গোন্দলপাড়া জুট মিল দীর্ঘ সতেরো মাস ধরে বন্ধ। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক মুখে মুখে দু-তিন দিনের জন্য মিলের গেট খুললেও মেশিন চলেনি, মজুরিও পায়নি শ্রমিকরা। ৪৫০০ শ্রমিক, যার বেশিরভাগই অস্থায়ী বদলি শ্রমিক। উৎসবের মুখে দাঁড়িয়ে অসহায় শ্রমিকেরা শোনাচ্ছিলেন তাঁদের দুঃখের কথা। ভোট মিটে গেছে, রাজ্যের শাসক দলের মিল খোলা নিয়ে নাটক করার আর দায় নেই, বিজেপিও সংসদীয় আসনটা দখল করার পর আনাগোনা কমিয়ে দিয়েছে। আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম, দুঃখের ডালি তারা উজাড় করে দিলো, এইটুক শোনার মতো লোকও তারা পায়না! এআইসিসিটিইউ জেলা সম্পাদক বটকৃষ্ণ দাস, সভাপতি প্রবীর হালদার সমেত চার জনের এক দল সরেজমিনে অবস্থা বুঝতে হাজির হয়েছিলাম শ্রমিক মহল্লায়। এক নম্বর লাইনে ঢোকার মুখেই লখেন্দ্র সিং বসে ছিলেন একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে, পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করতেই ভীড় জমে গেল জায়গাটায়। কেউ ওয়াইন্ডিং, কেউ স্পিনিং, কেউ ব্যাচিং, কেউ ফিনিশিং ডিপার্ট (ওঁরা এইভাবেই বলেন)-এর শ্রমিক ছিলেন। আজ সবাই কর্মহীন! কপিলদেব দাস বলছিলেন, ‘পাশেই জ্যোতির মোড়ে যেতে পারি না, প্রত্যেকবার পূজোর সময় ওখান থেকেই পূজোর বাজার করতাম, তাই যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে, বাচ্চাগুলো বোঝে না মিল বন্ধ, নতুন জামা কাপড়ের আব্দার করে’। এই আব্দার সইতে না পেরে কদিন আগেই আত্মঘাতী হয়েছে কারখানার শ্রমিক, এগারো বছরের মেয়ের বাবা বিশ্বজিৎ দে আর তার কদিন পরেই সদ্য বিবাহিত ৩০ বছরের তরতাজা ছেলে বিক্রম চৌধুরী। গণেশ দাস, রাজু মাহাতো, লালচা সাউ সবার মুখে একই করুণ কাহিনী। সকালে কোনো এজেন্টের সঙ্গে দল বেঁধে কাছের, দূরের, নদীর ওপাড়ের মিলে কাজের খোঁজে যাওয়া, দু-একজনের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া, আর বাকিদের কাজ না পেয়ে আবার মহল্লায় ফিরে আসা। ২৭ বছরের ছেলে রবিশঙ্কর, বদলি শ্রমিক, কিডনির অসুখে ভুগছে, সপ্তাহে সপ্তাহে ডায়ালিসিস নিতে হয়, বাবা নেই, মা দিনভর পরিশ্রম করে চলে ছেলের চিকিৎসা চালানোর জন্য। পেনও যেন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে, নোট নেওয়া থামিয়ে দিই।
বন্ধ গোন্দলপাড়া জুটমিলের শ্রমিকদের জন্য ফাউলাই স্কিমের অনুদান চালু নেই, মিলের শ্রমিকরা আবেদন করে বসে আছে বহুদিন। শ্রম দপ্তরে আঠারো মাসে বছর, আমরা জানতে চাইলে শ্রম দপ্তর বলে, পূজোর আগেই ভাতা প্রদানের চেষ্টা চলছে। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক দয়া শংকর সাউ বলছিলেন, ‘আপনারা কিছু করুন, আমরা সাথে আছি’। বাবাসাহেবের মূর্তি বসান আছে যেখানটায়, সেই আম্বেদকর মোড়ের ছোট দোকানি অনেক কথাই বললেন, শুনলাম ইউনিয়নগুলোর দালালির কথাও, এই মোড়েই সবাই সভা করে বা করতো! হুগলী শিল্পাঞ্চল জুড়ে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাস, গোন্দলপাড়া ছাড়াও একই মালিক সঞ্জয় কাজোরিয়ার শ্রীরামপুরের নিউ ইন্ডিয়া জুট মিল আর লগন মেশিনারি বন্ধ, বন্ধ ছোট বড় মিলিয়ে আরও বহু শিল্প। কেন্দ্রের আর্থিক ও শিল্পনীতি এবং রাজ্য সরকারের উদাসীনতার ত্র্যহস্পর্শে শ্রমিকরা বিপন্ন। কর্মসংস্থান নাই, মৃত্যুর মিছিল, বন্ধ কারখানার সমস্যার সমাধানে রাজ্য সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে এআইসিটিইউ কর্মসূচী গ্রহণ করে। গোন্দলপাড়া সহ সমস্ত বন্ধ কারখানা খোলা, বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ফাউলাই স্কিমে অবিলম্বে ভাতা প্রদান