হুগলীর চণ্ডীতলা ১ নং ব্লকের আঁইয়ার খালকুল্লা দক্ষিণপাড়ার মাছবিক্রেতা নাসির আলি মল্লিকদের চোখের জলটাও শুকিয়ে যাচ্ছে ... পানীয় জলের সাথে সাথে চোখের নোনা পানিটুকুও শুকিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও যে নিয়েছে ‘আচ্ছে দিন’ আর ‘উন্নয়ন’-এর কারবারীরা। গ্রামের অনেক ছেলেই সোনা-রূপোর কাজে বিদেশ বিভুঁইয়ে আছে। পরবের সময়ে তারা ঘরে আসে। কটা দিন আগেই নাসিরের বড় ছেলে রাজাও ফিরলো নেপাল থেকে নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে, গত বুধবার ছিল ওর বিয়ের আশীর্বাদ। কিন্তু গেরুয়া আর সবুজের ঝলকানির মাঝে শান্তির সাদা রঙটাই যে দেশে উবে যাচ্ছে একটু একটু করে প্রতিদিন, সে দেশে রাজা তার রানীর হাতে আংটিটা পরানোর আগেই হয়ে যায় শিরোনাম — গণপিটুনিতে নিহত যুবক: আসিফ আলি মল্লিক।
ঘটনা গত শনিবারের, আমাদের গোচরে খবরটা আসতে বেশ কিছুটা দেরিই হয়ে গেল, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে যতটা জানা যাচ্ছিল সেটুকু তথ্য, সাথে চণ্ডীতলা এলাকার বাসিন্দা জামশেদদার সংগৃহীত কিছু সূত্র হাতে নিয়েই যাওয়া। সুদর্শন বসু ঐ গ্রামেরই বাসিন্দা এক যুবক মঞ্জুর যোগাযোগ দেন। ২৭ সেপ্টেম্বর বিকালে ডানকুনি থেকে ২৬সি বাসে মিনিট পঁয়তাল্লিশ — নামা হল আঁইয়া পাঁচমাথায়, গন্তব্যে যাওয়ার পথেই রাস্তার উপর পড়লো ঘটনাস্থল-কল্যাণবাটি আশুথতলা, সেখানে বড়সড় গোলমালের আশঙ্কায় ইতিমধ্যেই RAF মোতায়েন হয়েছে এবং পাঁচমাথা বাসস্টপেও পুলিশ পিকেট (ঘটনার দিন ও তার অব্যবহিত পরে যদিও এর ছিটেফোঁটাও প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা যায়নি বলেই অভিযোগ)।
বাসস্টপ থেকে কাঁচাপাকা গ্রাম্য রাস্তায় মিনিট দশ হেঁটে প্রথমে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা পেরিয়ে পৌঁছানো গেল মুসলিম অধ্যুষিত খালকুল্লায়, যার একদম শেষপ্রান্তে আসিফদের (রাজা) মহল্লা দক্ষিণপাড়া। এই সংকটের সময়ে যা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই অসাধারণ সংযম আর পারস্পরিক পাশে থাকার পরিবেশটাই পাওয়া গেল একদম গায়ে লাগোয়া দুই সম্প্রদায় অধ্যুষিত কয়েকটা পাড়ার মধ্যে। দক্ষিণপাড়ার দ্বিতীয় মসজিদতলায় যুবক ও মধ্যবয়সীদের জটলা। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সংগঠনের নাম, টিমের কমরেডদের সংক্ষিপ্ত ব্যক্তি পরিচয় ও যাওয়ার উদ্দেশ্য জানাতে হল ওঁদেরকে। পরিচয় পর্ব মিটতেই এক যুবক আঙুল তুলে কয়েক পা দূরেই দেখালো মাটিতে বাঁশ দিয়ে ঘেরা, পরিপাটি করে মশারি টানানো একটা জায়গা — ‘‘ঐ দেখুন, যার খবর নিতে এসেছেন তার কবর ওটা”। কীই বা থাকে বলার ... সেখান থেকে আরেকটু ভেতরে নিয়ে গেলো ঐ যুবকরাই, সোজাসুজি বাড়িতে। শোকস্তব্ধ প্রান্তটায় ভিড় করে কে নেই? আসিফের চাচাতো ভাইয়েরা যাদের বেশিরভাগই স্কুলপড়ুয়া