কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবার অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন। ১৯৬১ সালে মুম্বইয়ে জন্ম অভিজিৎ বিনায়কের। প্রথমে পড়াশোনা কোলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন অভিজিৎ। বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সিতেই অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। স্নাতকোত্তর পড়তে অভিজিৎ চলে যান দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর গবেষণা করেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণার বিষয় ছিল ‘ইনফরমেশন ইকোনোমিক্স’। বর্তমানে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক অধ্যাপক হিসেবে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কর্মরত অভিজিৎ। ২০১৩ সালে অভিজিৎ ‘আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশান ল্যাব’ গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বের দারিদ্র নিয়ে গবেষণার জন্যে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এস্থার ডাফলো। তিনিও অভিজিৎ এর সাথে এবারের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত। তাঁদের পরীক্ষামূলক গবেষণাকে সম্মান জানিয়ে নোবেল কমিটি বলেছে, ‘ওঁদের গবেষণা গোটা বিশ্বকে দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়ার নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে ওঁদের গবেষণা পদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম পাথেয় মডেল।’
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বই ‘পুওর ইকনমিক্স’ বিশ্ব জুড়েই সমাদৃত। অভিজিৎ জানিয়েছেন, ‘নব্বইয়ের দশকের শেষে আমার স্ত্রী এস্থার ডাফলো আমার সঙ্গে কাজে যোগ দেয়। গত পঁচিশ বছরে বহু দেশ ঘুরে আমরা গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করেছি। ঘানা, চিলি, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত — সর্বত্র ঘুরে ঘুরে কাজ করেছি’। এই বইতে দারিদ্র দূরীকরণের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়ার আছে তাই নিয়ে আলাপ আলোচনা রয়েছে। তাঁর লেখা অন্যান্য বইপত্রের মধ্যে রয়েছে ভোটেলিটি অ্যান্ড গ্রোথ, আন্ডারস্ট্যান্ডিং পোভার্টি, মেকিং এইড ওয়ার্ক, অ্যা শর্টহিস্ট্রি অব পোভার্টি মেজারমেন্টস।
ভারতের শিক্ষা ও টীকাকরণ কর্মসূচী নিয়ে অভিজিৎ বিনায়কের গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। এইসব কাজের ক্ষেত্রে বিনায়ক ও তার সহযোগীরা ‘যথেচ্ছ চয়ন নিয়ন্ত্রণ নিরীক্ষা’ বা র্যােনডমাইসড কনট্রোলড ট্রায়াল নামের এক ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যার পক্ষে বিপক্ষে অনেক তর্কহয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে মিশেল ক্রেমার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে কেনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেতাঁর গবেষণা করেন। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেতাঁর গবেষণায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন অভিজিৎ ও এস্থার। এবার একসাথেই এই “র্যা নডমাইসড কনট্রোলড ট্রায়াল” নিয়ে কাজ করা তিনজনের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি।
গবেষণা থেকে তাঁর মনে হয়েছে ভারতে শিক্ষকেরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মানের উন্নতির চেয়ে মেধাবীদের বিকাশ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সকল ছাত্রছাত্রীর মানের অল্প উন্নতিও যে বড় প্রাপ্তি সেটা অনেক সময়েই শিক্ষকদের মাথায় থাকে না। সিলেবাস শেষ করার দিকেই তাদের মূল নজর থাকে। সৃজনশীল শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা কম। কঠিন পরীক্ষা বৈতরণী পেরনো ও চাকরি মুখীনতা এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য বলে এই গবেষণা থেকে তাঁর মনে হয়েছে।
নোটবন্দীর পরে এর বিরুদ্ধে অভিজিৎ জোরালো মত প্রকাশ করেছিলেন। মোদি – ২ সরকারের নীতিমালা নিয়েও তিনি তাঁর অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। ২০১৮ সালে যে তেরোজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ভারতীয় অর্থনীতির ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন, তার একজন ছিলেন অভিজিৎ। এই ম্যানিফেস্টো ভারতের অর্থনীতির উন্নতির জন্য বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে সরকারের ব্যয় বরাদ্দের ওপর জোর দিয়েছিল। সম্প্রীতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে ভারতের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে জনগণের হাতে অনেক বেশি অর্থ আসা দরকার। এজন্য মনরেগার মতো প্রকল্পে মজুরি বাড়ানোর প্রয়োজনিয়তার কথা বলেন তিনি।