিয়ন রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে কোনো অজুহাতেই মিড-ডে-মিলের রান্না ‘কেন্দ্রীয় রন্ধনশালা’ থেকে তৈরি করে স্কুলে সরবরাহ করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এআইসিসিটিইউ আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলির উপর চাপ তৈরি করা হবে। যাতে রাজ্য সরকার মিড-ডে-মিল প্রকল্প বেসরকারিকরণ করতে না পারে।
মহিলা কর্মীদের উপর নির্ভর করে ‘জাতীয় পুষ্টি সহায়তা প্রকল্প’-এর অধীনে ১৯৯৫ সালে ‘মিড-ডে-মিল’ প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকার চালু করে। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের আমলে প্রতি বছর মিড-ডে-মিলের জন্য বছরে ৭ শতাংশ হারে বরাদ্দ বৃদ্ধি করত। কিন্তু মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর লাগাতারভাবে মিড-ডে-মিলের বরাদ্দ কমিয়ে চলেছে। আগে এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের আর্থিক দায়ের অনুপাত ছিল ৭৫:২৫। বর্তমানে তা ৬০:৪০ হয়েছে। এইভাবে মোদী সরকার ক্রমশ মিড-ডে-মিল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। এখন তো আবার ‘কেন্দ্রীয় রন্ধনশালা’র নামে সমগ্র প্রকল্পটিকে অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে তুলে দিয়ে মিড-ডে-মিল প্রকল্পকে বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে মিড-ডে-মিল গবেষক এবং আইআইএম আমেদাবাদের অর্থনীতির অধ্যাপক ঋতিকা খেরার কথায় “স্কুলের ভিতরেই যদি রান্নাঘর থেকে রান্নার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে রান্নার গুণগত মান শিক্ষক-শিক্ষিকারা কিংবা পড়ুয়াদের মা-বাবা যাচাই করে নিতে পারেন। কিন্তু যদি বেশ কয়েকটি স্কুলের খাবার তৈরির জন্য একটি কেন্দ্রীয় রন্ধনশালার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে খাবারের মান রাখা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা থেকে স্কুলে খাবার আনানো অনেক বেশি খরচ সাপেক্ষ”। তিনি আরও বলেন “গ্রামীণ অঞ্চলে স্কুলগুলির মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি। এখানে একটি স্কুল থেকে আরেকটি স্কুলে খাবার পাঠানোর খরচও অনেক বেশি। আবার রাস্তাতেই খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকছে। বিশেষত, গরমের সময় খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। রেফ্রিজারেটর ভ্যান ব্যবহার করলেও খরচ বাড়বে।” একই সঙ্গে উদ্বেগের সাথে বলেন, “স্থানীয় যে সমস্ত মানুষ এই মিড-ডে-মিল প্রকল্পের অধীনে রান্নার কাজ করেন কিংবা সহকারির কাজ করছেন, তাদের অধিকাংশই কাজ হারাতে পারেন, যদি একটি করে কেন্দ্রীয় রন্ধনশালা তৈরি হয়। আবার যে স্কুলে এই রান্নার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বা অন্যান্য সরঞ্জাম রয়েছে সেগুলিও নষ্ট হবে।”
ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি সহ দেশের ১৩ টি রাজ্যের ১৩৭টি জেলার সদরদপ্তরের অধীনস্ত স্কুলে মিড-ডে-মিলের দায়িত্বে আছে কমপক্ষে ৭০টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ‘অক্ষয় পাত্র’। যারা ১৮ লক্ষ পড়ুয়ার খাবারের দায়িত্বে আছে। এরা সব সময় নিরামিষ খাবার সরবরাহ করে। ফলে শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্যের বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
‘অক্ষয় পাত্র’র মতো বড় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতেই মোদী সরকার এই প্রকল্প তুলে দিতে চায় দু’টি লক্ষ্যে — প্রথমত সরকার সব ধরনের সামাজিক দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে চায় এবং দ্বিতীয়ত পশ্চিম ভারত ও গো বলয়ের নিরামিষ খাদ্য সংস্কৃতির আধিপত্যকে চাপিয়ে দিয়ে সারা দেশে একই ধরনের খাদ্যাভাস তৈরি করতে চায়। যেমন গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে ডিম দেওয়া হয় না। শুধুমাত্র নিরামিষ খাদ্য দেওয়া হচ্ছে। মোদী সরকারের এই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠছে। মিড-ডে-মিল প্রকল্পে রান্নার কাজ যুক্ত আছেন ২৫ লক্ষাধিক রন্ধনকর্মী, যারা প্রতিদিন ১০ কোটি পড়ুয়াকে রান্না করে খাবার পরিবেশন করেন। আর আছেন ১০ কোটি পড়ুয়ার অভিভাবক ও অভিভাবিকা যারা নিশ্চিন্তে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠান। এইভাবে মিড-ডে-মিল প্রকল্পে কয়েক কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছেন। আর মোদী সরকার যদি লোকসভার দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে বলীয়ান হয়ে মিড-ডে-মিল প্রকল্পকে বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ নেয়, তা হলে এক গণবিস্ফোরণের মুখোমুখী তাকে হতে হবে।
(তথ্যসুত্র গণশক্তি ও দি টেলিগ্রাফ পত্রিকা)