বয়সী, মামা, চাচা, মেসো, পিসি, দিদি, প্রতিবেশী ...। চৌচির হয়ে যাওয়া অন্তরগুলোতে এতটুকু খামতি নেই আন্তরিকতার, মনুষ্যত্বের — পড়শিরা গাছতলায় পেতে দিলেন চেয়ার, ভাইরা গিয়ে ঘর থেকে ডেকে আনলো নাসির (নেসুর) আলি মল্লিককে, যিনি হারিয়েছেন তাঁর কলজের টুকরো বড় ছেলে রাজাকে, ক্ষেতমজুর পরিবার, নাসির এখন পাড়ায় পাড়ায় মাছ বিক্রি করেন। ‘‘আমরা মানুষ, আমরা বাঙালী, আমরা ভারতীয় — আর কোনো পরিচয় আমাদের কাছে বড় নয়, তবু কেন আমাদেরই মরতে হচ্ছে বলতে পারেন?” — প্রশ্নটা এলো শরাফত সাহেবের (বাড়ির জামাই) মুখ থেকে।
গত জুন মাসেই প্রায় একই ঘটনাস্থলে এরকম আরো একটি ঘটে, বছর দেড়/দুয়েক আগে আরো একটা!!! সন্দেহ নেই এলাকায় আরএসএস-বিজেপির প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে, তবে শুধু সেটুকুই নয়, ঘটনাস্থল কল্যাণবাটির বাগদিপাড়ার মানুষদেরকে কয়েকবছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী এলাকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে। সেই কারণে প্রতিটি মুসলিম পরিবার ঘরের মানুষদের বারংবার সতর্ক করেন ঐ জায়গাটা দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরা করতে, কারণ জায়গাটায় সামান্যতম কারণেই মারমুখী হয়ে ওঠে জনতা। যে ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে আমাদের যাওয়া, সেটাকে ক্ষমতাসীন মহল থেকে অনবরত ‘স্পিডে বাইক চালানোয় পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু’ বলে সাজানোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু গ্রামবাসীদের মতে, কমবয়সী ছেলেরা যে যেমনই বাইক চালাক, কল্যাণবাটির কাছে একটা গোরস্থান থাকায় প্রত্যেকেই সেটাকে মান্য করে গতি কমায় এবং এলাকাটায় উত্তেজনা কয়েক বছর ধরেই থাকায় তারা সংযত হয়েই চলে। দ্বিতীয়ত আসিফ ও বাইকের সওয়ারী তার বন্ধুর শরীরে যে ধরনের আঘাতের ক্ষত তা কোনো দুর্ঘটনার হতে পারেনা। সর্বোপরি ঘটনায় বাইকে আসিফের পিছনে বসা বন্ধুরিয়াজের বক্তব্য অনুসারে, বিয়ের বাজার সেরে মশাট বাজার থেকে ফেরার সময়ে শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা নাগাদ কল্যাণবাটি আশুথতলার কাছে হঠাৎই তাদের বাইকের সামনে এক ব্যক্তি চলে আসে, তাকে পাশ কাটাতে গিয়ে নিজেরাই বাইক সমেত পড়ে যায় এবং অপর এক যুবকের (যার আত্মীয় অমর মালিক, তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য এবং ঐ ঘটনাস্থলেই তার চায়ের দোকান, পাশেই একটি কাঠের দোকান) গায়ে বাইকের সামান্য আঘাত লাগে তবে সেই যুবক এবং আসিফ ও তার বন্ধু কারোরই আঘাত মোটেই গুরুতর কিছু ছিলনা, এমতাবস্থায় বন্ধুরিয়াজ নিজে উঠে দাঁড়িয়ে আসিফকেও তুলে বসায়, আসিফ কথা বলার অবস্থাতেই ছিল, পাশেই একটি বাড়িতে জল আনতে ঢোকে বন্ধুটি। এরই মধ্যে অকুস্থলে অমর মালিকের দোকানে (অঘোষিত মদের