প্রয়াত নেতা বিমান বিশ্বাস স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

ফেরারি ফৌজ

১৯৭৮ সাল। তখন আমি নদীয়ায়। কোনো একদিন প্রথম কালীনগর গ্রামে যাচ্ছি। ১৯৭৪ সাল থেকে কালীনগরের নাম শুনছিলাম। মহাদেব মুখার্জী তাঁর ছেলেমানুষী লেখা লিখছেন ‘কালীনগরের লড়াই ভিয়েতনাম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে’। আর সেই লড়াইয়ের অন্যতম এক যোদ্ধার সাথে কালীনগরে রাতে দেখা হবে। সকাল থেকে মনের ভিতর উত্তেজনা -- কখন দেখা হবে। সময় কাটতে চাইছে না। কৃষ্ণনগর থেকে শেষ বাসে চড়ে বাঙালঝি বাস স্টপেজে নেমে বাঁ দিকের কাঁচা রাস্তা ধরে জলঙ্গী নদীর পাড়ে পৌঁছালাম। মাঝি জানতো রাতে মধুর পার্টির লোকজন আসে। এপার থেকে হাঁক দিলাম, ওপার থেকে শ্যামভাই নৌকা নিয়ে হাজির হলেন। তারপর আবার নৌকা ঘুরিয়ে ওপারে কালীনগর ঘাটে নিয়ে গেলেন। কমরেড নস্কর এসে একটা বাড়িতে নিয়ে গেলেন। খাওয়া হয়ে গেছে, বিমানের অপেক্ষায় বসে আছি। বেশি রাতে বিমান এলো। এরপর অনেক হাঁটা কথা পথ চলা। বিমান ছিল জন্মসূত্রে মুসলমান। কিন্তু দীর্ঘ পথ চলায় আচার-আচরণে খাদ্যাভাসে কখনও কোনো সংস্কার নজরে পড়েনি। কমিউনিস্ট আন্দোলন ওকে ধর্ম জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠার শিক্ষা দিয়েছিল।

১৯৭৯-তে চাপড়ায় ভয়ঙ্কর দাঙ্গা। দাঙ্গা প্রতিরোধে ওর সাহসিকতা ও নেতৃত্বে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার এক নজিরবিহীন ইতিহাসের সাক্ষী হলাম আমরা। সেই সময় নদীয়া জেলা পার্টির সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত কমরেড সুদর্শন বসু।

ইতিমধ্যে বিমানের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ওর চাপড়া স্কুলের শিক্ষক কামাক্ষ্যাদা, সঞ্জয়দা এদের মাধ্যমে কৃষ্ণনগর টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যাপক সত্যদা, সরকারী কর্মচারি আন্দোলনের নেতা সাধন রায়, বন্দিমুক্তি কমিটির অমল তরফদারের সাথে যোগাযোগ করে শান্তি কমিটি গঠন করা হল। এই কমিটিতে পার্টির পক্ষ থেকে স্থানীয় মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে আমাকে যুক্ত করা হল। আমারও খোলা কাজের হাতেখড়ি শুরু হল।

এই সময় নদীয়া জেলার গ্রাম শহর সর্বত্র পার্টির অগ্রগতির উল্লম্ফন ঘটতে থাকে। খাস জমি, বেনামী জমি, চরের জমি দখল ও বণ্টন হতে থাকে। আক্রমণ প্রতি আক্রমণ ঘটছে। একদিকে শত্রুরা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে, আবার মরণ কামড়ও দিচ্ছে। শত্রুর আক্রমণে শহীদ হলেন জালাল, ফজলু সহ কৃষক আন্দোলনের বেশ কয়েক জন নেতা।

পুলিশ মধু বাগের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র আইন সহ একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করে। তখন থেকেই মধু বাগের ছদ্ম নাম ‘বিমান বিশ্বাস’ই প্রকৃত নাম হয়ে ওঠে। আইনজ্ঞদের পরামর্শ ছিল গ্রেপ্তারি এড়িয়ে চলার। আর এইভাবেই এড়িয়ে চলতে চলতে তখন থেকেই ফেরার। এখন সারা জীবনের মতো সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে ফেরারি ফৌজ হিসাবেই তিনি থেকে গেলেন। কমরেড বিমান বিশ্বাস লাল সেলাম।

