সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য কাউন্সিল বৈঠক আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সম্মেলন সফল করার আহ্বান

২০ অক্টোবর বিএমপিইউ হলে অ্যাপোয়ার বর্ধিত রাজ্য কাউন্সিল-এর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে বৈঠকের উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন অ্যাপোয়ার সর্বভারতীয় সম্পাদিকা মীনা তেওয়ারি। শুরুতেই কমরেড মীনা বলেন, দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর মোদী সরকার অত্যন্ত নির্লজ্জ ভাবে খোলাখুলি হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাগুলিকে সামনে নিয়ে আসছে। কাশ্মীর, এনআরসি, রামমন্দির বিভিন্ন ইস্যুগুলিকে সামনে এনে দেশের ভয়ঙ্কর মন্দাপরিস্থিতিকে চাপা দিতে চাইছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সমস্ত ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দিচ্ছে। এর ফলে বেকারত্ব-জর্জরিত নিঃস্ব মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। যারা বিত্তশালী তারাই শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষালাভের অধিকারী হবে। মনুস্মৃতি নারী ও দলিতের শিক্ষার বিরোধী। বিজেপি সরকার মনুবাদকে অনুসরণ করছে। তিনি আরও বলেন, বিজেপি-আরএসএস জেএনইউ, যাদবপুর সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত নিন্দনীয় আচরণ করছে। ঘোর দুরভিসন্ধি নিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করছে। ভারতভূমির মূল নিবাসীদের উৎখাত করা হচ্ছে। তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে। হিন্দু ধর্মের খারাপ দিক-অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার এসব সামনে এনে তাকেই হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। ব্রাহ্মণ্যবাদকে সমাজে আবার জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু হিন্দুধর্মের প্রগতিশীল দিকগুলির কথা বলছে না।

সারা ভারতে, পশ্চিমবঙ্গেও, আরএসএস দুর্গাবাহিনী তৈরি করে লাঠি-বন্দুক চালানো শেখাচ্ছে। কিন্তু চিন্ময়ানন্দ, আশারাম বাপু, কুলদীপ সেঙ্গারদের মতো ধর্ষক খুনী অত্যাচারীদের উপর তো সেই লাঠি- বন্দুক তারা চালাচ্ছে না! বরং মুসলমানদের শত্রু খাড়া করে তাদের উপর, দলিতদের উপর, গরিব মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে তাদের উপর সেই অস্ত্র প্রয়োগ হচ্ছে। দুর্বলের উপর হামলা হচ্ছে। এতেই প্রমাণ হয় তারা মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে আদৌ ভাবছে না। মহিলা সংরক্ষণ বিল আজও পাশ হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে সম্মেলনকে সামনে রেখে অ্যাপোয়ার কী করণীয়? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, আজ আরএসএস বিজেপি’র সঙ্গে আমাদের লড়াইটা মুখোমুখি। এই রাজ্যে অন্তত ৩০ হাজার মহিলার কাছে অ্যাপোয়ার কথা পৌঁছে দিতে হবে। তাদের সদস্য করতেন হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথমে মহিলাদের, যে সংখ্যায়ই হোক, একত্রিত করে তাদের কাছে অ্যাপোয়ার রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। তারপর সদস্য করতে হবে। গ্রামে গঞ্জে শহর ও শহরতলিতে, বস্তি ও শ্রমিক মহল্লায় সর্বত্র এই অভিযান চালাতে হবে। শ্রমজীবী, পরিচারিকা, মিড-ডে-মিল, আশা কর্মী থেকে শুরু করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহিলা, শিক্ষিকা, অফিস কর্মী — সবার মধ্যে সংগঠনকে নিয়ে যেতে হবে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম শহরে ইদানীং পুজো পাঠের সংস্কৃতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। তৃণমূলও পাল্লা দিচ্ছে। ঘরে ঘরে ভিন্ন রাজ্যের সংস্কৃতির নাচ গান ইত্যাদি চলছে। কিন্তু বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে অ্যাপোয়াকে নারীমুক্তি সহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ভাবনায় সাংস্কৃতিক টিম গড়ে তুলতে হবে।

wb aipwa

 

কোনো আন্দোলন শুরু করলে সেটি মাঝপথে ছাড়া চলবে না। ইস্যু ও পরিকল্পনা তেমনই হতে হবে যেটিতে ধারাবাহিকতা থাকবে। অ্যাপোয়ার আন্দোলন ‘মহিলা’ নিয়ে শুরু হলেও সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না, দেশের সামাজিক। রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলে যায়। অর্থাৎ মহিলা আন্দোলনে সামাজিক এবং শেষ বিচারে রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থাকতে হবে। ‘নির্ভয়া’র সময়ে দেশজোড়া আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল অ্যাপোয়া ও আইসা’র উদ্যোগে।

বিজেপি সাংঘাতিক দমন পীড়ন চালাচ্ছে। অপরাধী ধর্ষকদের ছেড়ে দিয়ে অভিযোগকারীদেরই গ্রেফতার করছে। সেই জন্যই জনসাধারণকে সাথে পেতে আন্দোলনকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। আশা, পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী ইউনিয়ন ও অ্যাপোয়ার কাজের সমন্বয়ের প্রশ্নে জানান, প্রকল্প-কর্মীদের মহিলা হিসাবে যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শোষণ নির্যাতনের শিকার হতে হয় সেটিকে সামনে এনে তাদের অ্যাপোয়ার সদস্য করতেন হবে। আবার অ্যাপোয়ার মধ্যে যে শ্রমজীবী মহিলারা আছেন তাদের সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন তথা এআইসিসিটিইউ-এর আওতায় আনতে হবে। এর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসছে। তাই অ্যাপোয়া অনেক দূর এগিয়ে যাবে — এই আশা রেখে তিনি বক্তব্য শেষ করেন। এরপর বিভিন্ন জেলা সম্পাদক ও অন্যান্য দায়িত্বশীলরা সার্কুলারে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার প্রেক্ষিতে তাদের জেলায় জেলা সম্মেলন, সদস্যকরণ অভিযান এবং আগামী জাতীয় সম্মেলনের সামগ্রিক প্রস্তুতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রিপোর্ট পেশ করেন। বৈঠকে ছাত্রী তথা নতুন প্রজন্মের ক’টি নতুন মুখের সরব উপস্থিতি সকলকে উৎসাহিত করে। প্রবীণ নেত্রীরাও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বর্ষীয়সী নেত্রী কমরেড মীনা পাল সংগঠকদের উদ্দেশে বলেন,টীমভিত্তিক কাজে গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রকল্প-কর্মীদের অ্যাপোয়ার পতাকাতলে আনতে হবে।

রাজ্য সম্পাদিকার ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর সমবেত কণ্ঠে ‘ইন্টারন্যাশনাল’-এর উদ্দীপ্ত সুরের রেশ রেখে প্রাণবন্ত সভা শেষ হয়।

খণ্ড-26
সংখ্যা-33