ঠেক) নিত্য আড্ডা ও নেশায় জড়ো হওয়া প্রায় ৩০ জন সাহায্য করার পরিবর্তে আসিফ ও তার বন্ধুকে রাস্তার দু’দিকে নিয়ে গিয়ে দুই দলে বেমক্কা কিল, চড়, লাথি, ঘুষি, গলায় পা তুলে দেওয়া ইত্যাদি করতে থাকে। এই জনতার মধ্যে অনেকেই বিজেপি, এবং তাদের ঠেক হল তৃণমূলী অমরের দোকান। এই সময় অমর আসিফদের বাইকে সামান্য চোট পাওয়া নিজের আত্মীয়কে (সম্ভবত ভাইপো) নিয়ে হাসপাতাল রওনা দেয় আর মারমুখী জনতাকে বলে যায় “মার শালা মুসলমানের বাচ্চাদের”।
ইতিমধ্যেই কারোর মারফত আসিফের বাড়িতে খবর যায়, বাবা নাসির মল্লিক ছুটে এসে দেখেন তার ছেলেকে এ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়ে গেছে এবং তাঁকেও প্রায় ধাক্কা দিয়ে এম্বুল্যান্সে উঠিয়ে বলে দেওয়া হয়, এক্সিডেন্ট হয়েছে, ছেলেকে এখুনি হসপিটাল নিয়ে যাও। নাসির ও তাঁর আরেক আত্মীয় আসিফের আঘাতের যেরকম বিবরণ দিলেন, ছেলের চোয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে, অণ্ডকোষ রক্তাক্ত, গোটা বুকে, হাতে লাল টিপ টিপ দাগ, ঘটনাস্থলে বড় একটা পাথর ও অনেক টুকরো ইঁট পড়েছিল। এক্সিডেন্টে কি এমন হয়?। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরুর জন্য এম্বুল্যান্স চালকের পরামর্শে প্রথমে ডোমজুড়ের একটি বেসরকারী হাসপাতালে পৌঁছান, কিন্তু সেই হাসপাতাল ঝুঁকি নেয়না, কলকাতায় রেফার করে। নিয়ে যাওয়া হয় পার্কসার্কাসের একটি নার্সিংহোমে (সম্ভবত নাম T.R.A জাতীয় কিছু), সেখানে ঘন্টায় ঘন্টায় হাজার হাজার টাকার বিলের ফিরিস্তি দেওয়া চলতে থাকে, সহায়সম্বলহীন হয়েও শেষ চেষ্টা করেন নাসিররা, উন্নতির কোনো আশ্বাস মেলেনা, ভোরের দিকে আসিফ মারা যায়। নাসিরের কথায়, “ফজরের নমাজের সময় হাসপাতালের বারান্দায় বসে যেন মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে, মনে হল ছেলেটা বোধহয় আর নেই”। ডেথ সার্টিফিকেটেও আঘাতজনিত মৃত্যু লেখা হয়েছে। মৃতদেহ নিয়ে গ্রামে ফেরার পর থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে প্রথমে প্রশাসন অগ্রাহ্য করে, পরবর্তীতে দু’তিনটি গ্রামের জনতা জোটবদ্ধ হয়ে গত মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর চণ্ডীতলা গ্রামীণ থানায় বিক্ষোভ দেখালে পুলিশ এফ আই আর নেয়। এফ আর আই করেন আসিফের সাথেই গণপিটুনির শিকার হওয়া বন্ধুরিয়াজ, সেই মুহূর্তে যা যা মনে পড়ে তার ভিত্তিতে পাঁচজনের নামে তারা অভিযোগ করতে চান, যার মধ্যে অমর মালিক অন্যতম, কিন্তু তৃণমূলের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগকারীদের সেই মুহূর্তেই চাপ দিয়ে অমরের নাম তুলে নিতে বাধ্য করা হয়, সে নিজে হাতে পেটায়নি এই অজুহাতে! পুলিশ বলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেফতার করবে, কিন্তু তা হয়নি। ইতিমধ্যে ফুরফুরা শরীফের ত্বহা সিদ্দিকী আসেন, ক্ষুব্ধ জনতা তার কাছেও প্রতিকারের উপায় চান, তিনি এডিশনাল ডিএসপির কাছে দরবার করতে বলেন।