-- নবেন্দু দাশগুপ্ত


বিমান বিশ্বাস লাল সেলাম

নদীয়া জেলার বুকে বিপ্লবী বামপন্থার ভিত্তিভূমি নির্মাণের অগ্রণী নেতৃত্ব এবং সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্য কমরেড বিমান বিশ্বাস ১১ অক্টোবর ২০১৯ সকাল ৮টায় প্রয়াত হন।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর কিডনির গুরুতর রোগের চিকিৎসার জন্য তিনি কলকাতায় আসছিলেন। সে সময় আকস্মিকভাবে পড়ে গিয়ে তাঁর কোমরের নীচের হাড় ভেঙ্গে যায়। তারপর থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ছাত্রজীবনেই তিনি নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে, দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকশ্রেণীকে জাগিয়ে তোলার কর্মকাণ্ডে সারাটা জীবন ধরে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১০৭০ দশক এবং তার পরবর্তী সময়কালে দীর্ঘ সময় ধরে গ্রাম গ্রামান্তরে, জেলখানায় তিনি জোতদার-দালাল শ্রেণী ও শাসকের খুনী বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলা করেছেন। বিরাট এলাকা জুড়ে তিনি এবং তাঁর পরিচালনায় এক গণপার্টি সংগঠন পরিণত হয়েছিল জনগণের শত্রুদের কাছে ‘ত্রাস’ -- পাশাপাশি গরিব মানুষের কাছে নয়নের মণি।

নদীয়া জেলার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্বে বিপ্লবী ভূমিসংস্কারের আন্দোলন শত শত একর পরিমাণ খাস-বেনামী জমি উদ্ধার করে ভূমিহীনদের বিলি করা, বাস্তু স্থাপন করা, সশস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার দীর্ঘ কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন প্রকৃতই যেন এক “জননায়ক”। সমস্ত আধিপত্য ধ্বংস করে গরিব-খেটেখাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বজন গ্রহণীয় এক জননেতা।

১৯৭৮ সালে চাপড়া ব্লক সন্নিহিত এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্তের বিরুদ্ধে সব ধর্মের-সব জাতির কৃষক জনগণের সংগ্রামী একতা গড়ে তুলেছিলেন। দৃষ্টান্তমূলকভাবে গড়ে উঠেছিল সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ। ৪০ বছর পর বর্তমান সময়ে আবারও নতুন করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সেই চাপড়ার বুকেই বামপন্থীদের যুক্ত সম্প্রীতি মিছিলের সামনের সারিতে সোচ্চার থেকেছেন।

অর্ধ শতাব্দী সময়কালব্যাপী তাঁর কমিউনিস্ট বিপ্লবী জীবনের অবসান হল। কিন্তু অবিনশ্বর হয়ে থাকবে তাঁর একরোখা অথচ গণমুখী সংগ্রামী কর্মকাণ্ডের স্মৃতি, বিপ্লবী স্পিরিটের মর্মবাণী।

কমরেড বিমান বিশ্বাস অমর রহে। তাঁকে জানাই লাখো লাখো লাল সেলাম।

-- জয়তু দেশমুখ

 


চিরবিদায় বিমান বিশ্বাস

১২ অক্টোবর তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় পার্টির রাজ্য দপ্তরে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানান পার্টির রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল সহ কমরেডের পথ চলার সঙ্গী পার্টির নেতা কর্মীরা। তারপর ইন্টারন্যাশনাল গানের সাথে পা মিলিয়ে পার্টি কমরেডদের মিছিল প্রয়াত কমরেডের দেহ নিয়ে পৌঁছায় নীলরতন সরকার হাসপাতালে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার স্বার্থে সেখানেই তাঁর মরদেহ দান করা হয়।

বিভিন্ন জেলা ও আঞ্চলিক পার্টি কার্যালয়ে প্রয়াত কমরেডের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয়। নদীয়ার জেলা অফিসে ১১ তারিখেই স্মরণসভা আয়োজিত হয় কমরেডকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, যে জেলায় দীর্ঘদিন জেলা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন কমরেড বিমান বিশ্বাস। নদীয়া জেলার কৃষক আন্দোলনের সংগঠক নেতা হিসেবে কমরেডের অবিস্মরণীয় অবদানকে সেখানে স্মরণ করেন তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের উত্তরাধিকারীরা।

 

নকশালবাড়ি আন্দোলনের নদীয়া জেলার বীর যোদ্ধা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির নেতা কমরেড বিমান বিশ্বাস লাল সেলাম

যাঁকে ঘিরে আছে অসংখ্য বীর গাথা। সশস্ত্র বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের মিথ বিমান বিশ্বাস ওরফে “মধু বাগ”-এর নাম নদীয়ার প্রতিটি ধূলিকণার সাথে মিশে আছে।

জলঙ্গী নদীর প্রতিটি বাঁক চেনে বিমানকে। ধুবুলিয়ার কালীনগরের ভূমিপুত্র আমাদের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক পদক্ষেপে তাঁর সহযোগিতায় আমরা ঋদ্ধ হয়েছি। গ্রাম পরিক্রমা সৃজন উৎসব সবখানেই তাঁর আন্তরিক ছোঁয়া লেগে আছে। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ তাঁকে জানায় বিদায়ী রক্তিম অভিবাদন। অমর হোক তাঁর কীর্তি।

-- নীতীশ রায়

খণ্ড-26
সংখ্যা-32