খবরা-খবর
দেশজোড়া নজিরবিহীন আর্থিক সঙ্কট ও জনগণের দুর্দশা : দিল্লিতে বাম দলগুলির কনভেনশন

সম্প্রতি গত ২০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে পাঁচটি বামদলের এক সর্বভারতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল।

সিপিআই, সিপিআই(এম), সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক দলের নেতৃবৃন্দ এই কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। এছাড়া বক্তব্য রাখেন সিপিআই সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

এই কনভেনশনের বিষয়বস্তু ছিল ভারতের ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংকট এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশা।

conv del

এই কনভেনশনের প্রস্তাবনায় বলা হয় —

  • আমাদের দেশ বর্তমানে এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটের করাল গ্রাসে পড়েছে। সরকারের তরফে যে সমস্ত তথ্য খানিকটা চেপে, খানিকটা অদল-বদল করে, বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে এমনকি সেখানেও সংকটের ছবিটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। অন্যান্য নানা তথ্য পরিসংখ্যান থেকে এই আর্থিক সংকটের আরও গভীর এবং ব্যাপ্ত এক ছবিই ফুটে উঠছে।
  • যে পরিমাণ মানুষ এই সময়ে কাজ হারিয়েছেন তা আগে কখনো দেখা যায়নি। মহিলারা এই সংকটের দ্বারা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাজারে বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা ভয়ংকরভাবে কমেছে। গাড়ি থেকে শুরু করে জামা কাপড়, এমনকি চা বিস্কুটের এই দেশে বিস্কুটের বিক্রিও ভীষণভাবে মার খেয়েছে।
  • মোদি সরকার প্রথম দিকে এই সংকট কে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিল। এখন ধীরে ধীরে তারাও মেনে নিতে শুরু করেছে দেশে একটা আর্থিক সংকট চলছে। যদিও সরকার এটা কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি নয় যে নোটবন্দি বা অপরিকল্পিতভাবে যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিয়ে হঠাৎ করে জিএসটি চালু করে দেওয়ার মতন ব্যাপারগুলোর জন্যই আর্থিক সংকট এইরকম ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে, যা বেকারত্বের হার ভয়াবহ করে তুলেছে, বাড়িয়ে দিয়েছে জিনিসপত্রের দাম এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সংকটগ্রস্ত করে তুলেছে।
  • সঙ্কটের সমাধান করার করার পরিবর্তেমোদি সরকার নানাভাবে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে সঙ্কট থেকে মানুষের নজর সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
  • যে সামান্য আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে তার সমস্ত সুফল আবার নিয়ে যাচ্ছে ভারতের অতি ধনী কয়েকটি গোষ্ঠী। মোদি সরকারের স্যাঙাতি পুঁজিবাদ (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) ঘেঁষা নীতিমালার জন্য এই ব্যাপারটা ঘটছে। সম্প্রতি অতি ধনীদের জন্য আয়করে যে সারচার্জ বসানো হয়েছিল তা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছে সরকার। ভারতে অসাম্য যেভাবে বাড়ছে গোটা পৃথিবীতেই তার তুলনা মেলা ভার। অসাম্যের এই ভয়ঙ্কর বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে নব্য উদারনৈতিক (নিও লিবারাল) আর্থিক সংস্কার।
  • এই আর্থিক সংকটের পেছনে আছে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার অবনতি ও দেশীয় বাজারের সংকোচন। বিশ্বজুড়েই আর্থিক সংকট দেখা যাচ্ছে এবং এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে সংকটের মোকাবিলা করার জন্য দরকার দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে যতটা সম্ভব ব্যাপক করে তোলা। যতক্ষণ পর্যন্ত না দেশের বেশিরভাগ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততক্ষণ অভ্যন্তরীণ বাজারের বিকাশ সম্ভব নয়। অভ্যন্তরীণ বাজারের বিকাশের জন্য দরকার সরকারী বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ, নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা ইত্যাদি।
  • এসব করার পরিবর্তেমোদি সরকার বেছে নিয়েছে পুঁজিপতিদের নানারকম ছাড় ও সুবিধা দেবার নীতিমালা। এর মধ্যে দিয়ে তারা আশা করছে বিনিয়োগ বাড়বে, রপ্তানি বাড়বে এবং রপ্তানীর হাত ধরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। সারা বিশ্বে যখন আর্থিক মন্দা দেখা যাচ্ছে তখন রপ্তানির মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, এটা নেহাতই একটা কষ্টকল্পনা।
  • অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ক্ষেত্রে সত্তর হাজার কোটি টাকা সাহায্য করা হবে। কিন্তু মানুষের হাতে ঘরবাড়ি বা জমি কেনার যথেষ্ট টাকা নেই বলেই যে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, সেই সত্য থেকে সরকার মুখ ঘুরিয়ে থাকতে চাইছে।
  • বাম দলগুলো সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাংকের থেকে সরকার যে ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা নিয়েছে সেটা বিনিয়োগ করা হোক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে এবং ঘরোয়া বাজার বিকাশের জন্য। এর পরিবর্তে মোদি সরকার বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করছে নোটবন্দি জিএসটি ইত্যাদি করার জন্য রাজস্বর যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণ করার কাজে।
conv delhi

এই কনভেনশন দাবি তুলছে —

  • কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারী ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
  • যতক্ষণ পর্যন্ত না বেকারদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক চাকরির সুযোগ সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ তাদের মাসে ১৮০০০ টাকা করে বেকার ভাতা দিতে হবে ।
  • যে সমস্ত শ্রমিকেরা কাজ হারিয়েছেন তাদের বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ সরকারকে দিতে হবে।
  • রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারীকরণের নীতি থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
  • প্রতিরক্ষা এবং তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের যে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে সেখান থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
  • বিএসএনএল, বিভিন্ন প্রতিরক্ষা কারখানা, ভারতীয় রেলওয়ে, এয়ার ইন্ডিয়া প্রভৃতির বড় ধরনের বেসরকারীকরণের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে।
  • মনরেগা প্রকল্পকে আরো বাড়াতে হবে এবং অন্তত ন্যূনতম মজুরির হার এ বছরে দুশো দিন কাজ দিতে হবে
  • কৃষকদের এককালীন ঋণ মকুবের সুবিধা দিতে হবে এবং কৃষকদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার জন্য ন্যূনতম ফসলের মূল্য ঘোষণা করতে হবে, যেটা হবে উৎপাদন খরচের অন্তত দেড় গুণ।
  • বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য পেনশন কে মাসে অন্তত ৩০০০ টাকা করতে হবে।

এই কনভেনশন এই সমস্ত দাবি জোরদার করে তোলার জন্য মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আগামী অক্টোবর মাসের ১০ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি নেওয়ার কথা ঘোষণা করছে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-30