আসিফের পরিবারের বক্তব্য, থানা এখনও আমাদের এফআইআর কপি দেয়নি, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চাইলে ২০/২২ দিন সময় লাগবে বলে ঘোরাচ্ছে আর অভিযুক্তদের গ্রেফতারের ব্যাপারটাও আর দুটো দিন টাইম দিন — বলেছে গত ২৭ সেপ্টেম্বর অবধি। আমরা এখনও চাই না কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হোক, গ্রামগুলোর হাজার দুয়েক মানুষ শুধু আমাদের মুখ চেয়েই এখনও অবধি আস্থা রাখছেন প্রশাসনের কথায়, কিন্তু আমাদের পক্ষে রবিবারের বেশি অপেক্ষা করা সম্ভব না, পুলিশ বলছে, দু’জনকে ধরেছে কিন্তু কিছুতেই তাদেরকে দেখাচ্ছেনা। এটা কোনো জাতপাতের ভেদাভেদ নয়, আর কারোর ছেলের সাথেই এটা হোক আমরা চাইনা, আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী সব হিন্দুমানুষ আমাদের পাশে আছেন বলেছেন। নাসির সাহেব বললেন, আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাছ বেচি, মানুষ চিনি, মোটেই মনে করিনা যে সব হিন্দুরাই এমন, কিন্তু যারা আমার ছেলেটাকে মারলো তাদেরকে মানুষ বলেই মনে করছিনা। আপনারা কতদূর থেকে এলেন, আপনারাও বামপন্থী দল করেন, আমরাও কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক দীর্ঘদিনের পরিবার, কিন্তু এলাকার সিপিএম তো একবারও এলো না এখন অবধি — বলতে বলতেই এতক্ষণের শক্ত চোয়াল কেঁদে ককিয়ে উঠলো। আসিফের মেসো মিয়াজান গাজি সিপিএম কর্মী, তিনিই আমাদের অনেকটা বিবরণ দিচ্ছিলেন, বললেন, ঘটনার সময়ে হাফ কিলোমিটার দূরেই আমাদের পার্টির সভা চলছিলো তাই মাইকের শব্দে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। গ্রামের তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য একবারও আসেনি, গ্রামবাসীরা ওদের চিনছে। আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ।
আমরা বলি, এটা ধন্যবাদের কোনো বিষয় না, এরকম ঘটনা ঘটলেই মানুষের জন্য, দেশের জন্য লড়াইতে যতদূর সম্ভব থাকা আর সবথেকে আগে ঘটনার বলি হওয়া মানুষের নিজের মুখ থেকে ঘটনা জানার, বোঝার দায় থেকেই আপনাদের কাছে আসা। আইন, আদালতে এই বিষয়ে আপনাদের যাবতীয় পদক্ষেপের পাশে ও দরকারে রাস্তার লড়াইতে আমরা পাশে থাকতে চাই আন্তরিকভাবে। তবে প্রশাসনের ভূমিকা আমাদের একেবারেই ভাল লাগছেনা, এই বিষয়েও কর্তব্য নিয়ে পরামর্শ হল পরিবার ও গ্রামবাসীদের সাথে। ওনারাও এই বিষয়ে আমাদের সাথে পরামর্শ করে পরবর্তীতে এগোবেন বলে জানালেন।
মানুষের কাছে পৌঁছালে বোঝা যায় অ-চেনা মানুষ অনেকটা চেনা হয়ে যায়, চোখের জলের রঙ নেই, দাঙ্গাবাজ খুনীদের ক্ষমা নেই।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের তথ্যানুসন্ধানী দলের (সজল অধিকারী, সৌরভ, অপূর্ব ঘোষ, প্রদীপ সরকার, অতনু পাল ও রঞ্জিত রায়) রিপোর্ট