সম্পাদকীয়
বিতর্ক যখন গণতান্ত্রিক অধিকার ও সৌজন্য নিয়ে

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য ঘটনাবলীর ঘনঘটায় ঝড় উঠেছে বহু তর্ক-বিতর্কের। তোলপাড় হচ্ছে মিডিয়া থেকে নেট দুনিয়া। তর্কে যেমন বর্ণময় ফুলঝুড়ি আছে, তেমনি ছুটছে কুৎসিত তুবড়ি। নানা তর্কাতর্কি না হয় নানা পরিসরে চলুক, তীব্র তীক্ষ্ণভাবে চলুক। এটাও ঠিক সব তর্ক সুস্থভাবে চলবে আশাপ্রদ নাও হতে পারে। কারণ দৃষ্টিভঙ্গী, সাধারণ ন্যায়নীতিবোধ, শিক্ষা-সভ্যতা-রুচিগত দিক থেকে পরস্পর বৈরিত্যের অবস্থানগুলো এমন জড়িয়ে রয়েছে যে বিতর্কের পরিবেশ সবক্ষেত্রে খুব অবাধ সুস্থ থাকবে প্রত্যাশা করা নিরর্থক। তবে তা সুস্থভাবে চালানোর দায়িত্ব নিতে হবে নাগরিক সমাজের আন্তরিক চিন্তাশীল অংশকে। যারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাদের। বিতর্কের ভেতর থেকে সত্যিকারের প্রগতিশীল পরিবর্তনের পথ দেখাতে হবে। তাহলে সময়-সমাজ আলোকিত হতে পারবে।

একটা বিতর্ক বোধহয় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় দানা বেধেছে। এটা মূল বা কেন্দ্রীয় বিতর্ক কিনা সে তর্কে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু এ তর্কে মুখোমুখি হওয়া, গভীরে যাওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। বিশেষত একটা অভিযোগ যখন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যাদবপুরের ছাত্র সমাজের ওপর। যে ছাত্ররা নিয়েছে প্রতিস্পর্ধী অবস্থান, তাদেরকে দায়ী করা হচ্ছে তারা বিরোধী মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধা দিচ্ছে। এ অভিযোগ তুলেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন। অভিযোগ করেছে এবিভিপি, বিজেপি। এদের তৈরি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিতর্কের জবাব নিশ্চয় দিতে হবে। কিন্তু দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে অন্য সমস্যা। ঘোষিতভাবে গৈরিকপন্থার বিরোধীদের কোনো কোনো কণ্ঠ থেকে একইসাথে উচ্চারিত হচ্ছে ‘মন্ত্রী বাবুলকে ছাত্রদের বাধা দেওয়ার ঘটনা গণতান্ত্রিক সৌজন্যের নিরীখে আপত্তিকর’, ‘ছাত্রদের একটু সংযমের পরিচয় দেওয়ার দরকার ছিল।’ কিন্তু এহনে সতর্ককরণের প্রদর্শন কেন! যৌক্তিকতা কীসের! অশুভ গৈরিক শক্তির প্ররোচনার ফাঁদ থেকে ছাত্রদের মুক্ত থাকার এরকম পরামর্শ দিতে গিয়ে অজান্তে লঘু করে দেওয়া হল না কি ছাত্রদের প্রতিস্পর্ধাকে! সমাজে যাতে খারাপ প্রভাব না পড়ে ছাত্রদের তার সবক দেখাতে গিয়ে উল্টো ছাপ ফেলা হয়ে যাচ্ছে না কি! এহেন প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ধরনকে হামলাবাজ গৈরিক শক্তিশিবির কোনোভাবে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে যাবে না তো! ফ্যাসিবাদ কিন্তু জনমতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারা সমাজের বৌদ্ধিক অংশের অসচেতন শিথিল দুর্বল অবস্থানগুলোর জন্য় তক্কে তক্কে থাকে। এতটুকু মওকা পেলে বড় অস্ত্র করে তার প্রচারের হাওয়া তুলতে। ঠিক যেমন অর্ধসত্য-মিথ্যার মিশেলে বানায় প্রচারের মিসাইল। যথেষ্ট ভাবার তাই দরকার আছে কোনও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ থেকে গেরুয়া হানাদাররা যেন ফায়দা তুলতে না পারে। ছাত্রদের পাশে থাকা, সাথে থাকা তো অবশ্যই দরকার, পরামর্শও দেওয়া যায়, কিন্তু অভিভাবকত্ব প্রদর্শনের প্রয়োজন নেই। ছাত্রদের তো সংযম দেখানোর কিছু নেই। বরং তাদের সংযত থাকার পরামর্শ না দেওয়াই কাম্য। ছাত্ররা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা বুঝেছে করেছে, তার সারবস্তু অবশ্যই সময়োচিত। ভুলে যাওয়া উচিত নয় প্রতিস্পর্ধার প্রকাশ সমসময় শান্ত সুললিত বাঁধা গৎ মেনে হয় না।