এবং আত্মঘাতী শ্রমিক পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে ১৫ সেপ্টেম্বর মিছিল করা হয়, এঙ্গাস জুটমিলের গির্জা গেট থেকে শুরু হয়ে, ডালহৌসি ও নর্থব্রুক জুটমিলের শ্রমিক মহল্লা পেরিয়ে পলতা ঘাটে গিয়ে মিছিল শেষ হয়। মিছিলের শুরুতে ও শেষে বক্তব্য রাখেন জুট শ্রমিক সংগঠক বটকৃষ্ণ দাস ও সুদর্শন প্রসাদ সিং। রাজ্য সরকার বিশেষ করে শ্রম দপ্তরের অপদার্থতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাজ্য শ্রমমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়।
এরপর বিসিএমএফ রাজ্য সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী ও বটকৃষ্ণ দাস রাজ্য শ্রমমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত-আলোচনা করেন। তাঁরা অবিলম্বে বন্ধ গোন্দলপাড়া জুট মিল শ্রমিকদের ফাউলাই প্রদানের দাবি জানান এবং একইসাথে আশু রিলিফ হিসাবে ২ টাকা দরে চাল-গম বিলিবণ্টন সহ চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা দাবি তুলে ধরেন। শ্রমমন্ত্রী ও লেবার কমিশনার উভয়েই জানান যে ফাউলাই খাতে অর্থ বরাদ্দ অনুমোদিত হয়েছে, ট্রেজারিতে তা পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে শ্রমিকরা টাকা পেয়ে যাবেন। আর, ইএসআই-এর সুযোগ থেকে যাতে শ্রমিকরা বঞ্চিত না হন তা তারা দেখবেন। আগামীদিনে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা ও আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ চলবে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, বিশ্বজিৎ দে’র পর বিক্রম চৌধুরী। প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকা হুগলী জেলার চন্দননগরের গোন্দলপাড়া চটকলের হতভাগ্য শ্রমিক। বেঁচে থাকা অসহনীয় হয়ে পড়ায় আত্মঘাতী হওয়াই একমাত্র পথ হিসাবে বেছে নিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়স। বৃদ্ধ বাবা, ফুটপাতে সবজি বিক্রি করেন, আর স্ত্রীকে রেখে চলে গেলেন। এ পথে চলে যাওয়া ঠিক কি ভুল, সে বিচারের দায়িত্ব সহনাগরিক ও শ্রমিক সহযোদ্ধাদের কাছে রেখে। অথচ তিন সপ্তাহ আগে ঐ বন্ধ গোঁদলপাড়া জুটমিলের আর ও এক হতভাগা শ্রমিক বছর ৩৪-৩৫ বছরের বিশ্বজিৎ যখন এ পথেই চলে গিয়েছিলেন, তখন কত হৈ চৈ। এলাকার সাংসদ কত প্রতিশ্রুতি দিলেন, কারখানা খোলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করার কথা বললেন, আরও আরও কত কি! রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী ও তার আধিকারিকরা খোলা মনে সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। তারপর তিন সপ্তাহে পাশের ভাগীরথী দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে। রাজ্যের কোন বন্ধ বা রুগ্ন কারখানা বা মিলের কোনো শ্রমিকের আজ আর এইসব প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস নেই। বিশ্বজিৎ বা বিক্রমরা তাই আপন খেয়ালে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
অথচ রাজ্যের শ্রমদপ্তরের ১৬/৪/১৯ এর বিজ্ঞপ্তিটি (Labr/309/LC_IR/IR /12L16/08) দেখুন। বলা হচ্ছে এই নির্দেশবলে ১ বছর নয়, এখন থেকে ৬ মাস বন্ধ থাকা মিল বা কারখানা শ্রমিকরা ফাওলাই স্কীমের সুবিধা ও সহায়তা পাবেন। অর্থ দপ্তরের মঞ্জুরীর পর এই নির্দেশ ঐদিন থেকেই কার্যকরী হচ্ছে বলে জানানো হয়েছিল। অথচ গোঁদলপাড়া চটকল প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ। একজন শ্রমিক কর্মচারীও এই আর্থিক সহায়তা পায়নি। কেউ ব্যস্ত আদানি আম্বানি নিয়ে, কেউ ব্যস্ত গোয়েঙ্কা সিংহানিয়া নিয়ে। বেঁচে থাকার পথ শ্রমিকদেরই বেছে নিতে হবে। আমরা সাথে আছি।