পাশের মণ্ডপে সন্ধ্যারতির ঢাক বাজছে। স্টলের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক সাদাসিধে মহিলা, বয়স্ক আটপৌরে চেহারা। স্টলে তখন মুড়ি-আলুর চপের ঠোঙা ঘুরছে। খেতে খেতেই সদ্য তরুণটি এগিয়ে আসে “বই নেবে দিদা? কী বই--” প্রৌঢ়ার উত্তর শুনে ছেলেটি যুগপৎ বিস্মিত, পুলকিত এবং পরে বিমর্ষ হয়। মুহূর্তে সামলে নিয়ে বলে “দিদা, ঐসব (সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার) বই তো আর পাওয়া যাচ্ছে না, তবে তোমার নাতনির জন্যে অন্য বই দিচ্ছি, দেখো, পড়ে খুব আনন্দ পাবে!”-- ‘মন্দের ভালো’ গোছের মুখ করে মহিলা বই ক’টি নিয়ে চলে যান। তরুণটি নিজের রঙিন শৈশবে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবে, এখনও কি তার বিকল্প তৈরি হল না? শিশু সাহিত্যের আকাল তো আছেই। কিন্তু সামনের বার দেখে শুনে ছোটদের ভালো ভালো বই আনতে হবে।
অষ্টমীর রাত। স্টলে জমাটআড্ডা চলছে। সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, নাটক – ভূ-ভারতে আর কোনো বিষয় বাকি নেই। উদ্দাম তর্ক। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা মেয়েটির হঠাৎ নজর পড়ে – এক বয়স্ক ভদ্রলোক বই নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে ওদের কথা শুনে মৃদুমন্দ হাসছেনও। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে “জ্যেঠু, কী বই খুঁজছো?” না, ওনার অভীষ্ট বইটি স্টলে আসেনি। মননশীল বহু প্রবন্ধের বই অবশ্য এসেছে। সেগুলো এগিয়ে দিতে উনি জানালেন বাড়িতে প্রচুর বই। আসলে নতুন নতুন বই দেখতেও ভালো লাগে। ভালো লাগে স্টলের সুস্থ আড্ডাঘন পরিবেশ। হেসে বললেন “এই যৌবনকেই তো খুঁজি। ফিরে পেতে চাই।” বেশ কিছুক্ষণ স্টলে কাটিয়ে দুটি বই কিনে, যাওয়ার সময় ঠিকানা দিয়ে ওঁদের পাড়ায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।
নবমীর সন্ধ্যে উতরে গেছে। জেলা প্রান্তের স্টলে ক্রেতার ভীড় তুলনায় আজ একটু কম। সবাই আজ শহরমুখী। তবে স্টল জমজমাট। স্টলে এসে দাঁড়ায় এক কমবয়সী দম্পতি। কিছু বলতে চাওয়া লাজুক মুখে ছেলেটি বই দেখতে থাকে। স্টলের মাঝবয়সী সংগঠক কমরেড তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেন। ছেলেটি নির্মাণ শ্রমিক। কিছুদূর পড়াশুনো করেছে। মার্কসবাদ, বামপন্থা নিয়ে তার অনেক জিজ্ঞাসা। পোড় খাওয়া সংগঠক তার ভালো লাগার, জিজ্ঞাসা মেটানোর মতো কিছু বই এগিয়ে দেন। সেগুলো নিয়ে নতমুখী বৌটির দিকে লাজুক ইঙ্গিত করায় কমরেড তার জন্যেও একটা বই এগিয়ে দেন “ এটার দাম দিতে হবে না, কিন্তু বইটি পড়তে হবে, কেমন?”
মেয়েটি এবার মুখ তুলে সপ্রতিভভাবে ঘাড় নাড়ে হাসিমুখে। কমরেড বলেন “দীপু, ওরা কিন্তু তোমাদের গ্রামের পাশেই থাকে –”
এইভাবেই কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয় বরাবরের মতো এবারও সিপিআই(এমএল) এবং গণসংগঠন বিশেষ করে আইসার উদ্যোগে শারদীয়া প্রগতিশীল পুস্তক বিপণি কেন্দ্রগুলি নানা বইয়ের সম্ভার নিয়ে সেজে উঠেছিল। বই, আড্ডা, গান, তর্কেমেতে উঠেছিল। এবার কমপক্ষে প্রায় আঠারোটি স্টলের খবর এসেছে।
প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় অশোকনগর স্টলের কথা – এবার ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে।
বেহালা লোকাল কমিটির স্টল এবার ২৯ বছরে পা রাখলো। উত্তর পাড়া-রিষড়া এরিয়া কমিটির তত্ত্বাবধানে কোন্নগর রিষড়ার বুক স্টল, মধ্য হাওড়া লোকাল কমিটির উদ্যোগ হালদার পাড়া বুক স্টল, বাগনান ঘোড়াঘাটা লোকাল কমিটির স্টল, বালি বুক স্টল, গোস্বামী মালিপাড়া সেনেটের বুক স্টল, হিন্দমোটর স্টল বেশ সাড়া জাগিয়েছে। যাদবপুর ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটির স্টলটি উদ্বোধন করেন রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড পার্থ ঘোষ। বজবজ, বাখরাহাটেও স্টল হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘরিয়ায় স্টল উদ্বোধন করেন জেলা সম্পাদক কমরেড সুব্রত সেনগুপ্ত। এখানে এনআরসি ও কাশ্মীরী জনগণের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে পোস্টারগুলি মানুষের মনে দাগ কেটেছে
আইসা’র যাদবপুর, শ্যামবাজার স্টল ছিল জমজমাট। যাদবপুর স্টলে প্রথম দিনেই ১৫০০০ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। বেহালার শিবরামপুরেও আইসা স্টল করেছিল।
এবার প্রায় সব স্টলসজ্জায় এনআরসি বিরোধিতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশব্রতী প্রকাশনীর ‘বন্দী কাশ্মীর’ এবং ‘আসাম থেকে শিক্ষা নাও, বাংলায় রুখে দাও: এনআরসি মানছি না’ পুস্তিকাদুটি ভালো বিক্রি হয়েছে । বিভিন্ন স্টলে রাজ্য ও জেলার নেতৃত্বসহ বহু বিশিষ্টজনের উপস্থিতি উদ্যোক্তাদের উৎসাহ বাড়িয়ে তুলেছে।