বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রসমাজ ও আকাদেমিক সমাজের ওপর সঙ্ঘ-বিজেপির হামলা অবিরত চলছে। সম্প্রতি জেএনইউ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নির্বাচনে আরও একবার বামপন্থী ছাত্রছাত্রীদের জয় তারা আটকাতে পারেনি, ছাত্রসমাজ বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলিকে সোৎসাহ সমর্থন দিয়ে জিতিয়েছে। জেএনইউ-তে ব্যর্থহয়ে সঙ্ঘ পরিবার দেশের অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী ক্যাম্পাস কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববদ্যালয়ের ওপর নজর দেয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে তারা আরও একবার তাদের ছাত্র-বিরোধী শিক্ষা-বিরোধী ফাসিস্ত চেহারা প্রকাশ করে দিয়েছে।
সাংসদ তথা মোদির মন্ত্রীসভার প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং অগ্নিমিত্রা পাল — এই দুজন বিজেপি নেতানেত্রী তাঁদের সিকিউরিটি গার্ডদের সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার মধ্যে দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এবং মোদি সরকারের নীতিগুলির বিরুদ্ধে, বিশেষত এনআরসির শয়তানি ছকের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীরা শ্লোগান তুললে মন্ত্রী মহোদয় উস্কানিমূলক মন্তব্য ও ছাত্রীদের প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণযৌনহিংসামূলক মন্তব্য দিয়ে তাদের মোকাবিলা করেন। ঠগবাজ বাবুল সুপ্রিয় ও প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়, উপাচার্য ছুটে আসেন। মোদি মন্ত্রীসভার দুর্বিনীত অভব্য প্রতিমন্ত্রীর দ্বারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হন উপাচার্য, প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রীকে ঘেরাও ক’রে তার কুমন্তব্যগুলির জন্য ক্ষমা চাইতে বলে। কিন্তু দ্রুতই ছুটে আসেন রাজ্যপাল। রাজ্য সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ক্যাম্পাসে ঢোকেন তিনি এবং মন্ত্রীকে টেনে বের করে নিয়ে যান। এবং বেশ কিছুক্ষণ বিজেপি ও এবিভিপির গুন্ডাবাহিনী অবাধ ছাড় পায়, তারা ক্যাম্পাসে ও স্টুডেন্টস ইউনিয়ন রুমে ধ্বংসলীলা চালায়।
এটুকুও যেন যথেষ্ট ছিল না। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ সভাপতি দিলীপ ঘোষ মহাশয়, যিনি একজন সাংসদও বটে, এবার লাফিয়ে পড়েন এবং তাঁর দলীয় কর্মীদের ডাক দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে, যা তাঁর ভাষায় দেশদ্রোহী কার্যকলাপের ঘাঁটি, ‘অপারেশন বালাকোট’ চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে। বিজেপি-নেতৃত্বসুলভ সহজাত নারীবিদ্বেষী মানসিকতা প্রকাশ ক’রে শ্রীমান ঘোষ যাদবপুরের ছাত্রীদের বাজে ধরণের মেয়ে অভিধায় লজ্জা দিতে চান। অথচ বিজেপির প্রচারদল ও ক্ষমতাশালী মিডিয়ার বৃহৎ অংশের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের হামলাকারী আর বিজেপি নেতাদের আক্রান্ত হিসেবে তুলে ধরে প্রচার চলতে থাকে। তারা ভাবে যে বানোনো ভিডিও ছড়িয়ে ও ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ তকমা দিয়ে যেভাবে জেএনইউ ও সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিল ঠিক সেভাবে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদেরও বদনাম করে দেগে দেবে।
কিন্তু জেএনইউ-এর মতো যাদবপুরও বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রামে রুখে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসে বাবুল সুপ্রিয়র ঠগবাজি ও এবিভিপি-বিজেপির গুন্ডাগর্দির ঠিক পরের সন্ধ্যায় যাদবপুর ও অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ও প্রাক্তনী এক সুবিশাল সংহতি যাত্রায় সামিল হয়। মোদি-শাহ জমানার স্বৈরাচারী হামলাকে প্রতিহত করার দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা দেন তাঁরা, শ্লোগানে, গানে (ইতালীয় ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনের প্রতীকে উন্নীত হওয়া গান ‘বেল্লা জ্জাও জ্জাও’ তাঁদের সৃজনশীল পুনর্নির্মাণে হয়ে যায় ‘বাবুল যাও যাও’)। ২৩ সেপ্টেম্বর যখন দু’একশ এবিভিপি গুণ্ডার দল “দেশদ্রোহীদের চামড়া তুলে নেওয়ার” ডাক দিয়ে যাদবপুর অভিযানের হুমকি দেয় (দিলীপ ঘোষের ভাষায় অপারেশন বালাকোট) তখন শিক্ষক ও পড়ুয়ারা হাজার হাজার সংখ্যায় জড়ো হয়ে ক্যাম্পাস গেটের সামনে মানব-বন্ধন গড়ে তোলেন শ্লোগানে ব্যানারে তাঁদের দৃঢ় প্রতিরোধের সঙ্কল্প ঘোষণা দিয়ে : জান থাকতে হারব না, ফ্যাসিবাদ মানব না।
যাদবপুরের প্রতিবাদ পাঁচ বছর আগের ঐতিহাসিক ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। সেই সময় যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা কয়েক মাস ধরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়েছিল পুলিশী নির্মমতা ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে। অনড় ও উদ্ধত টিএমসি সরকারকে তাঁরা বাধ্য করেছিলেন পিছু হঠে উপাচার্যকে অপসারণ করতে। এখন যুদ্ধের সূচীমুখ রয়েছে বিজেপির দাপাদাপির বিরুদ্ধে এবং দেশব্যাপী বৃহত্তর ক্ষেত্রজুড়ে গণতন্ত্রের সংগ্রামে সেই সুর অনুরণিত হচ্ছে।
বিগত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির চোখধাঁধানো ফল গৈরিক বাহিনীকে বাংলায় দাপাদাপি করতে শক্তি যুগিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের বিপজ্জনক নির্বাচনী ক্ষয়, বিশেষত মমতা ব্যানার্জী সরকারের অপশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার নামে বাম গণভিত্তির একটা বড় অংশ বিজেপির দিকে চলে যাওয়া বিজেপি ক্যাম্পকে আরও চাঙ্গা করে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা যে প্রতিরোধ খাড়া করলেন তা জনতার ক্ষমতার প্রতি আরও একবার ভরসা জাগিয়ে ফ্যাসিবাদের ষাঁড়টির সিং ধরে ধরাশায়ী করার দৃঢ় সংকল্প ছড়িয়ে দিয়েছে।