স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের শাসন নিয়ে ভগৎ সিং-এর ভাবনা আমাদের রাস্তা দেখাচ্ছে : দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

“ভগৎ সিং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুটো কাজ এক সাথে করেছিলেন। একদিকে দেশের স্বাধীনতা কিভাবে আসবে তার জন্য ভেবেছিলেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, দেশের মানুষকে বিশেষত নবীন প্রজন্মকে তাতে যুক্ত করেছিলেন। অপরদিকে সেই স্বাধীনতা কেমন হবে, স্বাধীনতার পর আমাদের সমাজ কিরকম হওয়া উচিত — তার উপরেও তিনি ভাবনা চিন্তা করেছিলেন। দেখা গেছে স্বাধীনতার জন্য অনেকেই সংগ্রাম করেছিলেন কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষকেমন হতে পারে তা নিয়ে তাঁদের তেমন কোনো কল্পনা ছিলো না। তাই ভগৎ সিং স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাকে সফল করে তুলতে আজও দেশের মানুষ লড়াই করে চলেছে।” গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাজস্থানের ঝুনঝুনুতে শহীদ ই আজম, ভগত সিং-এর ১১২তম জন্মদিবসে আয়োজিত এক সেমিনারে এ বিষয়টি তুলে ধরলেন সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আজকে অনেকেই স্বাধীন ভারতবর্ষনিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলে থাকেন, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের কোনো ভুমিকাই ছিলো না।

আজকের দিনে ভগৎ সিং এর প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ক এই সেমিনারে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, দেশের বুকে যে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালে সারা পৃথিবীতে তার বিকাশ ঘটেছিলো। যেমনটা ইতালী, জার্মানী প্রভৃতি দেশে দেখা গিয়েছিলো। তখন আমাদের দেশেও সেই শক্তি সংগঠিত হতে শুরু করেছিলো। ভগৎ সিং সেই দিকটাকে লক্ষ্য করেছিলেন। আজ ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদের তিনটি বৈশিষ্ঠ রয়েছে।

প্রথমত, দেশের মধ্যে এমন এক পুঁজিবাদ দেখা যাচ্ছে যারা সমস্ত সম্পদ লুঠ করছে, জল-জঙ্গল- জমি দখল করছে। আমরা দেখছি দেশের মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে রয়েছে সিংহভাগ সম্পত্তির মালিকানা। উৎপাদনের বড় অংশ তাদের কব্জায় চলে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের এই স্বরূপ ভগৎ সিং সেই সময়ই চিহ্নিত করেছিলেন। পুরানো জমিদারের পাশাপাশি এই পুঁজিবাদের কথাটাও তিনি বলেছিলেন। সেই সময় ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই চলাকালে এই কথাটা বলা সহজ ছিলো না যে, সাদা চামড়ার ইংরেজ চলে গেলে যদি কালো চামড়ার ইংরেজের হাতে ক্ষমতা আসে তথা পুঁজিপতিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় তাহলে দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে না। এই কথাটা সে সময় বলা খুবই কঠিন ছিলো। কারণ মানুষ তখন ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলো, ইংরেজ চলে গেলে ক্ষমতা কার হাতে যাবে এই চিন্তা করেছিলেন ভগৎ সিং। আজ দেশে পুঁজিপতিদের যে খোলাখুলি রাজত্ব করতে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পর এমনটা কোনোদিনই দেখা যায়নি। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ সফরে যাচ্ছেন তখন তিনি মন্ত্রীদের নিয়ে যাচ্ছেন না, দেশের বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে তাঁদের ব্যবসা বানিজ্য কিভাবে বাড়বে সেই স্বার্থ রক্ষার জন্য সহযোগিতা করছেন। যেমন আমেরিকায় দেখা যাচ্ছে একজন পুঁজিপতি সেই দেশের রাস্ট্রপতি হয়ে গেছেন। যদিও আমাদের দেশে তেমনটা ঘটেনি, কারণ মোদীকে একজন পুঁজিপতি বলা চলে না, তিনি হলেন তাদের একজন প্রতিনিধি। কিন্তু আমেরিকায় সেই দেশকে লুঠ করতে করতে একজন পুঁজিপতির হাতে ক্ষমতা চলে গেলো। এই বিপদটা ভগৎ সিং বুঝতে পেরেছিলেন।

jhunjhunu

 

দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িকতার বিপদ। এটা কেবলমাত্র দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়, ভারতের যে পরিচিতি তাকে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। আমাদের দেশ যেভাবে তৈরি হয়েছে, দেশের সংস্কৃতি যেভাবে সৃষ্টি হয়েছে তাতে যদি এভাবে বিচার করা হয় যে, এর মধ্যে কতটা ভাগ হিন্দুর আর কতটা মুসলিমের তাহলে দেশের আর কিছুই বেঁচে থাকবে না। আজ ধর্মের নামে দেশকে বিভাজনের চেষ্টা, দেশকে একপ্রকার বন্দী করে রাখার অপচেষ্টা — সাম্প্রদায়িকতার এই চক্রান্ত ভগৎ সিং সেই সময় দেখতে পেয়েছিলেন, সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনীতির মেলবন্ধনের বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করেছিলেন। আজ আমাদের সামনে একটা বড় বিপদ এসেছে। বিজেপি দেশকে পিছনের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে ওরা বলছে এনআরসি চালু করা হবে ১৯৫১ সালের ভিত্তিতে। এটা বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। স্বাধীনতার সময়কালে সবচেয়ে যে ক্ষতি আমাদের হয়েছিলো তা হলো সাম্প্রদায়িকতার উত্থান। স্বাধীনতার আন্দোলনে সব ধর্মের,সব ভাষার একটা একতা গড়ে উঠেছিলো। পাশাপাশি সেই সময় সাম্প্রদায়িকতার বিষ, তথা বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিলো, দেশ বিভক্ত হয়েছিলো। কিন্তু সেই বিভাজন কোনো ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি, ভৌগলিক ভিত্তিতে হয়েছিলো। বাংলা ও পাঞ্জাব যেখানে ছিলো মিশ্র জনগণের বসবাস সেটা ভাগ হয়ে গেলো। কাশ্মীরে ছিলো মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস, সেটা ভারতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেলো। ফ্যাসিবাদীরা ভেবেছিলো ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ঘটবে, সেটা কিন্তু পুরোপুরি হলো না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাগ হয়ে বাংলাদেশ হলো। একই ধর্মের দেশ হলেও ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হয়ে গেলো। ফলে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের দেশের ইতিহাসে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মাণ অর্থহীন বলে প্রমাণিত। বিজেপি বলছে সেই সময় তারা যে কাজটা করতে পারেনি, সেটা আজ তারা করবে। এজন্য ওরা নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে। এর ফলে যাতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে যত হিন্দু আছে তারা এ দেশে চলে আসবে, আর এদেশে যত মুসলিম আছে তাঁদের ঐ দেশে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আর সেটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে রাখা হবে। এইভাবে স্বাধীনতার সময়কালে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিলো এখন সেটাকে ওরা সম্পূর্ণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ভগৎ সিং সে সময় এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে প্রচার করেছিলেন এবং তার ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক সহ ব্যাপক সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আজকের দিনে ভগৎ সিং-এর সেই কাজটাকেই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয়ত, যে প্রশ্নটা রয়েছে তা হলো, দেশের সংবিধান সম্পর্কে। কার্যত ওরা সংবিধানকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। বিজেপি মনে করছে মনুস্মৃতি হলো সঠিক সংবিধান — একে আইন হিসাবে ওরা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ জন্যই দেখা যাচ্ছে দলিত, আদিবাসী, মহিলাদের উপর হামলা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম স্বচ্ছ ভারত অভিযান। যার নামে এই রাজস্থানের বুকে জাফর খানকে হত্যা করা হলো। মহিলাদের ভিডিওগ্রাফি করা, তাদের অপমানিত করার প্রতিবাদের জন্য তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। এভাবে ওরা মুসলিমদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করতে চায়। ভগৎ সিং-এর রচনা অধ্যয়ন করলে আমরা দেখতে পাবো যে, কেবলমাত্র ইংরেজ শাসন নয়, জাতিপ্রথা, অস্পৃশ্যতার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করার কথা বলেছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে “গঙ্গা যমুনা তহজিব” (গঙ্গা যমুনার এক মিশ্র সংস্কৃতি)-কে রক্ষা করার কথা বলেছিলেন।

এই তিনটি প্রশ্নেই ভগৎ সিং জনগণের ঐক্য গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে কেবল আইন প্রণয়ন করে নয়, শ্রমিক-কৃষকের যে ঐক্য গড়ে উঠবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরেছিলেন। আগামীদিনে এক ভয়ংকর বিপদের সামনে আমরা রয়েছি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই আসলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। এর অর্থ সংবিধান, মানবাধিকারকে লাগাতার ধ্বংস করার বিরুদ্ধে লড়াই। যেমন কাশ্মীরে অঘোষিত জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছে। সেখানে মোবাইল, ইন্টারনেট বন্ধ। এই যে সেদিন কাশ্মীর সহ সমগ্র উত্তর ভারতে ভূমিকম্প হল, মুজ্জাফরবাদ তার একটা কেন্দ্র ছিলো। কিন্তু কাশ্মীরের মানুষ তার কোন খবর জানতে পারলো না। কাশ্মীরে ১১ বছরের কিশোর জেলে, তার কোনো খবর জানা যাবে না। স্বাধীনতার মানে কেবল ৫ বছরে একবার ভোট দেওয়া নয়, প্রতিদিন স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য লড়াইয়ের কথা ভগৎ সিং বলেছিলেন। সেই স্বাধীনতা-একতা-সংগ্রামের প্রতীক হলেন ভগৎ সিং। কেবল আমাদের দেশেই নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ সমগ্র উপমহাদেশের মানুষ তাকে এই মান্যতা দিয়ে থাকে।

সেমিনারে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) নেতা ফুলচাঁদ বরবর, বিদ্যাধর গিল, বিশিষ্ঠ নাগরিক ডঃ ঘাসিরাম, সিপিআই(এমএল) নেতা মহেন্দ্র চৌধুরী, রাজারাম সিং, কবিতা কৃষ্ণান, মহঃ সেলিম প্রমূখ।

খণ্ড-26
সংখ্যা-31