প্রতিবেদন
ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে গণ আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ

বাংলাদেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর ছাত্র আবরারকে হত্যা করা হয় গত ৭ অক্টোবর, ২০১৯-এ। হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবরারের সহপাঠীরা দাবি করেন ফেসবুকে হাসিনা সরকারের সম্পর্কে সমালোচনামূলক লেখালেখির জন্যই তাকে আওয়ামী লিগের ছাত্রশাখা খুন করেছে। ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিহত আবরার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের সরকারি সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক দলিল স্বাক্ষরের সমালোচনা করেন। ভারতকে মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া, ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশ থেকে এলপিজি আমদানি করার বিষয়গুলি নিয়ে তিনি সেখানে সমালোচনা করেছিলেন।

ফেসবুকে বাইশ বছরের আবরার ফাহাদ লেখেন –
‘‘১. ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।”

আবরার হত্যার পর শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে কেউ কাউকে খবর দিতে পারছিলেন না। ভয়ের কারণ, যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেখে ফেলে। এজন্য ১৭তম ব্যাচের কয়েকজন একত্রিত হয়ে একটি মেসেজ লেখেন। একই সময় সেই টেক্সটটি বুয়েটের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন সহ সব ক’টি পেজ ও গ্রুপে তারা পোস্ট করেন। এরপর সবাই ধীরে ধীরে ঘটনাটি জানতে পারেন। এই হত্যার সাথে ২২ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জড়িত। আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। হত্যার অভিযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শাখা ছাত্রলীগের দশ সদস্যকে আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

অচিরেই আবরার হত্যার প্রতিবাদে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে এবং বুয়েটের শিক্ষার্থীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়। বুয়েটে শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবিপূরণের লক্ষ্যে অবস্থান শুরু করে।

bangladesh

 

তাদের দাবি ছিল —

  • খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শনাক্তকৃত খুনিদের বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে।
  • মামলা চলাকালীন সকল খরচ এবং আবরারের পরিবারের সকল ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে।
  • দায়েরকৃত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করার জন্য বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের আপডেট করতে হবে।
  • বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি তার জবাবদিহি করতে হবে।
  • আবাসিক হলগুলোতে পীড়ন নামানো এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সকল প্রকার শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনকে জড়িত সকল সন্ত্রাসীর ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে।
  • পূর্বে ঘটা এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তীতে ঘটা যেকোনো ঘটনা প্রকাশের জন্য একটা কমন প্ল্যাটফর্ম (কোনো সাইট বা ফরম) থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • নিরাপত্তার স্বার্থে সবগুলো হলের প্রত্যেক ফ্লোরের সবগুলা উইংয়ের দুপাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী সন্ত্রাস-বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের গোড়ায় একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও আবরার হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন সামিল হন। খুলনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসের সামনে মানববন্ধন গঠন করে এবং আবরার হত্যার প্রতিবাদ জানায়। আবরার ফাহাদের বীভৎস হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ জানিয়ে আধ ঘণ্টা রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সিলেটের ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে একটি মানববন্ধন করেন।পরে শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল, বগুড়া, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, যশোর, পটুয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়িতে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে।

আন্দোলনের মুখে বুয়েট প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা জানিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে —

  • বুয়েটে দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
  • বুয়েট কর্তৃপক্ষ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় ১৯ আসামীকে সাময়িক বহিষ্কার করা ও মূল চার্জশিটে যারা অভিযুক্ত হবে, তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা।
  • আবরার হত্যা মামলার সব খরচ ও তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবে বুয়েট প্রশাসন।
  • পূর্বে ঘটে যাওয়া সকল নির্যাতনের ঘটনার বিচার করবে এবং অনলাইনে অভিযোগ জমা দেওয়ার প্লাটফর্ম করবে।
  • প্রত্যেক হলে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো এবং মনিটরের ব্যবস্থা করা।

আবরার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শাসক দল ও তার ছাত্রশাখার দাদাগিরি, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তি, বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। গোটা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। ছাত্র ও গণ আন্দোলনের ঢেউ এর খবর স্থান পেয়েছে এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি, আল জাজিরা, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ান, দ্য হিন্দু, এবিসি নিউজ সহ বিশ্বের নামকরা সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তা নিয়ে চর্চা অব্যাহত।

বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের রাজনীতিতে এই পরিঘটনা আগামীদিনে বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-33