বিরোধী মত প্রকাশ করতে না দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে যাদবপুরের ছাত্রদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তুলেছে এবিভিপি-বিজেপি। এবিভিপি-র রাজ্য সম্পাদক বলছে, তারা বিতর্ক করার পক্ষে, তাদের যাদবপুরে ঢুকতে দেওয়া হবে না কেন? কিন্তু বিতর্ক চালানোর নৈতিক অধিকার এবিভিপি ও তার পিতা-পার্টি বিজেপি – কারও আছে? না, নেই, থাকতে পারে না। তারাই বরং এখন বিভিন্ন বিতর্কের টার্গেট। আর যেখানেই যাচ্ছেন-যাবেন সেখানেই সামনে পিছনে তাদের তাড়া করছে, করবে বিতর্ক-স্বরূপ উদ্ঘাটন-বিরোধিতা। তারা কি এনআরসি নামিয়েছে বিতর্ক চালিয়ে? কাশ্মীর থেকে প্রত্যাহার করেছেন সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা, বিতর্ক চালিয়ে? মোদী সরকার শিক্ষাক্ষেত্রের লগ্নি সংকোচন, বেসরকারীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ সহ ছাত্র সংসদের নির্বাচন ও স্বাধিকার হরণে লিংডো কমিশনের সুপারিশের সওয়াল করে চলেছে। এসব নিয়ে এবিভিপি বিতর্কের নাম করে? ‘গো হত্যা’ ও গো মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করতে বিতর্ক চালিয়েছেন? ‘লাভ জেহাদ’-এর জিগির তুলে মুসলিম যুবক হত্যা, দলিত বালিকাদের ধর্ষণ ও হত্যা, দলিত তরুণ-যুবকদের প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা, দলিত কিংবা মুসলিম কন্যাকে ধর্ষণ করলে দলের দুর্গা বাহিনী দিয়ে পৌরুষত্বের জাতিবাদী বা হিন্দুত্বের ‘জয়তিলক’ এঁকে দেওয়া হয় – এসব নিয়ে কি গৈরিক শিবিরে কোনও বিতর্ক চলে? হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত মেধাবী ছাত্র রোহিত হত্যা বা জেএনইউ-র মুসলিম ছাত্র নাজিব-এর ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া নিয়েও গেরুয়া শিবির কোনো বিতর্ক বরদাস্ত করেছে? সংবিধানের একের পর এক কালা সংশোধনী নিয়ে আসা, কথায় কথায় যে কোনো সমালোচনা ও বিরোধিতাকে গুঁড়িয়ে দিতে ‘দেশদ্রোহী’-‘জাতীয়তা বিরোধী’ দাগিয়ে দেওয়া – এসব কি কোনও বিতর্কের পরিণাম? তাতো নয়। এইসব প্রশ্নে বিতর্ককে বরং বলি দেওয়া হয়েছে। তারপর ধরুন কর্পোরেটদের কর ছাড় দেওয়া! সেটাও কি বিতর্কের গলা টিপে সিদ্ধান্ত নয়? বাবুল সুপ্রিয়দের সরকার ও দল তর্কে বহুদূর যাওয়ার হিম্মত দেখানোর বদলে চূড়ান্ত ধর্মবাদী-জাতিবাদী-বর্ণবাদী স্বেচ্ছাচারিতা অনুসরণ করে চলে। বাবুলরা তো সেই পার্টির যার নেতারা জেএনইউ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘দেশদ্রোহী’দের আখড়া বলে চূড়ান্ত কুৎসা প্রচার করে। অবাধ্য ছাত্রদের প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়! এরপরেও কি তাদের মুখে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের দাবি মানায়! সুতরাং বাবুলরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে ‘সৌজন্য’ আর ‘বিতর্ক’র প্রসঙ্গ তোলে তখন সেটা সুচতুর বাহানা ছাড়া আর কিছু নয়। আর, তাদের লাগাতার সব অন্যায় দেখতে দেখতে রাগে ফুঁসতে থাকা ছাত্রসমাজ যদি বিরুদ্ধতায় রুখ দাঁড়ায় তবে দোষের কিছু নেই। এই সারসত্য না বুঝলে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে তাই এবিষয়ে আরও মনোযোগী, সংবেদনশীল, বিশ্লেষণমুখী দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে, চিন্তার প্রতিস্পর্ধা ও প্রতিরোধে সক্রিয় থাকতে হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-30